|
এখন কী আর ফের যাওয়া যায়! একবার বিদায় নেওয়ার পর অপ্রত্যাশিতভাবে আবার! মানসম্মানের ব্যাপার। যদিও মাসিমা বিলকুল খুশিই হবেন। বার বার করে থাকতেও বলেছিলেন। ছাড়তে চাননি আজ। কত দিন পরে এই দেখল! তা প্রায় ছ-সাত সাল! মা না বললে তাও যাওয়া হত না এবারও। মা বলেছিল, হাসনাবাদ থেকে ফেরার পথে ছোটো মাসির বাড়ি একবার পাক মেরে আসিস তো! তোর মেসোর গলায় নাকি ক্যান্সার ধরা পড়েছে!
ওই মাসির বাড়ি গিয়েই এই ফ্যাসাদ। সেই বেরোতে যখন হবে, আর একটু আগে যদি গা নাড়াত! তবে সংবাদটা একেবারে মিথ্যে নয়, আবার টাটকা সত্যি কথা কিনা, বলা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। মেসোমশাইয়ের গলায় দগদগে সুপারিপানা লাল কী একটা ঠেলে উঠেছে! ডাক্তার-বদ্যি চলছে। কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করানো হয়েছে। সব গোলমেলে। ওকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল রিপোর্টগুলো। অত ছাইপাস মাথায় কিচ্ছু ঢুকল না। ও তো ডাক্তার বদ্যি নয়! তবে কোন বড়ো ডাক্তার নাকি ভরসা দিয়েছেন, সব সালটে দেবেন। মেসোমশাইও আশাবাদি। মনের জোর আছে ষোলো আনা। ওইটাই বলভরসা। এসব রোগে মন তেড়েফুঁড়ে না উঠলে, গেল। একটা অপরেশন এক্ষুনি দরকার। শক্ত একটু কিছু খাবার হলেই আর খেতে পারছেন না। সব চোটকেমোটকে গলিয়েমলিয়ে দিতে হচ্ছে। গলার হোড়োংয়ের ওপারে তবে যাচ্ছে। গলার স্বরও চেপে ফ্যাসফেসে। এই মেসোর কী মেজাজ ছিল! গলায় সিংহ গর্জন। ছোটোরা ভয়ে জুজু থাকত। রাশভারী মেসোর সুমুখে ছেলেপুলে খুব একটা ঘেঁসত না। আর এখন! একেবারে ছেলেমানুষের দেড়া।
ছাড়তে চায়নি মাসিমা টোটনকে। টোটন ওর বাচ্চাবেলার আদুরে ঘরোয়া নাম। কাগজ কলমে ইন্দ্রজিৎ প্রামানিক। ইন্দ্র নামেও তাকে ডাকে কেউ কেউ। কিন্তু উপায় নেই। কাল যেখানেই থাকুক, মরুক বাঁচুক, সকাল দশটার আগে অফিসের খাতায় সই তাকে লাগাতেই হবে। সরকারী কাজ হলে এত ঘাবড়াতো না। বড্ডো জোর না হয় একটা সি এল যেত! এ তো বেসরকারী, কম ভারিক্কি কোম্পানী! হাঁট্ বললেই মুখে কুলুপ এঁটে পাততাড়ি গুটিয়ে মানে মানে সরা ছাড়া গতি নেই। তাই সাততাড়াতাড়ি। রাতেই বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু এ যা হল!
মাসিমার বাড়ি না গেলেই হত। এদ্দিন তো মাড়ায়নি। খোঁজখবরও রাখেনি। অবশ্য মা ফোনে জানিয়েছিল মনে হয়, টোটন যাবে। কিন্তু তেমন আগেভাগে গোছানো মনে হল কই! ও যাওয়ার পরই মাসিমা পাড়ায় ডিম কবজা করতে বেরল। নেভা উনুনে ধোঁয়া ধরল আবার। ও আপত্তি জুড়েছিল। সব ফালতু। আরে বাবা, যা হয় দুটো, নাদাটা ভরা নিয়ে কথা। দুটো শাকান্ন হলেই সই। তা না, এটা আনো, সেটা কোথায় – যত্তো সব জোগাড়যন্তর! তবু মাসিমার মন। অনেক দিন পরে দেখা। তাও নিজের বাড়ি। একেবারে খালি নুনভাত! কেমন একটা দেখায়। শেষে ডিম না পেয়ে পুঁচকে একটা বাড়ির মুরগি কাটল। আর গপ্পের তো শেষ নেই মাসিমার। ছেলে মেয়ে বাবাই মান্তুর হাজার কথা, মেসোমশাইয়ের কী করে এই দশা, কারা এসেছিল, কী বলেছে তারা, ক’টা ডাক্তার কেন পাল্টেছিল, ওর মায়ের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল – হাজার কথার বাজার। ওর তখন বেরোনোর তোড়জোড়। বেলাগড়িয়ে পশ্চিমে টান। এত তাড়াহুড়োয় সময় সচেতন থাকলেও, সব গুলিয়ে গোলমাল। খাওয়াদাওয়ার পরপরই বেরিয়ে রাস্তা ধরলে এই ভোগান্তির রেহাই জুটত মনে হয়। খুব ভালো হত মেসোমশাইকে না দেখতে গেলে।
ইন্দ্র কাঁধের ব্যাগ কোলে নিয়ে ভাবে, কেমন একটা স্বার্থপরের মতো ভাবনা এগোচ্ছে, চাপা দেওয়া দরকার।
ওপারে গাছপালা পাতানাতার খোলে সূর্যিমামা ডোবো ডোবো। টান তার অন্য গোলার্ধমুখো। সারা দুপুরটায় যা গনগনে তেজ ঝাড়ল, গায়ের চামড়া তেতে কেলুটে। গরমে হাঁসফাঁস। এখন গাঙপাড়ে নোনা জোলো দখনে ফুরফুরে হাওয়ায় একটু স্বস্তি যেন।
বাবার জন্যে কাজ, মার জন্যে খেসারত। মা না বললে এ পথে আসতই না। হাসনাবাদ থেকে বাসে নেবুখালি, নেবুখালি পেরিয়ে ভান্ডারখালি, ভান্ডারখালি থেকে ইঞ্জিন ভ্যানে শিতলিয়া হাটখোলা, কদমতলা বাজার, ওইটুক্কুনি হেঁটে ভরতের ঘাট, খেয়া পেরিয়ে গোপালের ঘাট, পূর্ব আতাপুর, তারপর আর কথাই নেই। না হয় অন্যপথে – ভান্ডারখালি থেকে খুলনা, ডাঁশা গাঙ পেরিয়ে সন্দেশখালি, খেয়া মেরে ভাঙা তুষখালি, ওই দ্বীপে তো পৌঁছে যেত! গাড়িঘোড়া না পাক রাতভর হেঁটেও বাড়ি ঠিক পেত। আর এ যে কলে পড়েছে! এ যে কত নম্বর কল! কী পিন্ডি চটকাতে যে এ পথে এলো! মার জন্যে মাসির বাড়ির খবর আনতে গিয়েই! নেবুখালি পেরিয়ে দুলদুলি, পাটঘেরা, যোগেশগঞ্জ বাজার, সর্দার পাড়া ঘাট, চিমটার বাজার থেকে অনেক আগে এখানে খেয়া দিত, এখন আসেই না, অগত্যা হেঁটে মঙ্গলচন্ডীর ঘাট। ব্যাস, এই পর্যন্ত এসেই এখন হাওয়া খাওয়া কল। এর পরও আছে। রায়মঙ্গলের খেয়ায় পুঁইজালি হরিতলা ঘাট, চরণবাবুর গাড়িতে বাড়ি, ওখানে গাড়িঘোড়া নেই।
সেই খেয়াই পাওয়া গেল না। গরমের সময়। জামার খোলের এক্সাইস গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে শুকিয়ে আবার সেঁতিয়ে হদ্দো অস্বস্তি। রায়মঙ্গলে ভাটার চলনে থই-তা-থই ঢেউ। জলতরঙ্গে আছাড়ি পাছাড়ি পাড়ের গা। সেই ভয়েই মাঝি সাঁঝ নামার আগেই নাও ডাঙায় তুলেছে। বেলা ডুবে গেলেও বিশ্বচরাচর সব এই তো জ্যান্ত দেখা যাচ্ছে। আরে বাবা, যে সময় পর্যন্ত তোর খেয়া দেওয়ার রেওয়াজ সে সময় পর্যন্ত তো দিবি! তা না, সাত সকালেই - এপারের নাওমাঝি হলে তবু বলেকয়ে দেখা যেত। এখন কী যে হবে!
বাবার কাজটা প্রায় সকালটানেই মিটে গিয়েছিল হাসনাবাদে। দলিল লেখক লোকটাকে আগে থেকেই বলা ছিল। খুব বেশি সময় কাটেনি লোকটা। দু’পাঁচ মিনিট অবশ্য বসতে হয়েছিল। প্রাথমিক কিছু বাক্বিনিময়ের পর পয়সাকড়ি মেটাতে যা সময়। কাঠের বাক্স হাতড়ে দলিলটা। তারপর ওঠা।
এত সব করতে হত না। সব্বোনাশ করল উঁইপোকায়। যে বাক্সে বাবা কাগজপত্র রাখত, উঁইপোকায় জ্যাম করে দিল। কবে থেকে এ-কাজ হচ্ছে বাবা জানে না। একদিন প্রয়োজনে খুলতে গিয়ে আর খুলতে পারে না। টানাটুনি বেড়োবাড়ি করে যদিও হা করল মুখটা, খোলে তখন চড়চড়-চড়চড় চিড়বিড়-চিড়বিড়। সব্বোনাশ! জমাট বেধে কেটেকুটে সব একশা। মাঝেমধ্যে যদি একটু চোখ চালাত! দৌড়ে নিয়ে চুবিয়েছিল পুকুরে। কাটাকুটো খন্ড খন্ড কাগজ যা ছিল, শুক্নশাক্না করে শেষমেষ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। তখন দুই চব্বিশ পরগনা ভাগ হয়নি, এক ছিল। দলিলপত্র হাসনাবাদেই হত। এখন তো দক্ষিনে কাছেপিঠে বাসন্তীতে হয়েছে। কিন্তু পুরানো লেখাজোখা, খতিয়ান বলেই পুরানো জায়গা থেকেই উদ্ধার করতে হল।
বাড়িতে একটা ফোন মারলেই হয় – মা, কম্ম অনেক হয়েছে, এখন গাঙের এপারে...
প্যান্টের এপকেট সেপকেট, ব্যাগের ছোটো পকেট, মাঝের বড়োটা। ফোন আর পাওয়া গেল না হাতড়ে। গেল কোথায়? মহা চিন্তা। তাই হবে, হয় অটোয়, নয় ইঞ্জিন ভ্যানে – পথের মাঝে কোথাও। যাশ্বালা...
আকাশ বাতাস মাটি কাদা জলে পাকাপোক্ত আন্ধার। এইমাত্র বসেছে। চরের বাইন গেঁওয়ার পাতায় দোখনে বাতাস শাঁ শাঁ ডাক ফেলে ছুটছে। রায়মঙ্গলের নোনা ঘোলা জলে ঢেউমাতন। চরের নরম স্যাঁতানো আঠা মাটিতে ঝপ্পাস-সুড়ুৎ ধড়্ড়াশ-ছড়ছড় ঢেউচুমা। আলগা পলিমাটি ধুয়ে ফাঁক। ওদিক থেকে একবার ঘুরে এসেছে ইন্দ্র। গাঙের জল ফুঁসছে, দুলছে। গাঙময় ওদের দাপানি। ফিরে এসে ঝুপড়ি মতো দেখতে পাওয়া বাঁধ লাগোয়া বন্ধ দোকানের খুঁটিতে হেলান টেনে ও দেহের ভার ছেড়েছে।
আগে যেমন দেখেছিল, এ পারটা তেমন আর নেই। আগের দেখা সে বাঁধটা কবে যে গাঙের বুকে হাপিস! এটা নতুন। সামনে চরে বাইন, গেঁওয়া, কাঁকড়া, ক্যাওড়া লাগিয়ে ঢেউ ঠ্যাকানো দেওয়াল। রাস্তাটাও উঁচু, ওসারো। এ পাটায় কাছে পিঠে তেমন বাড়ি ঘরদোর নেই। দু’একটা ছাড়া। কবে যেন বসে গেছে ইলেক্ট্রিকের খুঁটি। তার টানা পোস্টের মাথায় এখন হলদে বাল্ব। আঁধার মুছে নিকটে ঝাপসা আলোক।
কী যে একটা কান্ড হল! বাড়ির লোকজনও কোনও সন্ধান পাবে না। মোবাইলটা কোথায় যে পড়ল! অটোয় পাশের লোকটা হাতায়নি তো!
হে, দোকান ঘরে কে? - টর্চের সাদা আলো দোকান ঘর ঘুরে যাবার পর বয়স্ক কন্ঠে এই জিজ্ঞাসা।
ইন্দ্র একটু নড়েচড়ে বসে। বলে - আমি, কাকু, ওপারের লোক, চিনবেন না।
নদীবাঁধে আলো ছড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে লোকটা। কোমরে আলুথালু লুঙ্গি গোঁজা, ওদলা গা, কাঁধে ভাঁজ করা গামছা ফ্যালা একজন। বলে - আজ তো সাতটার খেয়া আসেনি। আমি দোকানপাট সকাল সকাল বন্ধ করে -
-সেই কলেই তো ফেঁসে গেছি, খুড়ো।
- তা এখন কী হবে, বাবাজি!
- কী আর হবে! এই শুয়ে বসে -
- খাওয়াদাওয়া তো এই সেরে এলাম। আগে জানলে -
ইন্দ্র কথা ব্যয় করে না, ভাব বোঝে। এই ভর সন্ধেয় খেয়েদেয়ে ভদ্দর লোক!
-চলো বাবা, যাই।
- কোথায়?
- এই গরীবের বাড়ি।
- আপনি বরং চাবিটা নিয়ে আসুন। কিছু খাবারদাবার কিনি।
- সেই তো আমাকে বাড়িতে যেতেই হবে। ওর চেয়ে আমার সঙ্গে চলো।
ইন্দ্রের মুখে কুলুপ। খানিক সময় ব্যয়।
-অত ভাবাভাবির কী আছে! মানুষ কি মানুষের বাড়ি যাবে না! তুমি বাঘ না ভাল্লুক!
নিরাশ্রয় অসহায় অপরিচিত মানুষকে নিজের কুটিরে আশ্রয়দানে লোকটার কী ব্যাগ্রতা! গ্রামের বয়স্ক মানুষরা এখনও সন্দেহের উর্দ্ধে থাকেন।
-চলো, চাবিটা নিয়ে আসি।
- আপনি একলা গেলেও তো পারেন!
- তবু তোমাকে দরকার।
এবার ইন্দ্র সত্যিই লজ্জা পায়। বলেই ফ্যালে – চলুন।
বলেও কেমন একটা ঠেকছে ইন্দ্রের। অচেনা অজানা বাড়ি। বুড়োর বাড়ির লোকজনের ওপর চাপ বাড়ানো – অপ্রস্তুত, লজ্জায় পড়বেন। নিজেরও লজ্জার শেষ। তিথি কী – জানা নেই। আকাশে ফোটেনি চাঁদ। দোকান ধারের পোষ্টের আলোটা বাঁধের বাঁকে গাছের ছায়ায় আটকে আঁধার। লোকটা জ্বেলেই রেখেছেন টর্চ। রাস্তা ফুঁড়ে দু’একটা ভালো মন্দ ইট কাৎ চিৎ। তুলে আছে মাথা। অসাবধানে ফেললে পা খেতে হবে ব্যথা। লোকটা বললেন – বাবাজির বাড়িটা ঠিক কোথায়?
-চিমটা হাটখোলার পাশে।
- গিরেণ, তপন, গোবিন্দ – চেনা আছে?
- পাড়ার লোক, চিনব না কেন!
- তোমার বাবার নাম কী?
- সুপদ।
- সু-প-দ! বাগদার ব্যবসা করত!
- হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। চেনেন দেখছি।
- চিনব না কেন? গ্রামের মানুষ। না হয় এপার ওপার বাড়ি। দু’পাঁচজন না চেনা থাকলে চলে? ওদিকে নয়, বাবাজি, এইটা আমাদের বাড়ি।
বাঁধের গা ধরে আলগা ইট পাতানো ঢালু সিঁড়ি। সমান উঠোন। দাওয়ায় সাদা আলো। পিলারের খুঁটিতে অ্যাসবেস্টসের উঁচু ছাউনি। পাশে ছোটো খোড়ো ঘর। ওপাশে সরু লম্বা নিচু একটা কিসের ঘর, আয়লার পরপরই তাবু ভেঙে কাঠকুটো নাড়া পলের অভাবে ওদের বাসঘরটা যেমন ছিল, হাঁস কুকড়োর হবে হয়তো।
খুঁটির মাথা থেকে চ্যাটাই পেড়ে ইন্দ্রকে বসতে দিয়ে লোকটা বলল – বউমা, ভাত আছে নাকি হাঁড়িতে?
ঘরের খোল থেকে সাড়া এলো – সব ভাতে তো জল দেওয়া হয়ে গেছে, বাবা।
-ওই জল দেওয়া ভাতই বাড়ো, কী আর হবে! চলো, বাবাজি, পুকুর থেকে মুখ হাত ধুয়ে আসি।
- আপনাকে আর যেতে হবে না, কাকু, টর্চটা দিন। আমি যাচ্ছি।
পুকুরে যাওয়ার পথে দু’পাশে গরমের চোটে ঘাস শুকিয়ে চিঁ-চিঁ দশা। ছোট্টো পুকুর। তলানিতে জল। গরমে গ্রামের সব পুকুর ডোবার একই দশা। ছোটোবেলায় এরম পুকুর পেলে তেলিয়ে পাঁক তুলে ছাড়ত। পুকুরের ওপারে মাটির ঢেলায় খোঁসপাঁচড়া ওঠা খেত। নাড়ায় এক খন্ড ঢাকা। তার তলায় হয়তো ওল কচু পোঁতা। ভিটে বেড়ে ক’টা নারকেল সুপারির পাতায় খসখসানি। কলাগাছের ঝাড়ে জমাটি আঁধার ফিসফিস। লম্বা কাকতাড়ুয়া ঢঙে একটা শিমুলতুলা গাছ।
ইন্দ্র এসে দ্যাখে চ্যাটাইয়ের সামনে ভাত বাড়া। জলবুড়ো ভাত। পাশে চব্বিশ-ছাব্বিশে টানটান যুবতী বউ।
ইন্দ্র আঁতকে উঠল। কৃষ্ণকলি কী! পুঁইজালি জুনিয়র ইশকুলের দিকের ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। ইশকুলটা এখন হাই হয়েছে। ওও তো দেখছে। অবাক। চোখাচোখিতে বউটা শুধালো – আপনাকে চিনি দেবো, না লঙ্কা পেঁয়াজ?
-চিনি দাও, বউমা, অতিথিকে মিস্টিমুখই করো।
হ্যাঁ, সেই হাসি, সেই চোখ, মুখটা একটু ভেরে চকচকে, কন্ঠের হাড়গুলো পুরেছে, গা-গতরে ভরাটি যুত। আসা উচিৎ হয়নি এখানে। পুরানো ব্যথায় ঘা মেরে রক্ত বের করা ছাড়া আর কী হবে! সেই কদম গাছটার তলায় রাতে গোপনে দাঁড়িয়ে দু’জনার বিদায় দেখা। সারা জীবনের অন্তিম চুম্বন। শেষ শক্তিশেল বুকে বিঁধিয়ে চোখের জলে পথঘাট টলিয়ে সেই গোপন ফেরা। সেদিনই দু’জনার শেষ সিদ্ধান্ত ছিল, আর যেন কোথাও না দেখা হয়, তবে ভীষণ কষ্ট হবে আবার সেদিন। বেশি না ভাবাই ভালো দুঃখের কথা। কারণ কলির যে পাকা দেখা, পাকা কথা হয়ে গিয়েছিল। আর কেন!
আগে একদিন মাকে ঠারেঠোরে বলেই থ্রেট খেয়েছিল। আর বাবা! ওরেব্বাবা! পেঁদিয়ে বৃন্দাবন পার করে দিত। এই বয়সে পিরীত!
ঈশ্বরকে পথের মাঝে হাতের নাগালে পেতে সেদিন খুব ইচ্ছে ধরেছিল। না, ও মারত না। শুধু একটা জিজ্ঞাসা ছিল – হে দয়াল, কলির থেকে আর পাঁচ-সাত বছরের বড়ো করে কেন ওকে দুনিয়াতে পাঠালে না, কেন দু’জনকে সমবয়সি করলে? পাঁচ-ছ’বছরের বড়ো হলে, কলি এগারো ক্লাস, আর ও যা হয় কিছু একটা করে কম্মে খেত। অবিভাবকদের জানাত প্রথমে, রাজি না হলে যেত পালিয়ে। বিয়ের বয়স তো আইনি প্যাঁচে বেড় খেত না। এরকম তো আকছার কত জনের হচ্ছে। আর রাজি না হওয়ার কিছু ছিল না – ছেলে কিছু করে তো। সরকারী, বেসরকারী, দিনমজুরী, যা হয় হোক। দু’বেলা নিজেদের জোগাড় অবশ্যই হত।
বাবাজি, এত খিদে পেয়েছিল তোমার, আর তুমি চুপ করে দোকানে বসে ছিলে! – লোকটার কথায় ইন্দ্র দেখল সত্যিই পাত শেষ। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে থালা ছেড়ে গেল হাত ধুতে। নাঃ, থালায় একটু জল ঢালতে ভোলেনি। খালি থালায় নাকি জল না ঢেলে উঠতে নেই। ওর মা আগে প্রায়ই বলত। এখন আর না বললেও চলে।
লোকটার বাড়ানো গামছায় হাত মুখ মুছতে মুছতে ইন্দ্র বলল – কাকু, কাকিমা কোথায়?
লোকটা লম্বা শ্বাস বাতাসে মিশিয়ে বলল – ওপারে।
-আমাদের পারে! কোথায় গেছে?
লোকটা এবার তর্জনির ইশারা উর্দ্ধপানে তোলে।
ইন্দ্র একটা ঢোঁক গিলে নীরব।
শ্বশুরের কথা মতো বউটি দাওয়ায় ইন্দ্রের বিছানা পাতে। ‘এল’ বারান্দার ও-মাথায় ওর শ্বশুর থাকে মনে হয় বছরভর। এল-য়ের জোড়নে ইন্দ্রের বিছানা। বউটার ঘরের দরোজার দিকে ইন্দ্রের পা।
যতবার সামনে পেছনে ঘুরছে ফিরছে যুবতী বউটি, কৃষ্ণকলিই মনে হচ্ছে ইন্দ্রের। ইন্দ্রের এই দেখতে চাওয়াটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে বউটি। মুখে মিটিমিটি হাসির সঙ্গে ট্যাঁরা ঝটকা চাউনি। হ্যাঁ, কলিরও এমনি যুত ছিল। ওই ঘায়েল করা নজরেই তো ইন্দ্র প্রেমের চিটেগুড়ে আটকে খানিক দিন দেবদাস ছিল।
ইশকুলে যাওয়া আসার পথে কম ছেলেপুলে লাগত ওর পেছনে! সব্বাইকে উড়িয়ে দিত, কলা দেখাত। বলত – আমার সুজন বন্ধু আছে।
কেউ কেউ পাছ ধরত – একদিন মালটাকে এনো না, ময়না! দেখি আমাদের থেকে তার কোনটা ক’ইঞ্চি বেশি?
তবুও গেরো বাঁধতে পারেনি কেউ।
সে সুজন বন্ধু যে ও ছিল, নিজেই জানত না ইন্দ্র। ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুর মতো কলির সঙ্গে ওও ঘুরত ফিরত। তেমন কিচ্ছু না। বরং অন্যদের তুলনায় কম কাছে ঘেঁসত। ইয়ার্কি ঠাট্টা হলেও সংযত। কৃষ্ণকলিকে নিয়ে ইন্দ্র তেমন ফাঁক ফোঁকরও খোঁজেনি। কিকরে যে কলি ওকে পেঁচিয়ে নিল!
-বাবাজি, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
- না, কাকু, বলুন!
- তা যাওয়া হয়েছিল কোথায়?
- হাসনাবাদে। একটা দরকারে।
- কী করা হয়?
- একটা কোম্পানীর কাজ করি।
- কোথায়?
- বালিগঞ্জে।
- কয় ভাই বোন?
- দুই ভাই বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
- ভালো। তোমার?
- মা-বাবা জানে।
- হুঁ, গুরুজনদের দেখাশোনাই কোরো। মা-বাবা দুটো ভাত পাবে।
ইন্দ্রের দিক থেকে আর কথা যায় না।
-ঘুমাও বাবা, কাল সকালে আবার আমাদের এখানে আয়লার চাল দেবে। যে লাইন পড়ে, সকাল টানে যেতে হবে।
বাক্যালাপের চলন মরে আসে। বারান্দায় আলোটা নিভে গেছে অনেক্ষন। ঘরের আলোও। আন্ধার। এবাড়ি বিদ্যুৎ ঢোকেনি বা নেয়নি। সব সোলারের আলো। নোনা দক্ষিনে বাতাস বাড়ির মধ্যে আলুথালু পাক খেয়ে ফুস। আন্ধারটা বেশ জমাটি। দাওয়ার কানায় মাথা সরালে আকাশের তারা চোখে ঠ্যাকে। ওই তো সেই আলোর বিন্দু জমা পথ, ছায়াপথ। দেবরাজ জিউসের ঔরসজাত অবৈধ মানবপুত্র হারকিউলিসের কীত্তি। দেবরাজপত্নী হেরার স্তন্যপান করছিল তখন ছেলেটা। রাক্ষুসে খিদে যেন। স্তন্যদানের অস্বস্তিতে হেরা শিশুটিকে নামিয়ে দিলেন পথে। শিশুর মুখ ও হেরার স্তনের যে দুধের প্রবাহ ছড়িয়ে পড়ল আকাশে, তাই নাকি আকাশগঙ্গা, ছায়াপথ। সত্যিই গ্রিক পুরাণ! কী দারুণ গল্প! অনেক দিন আগে কোথায় যেন পড়েছিল!
দূর, দূর! বাবার কাজেই আজ দিনটা ফতুর। অফিসে আড়াইটা ফাইল সালটেও দেড়টা ছিল। এই এক দিনে আরও খানিক ফাইলের ভিড়। পারা যায়! অফিসে লোকজনও নেবে না, এক গাদা কাজ সবাই মিলে গুঁতোগুঁতি।
অবশ্য বাবার কী দোষ! হাইপ্রেসারে সকালে গ্যাসের সঙ্গে প্রেসারের বড়ি। সকাল সন্ধে বাতের কোঁ-কোঁ ঠেলায় তেল, মলম মালিশ – মাজায় গাছগাছড়ার কবিরাজি গিঁট। যদি বাবা যেত, রাস্তার যে ধকল, মনে আনতে নেই, মরা ছাড়া উপায় থাকত না। একেবারে না গেলেও বিরাট অসুস্থ হত। সেই ওকে আবার অফিস ফেলে আসতে হত। ডাক্তার বদ্যি। বোন কী আর আসতে পারত! যদিও আসল, ঠেকা তো সামলাতে হত ওকেই। সে আরও বেশি ঝক্কির। বরং বাপ-মাকে একেবারে যদি ওদিকে নিয়ে যাওয়া যেত, ও যেখানে থাকে, বিদ্যাধরপুর, সে এক রকম। মেলা বার বলেছে ও এ-কথা। তাদের উত্তর বৈষয়িক – ওখানে না হয় দু’এক কাঠা জায়গা দেখ, পাড়াগাঁ থেকে গিয়ে ভাড়া বাড়িতে আমাদের পোষাবে না, দরকারে এখানকার জমিজিরেতগুলো বেচে দেওয়া যাবে।
ও রিক্স নেয়নি। কোম্পানীর কাজ। আজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। কপালগুনে সেই যদি ফিরতে হয় গ্রামে! দু’এক বিঘে যা আছে, খোরাকির অভাব হবে না। চালটা বাড়ির হলে, গাঁয়ের দিকে শাকপাতার অভাব হয় না। কেন, একটা পুকুরও আছে ছোট্টো করে। তবে প্রিয়া কী আসবে! যাকে এখন ফি-দিন দেখার জন্যে মন আঁকুপাঁকু লাগায়, গুলোয়। সে পরে ভাবা যাবে। একসঙ্গে থাকতে পারলে চিন্তা, দুশ্চিন্তা খানিকটা কমে। দু’জায়গায় সংসার টেনে টেনে আর পারা যাচ্ছে না। বাপ-মার দায়টা যদি কাঁধ থেকে হঠে যেত! টানাহ্যাঁচড়া আর ভাল্লাগে না। যত্তসব উদোর খাটনি! এক পিঠো না হলে অশান্তি, খরচ – দুইই দ্বিগুন। আবার এখন যে অবস্থা, একটু যদি বাবার দিকেও না দেখা হয়!
বাইরে থেকে মাথা সরিয়ে নিল ইন্দ্র। একটু ঘুমানো দরকার। কাল যে আবার কী হবে! অফিসে যেতে পারবে! এখন গরমের দিন। সকাল ছ’টায়ও যদি খেয়া দেয়, বাড়ি ফিরতে আটটা। দলিলটা বাড়ি পৌঁছে দিয়েই তো আর কাজ নেই। ধামাখালি কম করে দেড় ঘন্টা। সাড়ে ন’টা। ধামাখালি থেকে এক ঘন্টা দশ-পনেরোয় ক্যানিং। সাড়ে দশটা তো এখানেই বেজে যাবে! ফোনটা শালা এমন সময় গেল! ম্যানেজার সাহেবকে একটা ফোন মারলে – স্যার, আমার এই অবস্থা, আমি একদম আটকে গেছি...কাজে পেঁয়াজি তো কোনও দিন মারেনি। ঠিক মাফ হত।
প্রিয়াটাও যে কী ভাববে! এক সঙ্গেই কাজ করে। তবে শুধু সহকর্মী নয়, সম্পর্কটা আরও একটু এগোতে যাচ্ছে। বলে এসেছে যদিও। এ সময়ে ফোনটাও পকেট ফাঁকা। মাসিমার বাড়িতে থাকাকালিন ফোন করেছিল মেয়েটা। কেসটা প্রায় খেয়ে যাচ্ছিল মাসিমার হাতে। পেছনে মাসিমা যে কখন এসে দাঁড়িয়েছিল! ফোনে মনোযোগের ঠেলায় টের পায়নি। ‘ব্যস্ত আছি’ বলে না রাখলে কী যে হত! তবুও জিজ্ঞেস করেছিল মাসিমা – কে মেয়েটা?
-আমার কলিগ। পাশের চেয়ার খালি দেখে ফোন করল।
মাসিমা এগোয়নি বটে, চোখে মুখে কী সন্দেহ ছিল! ঠিক খেয়াল পড়ে না ওর।
পায়ের দিকে মশারির ওপার থেকে কিসের যেন ঠোকা। গরমের দিনে সাপপোকের উপদ্রব এ এলাকায় আছে। মশারি থেকে লম্বা পা সরিয়ে পাশ ফেরে ও। এবার পাশ থেকে। জ্বালাতন! উঠে বসে ইন্দ্র।
মশারির ওপাশে দরোজার চৌকাঠে বউটা। ফিসফিসিয়ে ডাকে – দাদা!
-হ্যাঁ, বলো!
যত তাড়াতাড়ি পারেন, এখান থেকে চলে যান। - এবারও ফিসফিস কথা।
- কেন?
আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। বেশি কথা এখানে বলা যাবে না..আমি রাস্তায় যাচ্ছি। আপনি গুছিয়ে আসুন। - বউটার গলায় পূর্ব ঢঙ।
নিমেশে ইন্দ্রের মাথা শূন্য হয়ে যায়। ঠাউরে পায় না কিছু। হুর পরিটরি নয়তো! চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে নেয় ইন্দ্র। ভুতুড়ে কোনও ঝক্কি নয় তো! ডাকবে নাকি লোকটাকে!
না, বাবা, কাউকে ডাকাডাকির দরকার নেই। এ নিগ্ঘাত কৃষ্ণকলি। এখানে কথা বলার ফুরসত নেই, ওর শ্বশুর সন্দেহ করতে পারে, তার চেয়ে নিরিবিলি গোপনে – তা ভালো।
সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অনেক জিজ্ঞাসা আছে ওরও। কতদিন হয় না দেখা। আজ পুঁশিয়ে নেবে। কলির দাম্পত্য জীবনে অশান্তি হোক, তাও চায় না ও।
নিঃশব্দে পা টিপে বউটা রাস্তায় ওঠে।
তড়িঘড়ি বালিশের পাশে রাখা জামা ঘড়ি ব্যাগ সাড়াহীন সামলে চোরের মতো চুপি চুপি নদীবাঁধে উঠে যেন দম পায় ইন্দ্র। কৃষ্ণকলি দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দ্র আর থাকতে পারল না। বলল – বলো, কলি, কী হয়েছে?
অনুচ্চ কথাটি বউটা নোনা হাওয়ার চোটে ঠিকঠাক শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। শুধু ঠোঁটে আঙুল চেপে মুখ ইশারায় খেয়াঘাটের দিকে এগোতে বলল।
ইন্দ্র অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে।
যুবতী বউটা ইন্দ্রের হাত ধরে পথ দেখিয়ে চলল। চরে বাইন গেঁওয়া ক্যাওড়ার পাতায় গাঙশরীর ঘেঁসা নোনা বাতাসের শিরশিরানি পিরীত। চরের কাদায় চট্চট্ পট্পট্ সাড়া। ইন্দ্রের পায়ে ইটের হোঁচট। ইন্দ্র অনুচ্চে কথা ছাড়ে – কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে, কৃষ্ণকলি?
-আমি রিক্তা।
- তাই?
- আমার নাম রিক্তা...
- তুমি ভুল বলছ। তুমি রিক্তা নও, তুমি কলি। একদিন আমার ছিলে। আমি তোমার টোটন। চিনতে পারছ না!
- আমায় মাপ করবেন। অন্য কারো সঙ্গে আমায় গুলিয়ে ফেলছেন।
ইন্দ্র ফট করে বউটার ডান হাত চেপে ধরে। শাখা পলা চুরি সরিয়ে চামড়ায় হাত বোলায়। এক হাতে মালুম হয় না। আরেক হাত লাগায়। বলে – চুমু খেতে গিয়ে সেই আমার কামড়ানো দাগটা ভ্যানিস করে ফেলেছ?
-আপনি পাগোল, নাকি!
- তাও সাজাতে পারো। তোমায় হঠাৎ দেখে প্রায় তাই।
- আপনি যেই হোন, পালিয়ে যান।
- তুমি এখন সুখী তো?
- আমার ব্যক্তিগত জীবন জেনে আপনার কী লাভ?
- এভাবে কষ্ট দিয়ো না আমায়। দোষ আমাদের দু’জনের ছিল। তুমি নিজেও জানো। সেই যখন দেখাই হল, বলোনা? বলো, তুমি সুখি তো! শুধু এই একটা উত্তর, একটা উত্তর তোমার মুখ থেকে আমার জানা খুব দরকার।
- আপনি মনে হয় কোথাও ভুল করছেন। আমি আবার বলছি – আমার নাম রিক্তা রায়। বিয়ের পরে হয়েছি মন্ডল। আমার বাপের বাড়ি পারঘুমটে।
না, তুমি কিচ্ছু ঠিক বলছ না - কথাটা কি একটু জোরে হয়ে গেল? ইন্দ্র নিজেই যেন ফাটা বেলুনপানা চুপসে আসে।
- আচ্ছা, আমি সব ভুল বলছি। শুধু মনে করুণ এইটুকু ঠিক বলছি। মন দিয়ে শুনুন।
ইন্দ্র ধাতস্থ।
-আপনি এখনি এখান থেকে চলে যান।
- কেন?
- আপনার সম্মানের ক্ষতি হবে, বদনামের ভাগিদার হবেন।
- একদিন তোমার বন্ধু ছিলাম। সেই অস্বীকারে যদি আমাকে বদনামের ভাগিদার করো, মন্দ কী!
- তা যদি চাইতাম, আপনাকে এখানে আনতাম না।
- কে, তবে আক্রমনে কে?
- আমার শ্বশুর।
- কিকরে?
- আমাকে জোর করে সব্বোনাশ করার অজুহাতে।
- বা রে! আমি যদি কিছু না করি! আমি না করলেও!
- ঘটনাচক্রে তাই দাঁড়াবে হয়তো।
- কেন, কোনও দিন কি এর আগে এমন করেছেন?
- না।
- তবে?
- হঠাৎ আজ আবার আমার মনে হল।
- কিন্তু কেন?
বউটা খানিক থেকে থেকে বলল – আমার পরিস্থিতিতে থাকলে ভয় আপনারও হত।
-একটুখানি শুনি!
- খেয়ায় পার হতে না-পারা মানুষজনকে প্রায়ই উনি বাড়ি নিয়ে তোলেন। কেন বলুন তো! আমাদের ফাঁকা বাড়ি। বছরের বেশিরভাগ সময় আমার উনি বাড়ি থাকেন না। এখন আমার মনে হয়, আমার শ্বশুর কী লোভী! কী নিচ স্বভাবের! এভাবে একটা কিছু রটিয়ে দিয়ে লোকটার পয়সাকড়ি হাতানোর ধান্দা।
একটা টর্চলাইটের আলো বউটার বাড়ির দিক থেকে রাস্তার এপাশ ওপাশ কাৎ চিৎ। বউটা অস্থিরিয়ে উঠল – আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আসুন। দয়া করে কাউকে কিছু বলবেন না।
ইন্দ্র মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারল না। এসব কী! নাটক নয় তো! কী সুন্দর ম্যানেজ করে গেল! নাম ঠিকানা যা বলল, বানানোই হবে। কোনও প্রয়োজন ছিল! ধরা দিল না কেন! কী হত! ও তো কেড়ে নিয়ে যেতে আসেনি। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে দীর্ঘদিন পরে দেখার আনন্দটাই বুঝল না। হায়, অবুঝ কৃষ্ণকলি। কিন্তু ও তো ছিল না এমন! কী হয়েছে! মানসিক স্বাস্থ্য এত খারাপ হল কিকরে! ওর কি একাকিত্ম থেকেই সন্দেহ, সন্দেহ থেকে... ইন্দ্র আর খোটাতে চায় না। ও তো কৃষ্ণকলি নয়। তেমন প্রমান পাওয়া গেল কই! পরের বউকে নিয়ে, সত্যি! ভাগ্যিস, চড়চাপ্পড় চালায়নি। এ রাস্তাটা বন্ধ হয়ে থাক। একটাও চিন্তা যেন আর ওপাশে না যায়। মন, তুই ঠান্ডা হ, বাছা। কেন যে মাঝেমধ্যে ভুলভাল পথে যাস! তোকে তো বেঁধে দিয়েছি প্রিয়ার বুকে। ওর সঙ্গে ওর হয়েই শান্তিতে থাক না! আবার কেন ওলোটপালোট! হা ভগবান, মনটাকে যদি একটু কসে জড়িয়ে দিতে পারতে! মাঝেমধ্যে পাগোলপানা বড্ডো জ্বালায়। একটা কিছু ঢুকলে মোট্টেও থির দেয় না।
চোখ বুজে দোকানের খুঁটির গায়ে হেলান টেনে ইন্দ্র চুপ। বাতাসে একটু শীত শীত। তবু উত্তেজনায় গা গতরে ঘাম। ঝাঁ ঝাঁ মাথার পিছনে টিসটিসে চাপ। হঠাৎ গা ঠান্ডা ধরে। শীত শীত অস্বস্তি। একটা ঘুম বড়ো দরকার ছিল। এত রাতেও ওপারের কোন্ বিয়ে বাড়ির মাইকের গলা চেনা যাচ্ছে। দক্ষিনে হাওয়া বেয়ে পষ্ট। বাঃ! প্রিয় বন্ধুরা, স্বপ্ন বেঁচে থাকুক তোমাদের। সুখে থেকো।
বাতাসের বাড়ানি কমেছে। গাছগাছালির পাতালতার ফুসফাস খানিকটা মরে প্রায় নীরব। গাঙের ঢেউও নরম পড়েছে। স্রোত উলটো।
কী একটা মনে হতেই নদী-চরপানে চাইল ইন্দ্র। আঁধারেও যেন সে পস্ট দেখতে পাচ্ছে – তার কৃষ্ণকলি তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে তরতরিয়ে নেমে যাচ্ছে গাঙমুখো। ও কোথায় যাচ্ছে এখন! মতিগতির ঠিক আছে তো! খুব একটা স্বাভাবিক নেই বলে মনে হচ্ছে। ওই তো তার জান চরের কাদা ঠেলে নদী-জলের কিনারে। ওকি! ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে! কেন, কেন, কেন!
ইন্দ্র পড়িমরি গতি ধরল। তার কলিজা নোনা জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। ডুবছে আবার ভাসছে। স্রোতের ঠ্যালোনে হঠে যাচ্ছে দক্ষিনে। ঠাকুর আরও কিছুক্ষণ ওকে লড়াই করার ক্ষমতা দাও, গিয়ে উঠব।
চরের কাদায় পা ডোবাতেই ইন্দ্রের পায়ে মচকা। হুমড়ি টেনে পড়ল চর-কাদায়। সাজপোশাক কাদা জলে লেউড়িচেউড়ি। ওর পরাণটা ভেসে যাচ্ছে গাঙ-স্রোতে।
ইন্দ্র খাঁড়া হয়ে উঠতে চাইল কাদায়। পায়ের যন্ত্রনায় বেসামাল। ইন্দ্রের চোখে জল চলে এলো। স্রোতের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তার প্রিয়তমা তলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে যে!
কারা যেন কল কল কথা চালিয়ে আসছে। টর্চের আলোয় রাস্তার অন্ধকার মুছে ফর্সা। আলোয় আলোয় চৌপাশ খানিকটা দৃষ্টিগোচর। স্বপ্ন ভেঙে গেল ইন্দ্রের। দোকানের খুঁটির হেলান ভেঙে ধড়ফড়িয়ে উঠল সে। লোকগুলো কাছে আসতেই বুঝল, মাথায় হাঁড়ি নিয়ে বাগদা মীনের ক’টা ভারি। আলো ফেলে ওদের একজন শুধালো – দোকানে কে?
-আমি।
- আমি, কে!
- চলুন, আপনাদের সঙ্গে যাব।
ভোরের ভটভটিতে ন্যাজাট, না হয় ধামাখালি, আরশাদ মিঁয়ার ঘাটে যাবে হয়তো ওরা। তাড়া আছে। ইন্দ্র ওদের পাছ নিল।
ভালোই হল। ভোরে ভোরে অনেক আগেই বাড়ি ঢুকে যেতে পারবে। কিন্তু! মনের খোলে একটা খটকা লাগতেই ইন্দ্র শুধাল – দাদা, আপনারা যাবেন কোথায়?
ওদের এক জন জবাব টানল – রহমতের খটি পর্যন্ত। তুমি কোথায় যাবে?
ইন্দ্রের পা মাটিতে আটকে অচল। এদের সঙ্গে গিয়ে তবে লাভ কী! কোথায় রহমতের খটি তাও জানা নেই। বরং সরদারপাড়ার ঘাটে বসে থাকা অনেক ভালো। ভুটভুটি সিন্ডিকেট। এখন না হোক, ভুটভুটি ছাড়বেই।
ওদের এক জনের খোঁচা – ও ভাই, দাঁড়িয়ে পড়লে যে!
-আমি তো গোপালের ঘাটে যাব।
- ওখান থেকে আমাদের হাঁড়িগুলোও প্যাসেঞ্জারি ভুটভুটিতে ন্যাজাট যাবে।
ইন্দ্রের মনে ফুরফুরে ঢেউ। খানিক স্বস্তি। ভারিদের সঙ্গে এবার টেনে পা ফ্যালে।
সবার পেছনে ইন্দ্র। ভারিদের আলোর জ্যোতি ধরে পথ কমানোর ধান্দা। হঠাৎ ওর মনে হল, একটি নরম মেয়েলি হাত পিছন থেকে ডান হাতটা হ্যাঁচকা ধরে কতদিনের ভীষণ আপন। ইন্দ্র থেমে গেল। শিউরে উঠল গা। কৃষ্ণকলির সোহাগ জড়ানো বাধা। সামনে কী আর এগোনো যায়! ঘাড় ঘুরিয়ে খুশি মনে পাছ ফিরল ইন্দ্র। দৃষ্টিভর আলো-আঁধার। হালকা বাতাস সপাটে আছড়ে পড়ল তার গায়ে। ক্রমে ইন্দ্রের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে ভাঁজ ধরল। কোত্থাও কিচ্ছু নেই, শূন্য পথ।
এপার বাংলা ওপার বাংলা , নভেম্বর, ২০২১