"হুম, স্বর্গে গিয়েও খাস। ওখানে নাকি আরও ভালো ভালো মদ পাওয়া যায়। সুন্দরী নারীরা সোনার গ্লাসে মদ দেয়। আমাদের তো সে ক্ষমতা নেই বন্ধু ---- এই প্লাস্টিকের গ্লাসেই দিলাম। ওই ভবা শালা কাঁসার গ্লাসে দিচ্ছে। তুই তো জানিস ও শালার হাতে আস্তে - সুস্থে বলে কোন জিনিস নেই। বাঞ্চোৎ প্লাস্টিকের গ্লাসে খেতে পারে না। ওটাই সোনার গ্লাস মনে কর।
আজ যেখানে খড়কাটা বাজার, কিছু বছর আগে সেখানে রাশি রাশি খড় ছিল। সেই খড় কেটে একটা-দুটো করে দোকান করতে করতে বাজারের পত্তন বলে নাম 'খড়কাটা বাজার'। এই বাজার থেকে পুবদিকে যে রাস্তাটা বেরিয়ে 'গোঁটরা' এবং 'পানপুর' হয়ে হরিণঘাটা পৌঁছে গেছে, সেই রাস্তায় একজন জোয়ান মানুষ হেঁটে গেলে মিনিট দু'য়েক পরে ডানহাতে একটা বড়ো শোভাফুল গাছ দেখতে পাবে। সেই গাছের নিচে একটা মদের দোকান। না, সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত দোকান নয়; লুকিয়ে চুরিয়ে বিক্রির দোকান। প্রথমে বাঁশের মাচার ওপর টং তৈরি করে সেখানে মদ বিক্রি করত ট্যাঁরা দাস। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় টঙের সামনে একটা দশ বাই বারো ফুটের পাকাপোক্ত ঘর উঠেছে। আর বাঁশের খুটি ও মাচা পচে-ক্ষয়ে যাওয়ায় মাচা বাদ দিয়ে টিনের টংটা ইঁট বিছিয়ে সেখানেই বসিয়ে দিয়েছে।দোকান থেকে মদ, চাট নিয়ে এখানেই বসে খায় সকলে। সেই পুরনো টিনের টঙের পিছন থেকে জল ঢালার শব্দ আসে, সঙ্গে কথাও। দু'- একজন উপস্থিত খরিদ্দার বুঝতে পারে না কী ব্যাপার? তাই ট্যাঁরা দাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্যাঁরা দাস, " যা হচ্ছে হোক,তোমাদের কাজ করে সরে পড়ো। আজ আর ঝামেলা করো না।" - বলে খরিদ্দার সামলায়। সব দিন সব ক্ষেত্রে ব্যবসা উচিত নয় --- মানবিকতাও থাকা উচিত। না হলে ব্যবসা জমে না। ট্যাঁরা দাস তা জানে--- মানেও। তাই তার পসার অন্যের চেয়ে বেশি।
একটু পরেই পাঁচ জন মানুষ টঙের পিছন থেকে একে একে বেরিয়ে আসে। চার জনের হাত খালি--- শুধু ভবার হাতে কাঁসার গ্লাস। সকলে লাইন করে ট্যাঁরার সামনে দাঁড়ায়। ট্যাঁরা পেগ তৈরি করে প্লাসটিকের গ্লাস ধরিয়ে দেয়। ভবার হাতের কাঁসার গ্লাসের গলা পর্যন্ত মদের স্তর ওঠে। আবার পাঁচ জন টঙের পিছনে চলে যায়। শিবের মাথায় জল ঢালার মতো একটা গর্তের মধ্যে সব মদ ঢালে। বন্ধুকে খেতে বলে। তারপর গ্লাসগুলো ফেলে দেয়। এভাবে সাত বার তারা ঢেলে এসে টঙের মধ্যে বসে।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। এমনকি ট্যাঁরা দাসের মুখেও। দু'-একটা খরিদ্দারের আবদার মেটায় সে নিঃশব্দে। তারা কথা বলতে চাইলে দুই ঠোঁট বন্ধ করে তর্জনি ঠেকায়। খরিদ্দারেরা সকলকে চুপচাপ খালি হাতে 'থ' হয়ে বসে থাকতে দেখে টঙে ঢুকতে সাহস পায় না। অগত্যা কোনো ঝোপেঝাড়ে গিয়ে বসে তারা। সেখানেই ফূর্তি করে।
আজ এই পাঁচ জন শুষ্ক মুখে বসে থাকে। অথচ অন্য দিন হলে এদের মাতলামো হয় দেখার মতো। কিন্তু কাল রাতেই এরা বন্ধুকে হারিয়েছে, তাই আজ তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোক পালন। এমন পালনের উদগাতা যে, সেই শুকলালই আগে আগে চলে গেল। বেশ প্রাণশক্তি ছিল। অথচ কেমন হঠাৎ করে মরে গেল ! সুরা পানের জন্য ? প্রশ্ন জাগে ভবার মনে। বলেও ফেলে একবার -" ফায়েক, এত মাল খাওয়ার জন্য লালু টেঁসে গেল না তো? "
"দেখ ভবা, মাথা গরম করিস না! মাল তো শালা তুইও খেয়েছিস কালকে গলা পর্যন্ত। তুই মরেছিস?" অসিকুল ঝাড় দেয় ভবাকে। ভবা লজ্জিত ভাবে মাথা নাড়ে। তারপর চুপচাপ সকলে। হঠাৎ মিনিট তিনেক পরে ট্যাঁরা দাসের দিকে তাকিয়ে কচি বলে, " তারাদা, একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেল যে ! " ট্যাঁরার দোকানের পিছন দিকে একটা বড়ো জানালা করা আছে,সেখান দিয়ে টঙের মধ্যে যারা থাকে তাদের সঙ্গে আদান-প্রদান চলে। সেখান দিয়ে ট্যাঁরা দাস ভ্রূ কুঁচকে তাকায় কচির দিকে।
" লালুদা যে ডালের বড়া খেতে ভালোবাসত, সেকথা তো কারো মনে নেই! "
কচির কথায় সকলে লজ্জিত হয়ে নড়েচড়ে বসে। প্রিয় বন্ধুর প্রতি শেষ নিবেদনে তার প্রিয় খাবারটাই দিতে ভুলে গেল সবাই ! ফায়েক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। দলের মধ্যে সে-ই জোগাড়-যন্ত্রের ওস্তাদ। খুব দ্রুত সব কিনে-কেটে আনতে পারে। যায়ও সে। উঠে দাঁড়িয়েও কেমন যেন একটু ইতস্তত করে। ট্যাঁরা দাসের চোখ এড়ায় না। কাছে ডাকে। ক্যাশবাক্স থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে ফায়েকের হাতে দেয়। টাকাটা নিয়ে ফায়েক বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে যায়। সকলে জানে ফায়েক দরাজ দিলের ছেলে। কাছে যতক্ষণ টাকা থাকে মূলধন রেখে এটা সেটা কিনতে থাকে। আর যদি টাকা না থাকে তো ইতস্তত করে কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে বলে না টাকা দেওয়ার কথা। তাতেই সকলে বুঝে যায়।
ফায়েক একজন ব্যবসায়ী। গ্রামের ভাষায় ফড়ে। সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগি কিনে সংগ্রহ করে। বৃহস্পতিবার হলে সব নিয়ে বিরহীর হাটে চলে যায় বিক্রি করতে। পশুহাট বসে সেখানে।গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, খরগোস, পায়রাসহ বিভিন্ন পাখির কেনাবেচা চলে। দু'দিন আগেও বৃহস্পতিবার হাটে গিয়েছিল মিলনের মোটরভ্যান নিয়ে। মোটরভ্যান মানে প্যাডেলভ্যানের চেয়ে উন্নত সংস্করণ। শক্তপোক্ত কাঠের মাচা, প্যাডেলের পরিবর্তে অটো কিংবা হ্যান্ড ট্রাক্টরের মতো ছোট ছোট চায়না ইঞ্জিন বসানো। যেমন মাল টানে, তেমন ছোটেও খুব। ইদানিং এই ভ্যান ছাড়া প্যাডেল ভ্যান চোখে পড়ে না। এমনই একটা ভ্যান মিলনের। বিক্রিবাটা শেষে যখন চৌত্রিশ নং জাতীয় সড়ক ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে তখন প্রায় দুপুর দুটো। খুব সকালে হাট বসে। এর মধ্যে মিলনকে দুবার চা ও একবার পরোটা খাওয়াতে হয়েছে। মিলনের মোটরভ্যান যখন বাড়ির পথে রিল্যায়েন্স তেল পাম্প ছাড়িয়ে বিদ্যাসাগর বি.এড কলেজ ছোঁবে ছোঁবে তখন দেখে এক মারাত্মক দৃশ্য--- দুটো মাল বোঝাই লরি কাত হয়ে পড়ে আছে নয়নজুলিতে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে মদের বোতল এবং বাঁধাকপি। বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। যে যেমন পারছে হাতে, বগলে, লুঙ্গিতে, পকেটে মদের বোতল নিয়ে পালাচ্ছে। পুলিশ এখনও আসেনি। হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় মিলন। লাফ দিয়ে সিট থেকে নেমে দুটো বোতল কুড়িয়ে মুরগির ক্যারেটে চালান করে দেয়। ফায়েকও নেমে পড়ে। দুজনের সংগ্রহ দাঁড়ায় ছোট-বড়ো দিয়ে সতেরটা বোতল। হঠাৎ যেন 'অতি লোভে তাঁতি নষ্ট' প্রবাদটা মনে পড়ে যায় ফায়েকের। মিলন তার মোটরভ্যান হাতল ঘুরিয়ে চালু করতে না করতেই দেখে দু'জন সিভিক ভলেন্টিয়ার বাইকে চেপে এসে পড়ে ঘটনাস্থলে। এক কিমি দূরে যারা শিমুরালি কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে ডিউটি করছিল। মিলন আর মোটেই দেরি করে না। ফোকোটিয়া মাল যদি আবার ফেরত দিতে হয়!
ফায়েকের নির্দেশ মতো মিলন ট্যাঁরা দাসের দোকানের সামনে থামায় তার মোটরভ্যানটি। ফায়েককে অত বড়ো বড়ো মদের বোতল হাতে করে তার দোকানে ঢুকতে দেখে অবাক হয় ট্যাঁরা দাস! মাতালেরা মদের দোকান থেকে মদ কিনে নিয়ে যায় ; আর এ মাতাল যে উল্টে তাকে দিতে আসছে! জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে ট্যাঁরা দাস। দশটা বোতল নামিয়ে বলে," ট্যাঁরাদা বোতলগুলো থাক। ভিতরে রেখে দে, সন্ধ্যাবেলা এসে সব বলব। বাড়িতে তো নেওয়া যাবে না, তোর বৌমা পাঁচ ওয়াক্তের নামাজি! এসব দেখলে পানা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলবে।" বলেই হাঁটতে শুরু করে। ট্যাঁরা দাস এবার কথা না বলে পারে না। চেঁচিয়ে বলে -" এত মাল কোথায় পেলি? চোরাই মাল নয় তো? আমাকে না ফাঁসাস শেষে!"
"ভয় নেই। চোরাই না। তবে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।" বলেই ফায়েক লাফ দিয়ে ভ্যানে ওঠে।
চিনির খবরে যেমন পিঁপড়ে জড়ো হয়, তেমনি মদের খবরে মাতাল একত্রিত হয়। সব খবর চেপে রাখা যায়, কিন্তু ফোকোটিয়া নেশার বস্তু পেলে নেশাপাগলেরা উৎফুল্লে ঢাক বাজায়। মিলেমিশে ভোগ করে। সন্ধ্যার পর তাই ছ'জনে জড়ো হয় ট্যাঁরা দাসের টঙে। যত বড়ো খরিদ্দারই হোক,'সাত সমুূদ্র' দল দোকানে থাকলে তার জায়গা হয় না টঙের মধ্যে। কেউ আসলেও ট্যাঁরার কাছ থেকে মাল, গ্লাস, জল, চিপস্, ঘুগনি, মাংস নিয়ে আশেপাশে বসে পড়ে। মদের সঙ্গে ট্যাঁরা চাট হিসাবে ঘুগনি, মাংসও বিক্রি করে। খরিদ্দার ধরে রাখার সমস্ত কিছুই তার কাছে পাওয়া যায়। এদিকটা ফাঁকা জায়গা হওয়ায় তেমন কোনো ঝামেলা থাকে না। তাছাড়া থানার সঙ্গে চুক্তি করা আছে, তাই কোনো রকম রেইড হয় না। প্রতি মাসের পয়লাতে গাঁয়ের একজন সিভিক ভলেন্টিয়ার থানার তরফে তিন হাজার টাকা নিয়ে যায়। তাই ট্যাঁরা দাস চুটিয়ে ব্যবসা করতে পারে।
মদ বিক্রেতা কখনও মদ খায় না বলে একটা প্রবাদ আছে। কিন্তু ট্যাঁরা দাসের কাছে সে প্রবাদের গুরুত্ব নেই। কেননা মন চাইলে সে নিজেই 'সাত সমুদ্র ' দলের সঙ্গে বসে পড়ে। কিন্তু মানুষটা গলা পর্যন্ত মদ খেলেও কখনও উল্টো-পালটা কথা বলে না কিংবা আবেগ তাড়িত হয় না। স্নায়ু বশেই থাকে। মাল খেতে খেতে খরিদ্দার এলে উঠে গিয়ে তাদের মাল,চাট দিয়ে আসে। তাই 'সাত সমুদ্র' গ্যাংয়ের সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক। এদের সে খরিদ্দার ভাবে না। বন্ধু মনে করে। তবে ব্যবসায় লস করে না। প্রয়োজনে কেনা দামে দেয়, লাভ রাখে না, তারপরও যদি কেউ মজা করে বলে আরও কমের কথা, তাহলে সে বলে- "পারব না ভাই, বাড়িতে আমরা ছয়জন মানুষ, চারজন ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার বেতাল খরচ; তারওপর থানা পুষতে হয়! টমাস তখন বলে, " মিস্টার ট্যাঁরা দাস, তোর টাইটেল দাস না হয়ে 'সরকার ' হওয়া উচিত ছিল। তুই সরকারের মতো পুলিশ পুষিস!"
টমাস এখন খ্রিস্টান। তাই তার মধ্যে একটু ইংরেজ ইংরেজ ভাব রাখার চেষ্টা করে সবসময়। প্যান্ট-শার্ট ছাড়া পরে না। লুঙ্গি-ধুতি ঘৃণা করে। দরকার হলে বারমুডা পরে, থ্রি-কোয়ার্টার পরে। অনেকটা সেই 'হিঁদুর ছেলে মোছমান হলে ঘন ঘন গোস্ত খায়'এর মতো। বছর তিরিশ আগে অভাবের তাড়নায় টমাসের বাবা সতীশ দুলে থেকে স্যান্টিয়ানো হন, আর টঙ্কা থেকে টমাস। তবে এদের টাইটেলের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয় না। স্যান্টিয়ানো পায় নগদ কুড়ি হাজার টাকা, দু'কাঠা জমি আর সেই জমির ওপর প্লাসটার বিহীন ইঁটের দেয়াল ও টিনের চালের দু'কামরা বাড়ি। সঙ্গে একটা পায়খানা ও জলের কল। সেই টঙ্কা আর আজ এই টমাসের পার্থক্য অনেক। বাড়ির ছাগল, শুকরের সঙ্গে ধুলোতে গড়াগড়ি খাওয়া টঙ্কা আজ ধুলো বিক্রি করে। অর্থাৎ মাটি কেনাবেচা করে। বড়োদিনের অনুষ্ঠানে, গুড ফ্রাইডে প্রভৃতিতে ভালো চাঁদা দেয় এবং খ্রিস্টানদের মতো মদ্য পান করে।
আর সকলে আসলেও অসিকুলের আসতে দেরি হয়। সে গিয়েছে ফুফাতো ভাইয়ের বিয়েতে। ফায়েক তাকে খবর দেওয়ায় সঠিক সময়ে আসবে বলে কথা দিয়েছে। সকলকে অপেক্ষা করতেও বলেছে। ঠেকে এসে এর মধ্যে দু'বার ফোন করা হয়ে গেছে অসিকুলের কাছে। প্রথমবার ধরে বলে নগরউখড়ায় পৌঁছেছে; আর মিনিট কুড়ির মধ্যে চলে আসবে। বাড়িতে ছেলে-বৌকে নামিয়ে দিয়েই আসবে। এদিকে 'সাত সমুদ্র' গ্যাংয়ের পাঁচ জন হাজির। দামি দামি মদের বোতল হাতের কাছে পেয়ে উসখুস করছে সকলে। টমাস খ্রিস্টান হবার পর বোর্ডিংয়ে থেকে ইংরেজি পড়েছে কিছু দিন। তারপর ভালো না লাগায় কিভাবে যেন পালিয়ে এসেছে। সে পড়তে থাকে - Black lebel, Bowmore Jura, Blenders pride, XXX Rum, Vodka একে একে। কচি হাতে নিয়ে বোতলগুলো নাড়াচাড়া করে। গন্ধ শোকার চেষ্টা করে। আজ মাল স্পেশাল বলে চাটও স্পেশাল --- বাজার থেকে টমাস খাসির ছাট-চর্বি দিয়ে রান্না ঘুগনি এনেছে একশ টাকার। ট্যাঁরার প্লেইন ঘুগনি তার মন টানেনি আজ। শুকলাল ডালের বড়া ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাল খেতে ভালোবাসে তাই আসার পথে বলরামের চপের দোকান থেকে তার প্রিয় চাট নিয়ে এসেছে। ভবা ট্যাঁরার দোকানের ঝাল ঝাল মাংস নিয়েছে সকলের জন্য দুই পিস করে। এর মধ্যে আরও এক পিস করে ট্যাঁরা দিয়েছে সকলকে। বিরক্ত হয়ে এবার শুকলাল ফোন করে অসিকুলকে। রিং হয়ে যায়,ধরে না। সামনে মদের বোতল নিয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করা প্রেমে অপেক্ষার চেয়েও অসহনীয়! শুকলাল গাল দিতে শুরু করে -" শালা কি আমাদের সঙ্গে মজা করছে নাকি? আর একবার কল করব। ধরলে ভালো, না ধরলে শুরু করব।"
"তুই কল করে যা। আমি এই খুললাম। "-- বোতল সাজিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ভবা বলে। আর শুধু বলে না, জলের বোতল কাছে টেনে নেয়, নেয় ব্ল্যাক লেবেলের বোতল। ছিপি খোলে--" কচি গ্লাস দে। আর আমারটা নিয়ে আয় ট্যাঁরার কাছ থেকে।"
সকলে প্লাস্টিকের গ্লাসে খায়, কিন্তু ভবা তা পারে না। প্লাস্টিকের গ্লাসে খেতে গেলে গ্লাসকে আদর দিয়ে ধরতে হয় নতুবা ছলকে পড়ে। পড়েছেও ভবার হাত থেকে কয়েকবার। বিরক্ত হয়ে শেষে ছেলের অন্নপ্রাশনে পাওয়া কাঁসার গ্লাস নিয়ে আসে। বন্ধুরা এ নিয়ে খিল্লি করেছে। করেও মাঝে মধ্যে। শুকলাল প্রথম দিন বলেছিল-" তুই সবই কি এরকম জোরে ধরিস? বাড়িতে বৌদি রাগটাগ করে না? "
কচি সবচেয়ে সরল-সোজা। কিন্তু ইঙ্গিতটা বুঝে সেও খক খক করে হেসে ফেলেছিল।
সকলে গোল হয়ে বসতে না বসতে পেগ রেডি করে ভবেশ। শুকলাল তার ডালের বড়ার প্যাকেট খুলে সামনে কাগজের থালায় রাখে। টমাসও ঘুগনি প্যাকেট থেকে ঢেলে দেয় অন্য থালার উপর। তারপর ট্যাঁরা দাসকে ডাক দেয়-" ট্যাঁরা দা প্লিজ কাম হেয়ার। পেগ ইজ রেডি। জয়েন আওয়ার টিম।"
"ওই! শালা খাওয়ার আগেই শুরু করেছে! খেয়ে না জানি আরও কত ইঞ্জিরি ঝাড়বে! ভবা বিরক্তি দেখায়।
" আরে রাগ করিস কেন ভাই? ফায়েক কি সব মাল জোগাড় করেছে দেখেছিস? জীবনে এসব খাইনি কখনও আমরা। আনন্দ তো হবেই; ব্ল্যাক লেবেলের দাম দেখেছিস! হাউ মাচ! ছয় হাজার নয়শো দশ আই মিন সাত হাজার টাকা! এই Bowmore টার দাম জানিস? আট হাজার চারশো কুড়ি টাকা! Grey goose vodka র দাম পাঁচ হাজার পাঁচশো টাকা! এর পরও কি আনন্দ হবে না? ফায়েক মাই ফ্রেন্ড --- গ্রেট, ইউ আর গ্রেট। ব্রাদার কাম হিয়ার এন্ড হাগ মি..... "
সেই মুহূর্তে খরিদ্দার না থাকায় ট্যাঁরা দাস এসে পেগ নেয়। সকলে মিলে গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে সিনেমার ঢংয়ে বলে " আজ কি শাম ফায়েক কা নাম। "
পরের পেগ ঢালতে ঢালতে অসিকুল এসে পড়ে। আসরে যোগ দিতে দিতে বলে "আমাকে ছাড়াই শুরু করে দিলি তোরা, বললাম না আমার জন্য ওয়েট করতে "?
" তোমার এ রস ভালো লাগবে কেন চাঁদু ; বিয়ে বাড়িতে কত রসের জিনিস দেখলে--- হয়তো পানও করেছো। তারপর আসিফা বিবিও ছিল হয়তো দাদার বিয়েতে। হয়তো কেন ছিলই।" টমাস বন্ধুর সঙ্গে মজা করে।
অসিকুলের ফুফাতো বোন আসিফা। যার সঙ্গে অসিকুলের একটা মাখামাখি সম্পর্ক ছিল। কিন্তু অসিকুলের মা রাজি না হওয়ায় বিয়ের পর্যায়ে পৌঁছায়নি ব্যাপারটা।
" ফালতু কথা ছাড়। ভবা আমার পেগ দে৷"
" প্রাণের মানুষও কখনও কখনও ফালতু মানুষ হয় তাহলে তাই না লালু ?" ফায়েক মজা নেয়।
" তোরা যে ক'পেগ মেরেছিস, আগে আমাকে সে ক'পেগ দে। তারপর সব গ্লাসে ঢালবি ভবা। " অসিকুল ও প্রসঙ্গ থেকে সরে আসতে চাইছে বুঝে শুকলাল বলে, "দে তো ভবা, শালাকে বোতলটা ধরে দে। "
এতক্ষণে অসিকুলের চোখ পড়ে বোতলগুলোর দিকে। আনন্দে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে-" ওরে গুরু, এ তো সব ইংলিশ মাল! তাও এতগুলো! কোথায় পেলি রে ফায়েক? "
ফায়েক এবার সবিস্তারে সকলকে বলে বোতল সংবাদের কথা।
একের পর এক বোতল শেষ করতে থাকে সাতজনে মিলে। ককটেল সম্বন্ধে কারো হুঁশ থাকে না। এক একজন অগস্ত্য ঋষি। সমুদ্র শুষে নেওয়ার মতো একের পর এক বোতল শুষে নেয়! তাই সাতজনের এই দলকে সকলে বিশেষিত করেছে 'সাত সমুদ্র' বলে। সেটা নরেশ থাকা কালেই। ঘন্টার কাটা পরের ঘরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে সকলের স্নায়ুগুলো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। জোরে জোরে কথা বলতে থাকে সকলে, হাসি, ঠাট্টা, মজা আর মাঝে মাঝে ফায়েকের জয়গান চলে। টমাস মাঝে মধ্যে ইংরেজি ব্যবহার করে। কচি ও ভবা টমাসের ইংরেজি ব্যবহারে অখুশি হয়। টমাস তাতে থোড়াই কেয়ার করে!
চারিদিকে ঝিঁঝির শব্দ ও দু'একটা কুকুরের ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। আশেপাশে যারা বোতল নিয়ে বসেছিল তারাও কখন চলে গেছে! কচি বেশি খেতে পারে না, সহ্য শক্তি তুলনামূলক কম। কিন্তু আজ পাল্লায় পড়ে বেশি খাওয়ায় এক সময় ভিতরে পাক দিতে থাকায় প্রস্রাবের অজুহাতে দূরে গিয়ে বমি করে এসেছে গোপনে। তারপরও আবার খেতে হয়েছে অনুরোধে, খিল্লিতে। কচি ছাড়া আর সকলে জবর টানে। আজ টেনেছেও সবাই। অবশিষ্ট হিসাবে আড়াইখানা বোতল পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেটা ট্যাঁরাকে তুলে রাখতে বলে সকলে। পরিতৃপ্ত হয়ে একে একে পিছনের টং থেকে বেরিয়ে আসে ওরা। এক ট্যাঁরা ছাড়া কারো পা স্বাভাবিক ভাবে পড়ে না। সকলে ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছাতে পারবে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ জাগে ট্যাঁরার মনে।
কচি একাই হেঁটে এসেছে। অসিকুল বাইকে। আর সকলে সাইকেলে। শুকলাল প্রথম সাইকেলে চাপতে যায়, কিন্তু পারে না, পড়তে পড়তে সামলে নেয়। টমাস তাই দেখে 'ননসেন্স' বলে গাল দিয়ে নিজে সাইকেল টেনে নেয়। কিন্তু সেও তাই । টলে পড়ে। ফায়েকেরও প্রায় সেই অবস্থা। অসিকুলের পুরনো বাইক। কিক করে চালু করতে হয়। কিক করে, কিন্তু চালু হয় না; ঠিকঠাক কিক করতে পারে না বলে। টমাস আর শুকলাল দোকানের সামনে বসে পড়ে। বাধ্য হয়ে ট্যাঁরা দাস তাদের পৌঁছে দিতে যায় দোকান বন্ধ করে। ওরা মুখে বলে 'এগিয়ে দিতে হবে না যেতে পারব '। তবু ট্যাঁরা দাস জোর করে যায়। সে জানে এরা মুখে যতই বলুক পৌঁছে না দিলে সারারাত পড়ে থাকবে কোন ঝোপেঝাড়ে! আগেও কয়েক দিন হয়েছে এমন। সাইকেলগুলো এবং বাইকটা দোকানের একপাশে তালা দিয়ে রাখে চেন দিয়ে। তারপর সবাইকে নিয়ে চলতে থাকে। বছরে দু'একবার এমন দিন আসে ট্যাঁরা দাসের ভাগ্যে। তবু এতে সে বিরক্ত হয় না। একে বন্ধু, তারওপর খরিদ্দার। তাই ঝামেলা হলেও সানন্দে এগিয়ে যায় ।
প্রথমে পড়ে কচির বাড়ি। সবাই একসঙ্গে চলতে থাকে। কচি বাড়ির সামনে এসে বিদায় নেয়। আর উঠানে পা দিয়ে তিড়িংবিড়িং করে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ছোটখাটো চেহারার পাতলা মানুষ। তাই তাকে সকলে কচি বলে ডাকে। নাম অবশ্য একটা ছিল কিন্তু সকলে কচি কচি বলে ডাকতে ডাকতে সে নাম চাপা পড়ে গেছে। সব থেকে মজার হলো কচির হাঁটার শৈলী --- ছোট্ট চেহারায় তিড়িংবিড়িং করে হাঁটে বলে দেখতে মজা লাগে।
শুকলালকে বাড়ির সামনে ছাড়তে গিয়ে ট্যাঁরা দাস অবাক হয়। তখনও শুকলালের স্ত্রী মাটির দাওয়ায় একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বালিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় বসে! রাস্তার একেবারে গায়ে ঘর, তাই সকলকে দেখতে পায় শুকলালের বউ। ট্যাঁরা দাস হাত ছেড়ে বলে, "যা লালু, আমরা আসি।"
এতক্ষণ ট্যাঁরাই লালুকে হাত ধরে সামলে আনছিল। হাত ছেড়ে দিলে সে টলতে টলতে এগোয় এবং পৈঠাতে পা দিতে গিয়ে সামলাতে না পেরে হুমড়ি খায়। শুকলালের স্ত্রীর চোখ জ্বলে ওঠে ট্যাঁরা দাসের প্রতি। ট্যাঁরা মাথা নামিয়ে সকলকে নিয়ে রওনা দেয় আবার। একে একে সবাইকে পৌঁছে দিয়ে ভাবে, বাড়িতে শোওয়া আজ ঠিক হবে না। অতগুলো সাইকেল ও অসিকুলের বাইকটা রয়েছে দোকানের সামনে! ফিরে গিয়ে দোকানের মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পড়ে।
পান করতে করতে আবার আসিফার কথা তোলে ফায়েক। তাতে মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে অসিকুলের। মায়ের ইচ্ছাতে বিয়ে করতে হয় তাকে,তাই মন থেকে ঠিক সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারে না বৌকে। কোথায় যেন একটু ফাঁক থেকে যায়!চোখের সামনে সুন্দরী আসিফাকে দেখে ব্যথাটা উথলে ওঠে বেশি করে। সেই ব্যথা ভুলতে আজ বেশি করেই গলায় ঢালে --- একেবারে গলা পর্যন্ত! আর টমাসের তো কথাই নেই। এত সুন্দর সুন্দর বোতল দেখে স্পৃহা আগেই জেগেছিল। আকণ্ঠ পান করে। ভবা, ট্যাঁরাও যথাসাধ্য।
কচির ঘুম ভাঙে বৌয়ের ঠেলায়। দলের সে-ই প্রথম খবর পায় । মাথা ধরেছিল প্রচণ্ড, তবু সেই অবস্থায় পা বাড়ায় লালুর বাড়ির দিকে। রাস্তায় পা দিয়েই শুনতে পায় লালুর বৌয়ের বুক ফাটা কান্না। অপরাধীর মতো ধীরে ধীরে বাড়িতে ঢোকে। কুড়ি-পঁচিশ জন মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। বারান্দায় শোওয়া আছে লালু। গায়ে একটা ছেঁড়া কাঁথা। লালুর মাথার পাশে বসে তার বৌ কাঁদছে নানা রকম কথা বলে। আর মোটা নাকটা আরো ফুলে ফুলে মোটা হয়ে উঠছে। নাকের ফোটানো গর্তের সঙ্গে লেগে থাকা ছোট্ট টিপ সাইজের চাঁদির ফুল ঝিলিক দিয়ে দিয়ে উঠছে। লালুর বৌয়ের চোখের সামনে যেতে সাহস পায় না কচি। মাথার পিছন দিক থেকে লালুর মুখটা দেখে। যেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। এক ঝলকের বেশি দেখতে পারে না। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। একটু চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যেমন চুপি চুপি এসেছিল, তেমনি চুপিচুপি পিছিয়ে আসে। তারপর কোনো কথা না ভেবে এক ছুটে ট্যাঁরা দাসের দোকানে পালিয়ে আসে। এসে সাটার ধাক্কাতে থাকে।
এত সকালে কোনো মাতালের উৎপাত ভেবে প্রথমটা বিরক্ত হয় ট্যাঁরা দাস। দুটো কটু কথা বলে ভাগিয়ে দেবে ভাবে। কিন্তু তারপরই মনে হয় এরা আছে বলে ট্যাঁরা দাস একতলা বাড়ি তুলেছে, ব্যাঙ্কে লাখ ছয়েক জমাতে পেরেছে এবং নাই নাই করে রথীন দালালের কথার গুণে হোক কিংবা হোক ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিশ লাখ টাকার জীবনবিমা করেছে এবং বাজারে চার শতক জমি কিনেছে। তাই ব্যাজার মন হলেও ধীরে সুস্থে উঠে সাটার তোলে। কচিকে এভাবে হাঁপাতে দেখে এবং এত সকালে দেখে অবাক হয়।
" তারাদা, লালুদা চলে গেছে!"
কচি 'সাত সমুদ্র' এবং ট্যাঁরা দাসের চেয়ে বয়সে ছোট; তাই সকলের সঙ্গে সমীহ রেখে কথা বলে। আর ট্যাঁরার প্রকৃত নাম 'তারা' বলেই সম্বোধন করে। আসলে ট্যাঁরার নাম 'তারা'। কিন্তু ছোটবেলায় বোঝা না গেলেও একটু বয়স হলে বোঝা যায় তারার বাঁ-চোখটা ট্যাঁরা ! তাই তার নাম 'তারা' থেকে 'ট্যাঁরা '-তে বিকৃতি ঘটে। সেই নামেই এখন পরিচিত।
কচির কথা বুঝতে পারে না ট্যাঁরা দাস। বলে," কোথায় গেল? "
"নরেশের মতো চলে গেছে --- আমাদের ছেড়ে!"
কচির কথা শুনে তাজ্জব হয় ট্যাঁরা দাস। এমন তো কিছু ব্যাপার ছিল না! দোষের মধ্যে কাল একটু বেশিই খেয়েছে সকলে। বাইরে তেমন বসার জায়গা নেই, পিছনে টং ছাড়া। তাই ট্যাঁরা কচিকে নিয়ে দোকানের মধ্যে ঢোকে। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না । মন খারাপ নিয়ে বসে থাকে। কোনো কথা বলতেই যেন ভালো লাগে না কারো। বেশ ক্ষণ পরে ট্যাঁরা দাস জানতে চায় - " কী করে হলো রে কচি? "
ততক্ষণে কচি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে।
" আমার মনে হয় দাদা হার্ট ফেল কিংবা গলা পর্যন্ত পানের জন্য লিভার ফেটে....... ! ঘুমের মধ্যেই। তা না হলে হসপিটালে অন্তত নিয়ে যেত।"
"ওহ!" বেদনাহত দেখায় ট্যাঁরার মুখটা। না, কোনো খরিদ্দারের কাটতি বলে নয়, বন্ধু বিয়োগেই। ট্যাঁরা দাস বন্ধুবৎসল। একটু পরে একে একে সকলকে ফোনে ডাকে। শুকলালের কথা জানায়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সকলে ট্যাঁরার দোকানে আসে। এক সঙ্গে শলাপরামর্শ করে, টাকাপয়সা যে যেমন পারে দিয়ে শুকলালকে দাহ করে বিকালের মধ্যে ঘরে ফেরে। সন্ধ্যায় আবার ট্যাঁরা দাসের দোকানে জড়ো হয় সবাই। ট্যাঁরাই প্রসঙ্গ তোলে -" আমি ভাবছি বৌদির হাতে কিছু টাকা দেওয়া দরকার। লালু তো কিছু রেখে যেতে পারেনি। না হলে বৌদির কষ্ট হবে!"
সকলে একবাক্যে সায় দেয়। তারপর তাদের বন্ধুর দেখানো পথেই বন্ধুকে তর্পণ করে। টঙের পিছনে গিয়ে একটা গর্ত করে সেটা লালুর প্রতিরূপ হিসাবে ধরে সেখানে সকলে মদ দিয়েই তর্পণ করে। 'সাত সমুদ্র' দলের সদস্য নরেশ যখন এক রাতে নেশা শেষে বাড়ি ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন শুকলালই বলে "প্রিয় বন্ধুর জন্য আমরা এমন একটা কিছু করি যাতে ওর আত্মা শান্তি পায়। "
সঙ্গীরা উৎসুকভাবে তাকায় তার দিকে।
" আমরা তো মদের জন্য এত কাছের। আর সবাই মদ্যপ্রিয়,তাই ভাবছি আজ আমরা সকলে মদ নেব,কিন্তু খাব না। বরং সেই মদ নরেশকে উৎসর্গ করব। তাতে তার আত্মা শান্তি পাবে বলে আমার মনে হয়।"
সকলে বন্ধুর জন্য এমন প্রস্তাবে উৎসাহিত হয় এবং নরেশকে সেভাবেই তর্পণ করে। আজও সকলে লালুর দেখানো পথে লালুকে উৎসর্গ করে।
ঝড়ের বেগে একজন মহিলা আসে ট্যাঁরা দাসের দোকানে। ট্যাঁরা তখন তার চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। চোখ বন্ধ। টঙে বন্ধু চারজনও নিশ্চুপ । কিন্তু নিরবতা ভাঙে মহিলার কণ্ঠে," এই তুর জন্যি, তুর জন্যি লালু আজ মরে গিল। তুদের আড্ডাখানাই উর পরান কাড়ে নিল। হামি এখোন কি খাব বলতি পারিস? একটা টাকা দিয়ে গেল না--- একটা বাচ্চা দিয়ে গেল না !"
--- এটুকুই অভিযোগ। এর বেশি কিছু বলতে পারল না। কথা কটা বলে চলে গেল। কোনো উত্তর না নিয়েই। ট্যাঁরা পাথরের মূর্তি --- টঙের দরজায় চারজনও। এরা জানে লালুর সংসারের কথা। আর্থিকাবস্থার কথা। শিমুরালির পাইকারি বাজার থেকে মাছ কিনে এনে সাইকেলে করে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করত। তাতে এমন কিছু হতো না। সংসার চলে যেত একরকম। এখন সেই সংসার চালাতে হলে বৌদিকেই গতরপাত করতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে লালু বিয়ের পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অপরাধ— জাতের বাইরে গিয়ে আদিবাসী মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করা। ফলে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া।
দ্রুতগতিতে ফায়েক আসে। হাতে প্লাস্টিকের সাদা ক্যারি প্যাকেটে ডালের বড়া ও কাঁচা লঙ্কা। তখনও সকলে অকস্মাৎ আঘাতে জড়গ্রস্ত কিংবা মনে মনে ক্ষতিগ্রস্ত। বাইরে গিয়ে ফায়েকের মনটা তুলনামূলক স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু বন্ধুদের দিকে তাকাতেই আবার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ট্যাঁরাই বলে," যা ফায়েক, তুই-ই দিয়ে আয় লালুকে।"
ফায়েক আর কাউকে কিছু বলে না, ধীরে ধীরে টঙের পিছনে যায়। তাদের খোড়া গর্তের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে অবাক হয়। দেখে গর্ত একটা নয়, পর পর ছয়টা এবং তাতে একটা অবয়ব তার ছয় হাত দিয়ে ছয় গর্তে সোনার গ্লাস থেকে মদ ঢালছে। ফায়েক ভয়ে ভয়ে অবয়বটির মুখের দিকে তাকায়--- এ যে লালু! ফায়েকের হাত থেকে ডালের বড়ার ঠোঙা খসে পড়ে! এক দৌড়ে সে বন্ধুদের দিকে এগোয়।