পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সুরক্ষা কবচ! –একটি প্রশ্নমালা

  • 11 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1140 view(s)
  • লিখেছেন : সংবিদা লাহিড়ী
কলেজ ভর্তি বা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের আগে সেই প্রতিষ্ঠানে বিগত কয়েকবছরের ইতিহাসে হয়রানির মাত্রাটি কতখানি, তা জিজ্ঞেস করার সাহস বা অধিকার থাকবে না যোগদানকারীর? শুধু মেয়েদের বা ছেলেদের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান কি কথা দিতে পারে তার অধিকৃত পরিসরের মধ্যে কোনও মহিলাকে সে হেনস্থার শিকার হতে দেবে না? এক মহিলা কি কর্মক্ষেত্রের অধস্তন মহিলা কর্মচারীকে উত্যক্ত করেন না! বা উল্টোটা কি ঘটে না শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে?

প্রতিষ্ঠান ও সুরক্ষা এই দুটি শব্দের যোগ পারস্পরিক। একটি থাকলে অন্যটি থাকার আশ্বাসটুকু যে থাকবেই, এ কথা একুশ শতকে দাঁড়িয়ে হলফ করা যায়। বিশেষত, প্রতিষ্ঠান যখন সুরক্ষা প্রদানের কথা বলে, তখন সে তার সুরক্ষা কবচের মানদণ্ড স্থির করে ‘মহিলা সুরক্ষা’ কতখানি প্রদত্ত, তার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই যে গোড়ায় গলদ রয়েছে, সে কথা স্বীকার করবে কে? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা কি এতই সহজ?

আসলে সমস্যাটি আমাদের মধ্যেই নিহিত আছে। এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে একখানি পেজ বাগিয়ে যতই চেঁচামেচি করি না কেন, আমরা কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের নাম জুড়বার সময় কখনওই কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করি না এই প্রতিষ্ঠানে এখনও অব্দি কয়জন মহিলা হেনস্থার শিকার হয়েছেন? কতজন সেই অপমানের প্রতিকার পেয়েছেন? কতজন পাননি? শুধু মহিলারাই হেনস্থার শিকার হন, একথাও ঠিক নয়। দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ে সমকামী মানুষেরা, বা শারীরিক সক্ষমতা কম এমন মানুষ, বা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ অথবা তুলনায় একটু কম বলিষ্ঠ পুরুষও হয়রানির আগ্রাসন থেকে বাদ পড়েন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। নানা ভাবে হয়রানি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আবার কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা জোর গলায় সবটা জানানোর সাহস রাখেন। চেঁচামেচি করেন। উপযুক্ত কথা শুনিয়ে ছাড়েন।

কিন্তু বেশরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, (ভারতের কথা বলছি) যৌন হয়রানির ঘটনায় চার ধরনের প্রতিফলন ঘটে,

  • চুপ করে থাকা বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তাতে মানসিক অবসাদের শিকার হওয়া। সেই অবসাদ থেকে নানা শারীরিক জটিলতা তৈরি হওয়ার ঘটনা।
  • চিৎকার করে জানানো। বাস্তবে তা সম্ভব না হলেও সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে গিয়ে লেখা।
  • তার প্রত্যুত্তরে নানা মত উঠে আসা এবং সেই নিয়ে চর্চা
  • আইনি পদক্ষেপ যা মূলত দীর্ঘ মেয়াদী এবং আইনের চক্রে মূল অভিযোগের ক্রম-অপসারণ।

কিন্তু আমার প্রশ্ন কোনও কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে, হস্টেল আছে কি না, ভর্তির ফি কত – ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন আমাদের মাথায় এলেও কেন ভাবি না এই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আদৌ আমি হয়রানির শিকার হবো কি না তা জানতে চাওয়া! জানতে চাওয়া এই তথ্য জানার অধিকার আমার আছে কি না, যে ওই প্রতিষ্ঠানে বিগত কয়েকবছরের ইতিহাসে যৌন হয়রানির ঘটনা কয়টি এবং তার প্রতিকারে কী কী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে?

কর্মক্ষেত্রে বিষয়টি জিজ্ঞেস করা আরও কঠিন। কারণ ইদানীং বাজারে চাকরি নিয়ে মানুষের বিস্তর হয়রানি বেড়েছে। একে চাকরি নেই, তায় হাতছাড়া হলে করণীয় কী?

সুতরাং এটা কি বলা যায়, কলেজ ভর্তি বা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের আগে সেই প্রতিষ্ঠানে বিগত কয়েকবছরের ইতিহাসে হয়রানির মাত্রাটি কতখানি, তা জিজ্ঞেস করার সাহস বা অধিকার থাকবে না যোগদানকারীর?

কয়েকটি ভীষণ ‘স্তিমিত’ হয়রানির উল্লেখ করা যাক।

আচ্ছা, ধরা যাক, কোনও মহিলা অফিসের ভেতরে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হয়ত তার প্রতি হেনস্থাকারী পুরুষটির আচরণ ‘তেমন কিছুই নয়’। মোবাইলে অকারণ গায়ে পড়া গোছের টেক্সট আসছে। বা লিফটে নামা ওঠার সময় ভিড় থাকলে গা ঘেঁসে দাঁড়ানোর চেষ্টা। অথবা, ফাঁকা অফিসে তার ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী বারবার শুনতে চাওয়া। বিয়ে হলে বাচ্চা হচ্ছে না কেন, সেই নিয়ে বড় দাদা হিসেবে নানা যৌন ইঙ্গিতবাহী পরামর্শ। বাচ্চা নিতে রাজী নয় (এখুনি বা কখনওই) শুনলে ‘এনজয়’ শব্দটির ওপর বারবার জোরারোপ করা। বিয়ে না করে থাকলে বিয়ে কবে করবে, করবে কিনা, প্রেম আছে না নেই। প্রেম বেশিদিন করা ভালো না নয়। প্রেমে শরীর আছে না নেই--- ইত্যাদি ইত্যাদি।

অফিসে কর্মরত মহিলারা আরও অনেক ধরনের হয়রানির শিকার হন। যেমন ধরা যাক, ঊর্ধতন পুরুষ পরিচালক খুবই মরমী। কিন্তু তিনি মহিলাদের শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে একেবারেই অবহিত নন। হওয়া প্রয়োজন বলে মনেও করেন না। মহিলা কাজ করার সময় পিরিয়ডের জন্যে পেটে ব্যথা বললে, লজ্জা পান। তক্ষুণি ছুটি দিয়ে দেন। এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরবর্তী বেশ কিছুদিন মহিলাটিকে কোনও উচ্চপ্রত্যাশা আছে এমন সমস্ত কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করে চলেন। ‘শরীর খারাপ’ রেস্ট নাও –বলে এমন করেন যে পরের মাস থেকে মহিলা নিজের ওইটুকু অসুবিধের কথাও আর জানাতে সাহস করেন না।

ছাত্রছাত্রীদের পরিসরে সাধারণভাবে প্রেমে পড়া, উত্তর না পেয়ে ধাওয়া করা, বিরক্ত করা, সুইসাইড করে ফেলার হুমকি-সহ একশো পঁচিশ কি তারও বেশি রকমের হয়রানির কথা তো আমরা শুনতে পাই। নিজেরাও কখনও না কখনও হয়তো গিয়েছি এই ধরনের ঝামেলার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু, ছুঁচো গিলে ফেলার কেস হয়ে যায় যখন দেখা যায় মাস্টার মশাইয়ের ছাত্রীদের প্রেমে পড়ার বাতিক ক্রমবর্ধমান।

এই ধরনের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায় এই নিয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের হয় না। কারণ নিত্য হয়রান হয়ে বেঁচে থাকার অভ্যেস প্রাণীজগতের আছে। আমরা তার বাইরে নই। তাহলে আমরা কোথাও কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে ফেলার আগে কেন যাচাই করে নিতে পারব না, যে সেই প্রতিষ্ঠানে সুরক্ষা কবচটির চেহারা কীরকম? আদৌ এরকম কোনও কবচ বাস্তবে ওই প্রতিষ্ঠানে আছে কি না! আমরা কেন প্রশ্ন তুলতে পারি না, ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিগত এক বছরে কর্মী বা পাঠরত মানুষদের লিঙ্গ- বৈষম্য সম্পর্কে অবহিত করতে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে যে শুধু মেয়েদের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান হলে বা ছেলেদের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে সেখানেও কি এই ধরনের প্রশ্ন করা যাবে?

এর উত্তর একটাই, শুধু মেয়েদের বা ছেলেদের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠান কি কথা দিতে পারে তার অধিকৃত পরিসরের মধ্যে কোনও মহিলাকে সে হেনস্থার শিকার হতে দেবে না? এক মহিলা কি কর্মক্ষেত্রের অধস্তন মহিলা কর্মচারীকে উত্যক্ত করেন না! বা উল্টোটা কি ঘটে না শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে?

এই সব সংরক্ষিত প্রতিষ্ঠানে যদি কোনও সমকামী বা রূপান্তরকামী মানুষ ঢুকে পড়েন, তাহলে তাঁকে কি সবসময় নিজের কর্ম ক্ষমতার চেয়েও বেশি সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে বিড়ম্বিত হতে হয় না? মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্রতিষ্ঠান সহজে সমকামী মেয়েকে কি গ্রহণ করতে পারে? বা একই ঘটনায় কি প্রভাব পড়ে শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠানে?

এই লেখায় পাঠকদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রইল মাত্র। উত্তর জানা নেই।

0 Comments

Post Comment