ভরদুপুরে বউমার মুখে তপ্ত বাক্যবাণে রাধারাণী আর রা কাড়ে না। বিড়বিড় করতে করতে এক মুঠো ভাত মুখে তোলে। রোজ রোজ লতাপাতা, শাক আর কচু ঘেচুর তরকারি। অরুচি লাগে। ভাত খেতে মন চায় না। এক গ্রাস ভাতের সঙ্গে বেশ কিছুটা জল খায় ঢক ঢক করে। ভাত গলা দিয়ে নামতে চায় না। ভাত পেটের ভেতর গেলেও পেট ভরে না। অতৃপ্তি রয়ে যায়। রাতে ঘুম আসে না। খিদের জ্বালা যেন রয়েই যায়।
বেশ কিছুদিন হলো পদ্মার ইলিশ মাছ খেতে মন চাইছে রাধারাণীর। মনে মনে ভাবে—আহা, যদি এক টুকরো সরষে-ইলিশ ভাতের থালার এক কোণে রাখতে পারতাম তাহলে সেই সুবাসেই পুরো থালা ভাত খেয়ে ফেলতাম। একাত্তরের ভয়ংকর টালমাটালের সময় অসুস্থ স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরের ভিটেমাটি ছেড়ে এক কাপড়ে নৌকা করে রাতের অন্ধকারে এ-বঙ্গে চলে এসেছিল রাধারাণী। প্রাণ হাতে এপারে এসে নদিয়ার বীরনগর কলোনিতে এক চিলতে ঘরে ঠাঁই। এপারে এসে থিতু হতে না হতেই ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয় স্বামী। অভাবের সংসারে অসুস্থ স্বামী ও ছোট্ট ছেলে ভুবনকে নিয়ে পরের বাড়িতে বাসন মাজা, উঠোন পরিষ্কার করার কাজ করে কোনও রকমে দিনগুজরানো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মারণ রোগের ছোবলে স্বামীকে হারায় রাধারাণী। তারপর ছোট্ট ভুবনকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের ময়দানে লড়াই আর লড়াই। দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রমে রাধারাণীর শরীর ভেঙে যায়। সময়ের ভেলায় ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরে। ভুবন মাকে আর পরের বাড়িতে কাজ করতে দেয় না। বয়সের ভারে এখন রাধারাণীর শরীর ন্যুব্জ। হাতে পায়ে বাতের ব্যথা। উঠতে বসতে খুব কষ্ট।
ছেলের সংসারে রাধারাণী বোঝা হয়ে আছে। এটা সে খুব ভালো ভাবেই বোঝে। তাই কখনও কোনও কিছু খেতে মন চাইলে আজকাল আর বলতে মন চায় না। এমন তো না যে ছেলে তার তালেবর। বিরাট তালুক আছে। নাতনি উর্মি সেয়ানা হয়ে উঠেছে। মাধ্যমিক পাশ করে অভাবের সংসারে পড়াশোনায় ইতি টানে। নুন আনতে পান্তা শুকোয় সংসারে চার জনের মুখের আহার জোটাতেই ভুবন হিমসিম খায়। তাই মা কোনও আবদার করে না।
অনেক রাতে পাতলা ঘুম ভেঙে গেলে খুব মনে পড়ে দেশের কথা। বাড়ির কথা। মাটির কথা। স্বামী শ্রীদামের কথা। পদ্মায় মাছ ধরতে যেত মানুষটা। নৌকা সাজিয়ে নিয়ে রহিমের সঙ্গে বের হয়ে যেত। খাবারও নিয়ে যেত। সাত দিন পর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নৌকা নিয়ে এসে হাজির হতো পাড়ে। বাড়িতে এসেই হাঁক দিত শ্রীদাম— কইরে ভুবন জলদি আয়, দেইখা যা।
ভুবন তখন ঘুমে কাদা। এতো সকালে তার ঘুম ভাঙে না। তবু বাপের হাঁকডাক আর মায়ের চিৎকারে সে উঠে পড়তো। বাপে নাও ভর্তি করে ইলিশ মাছ ধরে নিয়ে এসেছে। কত মাছ। সকালের নরম রোদে চকচক করছে। রুপলি ছটা ঠিকরে পড়ছে। বড় বড় দু'তিনটে মাছ রেখে বাকি মাছ নিয়ে তারা চলে যেত পূবনগর হাটে। সে দিন মাছ বিক্রি করে ঝাপি ভর্তি বাজার করে বাড়িতে ফিরতো শ্রীদাম বর্মন। রাধারাণীর খুশির দিন। বাড়ির পেছনের বাগান থেকে কচুর ডগা কেটে আনত। ইলিশের মাথা নিয়ে রান্না করার জন্য। মাছের কয়েক পদ রান্না করতো। সব চেয়ে ভালো লাগতো ইলিশ ভাজা। কড়াইয়ে গরম তেলে ইলিশ ছেড়ে দিলে যে ঘ্রাণ বের হতো সেই ঘ্রাণ পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ত। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে সেই মাছ ভাজার তেল লঙ্কা, লবন দিয়ে মেখে মুখে দিলে মনে হতো অমৃত। ভুবন উনোনের পাশ থেকে সরতেই চাইতো না। আধা ভাজা মাছ তুলে না দিলে সেই কান্না জুড়ে দিত। রাধারাণী বলতো— একটু তো সবুর কর বাপ। ভাজতেও তো সময় দেওন লাগে। ভুবন কোনও অপেক্ষাই করতে চাইতো না।
পাড়া প্রতিবেশীর মুখে রাধারাণী শুনছে, এ-বছর বাংলাদেশে খুব গণ্ডগোল। রাজপথে তীব্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে। সংঘর্ষে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে এসেছে। রাধারাণীর নিকট আত্মীয়পরিজন আজও ওপার বাংলায়। তাদের জন্য রাধারাণীর মন খুব উতলা। বাংলাদেশে এখন তদারকি সরকার। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় টিভির পর্দায় রাধারাণী দেখতে পায়, দুর্গাপুজোর আগেই এপার বাংলায় টন টন ইলিশ মাছ আসছে পদ্মার ওপার থেকে। এক নিমেষে স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে দেশের টুকরো টুকরো স্মৃতির কুচি। সারা বাড়ি মো মো করছে ইলিশ মাছের গন্ধে। মনটা উদাস হয়ে পড়ে। চোখের কোণ চিকচিক করে উঠে। পাশে বসে উর্মি বটিতে আনাজ কাটছিল।
— কী হলো ঠাম্মা, ও ঠাম্মা, তুমি কাঁদছ কেন?
—নারে বোন, কাঁদছি না, এমনি।
কাপড়ের খুট দিয়ে চোখ মোছে রাধারাণী। উর্মি কিছু বুঝতে না পেরে আবার আনাজ কাটায় মন দেয়।
রাধারাণী কত বছর পদ্মার ইলিশ খায়নি। অনেক নাকি দাম। ছেলের বউকে বলতে সাহস পায় না। যদি আবার বেজার হয়। তাকে দু'মুঠো খেতে দিচ্ছে এটাই বা কম কিসের। তারপর আবার ইলিশ মাছ। তবে সাহস করে একবার ছেলেকে বলে দেখা যেতে পারে। মায়ের এই সামান্য আবদার কি সে রাখবে না। একবার বলবে ছেলেকে, কত দিন পদ্মার ইলিশ খাইনা। পরানডা কান্দে। বলেই দেখবে। ছেলে যদি কোনও উপায় করে।
ভুবন টোটো চালায়। মাইক্রোফাইনান্স ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে টোটো কিনেছে। সপ্তাহান্তে আসলের সঙ্গে সুদের চাপান পরিশোধ করতেই হাঁপিয়ে ওঠে। মাইক্রো ফাইনান্স, এ এক আজব যাঁতাকল। এদিকে আকালের বাজারে টোটোর ছড়াছড়ি। তেমন রুজি রোজগার নেই। ভুবনের মতো টোটো চালকরা কোনও রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে।
দুয়ারে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। দুর্গোৎসব। এসময় রোজকারপাতি একটু ভালোই হয়। রাতে ছেলে খুব হাসি হাসি মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরলো। দেখে রাধারাণীর মনটাও ভালো হয়ে গেল। মনে করলো এক বার বলেই দেখি না।
— একটু ভালো মন্দ খাইতে মন চায় রে বাপ। কয় দিনই আর বাঁচুম।
ভুবন খুব আগ্রহ নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। অনেক দিন কোনও আবদার করে না মা। হঠাৎ করে মায়ের কথা শুনে তার মন প্রাণ আকুল হয়ে উঠলো।
— কী খাইতে মন চায় মা। কও আমারে। আমি কালই কিনা আনমু।
—মনডা খুব পদ্মার ইলশা মাছ খাইতে চায়। একটু মাছ অইলেই অইবো। আমি বাসনা দিয়াই ভাত খাইতে পারুম। টিভিতে দেখলাম, প্রচুর পদ্মার ইলশা মাছ আসছে।
— ঠিক আছে মা। আমি দেখুম অনে। কাইল এক বার বাজারে খোঁজ নিমু। তুমি অহন খাইয়া ঘুমাও।
পরের দিন খুব ভোরে ভুবন টোটো নিয়ে বের হয়ে যায়। আজ কপাল ভালো। তাড়াতাড়ি বেশ ভালো কয়েকটা খ্যাপও পেয়ে গেল। পকেট হাতড়ে গুণে দেখে চারশো দশ টাকা। মনটা খুশি খুশি। ভুবন মনে মনে বললো, "অহন আর টোটো চালাব না। বাজারে যাই। দেখি বাংলার ইলিশ পাই কিনা।"
অনেক দিন পর বাজারে ভুবন ইলিশ মাছ কিনতে এসেছে। ঠিক খেয়াল নেই কত বছর পর। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। প্যাচপেচে কাদা। থিকথিকে ভিড়। হইচই। ব্যস্ততা। কানে ভেসে আসছে, এই যে বাংলার ইলিশ, টাটকা, আজকেই এসেছে। জ্যাবজেবে ভিড়ের ফাঁক গলে মাছ বিক্রেতাদের সামনে ভুবন দাঁড়াল। বেশ কয়েক জন বিক্রেতার কাছে বড় ও মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছ। সুন্দর করে সাজানো। উপরে ডুমো বাল্ব ঝুলছে। তার সামনেই এক জন এসে আস্ত একটা ইলিশ কিনে নিয়ে চলে গেল। লোকটা কোনও দরদামও করলো না। মনে হল টাকা যেন তার কাছে খোলামকুচি।
— কাকা, ইলিশের ভাগা দাও না ? একটা ভাগা কিনতে চাই।
— না রে ভাইপো। অহন আর ইলিশের ভাগা চলে না। সবাই আস্ত মাছই কিনতে চায়। কেউ আর ভাগা কিনে না। আমাদেরও খাটুনি কম হয়। তোমার লাগবোনি মাছ একখান?
— এই মাছখানের দাম কত?
লেজ ধরে উঁচু করে তুলে মাছ বিক্রতা বলে,
—এক কেজির বেশি হবে। দুই হাজার এর নীচে দেওন যাইবো না।
দু'হাজার। দাম শুনে ভুবন থ! ইলিশ মাছ খাওয়া তাদের জন্য না। ফিরে চললো বাড়ির দিকে। রাস্তায় এক সময় ভুবন আনমনা হয়ে যায়। মনে পড়ে বাবার সঙ্গে সেও কয়েক বার নৌকায় গিয়েছে পদ্মায়। প্রচন্ড ভয় করতো তার। উত্তাল ঢেউ-এ নৌকার মাঝ খানে শক্ত হয়ে বসে সে বাবা আর রহিম চাচার মাছ ধরার কৌশল দেখতো। ইলিশ উঠলেই সে আনন্দে চিৎকার করে উঠত।
বাড়িতে মাছ আনার পর বড় আঁশবটি দিয়ে মা মাছ কাটতো। সে মায়ের সামনে বসে থাকতো। সব চেয়ে মজা লাগতো রান্নার সময়। যখন মা গরম কড়াইয়ে মাছ ছেড়ে দিত তখন ঝাৎ করে একটা শব্দ হতো। সেই শব্দটা তার কানে বাজে এখনও। কড়াইয়ের তেলে মাছ দেওয়ার একটু পড়েই ঘ্রাণ বের হতে শুরু করতো। সেই ঘ্রাণকে যেন সে আজও টের পাচ্ছে।
হঠাৎ করেই ভুবনের আগের জীবনে ফিরে যেতে খুব ইচ্ছে করল। সেই ছোটবেলা। সকালে ঘুমের ঘোরে থাকবে। ঘুম ভাঙবে বাবার ডাকে।
— ভুবন বাবা, কইরে, আয় দেখ আজ কত বড় ইলিশ ধরছি।