বেসরকারি অফিসে সামান্য বেতনের কাজ করত বিনোদ । এক ছেলে । চাকরিসুত্রে ভিন রাজ্যের বাসিন্দা । বউ- বাচ্চাও ওখানে থাকে । ছুটিছাটায় আসে ।
বহু কষ্টে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে এই বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটা বানিয়েছিল । বাড়ির সামনের উঠোনে একটাও ঘাস জমতে দেয় না । এই পঁচাত্তর বছর বয়সে নিজে হাতে বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল সাফ করে । নার্সারি থেকে বাহারি ফুলের চারা নিয়ে আসে । উঠোন জুড়ে গোলাপ, জারবেরা, পিটুনিয়া, ডায়ান্থাস, কসমস, ডেইজি । অনেক ফুলের নাম তো বিনোদ উচ্চারণই করতে পারে না । বাড়ির পিছনে বেশ কিছু ফলের গাছ । পাড়ার সবাই তার সাজানো বাড়ির প্রশংসা করে । গর্বে বুক ফুলে ওঠে বিনোদের । কিন্তু যবে থেকে বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে এই টোটোটা দাঁড় করানো শুরু হয়েছে তবে থেকে বিনোদের মাথা গরম হয়ে আছে । রাগটা যে শুধু টোটোর মালিক শান্তনুর উপর তা নয় । রাগ নিজের স্ত্রী সীমার উপরেও ।
প্রথমদিন টোটোটা রাখার সময় শান্তনু অনুমতি নিতে এসেছিল । খুব বিনীতভাবে বলেছিল , “মাসিমা, আপনাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় টোটোটা রেখে গেলাম । অসুবিধা হবে না তো ?”
সেইদিনই যদি সীমা বলে দিত, এখানে কেন ? তোমাদের বাড়ির সামনে তো ফাঁকা জায়গা আছে । ওখানে রাখো। তাহলেই সমস্যা মিটে যেত । তা নয় একমুখ হাসি নিয়ে বলে বসল ,” না না অসুবিধার কী আছে । তুমি তো আবার বিকেলেই নিয়ে যাবে ।“
সেই শুরু । তারপর থেকে রোজ দুপুরে গাড়িটা এখানেই রেখে যায় । আর ওই টোটোটার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে বিনোদের দুপুরের ঘুমটা মাটি হয় । এত সুন্দর বাড়ির সামনে কি না অমন একটা রং চটা সস্তার গাড়ি। বিনোদের কত দিনের শখ বাড়ির সামনেটায় গাড়ি বারান্দা করবে । সেখানে থাকবে একটা টুকটুকে লাল রঙের ফোর হুইলার । মাঝে মাঝেই উঠোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিনোদ । তার এখন যা ক্ষমতা তাতে তো নিজের টাকায় গাড়ি কেনা অসম্ভব । যদি কেনে ছেলে কিনবে । কিন্তু সে কি তার গাড়ি এখানে রাখবে ?
“ তুমি আবার বিছানায় না শুয়ে এখানে বসে আছো?”
সীমার কথায় বিনোদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ।
“ কতদিন বলেছি দুপুরে খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নাও । তা নয় , এখানে বসে ওই টোটোটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে ।“
“দীর্ঘশ্বাস ফেলব কেন ? আমি তো চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছি ।“ বিনোদ উত্তর দিল ।
“দেখো , তোমাকে আমি পঞ্চাশ – বাহান্ন বছর ধরে চিনি । তুমি মুখে না বললেও আমি সব বুঝতে পারি । “
“বুঝতেই যখন পারো তখন ওই টোটোটা এখানে রাখতে দিলে কেন ?” বিরক্তিতে চেঁচিয়ে উঠল বিনোদ ।
“তোমার মত নিজের মন মর্জিতে চললে এ সংসার কবেই লাটে উঠে যেত বুঝলে ?” বিনোদকে রেগে যেতে দেখে সীমাও সুর চড়ালো । “আমাকে অনেক ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হয় । নিজের ছেলে থাকে অন্য রাজ্যে । আমাদের বুড়োবুড়ির রাতবেরাতে কিছু হলে , পাড়ার ছেলেগুলোকেই তো ডাকতে হবে । “
সীমাকে সুর চড়াতে দেখে বিনোদ একটু চুপসে গেল । মিনমিন করে বলল , “কতদিনের ইচ্ছে বাড়ির সামনে একটা লাল টুক্টুকে ফাইভ সিটের কার থাকবে। “
স্বামীকে মিনমিন করতে দেখে সীমার মায়া হল । পাশে বসে শান্ত স্বরে বলল , “তোমার সাধ্যমত তুমি করেছ । ভগবান যতটুকু দিয়েছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকো। এখন ঠাকুরের কাছে একটাই প্রার্থনা কর , আমরা যেন সুস্থ থাকি । নিজেদের সমস্যা নিজেরাই যেন সামলে নিতে পারি । কারও কাছে যেন হাত পাততে না হয় । “
এমন সময় বাইরে থেকে আওয়াজ এলো , “ মাসিমা ও মাসিমা …”
সীমা আর বিনোদ দুজনে দুজনের মুখ চাওয়া চাইয়ি করল । সীমা এখন তাড়াহুড়ো করে বসা থেকে উঠতে পারে না । কোমরে ব্যাথা । বসেই একটু উচ্চস্বরে বলল “ আসছি …”
বাইরে বেরিয়ে দেখল , শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে ।
শান্তনুদের বাড়ি সীমাদের বাড়ির পিছন দিকে । গ্রামের একদম শেষ সীমানায় । ছেলেটা গ্র্যাজুয়েট । একসময় সীমা নিজের ছেলের বই-খাতা দিয়ে ওকে সাহায্য করেছে । শান্তনুর বাবা অন্যের জমিতে চাষবাস করত । ওরা তিন ভাই । শান্তনু ছোট । বাবা মারা গেছে । অন্য ভাই দুটো ট্রলি চালায় । শান্তনু পড়াশোনা শিখে ট্রলি চালাতে চাইত না । এখন টোটো চালায়।
“কী রে আজ এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিস ? কোনও রিজার্ভ ভাড়া আছ?” সীমা জিজ্ঞাসা করল ।
শান্তনু মনে মনে নিজেকে গোছাচ্ছিল । কীভাবে কথাটা বলা যায় । বুড়োবুড়ি একা থাকে । বুড়োটা খেঁচাটে হলেও বুড়িটার বুদ্ধি আছে । ওরা ভালো করেই জানে , টুকটাক অসুবিধায় আমাদের কাছেই হাত পাততে হবে । এই সুযোগটাকে আমরাই বা কাজে লাগাব না কেন ? সামনে বর্ষা আসছে । গাড়িটা রাস্তায় না রেখে , এই উঠোনের শেডের নীচে রাখতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। রাতেও এখানে থাকবে । এদের তো সুন্দর রেলিং দিয়ে ঘেরা উঠোন আছে। চুরি যাওয়ার ভয় নেই ।
সীমার কথায় , শান্তনু একেবারে গলে গিয়ে বলল , “না মাসীমা ,ভাড়া নেই । আসলে রোজ গাড়িটা নিয়ে চলে যাই । আজ ভাবলাম আপনাদের খোঁজ নিই।“
“তা বেশ করেছিস । আয় , ভেতরে আয় ।“
শান্তনু মনে মনে ভাবল , ঘরে বুড়োটা আছে । মহা ধুরন্ধর । সবসময় বাঁকা চোখে তার দিকে তাকায় । তাড়াতাড়ি বলল ,” উঠোনেই বসি । কী সুন্দর ফুল গাছ এখানে । ভালো হাওয়াও দিচ্ছে ।“
সীমাও ভাবনার আকাশে চিন্তারা আঁকিবুঁকি কাটছে । হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা করছে শান্তনুর অভিসন্ধি ।
উঠোনের শেডের নীচে সিমেন্টের বেঞ্চে শান্তনুর পাশে বসল সীমা । ঘরের ভেতর থেকে বিনোদ কানখাঁড়া করে আছে ।
“শুভদা কবে আসবে মাসীমা ? অনেকদিন আসেনি ।“ শান্তনু জিজ্ঞেস করল ।
সীমা আমতা আমতা করে বলল , “পরের মাসেই আসার কথা ।“
আজকাল সীমাকে এমন দুচারটা মিথ্যে কথা বলতে হয় । কী করবে ? সত্যি কথা বললেই সবাই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে । পাড়ার অনেকেই তাদের খোঁজ নিতে আসার ভান করে গাছের আম , নারকেল ,কাঁঠাল, এমনকি উঠোনের এক কোণে লাগানো ঢেঁড়স , বেগুন অবধি নিয়ে যায় । যাওয়ার সময় সবার মুখেই এক আশ্বাস বাণী- “কোনও অসুবিধা হলেই আমাদের ডাকবেন ।“ মাঝে মাঝে নিজেদের বড় অসহায় মনে হয় সীমার । মনে হয় ছেলেকে এত পড়াশোনা না করালেই হত । হয়ত শান্তনুর মত টোটো চালাত , তবু কাছে তো থাকত ।
শান্তুনু বুঝতে পারে সীমা মিথ্যে কথা বলছে । রুক্ষ্ম খসখসে গাল চুলকোতে চুলকোতে বাঁকা হেসে বলল, “গতমাসে বললেন যে এ মাসে আসবে । ছুটি পাইনি বোধহয়?”
সীমা একটু তুতলে বলল, “না মানে … “
“আমার ছেলে কবে আসবে , না আসবে তাতে তোমার কী দরকার বাপু ?” পেছন থেকে বিনোদের রাশভারী কণ্ঠস্বরে শান্তনু চমকে উঠল ।
“ না মানে আমি…”
“হ্যাঁ , তুমি যা বলতে এসেছ চটপট বলো । আচ্ছা তুমি বলার আগে আমি একটা কথা বলি ,এই যে তুমি রোজ আমার বাড়ির সামনে টোটোটা রেখে যাও, এরপর থেকে আর রাখবে না । আমাদের অসুবিধা হয় ।“
“যা শালা , রাস্তার একপাশে গাড়ি রাখলে আপনার কী অসুবিধা হয় ?” এতক্ষণে শান্তনুর বিনয়ী মুখোশ খসে পড়েছে ।
“আমার স্কুটার ঘোরাতে অসুবিধা হয় । তাছাড়া আজ তুমি রাখছ , কাল তোমার দেখাদেখি আর সবাই রাখবে । এই করে তোমরা একদিন এই জায়গায় টোটো স্ট্যান্ড বানিয়ে ফেলবে ।“
“না না আমি তো শুধু দুপুরবেলা …”
“ আজ দুপুরবেলা রাখছো , কাল রাত্তিরবেলা রাখবে ।“
এ শালা বুড়োটা কী মন পড়তে জানে নাকি ? মনে মনে ভাবল শান্তনু ।
“শোনো বাবা , আমরা অসহায় দুই বুড়োবুড়ি থাকি বলে তোমরা যে যেমন পারবে তার সুযোগ নেবে ,এটা তো হতে পারে না ।“ বিনোদ রাগত স্বরে বলল ।
সীমা পাশ থেকে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ,”আরে , কী যা তা বলছ ? শান্তনু, তুমি বাবা কিছু মনে কোরো না । তোমার মেসোমশাইয়ের বয়স হয়েছে তো, বুঝতেই পারছ, মাথার ঠিক নেই। “ বলেই বিনোদকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। উত্তেজনায় বিনোদ তখনও থরথর করে কাঁপছে ।
বিনোদকে ঘরে ঢুকিয়ে সীমা দরজা টেনে দিল ।
শান্তনু সাপের মত বিষাক্ত চোখে বিনোদের ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে । মনে মনে বলছে , শালা বুড়ো , এতখানি বয়স হল এখনো তেজ কমেনি । ভেবেছি যখন এদের শেডের তলায় টোটো রাখব,তখন রাখবই। শুধু আমার টোটো নয়, দাদাদের ট্রলি দুটোও রাখব । আমাদের বাড়ির সামনে এখন যেখানে ট্রলি দুটো থাকে সেখানে একটা ঘর তুলতে হবে। দুদিন বাদে বিয়ে করলে বউ নিয়ে থাকব কোথায় ? এদের শালা এত বড় বাড়ি অথচ থাকার লোক নাই । গরীব বলে আমরা শুধু আসতে যেতে দেখে যাব ,আর মিষ্টি হেসে , ভাল আছেন মেসোমশাই? ভালো আছেন মাসীমা.. বলব এটা তো হতে পারে না । না বাবা , সে জমানা আর নেই । কথাতেই আছে জোর যার মুলুক তার ।
বিনোদকে ঘরে বসিয়ে রেখে সীমা রাগে গজগজ করতে থাকে । মনে মনে বলে , কোনো মানে হয় ,এই বয়সে এমন মাথাগরম করার ! এখন কিছু হয়ে গেলে সে কাকে ডাকবে ? কোথায় যাবে ?একটু যদি বুদ্ধি লাগিয়ে কাজ করত লোকটা …
ইজিচেয়ারে বসে বিনোদ দরদর করে ঘামছে । মনের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ । না ,এখনও তার প্রাণ আছে । বেঁচে আছে সে । শরীরের রক্ত সরীসৃপের মত শীতল হয়ে যায়নি । বুকভরে শ্বাস নিয়ে বিনোদ তার সাজানো উঠোনটার দিকে তাকাল ।
সেই উঠোনে ফণা নামিয়ে গোঁজ হয়ে বসে আছে শান্তনু । সুযোগের অপেক্ষায়… পেলেই ছোবল মারবে ।