শ্যামলা রং, লম্বাটে গড়ন, গাল ভর্তি দুব্বোঘাসের মত পাতলা দাঁড়ি, ডান চোখের ভ্রুর উপর ছোটবেলায় বেকী নদীর ঘাটে পড়ে গিয়ে কেটে যাবার দাগ। বটতলার কালীমন্দির এর সামনে থেকে, কে আগে দৌড়ে গিয়ে ডিগবাজি খেয়ে জলে ঝাঁপ দিতে পারে, বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সেদিনও নদীর দিকে প্রাণপণ ছুটছিল বাহারুল। দৌড়ে সবার আগে থাকলেও, লাফ দেয়ার মুহুর্তে পা পিছলে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড। মায়ের কাছে কসম খেয়েছিল, আর কোনদিন নদীর দিকে ছুটবে না। কিন্তু সে না ছুটলে কি হবে, ফি বছর শ্রাবণ মাস পড়তে না পড়তেই নদী গায়ে গতরে ফুলেফেঁপে নিজেই ধেয়ে আসে তাদের ঘরের দিকে। গাঁ শুদ্ধু লোকের তখন কোনোমতে প্রাণটুকু হাতে নিয়ে রিলিফ ক্যাম্পে ছোটা ছাড়া গতি থাকে না। প্রতি বছর ব্রহ্মপুত্রে বন্যা আসে, আর বিঘার পর বিঘা চাষের ক্ষেত, ঘর বাড়ি, রাস্তা চিরকালের তরে তলিয়ে যায় নদীর গর্ভে। ছোটবেলায় দাদুর মুখে বাহারুল শুনেছিল, দু তিন বছরে এক আধবার বন্যা হওয়া নাকি ভাল, গৃহস্থের কদিন মুসিবত গেলেও, চাষের জমি নাকি তাতে উর্বর হয়। কিন্তু নিজে চাষের কাজে লাগার পর, শেষ কবছর বাহারুল দেখেছে, যে জমি তলিয়ে গেল সে তো একেবারেই গেল, যে জমি রইল তাতেও, বন্যার পর জল নেমে গেলে, মাঠ জুড়ে রয়ে গেছে শুধু বালি। সে মাটিতে সহজে চাষ হয় না আর। সংসারে এতগুলো পেট, এদিকে জমি ক্রমশ কমছে, যেটুকু আছে তার থেকেও চাষের আয় চূড়ান্ত অনিশ্চিত, বাধ্য হয়েই বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে কাজের জন্য শহরে ছোটে বাহারুল। সেই শুরু। বাকী জীবন কেবল ছুটে যাওয়াই কি তার নিয়তি?
২
প্রথমে সে লাগল রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজে। প্রতিদিন শহরে কোন না কোন পুরনো বাড়ী ভাঙ্গছে আর নতুন বিল্ডিং উঠছে। গতরে খাটতে পারলে, শহরে কাজের অভাব নেই। তবে চাষের কাজে সে ছিল নিজের মর্জির মালিক আর এখানে সারাক্ষণ ঠিকাদার এর সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারি। নতুন কাজে মানিয়ে নিতে তাই একটু সময় লাগে। কিন্তু সৎ, পরিশ্রমী এবং মিতব্যয়ী হওয়ার দরুণ, মাসে মাসে গ্রামের বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়েও বছর খানেকের মধ্যেই স্ত্রী-ছেলে মেয়েদের নিয়ে একটা এক-কামরার বাড়িভাড়া করার সঙ্গতি হয় বাহারুলের। জীবনটা এবার একটা ছন্দে বাঁধা যাবে ভেবেছিল বাহারুল- ঠিক যেমন নদীতে নৌকা বাইচ এর সময়, গায়েন এর কাঁসির তালে-তালে, মাঝিদের বৈঠা গুলো সব এক সুরে-এক লয়ে ওঠে-নামে আর জলে তরঙ্গ তুলে তরতর করে এগিয়ে যায় নৌকাগুলো- আল-আমিন, মায়ের দোয়া, চোখের মণি, সোনার অসম…। বাহারুল ভেবেছিল, আর বছর খানেক গেলে আস্তে আস্তে মা-ছোট ভাইকেও নিয়ে আসবে নিজের কাছে। কিন্তু আচমকা ‘হৈঁইয়া’ বলে এক হ্যাঁচকা টানে কে যেন নৌকাটা থামিয়ে দিল। পাশের শহরে একটি মেয়ের ধর্ষণে এক মিয়াঁ অভিযুক্ত হলে, এই শহরেও সব মিয়াঁরাই যেন রাতারাতি সন্দেহভাজন হয়ে ওঠে। বারে বারে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। মিয়াঁরা বাংলাদেশী- মিয়াঁরা বহিরাগত- মিয়াঁরা যেখানে, অপরাধ সেখানে- মিয়াঁরা বাড়তে বাড়তে একদিন গোটা রাজ্য, দেশ দখল করে নেবে- নেতাদের মাইক থেকে বিদ্বেষ বিষ টিভি-স্মার্টফোন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। তবে সব মানুষকে কী আর ঘৃণা দিয়ে বশ করা যায়! বাহারুলের দুঘর পরে থাকত নিখিল। কামরূপ জেলার ছেলে, তেলের কারখানায় কাজ নিয়ে শিবসাগরে আসা তার। এক ছুটির দিন বাসার সামনের একফালি জায়গায় স্টোভে কেরোসিন ভরতে ভরতে আপনমনেই গুনগুন করছিল বাহারুল, নিখিল যেচে এসে আলাপ করল তার সাথে। বলা নেই কওয়া নেই, একটু পরে নিজের টোকারি নিয়ে এসে হাজির। সেও যে গান পাগল। নিখিলের আব্দারেই অনেকদিন বাদে গলা ছেড়ে গান ধরে বাহারুল- “ বন্ধুর বাড়ী, আমার বাড়ী রে/ মধ্যে পিরীতের নদী/ উইড়া যাইতে দে নাই পাখারে/ বাদী দারুণ বিধিরে/মরি, বন্ধুর পিরীতে।" নিখিল এ গান আগে শোনেনি কিন্তু একটুখানি শুনেই সুরটা ধরে নেয়। তাদের যুগলবন্দীতে কখন যে পড়শিরা জড়ো হয়ে গেছে প্রথমে খেয়াল করেনি বাহারুল। খেয়াল হয়, যখন স্ত্রী নাজমা সকলের জন্য চা করে নিয়ে আসে। নিখিলের স্ত্রী কমলাকেও ডাকে। তাদের দুজনের অবশ্য আগেই আলাপ হয়ে গেছে। সেইদিন থেকে বাহারুল আর নিখিলের বন্ধুত্ব শুরু। তারপর মাঝে সাঝেই গানের আসর বসে, কখনো এ ঘরে, কখনো ও ঘরে- নিখিল নিজেও ভালো গান গায়- তার বিহু গানের সাথে, টিনের ড্রামে ঢোলের বোল তোলে বাহারুল। ওঘরের রান্না মাছের টেঙ্গা এঘরে আসে, এঘরের পানি হামুক ওঘরে যায়- দুবাড়ির বাচ্চারা এক সাথে খেলে- এক স্কুলে পড়ে। কিন্তু ওই একটা ঘটনা কেমন যেন সব এলেমেলো করে দিল। একদিন কাজ থেকে বাড়ী ফিরে বাহারুল শোনে- দুপুরবেলা পনেরো কুড়িজনের একটা দল এসে নাজমাকে হুমকি দিয়ে গেছে- সাতদিনের মধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে- নাহলে ফল ভাল হবে না। স্বাভাবিকভাবে নাজমা খুব ভয় পেয়ে গেছে। খবর শুনে একটু বাদে নিখিল আসে। সে জোর গলায় বলে- কটা উটকো লোকের কথায় অত গুরুত্ব না দিতে- কিছু হলে তারা তো পাশে আছে। কিন্তু সেদিন রাত্রেই কে যেন হোয়াটসঅ্যাপে ওই ভিডিওটা পাঠাল। কোন এক বিল্ডিং সাইটে- মাটিতে হাঁটু গেড়ে, কান ধরে বসে আছে কজন লেবার আর তাদেরকে ঘিরে ধরে মারছে- ধমকাচ্ছে মুখঢাকা একদল লোক- তাদের কারো হাতে লাঠি, কারো ভোজালি, কারো আবার পাইপ। একজনের লাঠি থামতেই আরেকজন মার শুরু করছে আর ঘুরে ফিরে বারবার লেবার ছেলেগুলোকে সেই একই স্লোগান দিতে বলছে। যে দেশে জন্মেছি- যে মাটির অন্ন খেয়েছি- সে দেশকে তো আমি এমনিই ‘মা’ বলব। কিন্তু তার জন্য এই অত্যাচার কেন? আর ‘মা’ বললেই যে মার থেমে যাচ্ছে তাও তো নয়- বরং উলটো- ছেলেগুলো যত হাতজোড় করে মাফ চায়- তত নৃশংস হয় অত্যাচার। ভিডিওটা পুরোটা দেখতে পারেনি বাহারুল- পাশে বসা নাজমা ডুকরে কেঁদে উঠে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছিল। দুদিন পর বাড়ীওয়ালাও এসে যখন খুবই সংকোচ নিয়ে, বাড়ী ছেড়ে দিতে বলে- নিখিল রীতিমত ঝগড়াই করে বাড়ীওয়ালার সাথে- বলে, আইনত মিনিমাম এক মাসের নোটিশ দিতে হবে। শুনে বাড়ীওয়ালা চুপ করে যায়- কিন্তু তবু শান্তি পায় না বাহারুল। গোয়ালপাড়ার রিয়াজ বলে- এসব আসলে লেবারদের টাকা মেরে দেবার কল। লেবাররা ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে চলে গেলে ঠিকাদারকে তাদের বকেয়া টাকা আর দিতে হবে না। লেবাররা একজোট হয়ে থাকলে, কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। কিন্তু তবু বাহারুল ভয় পায়। ভয় পায় কারণ, কদিন যেতে না যেতেই একে একে সব মিয়াঁ লেবাররা পালাতে থাকে। কেউ কেউ রিয়াজের মত গোপনে, কেউ চোখের জলে বিদায় নিয়ে। ধৈর্যের শেষ বাঁধটাও ভেঙ্গে যায়, যখন বাহারুলের ছ বছরের ছেলে আনোয়ার কাঁদতে কাঁদতে স্কুল থেকে বাড়ী ফেরে। তার বাপ মিয়াঁ, তাই তার বন্ধু দিলীপ আর তার পাশে বসবে না। বন্ধুর বাড়ি আর আমার বাড়ী হল কই? পিরীতের নদী যে শুকায়ে গেল! প্রায় রাতারাতি জিনিসপত্র গুছিয়ে, নিখিলকে কিছু না জানিয়েই আবার ছুট দেয় বাহারুল, ছোটে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
৩
হরিয়ানার এই বস্তিতে সে এসেছে মাস খানেক হল। ফোনে বাড়িতে বলেছে এক স্কুলে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ পেয়েছে, কিন্তু আসলে কাজটা ময়লা কুড়ুনির। এই বস্তিতে সবাই ওই কাজই করে। গৃহস্থের বাড়ী, দোকান, কারখানা আবার কখনো রাস্তা, পার্ক থেকে প্লাস্টিক বোতল, কার্ডবোর্ড, থার্মোকল, লোহা-লক্কড় এর মত হাজারো বাতিল জিনিস কুড়িয়ে এনে ডিলারের কাছে বিক্রি করলে নগদ টাকা পাওয়া যায়। দাম যদিও ডিলারের মর্জিমাফিক ঠিক হয়, তবু আবিদ বলেছে, সারা মাস খাটতে পারলে আট-দশ হাজার হবে। আর গরমকালে যখন ঠাণ্ডার বোতল বিক্রি বেড়ে যাবে, তখন রোজগার আরও বেশী হবে। আবিদ বয়সে বাহারুলের বয়সীই হবে, কিন্তু এই লাইনে সে অভিজ্ঞ লোক। প্রায় দু বছর ধরে সে এখানে আছে। কোন মাল বিক্রি হবে- কোন মাল ফেলনা- কোন ডিলার ঝামেলা করে- বাহারুলকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছে সে। তবে শুধু বাহারুল বলে নয়- আবিদ মানুষটাই মিশুকে- বন্ধুবৎসল। দাদু বলত- “আপ ভালো তো জগত ভালো”। আবিদকে দেখে, দাদুর কথাটা মনে পড়ে বাহারুলের। সারাদিন ময়লা ঘেঁটেও, আবিদের মনে কোন ময়লা নেই। বরং সে বলে- অন্যান্য বড় শহরের তুলনায়, এখানকার লোকেরা ভালো। যদিও তার প্রমাণ বাহারুল এখনো পায়নি। বরং উল্টোটাই মনে হয়েছে। সে এখানে আসতে না আসতেই একদিন সকাল সকাল পুলিশ এসে হাজির। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দেখেও তাদের বিশ্বাস হয় না যে বাহারুল এ দেশের লোক। আর এ দেশের হলেই বা, সে যে জঙ্গি বা ক্রিমিনাল নয়, তার প্রমাণ কই? লোকাল থানার সার্টিফিকেট চাই। সেদিন আবিদ ও অন্যরা হাতে পায়ে ধরে না আটকালে, বাহারুল কে ওরা হয়ত জেলেই ভরে দিত। একজন তো লাঠি উঁচিয়ে শাঁসিয়েই গেলো- কোন এদিক ওদিক হলে- সবকটাকে একসাথে তুলে নিয়ে যাবে। এতই সোজা! মগের মুলুক নাকি? কোন অন্যায় না করলেও তুলে নিয়ে যাবে? দেশে কি কোন আইন কানুন নেই! বাহারুলের রাগ দেখে, আবিদ ম্লান হেসে তার কাঁধে হাত রাখে। আবিদের মুখেই শোনে, পুলিশের হুজ্জুতি এখানে রোজকার ব্যাপার। আর শুধু কী পুলিশ! আর একদল আছে, তারা পুলিশের চেয়েও বেশী। ওরা চট করে সামনে আসে না কিন্তু সারাক্ষণ ওদের নজর রয়েছে এই বস্তির উপর। কে আসছে- কোথায় যাচ্ছে- কার ঘরে কী রান্না হচ্ছে- সব ওদের নখদর্পণে। ওরাই পুলিশকে খবর দেয়। "আসলে এখানে কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না'- আবিদের শ্যালক জিয়াউদ্দিন পাশ থেকে বলে। "কিন্তু আমাগো দোষটা কী? আমরা গরীব হেইডা নাকি আমরা মিয়াঁ, হেইডা?"- বাহারুলের রাগ তখনো কমেনি। জিয়াউদ্দিন কিছু উত্তর দেবার আগেই, আবিদ বাহারুলের ভঙ্গি অনুকরণ করে বলে- "দুইডাই। এহন কাজে চলো। কাজ না করলি খাবা কি, এইডা?" আবিদের বুড়ো আঙ্গুল তুলে কলা দেখানোয় সবাই হেসে ওঠে। এটাই আবিদের গুণ। কঠিন পরিস্থিতিতেও মুখের হাসিটা তার লেগেই থাকে। অথচ বাহারুলের মত, তার জীবনেও সঙ্কট কম নয়। আসাম নয়, তার ভিটে পশ্চিমবাংলা। তার বাড়ীর পাশ দিয়েও বয়ে গেছে এক নদী- নাম তার মাতলা। বর্ষা এলে সে নদীও দুকুল ভাসায়। তার উপর ফি বছর লেগে থাকে ঝড়। সে বছর আম্ফান ঝড়ে তার গোটা বাড়ীটাই ধূলিসাৎ হয়ে গেছিল। তারউপর প্রকৃতির মারকে যদিওবা আল্লার বিচার বলে সহ্য করা যায়, মানুষের মারের তো কোন সান্ত্বনা নেই। ফুলের নামে গ্রামের নাম- অথচ গ্রামের বাতাসে নিত্যদিন ভেসে বেড়ায় বারুদের গন্ধ। কে কত বড় নেতা হবে, মাদার না যুব, কার দখলে থাকবে গ্রাম পঞ্চায়েত, সরকারী প্রকল্পের টাকা কার পকেটে ঢুকবে এই নিয়ে লড়াইয়ে চাচাতো-ফুফাতো ভাইয়ের মাথায় কোপ দিতেও হাত কাঁপে না কারো কারো। দু বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটের দিন খুন হয় আবিদের আপন চাচা। তার পরপরই এক বন্ধুর থেকে খবর পেয়ে প্রথমে দিল্লী তারপর হরিয়ানার এই কাজে চলে আসে আবিদ। রোজদিন বোমাবাজি- খুনোখুনি- মারপিট এর থেকে অনেক দূরে, হোক না ছোট কাজ তবু রাতে একটু শান্তির ঘুম তো হবে। কিন্তু শান্তি আর রইল কই!
৪
সেদিন সকালে ওরা যখন দলবল বেঁধে বস্তিতে এল, বাহারুল আর আবিদ তখন রোজকার মত টোটো নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ছে। বাকী পুরুষরাও যে যার মত ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এদিক ওদিক। ছিল শুধু বাড়ীর বউরা, বাচ্চারা আর জামিল। দুদিন আগে ভারী বস্তা তুলতে গিয়ে কোমরে চোট লেগেছিল জামিলের, তাই সে কদিন কাজে যাচ্ছিল না। উঠোনের খাটিয়ায় শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছিল সে। কালো চকচকে জিপের মত গাড়িটা বিকট শব্দে জামিলের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। ঠিক যেন হিন্দি সিনেমার মত, গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে একের পর এক লোকগুলো নামে। কারো মাথায় ফেট্টি, হাতে তলোয়ার, কারো গলায় উত্তরীয়, হাতে লাঠি, কারো কপালে দীর্ঘ টিকা, হকিস্টিক হাতে, কারো আবার পেশীবহুল হাতে লম্বা বন্দুক ঝলসায়। সব শেষে নামে ওদের লিডার। তার হাতে কোন অস্ত্র নেই- বয়স মেরে কেটে আঠোরো হবে কিনা সন্দেহ- নাকের নীচে গোঁফের রেখা এখনো অস্পষ্ট- মাথার অবাধ্য চুলগুলো প্রায়ই কপালের হলুদ তিলক ঢেকে দিয়ে চোখের উপর এসে পড়ছে- ঢলঢলে গেরুয়া কুর্তার নীচে রুগ্ন হাতে একটা চওড়া বালা আর অনেকগুলো ধাগা। চারপাশের সশস্ত্র বাহিনী সরিয়ে দিলে তার মুখের ভেতর আলাদা করে হিংস্রতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, বরং একঝলক দেখলে মনে হয়, একটা নিষ্পাপ লাজুক কিশোর হাসি যেন লেগে রয়েছে ঠোঁটে। হয়ত সেই মনে হওয়াকে ভুল প্রমাণ করে প্রচণ্ড পুরুষ হয়ে উঠতেই গাড়ী থেকে নেমে ছেলেটা কোন কথা না বলেই জামিলের কলার ধরে সজোরে একটা চড় কষায়। সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনী রামের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে অভিবাদন জানায়। এরপরের ঘটনাবলী এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে জামিল বা বস্তির মহিলারা কেউই কোন দিশা পায় না। বাচ্চারা ভয়ে গুটিসুটি মেরে মায়েদের পিছনে লুকোয়। জামিল যতই বলে- বস্তিতে কেউ গরুর মাংস খায়নি- আগের দিন রাতে মাংস রান্না হয়েছিল বটে- তবে তা গরুর মাংস নয়- কেউ ওর কথা বিশ্বাস করে না। কোমরে ব্যথার জায়গায় হকিস্টিকের বাড়ী পড়তেই জামিলের আর্ত চিৎকার শুনে, ওর স্ত্রী ছুটে এসে ছেলেটির পা জড়িয়ে ধরে। তাতে মুহুর্তের জন্য মার বন্ধ হলেও, বস্তির বাকী পুরুষদের এখনি ডাকতে হবে, হুঙ্কার দেয় ওরা। ততক্ষণে এঘর ওঘর থেকে রান্নার হাঁড়ি, কড়াই বের করে এনেছে ওদের অন্য লোকরা। সকাল এগারোটা বাজে তখন- কারো হাঁড়িতে ভাত ফুটছিল- কেউ সবে ডাল নামিয়েছে- সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় নিমেষে। এর মধ্যেই কার ঘরে ঢাকা দেওয়া দুটুকরো বাসী মাংস আর ঝোল ছিল- হয়ত ভেবেছিল পরদিন পরোটা দিয়ে খাবে- ছোঁ মেরে ছিনিয়ে আনে ওরা। আবিদ সেদিন কাজে বেরোনোর সময় ভুল করে ফোন নিয়ে যায়নি, তাই ওর স্ত্রী সাকিনা বা জামাল কেউই এই তাণ্ডবের খবর ওর কাছে পৌঁছে দিতে পারে নি। আর বাহারুল সদ্য এসেছে, তার কথা আলাদা করে কেউ ভাবে নি। দুপুরে আবিদ যখন বাড়ী ফেরে, দ্যাখে চারপাশ শুনশান। কাকের দল উঠোনে ছড়ানো ভাত খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। সাকিনার মুখে সব শুনে ভয়ে শিউরে ওঠে বাহারুল। ঝামেলার খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিল কিন্তু পুলিশ ওই হামলাকারীদের তো কিছু বলেই নি, উল্টে জোর করে জামালকেই থানায় ধরে নিয়ে গেছে আর ওই বাসী মাংসও পাত্র ধরে তুলে নিয়ে গেছে। ওরা নাকি টেস্ট করে দেখবে, ওটা সত্যি গরুর গোস্ত কিনা। আবিদ কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে কিন্তু তার স্বভাব তাকে হতাশ হতে শেখায়নি বা হলেও প্রকাশ করতে দেয়নি, তাই সে বলে- “টেস্ট করবে তো করুক, করলেই তো সত্যিটা সবাই জেনে যাবে”। সে সাকিনাকে জামালের ঘরে গিয়ে ওর বউ এর খোঁজ নিতে বলে- ঘরে ছোট বাচ্চা রয়েছে- আদৌ রান্না বান্না কিছু হয়েছে কিনা। বাহারুলকে বলে- অন্য ছেলেরা ফিরলেই সবাই মিলে থানায় গিয়ে জামালের খোঁজ করতে হবে। ওরা জানতেই পারেনি বাকিদের পুলিশ আর ওই গো-রক্ষক গ্যাং রাস্তা থেকেই থানায় তুলে নিয়ে গেছে। তাই একটু বাদে, একটা বাচ্চা ছেলে যখন আবিদের ঘরে এসে বাসস্ট্যান্ডের ধারে একটা দোকানে যেতে বলে ভাঙ্গাচোরা নেয়ার জন্য, আবিদ সাতপাঁচ কিছু না ভেবেই বাহারুলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সাকিনা তখন স্নান করছিল। দুই বছরের মেয়ে নাফিসাকে কোলে নিয়ে আদর করে রোজকার লজেন্সটা হাতে দিয়ে, “এখুনি আসছি” বলে টোটো ছেড়ে দেয় আবিদ। সেই যে “আসছি” বলে ছুটেছিল আবিদ- আর ফেরেনি। ফিরল তার লাশ, পোর্ষ্টমর্টেম হয়ে।
৫
বাহারুল ছুটছে। ছুটতে ছুটতে জিভ বেরিয়ে আসছে, তবু সে ছুটছে। না ছুটে উপায় কী! টোটো নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই চারদিক দিয়ে ওদের ঘিরে ফেলে জনা পনেরোর দলটা। বাচ্চাটাকে দিয়ে ময়লা নেবার টোপ দিয়ে ওরাই ডেকেছিল আবিদ-বাহারুলকে। আবিদের বোধহয় বিশ্বাস ছিল পুলিশ যখন একবার কেস হাতে নিয়েছে, তখন আর ঐ গ্যাং কিছু করবে না। কিন্তু তার সমস্ত বিশ্বাস এক মুহুর্তেই ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে, আর একটার পর একটা লাঠি- তক্তা- হকিস্টিকের বাড়ী এসে পড়তে থাকে ওদের শরীরে। আবিদ বোঝেনি যে গো মাংসটা একটা অজুহাত মাত্র, যেনতেন প্রকারেণ ওদের উপর অত্যাচার করা, ওদের হত্যা করে ভয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপনই ওই স্বঘোষিত গো-রক্ষকদের লক্ষ্য ছিল। দু মাস পর যখন পুলিশ রিপোর্ট বেরোল, দেখা গেল, সেদিনের পাওয়া মাংস সত্যিই গরুর মাংস ছিল না। আর যদি হতই বা গরুর মাংস, তারজন্যও কি এভাবে মানুষকে পিটিয়ে মারা যায়! কয়েকজন স্থানীয় মহিলা বাধা না দিলে, ওই গ্যাং ওদের দুজনকে সেদিন ওই বাসস্ট্যাণ্ডেই পিটিয়ে মেরে ফেলত। লোক জড়ো হয়ে যাচ্ছে দেখে একজন তাড়াতাড়ি গাড়ী নিয়ে আসতে বলে। গাড়ী আসতেই ওরা আগে আবিদকে ধরে চ্যাংদোলা করে ছুড়ে দেয় গাড়ির ভিতরে, তারপর বাহারুলকে ধরে। কিন্তু বাহারুল নিজেও জানে না, কীভাবে যেন সে ওদের হাত পিছলে ছিটকে পড়ে পিচ রাস্তায়, আর তারপর উর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে। ছুটছে আর ছুটছে- বাহারুল ছুটছে- বাসস্ট্যান্ড-বাজার-চৌমাথার স্ট্যাচু- ডান হাতে গলি- সেই গলি থেকে অন্য গলি- গলি পেরিয়ে আবার রাস্তা- রাস্তার ধারে ভুট্টার ক্ষেত- হঠাৎ কিসে যেন হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে বাহারুল। স্থানীয় হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতেই আবিদকে খোঁজে বাহারুল। কিন্তু কেউ তাকে আবিদের খোঁজ দিতে পারে না। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায় তার, সে কিভাবে বন্ধুকে ফেলে, নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে পারল! বুক চাপড়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বাহারুল। লোহার খাটে উন্মাদের মত মাথা ঠুকতে ঠুকতে আবার জ্ঞান হারাবার আগে একটা কথাই বলতে থাকে সে বারবার- “আবিদ, দোস্ত আমায় ক্ষমা করিস!”
৬
আবিদের দেহ নিয়ে স্ত্রী সাকিনা আর মেয়ে গ্রামে ফিরে আসে। জিয়াউদ্দিন, সাকিনার ভাই, সেও হরিয়ানার পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে ওদের সাথে ফিরে আসে। শুধু তারা নয় বস্তির আরো অনেকেই নিজ গ্রামে ফিরে যায় প্রাণের ভয়ে। যদিও পুলিশ রাতারাতি ওই গোরক্ষক বাহিনীর কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করে তবু তারা ভরসা পায়না। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বলেন- গণপিটুনিতে মৃত্যু কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয় কিন্তু গোমাতার বিষয়ে গ্রামবাসীরা যেহেতু খুবই আবেগপ্রবণ, ফলে...। এদিকে বাংলায় স্থানীয় এম.পি. লোক মারফত আবিদের পরিবারের জন্য কয়েক লাখ টাকা পাঠায়। পর্দার আড়াল থেকে সাকিনা দ্যাখে, মুরুব্বি গোছের লোকটা জিয়াউদ্দিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে মুচকি হেসে কি যেন জিগ্যেস করে। জিয়াউদ্দিন দ্রুত বেগে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে- " না, না বিশ্বাস করেন, গরুর গোস্ত সেদিন আমরা খাইনি।" কদিন পর খবর আসে বিডিও অফিসে একটা ঠিকা চাকরি পাবে সাকিনা। হায়, আবিদ বেঁচে থাকতে যদি এই চাকরি পেত, তবে হয়ত তাকে পেটের দায়ে বাইরে ছুটতেই হত না। আর বাহারুল? তার অবশ্য মরেও শান্তি নেই। হাসপাতালে পরেরদিন সকালেই তার ঘোর ভাঙ্গে স্ত্রী নাজমার ফোনে। না, বাহারুলের বিপদের কথা শুনে নয়, ফোনের ওপ্রান্তে নাজমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কারণ, এন আর সি লিস্ট থেকে তাদের গোটা পরিবারেরই নাম কাটা পড়েছে- তারা নাকি এদেশের কেউ না, তারা ঘুসপেটিয়া - দু সপ্তাহ পর হিয়ারিং- এর মধ্যে ডকুমেন্ট না জোগাড় করতে পারলে... ডিটেনশন ক্যাম্পে...
আবারও ছোটে বাহারুল...
আজও, বাহারুল ছুটছে।
এই গল্পটি ২০২৪ সালের এই সময় পত্রিকা'র বিশেষ গল্প সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।