পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সদা দীপ্ত রহে

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমন মিত্র
না না না। একদম হচ্ছে না। সুরই লাগছে না। হবে কোথা থেকে? চর্চা কোথায়? দিনের একটা সময় মেপে রেওয়াজ করতে হয়। এভাবে শেষ মুহূর্তে অনুষ্ঠানের ঠিক আগে রেওয়াজ করে হয় না। বলতে গেলেই বলবে,’ বাবা...রেওয়াজ করার সময় কোথায় বলবে? দেখো না? সারাক্ষণ শুধু সংসার সংসার করে কেটে যায়।’

তার উত্তরে, আমি যদি বলি,‘ এ সব অজুহাত। শিখা পারছে কীভাবে? বিদেশে সংসার তো মুখের কথা নয়। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ ! সব সামলে ও তো ঠিক প্রতিবছর একটা করে বই লিখে চলেছে। তোমার মতো শিখার তো পাঁচটা কর্মচারীও নেই। তা হলে?‘ ব্যস! তখনই বহ্নি গোসা হবে। এই ঘর থেকে উঠে চলে যাবে।

  শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদবে কিছুক্ষণ। আমার সঙ্গে দশ দিন কথা বলবে না।

আমার হয়েছে যন্ত্রণা, বুঝলেন। কার কাছে কতটা বললে যে ভাল থাকব, এই বয়সে পৌঁছেও বুঝলাম না ! সমস্ত জীবন এই ভেবেই কেটে গেল। আর, কপালও তেমন আমার। ঠিক রিটায়ারমেন্টের বছর দুই আগে মালবিকা চলে গেল।

  কিডনি ফেল করল। কত চিকিৎসা, কত টাকা পয়সা খরচ করলাম। শেষমেশ কিছুই হল না। অদৃষ্ট! অদৃষ্ট!

এক সময় অধ্যাপনার পাশাপাশি জ্যোতিষী করতাম, জানেন। ক্যাম্পাসে ভাল পশরাও ছিল। তার পর… যা হয়, মালবিকা চলে যাওয়ার পর সংসারটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল আমার ! শিখার লেখাপড়া শেষ হয়নি তখনও। বিয়ে দিতে হবে মেয়েটাকে। কাঁধের ওপর হাজারটা দায়িত্ব !

   ঘরের সমস্ত সাবেকি আসবাবপত্র, বাসনকোসন, আমার সাধের সাইকেলটা, আরও কত জিনিসপত্র বেচে বর্ধমান থেকে চলে এলাম কলকাতায়। অবসরের পর যা কিছু পুঁজি ছিল, তার কিছুটা ইনভেস্ট করলাম কলকাতা শহরে একটা ফ্ল্যাটবাড়ি কিনতে, আর খানিকটা টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিলাম। বলা যায় না। বয়স বাড়লে অসুখবিসুখ হবে। তখন কাজে লাগতে পারে। আমার পুঁজির শেষ অংশটুকু খরচ হয়ে গেল শিখার বিয়েতে।

  বহ্নির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে প্রেম করত। মালবিকা টের পেয়ে চার হাত এক করে দিতে বলেছিল। আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তো এই বড় মেয়ের বিয়ে আর মালবিকার অসুখেই খরচ হয়ে গিয়েছিল।

 এখন সে সব মনে আছে কারও? দূর ! কিস্যু মনে রাখে না এই যুগের সন্তানরা, বুঝলেন। আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই। প্রতিদিন।

সে যাই হোক। যে কথা বলছিলাম। জানেন, আমার দুই মেয়েই খুব গুণী। দু'রকম ভাবে।

বহ্নির গান গায়। আর শিখার হল লেখার হাত। দুই মেয়ে সুন্দরীও। বহ্নির চেহারা ভাল। মায়ের আদল পেয়েছে। দূর থেকে মালবিকার মতো দেখায়। মা লক্ষ্মীর মতো।

শিখার সুঠাম চেহারা। টানা টানা চোখ। বুদ্ধিদীপ্ত হাসি। সম্প্রতি বেশ নাম করছে, জানেন। ভাল ভাল প্রকাশনা থেকে গোটা দশ বারো বইও প্রকাশিত হয়েছে।

 আমার মা শিখাকে প্রথম কোলে নেওয়ার দু’দিন পরই চলে গিয়েছিল। তখন শিখা তিন মাস। বহ্নি আট বছর।

দুই মেয়ে। নানা লোকে নানা কথা বলত। কানাঘুষো শুনতাম।কারও মুখেও এও শুনেছি। দুই সন্তানই তো মেয়ে হল। তা মেয়েরা মুখাগ্নি করতে পারবে? আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় উত্তরে বলেছি, আমার মেয়েরা করবে। পুত্র সন্তানকেই মুখাগ্নি করতে হবে, এমন শাস্ত্র আমি মানি না। আসলে, শাস্ত্র তো পুরুষের হাতেই লেখা। তাই না?

 

 মা শিখার কপালে কাজলের ফোঁটা দিয়ে বলেছিল মালবিকাকে,’ তোমার এক মেয়ে লক্ষ্মী। এক মেয়ে সরস্বতী। সুন্দর করে বড় করবে।’

 মালবিকা আর আমি মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। দু’জনকেই ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শিখিয়েছি। স্কুল, কলেজ, বই খাতা, সাহিত্য চর্চা, গান, নাচ, পোশাক, জুতো, খাওয়াদাওয়া – কোনও কিছুর অভাব রাখিনি।

এর জন্য আমি আর মালবিকা আমাদের কোনও মধ্যবিত্ত শখ পূরণ করিনি। বেড়াতে যেতাম না। নিজেদের পিছনে খরচা করতাম না। শুধু চেয়েছিলাম, ওরা বড় হোক। মানুষ হোক।

 এখন এই শেষ বয়সে এসে ভাবি, সত্যিই কি বড় করতে পারলাম ওদের? সত্যিই কি মানুষের মতো মানুষ হল ওরা?

 

মাঝেমধ্যেই দুই বোনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারি না। আরে, আমি কী চিরটাকাল থাকব? তখন তোরাই তো মিলেমিশে থাকবি!

 

‘কী গো বাবা, খাবে না? সাড়ে ন'টা বেজে গেল তো!’ বহ্নি ডাকছে।

আমি এখন বহ্নির ঘরেই থাকি, জানেন। সে লম্বা কাহিনি ! খেয়ে আসি। তার পর বলব। বুঝতেই তো পারছেন। মেয়ের বাড়িতে থাকি। মেয়ের কথা শুনে চলতে হবে না? তবে সত্যি বলতে কি, বহ্নি ভাল। আমাকে দেখেশুনে রাখে। ঘরে প্রচুর কর্মচারী। কেউ না কেউ সব সময় আমার সেবায় হাজির।

সকালে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জুস, ফল, রুটি তরকারি, দুধ,দই। রুপোর থালা বাটিতে সাজিয়ে আমার ঘরে দিয়ে যায়। আমি আমার ঘরের মধ্যেই থাকি সারাক্ষণ। বেরোতে ইচ্ছে করে না। কী জানি কেন ! 

 

‘কই বাবা? এলে না?’ আবার ডাক দিল বহ্নি।

‘আসছি। আসছি।’নাহ। আসি এখন। খেয়ে নিই। আমার ওষুধের ঠিক কুড়ি মিনিট পর রাতে খাবার খেতে বলেছে ডাক্তার। না গেলে বহ্নি বকাবকি করবে।

 

হল। খাওয়া দাওয়া হল। খেতে বসে বহ্নি বলল,’ শিখা আসছে। এক মাস পর। অনেক দিন পর ওর বাচ্চা দুটোকে এক সঙ্গে পাব। আমার মেয়েটা তো কবেই লায়েক হয়ে গিয়েছে। আমাদের অমতে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করল। কষ্ট জমে জমে বুকটা--শিখার বাচ্চা দুটো এলে মনটা ভাল লাগে। সেও তো কত বছর বন্ধ ছিল। দম আটকে আসত!’

এই কথাটা কি বহ্নি আমাকে ঠুকে বলল? হতে পারে। দুই বোনের বক্তব্য আমিই নাকি ওদের ঝগড়া বাধাই। বেশ। তর্কের খাতিরে যদি সে কথা মেনেও নিই, তা হলে আমার প্রশ্ন হল, তোদের দুই বোনের সম্পর্ক এতই ভঙ্গুর কেন? এত সহজে ভাঙন ধরে কীভাবে?

শিখাকে এ কথা বললে, কটাস কটাস জবাব দেবে।

‘কী করে বুঝব বলো, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে? তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল।’

বাপের মুখের কথা বিশ্বাস করে না। ভীষণ অহংকার শিখার। কিসের অহংকার করিস তুই? মালবিকা চলে যাওয়ার পর লেখাপড়া শেষ করাল তোর বাবা। কলেজে, বাসে, ট্রামে যেভাবে ছেলেপিলে তাকাত শিখার দিকে! আর ক'টা দিন গেলেই প্রেম করতে শুরু করে দিত।

আমার অত সাংসারিক বুদ্ধি নেই মালবিকার মতন, আমি টেরও পেতাম না। তাই, মাস্টার্স করার পরই ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিলাম। সেই নিয়ে কম কথা শুনিয়েছে শিখা আমাকে!

 ‘ব্রিটিশ যুগের মানসিকতা। আর ক’টা দিন আমাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দিতে পারলে না? বাইশ বছর একটা বিয়ের বয়স হল? বিদেশে যাওয়ার পর ক্যামপাসের কত ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, জানো? প্রত্যেকটা ছেলে বলেছে আমাকে। তোর হিটলার বাবার জন্য তোকে ঠিকঠাক প্রোপোজই করতে পারিনি।’ 

বুঝুন ! আমি হিটলার? সন্তানকে শাসন করব না? আর আমি জানি তো। বহ্নির মতো সাদাসিধে নয় শিখা। জীবনে ধূসর দিকটাই ওকে টানে। আমি বলছি, আমি শিখার বাবা হয়ে বলছি আপনাদের। আমি যদি শিখাকে এই সৎ পাত্রের হাতে ঠিক সময় তুলে না দিতাম, কী হত জানেন? আমার কনিষ্ঠ কন্যাটি বিয়েই করত না। আজ এই ছেলে কাল ওই ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ঘুরে বেড়াত।

ও যতই ঝগড়া করুক। ভুল বুঝুক আমাকে। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বহ্নির মতো শান্ত ধীর স্থির মেয়ে হলে তাও আমি রিস্ক নিতাম। কিন্তু, শিখা? না না। ও একদম অন্যরকম। স্বাধীনচেতা, স্বেচ্ছাচারী। আবেগের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সে তো লেখা পড়লেই বুঝতে পারি আজকাল। এই কথায় মনে পড়ল। শিখার একটা সাম্প্রতিক লেখা.....

 

ও মা! মা গো! মা গো! আমাকে ধর। ধর তোরা ...... বহ্নি বহ্নি......

 

 ২

চোখের সামনে সাদা পর্দা ঝুলছে। দূরে সৌভিক দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার পায়ের কাছে। আমার নাত জামাই। মাথা তুলতে গিয়েছি, নাতনি, শৈলী, বাধা দিল। ‘উঠবে না একদম। ডাক্তার আসছে।’ কপালে অসহ্য যন্ত্রণা।পারছি না !

‘আমি কোথায়?’

শৈলী বলল, ‘ হাসপাতালে। ওয়াশরুমে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিলে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।’ ও কথা শেষ করার আগেই পাঁচজন ডাক্তার চলে এল কোথা থেকে। কোন হাসপাতাল? কোথায়? কিছুই বুঝলাম না। তার পর আধ ঘণ্টা আমার মাথার পিছনের দিকে সেলাই করল। কপালে ব্লাড ক্লট করে গিয়েছিল। চেপে চেপে রক্ত বের করল। ব্যথায় আমি ছটফট করছি। একগাদা টেস্ট দিল। সিটি স্ক্যান, ব্লাড টেস্ট ,আরও কী কী সব ! শৈলী জানে। আমাকে বলেনি। বয়স হয়ে গিয়েছে। অত বুঝিও না।

 

কিছুক্ষণ পর ঘরে ফিরলাম। দেখি বহ্নি একা একা কাঁদছে। ও এখনও বাবার জন্য কাঁদে? গত কয়েক মাস ধরে তো কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। শিখা ফোন করেছিল? কী জানি ! এখন ভাবতে ইচ্ছে করছে না এ সব।

আমি ঘরে ঢুকতেই বহ্নি আমার বিছানায় বালিশ সাজিয়ে দিল। বলল, ‘এখানে হেলান দিয়ে আধ শোয়া হয়ে বোসো।’ শৈলী আমাকে ধরে নিয়ে বসাল।

‘ব্যথা করছে খুব, না?’ বহ্নি জিজ্ঞেস করল। আমি মাথা নাড়লাম। শৈলী ওষুধপত্রগুলো বুঝিয়ে দিল ওর মাকে।

‘আমার কী হয়েছিল রে?’ জিজ্ঞেস করলাম বহ্নিকে। অস্থির লাগছে।

‘পড়ে গিয়েছিলে। বহ্নি বহ্নি বলে চিৎকার করছিলে। এসে দেখি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছ। শৈলীকে ফোন করলাম। ও এসে অ্যামবুলেন্স ডাকল......... তোমার জামাই, অরিত্র তো মাসের মধ্যে পনেরোদিন শহরের বাইরে। চাকরি করছে। একা বাড়িতে আমার যে......তাও ভাল শৈলী এখন নীচের ফ্ল্যাটে থাকে।’ শৈলী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমিও চুপচাপ। কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল ! আমি কিছুই টের পেলাম না? কীভাবে?

 কয়েক মিনিট পর, ‘বিশ্রাম নাও। আজ বেস্পতিবারের। ব্রত পড়ে আসি। কিছু লাগলে ডেকো। তিনজন আছে। কাজ করছে। আজ বাড়ি যাবে না ওরা।’ ব’লে বহ্নি চলে গেল। শৈলীও ফোন খুটখুট করতে করতে বলল,

‘ আমি স্নান করে আসি। তুমি বেশি নড়াচড়া করবে না একদম। ঠিক আছে?’

বেশ। আমি তবে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকি। বুকটা এখনও ধড়ফড় করছে।

সবে ঘুম আসছে চোখে, এমন সময় দরজায় খটখট।

‘ কে?’

‘ আমি…’

মালবিকার গলা না? উফ! এই এক হয়েছে। মরেও রোজ আসবে কথা বলতে। কখনও জ্ঞান দেবে। কখনও শাসন করবে। কখনও...আবার, আবার খটখট শব্দ দরজায়। বিরক্তিকর !

‘ কী বলবে বলো। আমার শরীর ভাল নেই।’

‘ সে তো দেখছি। বাধিয়ে বসলে এক কাণ্ড!’

‘ আমি বাধাবার কে? আশ্চর্য! সবই ওপরওয়ালা। প্রতিটি অণু পরমাণু তাঁর হাতে। পালাবার পথ নাই। আর কত যে শাস্তি বাকি এই জীবনে?’

‘ ওপরওয়ালার আর দোষ কী বোলো! পাপের যা বোঝা…এমন দুই সন্তান, এমন দুই জামাইয়ের সঙ্গে ঘর করতে পারলে না তুমি।’ মালবিকার ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি।

 ‘ হ্যাঁ, আমারই দোষ। করো বিদ্রূপ। আজ বহ্নি আর শিখা সাফল্যের যে আলো দেখছে, সেটা কার জন্য? বাপ না থাকলে গতি হত কী দুটির?’

‘ সব বাপ মা-ই সন্তানের জন্য করে। তাই বলে তাঁর বিনিময়ে কেউ কিছু চায়? ছি!’

‘ ছি! মানে? আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো, কষ্ট করে, কত কষ্টে করে বড় হয়েছি। বাংলাদেশ থেকে এসে মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না আমার মায়ের। অতগুলো ভাই বোন আমরা ! তারই মধ্যে লেখাপড়া শিখেছিলাম। মেধাবী ছিলাম। চাকরি পেতে সময় লাগেনি। মন দিয়ে চাকরি করেছি, তোমার চিকিৎসায় কোনয় ত্রুটি রাখিনি, দুই মেয়ের ভাল বিয়ে দিয়েছি, এখন ওরা আমাকে বিলাসিতা দেবে না? এই চাওয়া অন্যায়? ভুল?’

‘ ভুল তো বলিনি। মনে মনে চাহিদা থাকতেই পারে। কিন্তু, চাহিদাগুলো দাবি হয়ে গেলে, বিশেষত সন্তানদের সংসারে দাবি হলে, সেটা ভুল। ভালবাসার অধিকার থাকতে নেই। অধিকার বোধ এলেই সম্পর্ক কদর্য পর্যায় পৌঁছে যায়। অনেকবার বলেছি। বুঝিয়েছি। কে কার কথা শোনে ! বেঁচে থাকতে দূর ছাই করেছ আমাকে, এখন তো মরে ভূতই হয়ে গিয়েছি। বহ্নির বাড়িতে থাকতে। বেশ ছিলে। ওর সংসারের প্রতিটা বিষয়ে নাক গলাবে কেন? কেন? ওকে শিখার উদাহরণ কেন দেবে কথায় কথায়? কী হল এতে? পারলে না থাকতে। চলে গেলে বৃদ্ধাশ্রম। সেখানেও টিকতে পারলে না। শিখা ডেকে নিল নিজের ফ্ল্যাটে। ও তখন বিদেশে। থাকো একা ওর ফ্ল্যাটে। তা না। সেইখানেও ঘোঁট পাকালে। একই কাজ করলে। ওর সংসারেও সব বিষয়ে তোমাকে ঢুকতে হবে ! কেন? বহ্নির সংসারের উদাহরণ কেন দেবে?’

‘ ও মা ! ভুল করলে বলব না?’

‘ না......’ মালবিকা গলা চড়িয়ে বলল।

‘ আশ্চর্য! একে অপরের ভালগুলো অনুসরণ করলে নিজেদেরই তো উন্নতি হবে। হবে না?’

‘ না। তাতে হিংসে বাড়ে। বহ্নি একটু বেশি বড়লোক। এটা শিখার গর্বের বিষয়। ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়। আবার শিখা রুচিশীল, মধ্যবিত্ত, আত্মবিশ্বাসী। এও আনন্দের।আত্মমর্যাদার। বাবা মায়ের চোখে কোনও সন্তান ছোট বড় হয় না। বুড়ো আঙুল কাটলে যে ব্যথা, অন্য যে কোনও আঙুল কাটলে একই ব্যথা হয়। এ কথাটাই দুই বোন বোঝে না। আর, এ কথা ওদের বোঝাওনি, তুমি !’

‘আমি ?’  

‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি। তুমি দু'জনের মনে একে অপরের জন্য ঈর্ষা তৈরি করেছ। অথচ তুমি ওদের মিলেমিশে থাকা দেখতে চাও, এমন ভান করেছ। এইভাবে ওদের চোখে ভাল থাকতে চেয়েছ। তুমি চাও ওরা প্রতিযোগিতা করুক। ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা থাকলে ওরা তোমাকে পাত্তা দেবে। তুমি আসলে মনে মনে চাও তোমার ওপর নির্ভর করবে ওরা। বহ্নি, শিখার মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকলে সেটা সুবিধে। এ বড় সূক্ষ্ম খেলা। শিখা সেইদিন একটা গল্পে লিখল এই সমস্ত।’ 

‘ কী? শিখা লিখল? সাহস তো কম নয় ওর ! ’

‘চেঁচিও না। চেঁচালেই সত্যিটা মিথ্যে আর মিথ্যেটা সত্যি হয়ে যায় না। সারাজীবন আমাকে দাবিয়ে রেখেছিলে এইভাবে গলাবাজি করে। মেয়েদের সঙ্গে পারছ? পারবে না। পারার চেষ্টাও কোরো না। বয়স হয়েছে। এই তো চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। বহ্নি পড়িমরি করে দৌড়ে এসে ধরল। ওরা না থাকলে কী গতি হত তোমার ? ভেবেছ? জীবনে জন লাগে। একা তো রাস্তার কুকুর বেড়ালও থাকতে পারে। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার জন্যই মানুষ তৈরি করেছেন ঈশ্বর। কবে যে এই সাংসারিক বোধ তৈরি হবে তোমার !’

‘ শেষ বয়সে এসে আর হবে না। এটুকু বলতে পারি। তুমি এখন যাও। যাও বলছি।’

‘ আমার যাওয়া আসা তোমার হাতে আর নেই। আমার বহ্নি আমার শিখা। আমার প্রাণ।এই বলে গেলাম।’

 

এর পর বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। হাসপাতালের লোক বহ্নির ঘরে এসে মাথার ড্রেসিং পাল্টে যায়। অ্যান্টিবায়ওটিকের কোর্স প্রায় শেষ হতে চলল। ব্যথার ওষুধ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শৈলী, সৌভিক মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায়। বহ্নির সঙ্গে বসে আজ সকালে চা খাচ্ছি। ও শান্ত গলায় বলল ,‘ শিখা আসছে। পরশুদিন। কত বছর পর রুনাই আর ঋভুকে দেখব।’

দুই বোনের মিটমাট হয়ে গিয়েছে, তা হলে। এ কথা আগেও একদিন শুনেছি, বহ্নির মুখে। ভালই তো ! আমারও আনন্দ। প্রকাশ করি না। ভালবাসা প্রকাশ করলে মানুষ দুর্বল ভাবে, বুঝলেন।

‘ আর ভালবাসা প্রকাশ না করলে? সবল? এই আশি পেরিয়ে সবল হওয়ার শখ জন্মাল, নাকি?’

কী আশ্চর্য ! সাত সকালে মালবিকার গলা কোথা থেকে?

‘ এই যে। আমি এইদিকে। বলেছি না। আমার যাওয়া আসা আমার হাতে। তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই। যে কথা বলতে এলাম। দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। এইবার ক্ষান্ত হও। আমার বহ্নি-শিখা প্রয়োজনে আগুন জ্বালতে পারে। যে আগুন আলো ছড়ায়। সেই আগুন পুড়িয়ে দেয় না। মিলেমিশে থাকুক দুইজন। তুমি বাপু আর ঘোঁট পাকিও না। অনেক হল। পরশু পিতৃ দিবস। দুই মেয়ে পাশে থাক। একে ওর নামে ওকে এর নামে, পাড়াপ্রতিবেশীকে মেয়েদের নামে আষাঢ়ে গল্প বলে বলে লোক হাসানো–এগুলো আর তোমাকে মানায় না। বুঝলে? টাকা, পয়সা, ক্রোধ, অহংকার, আদান প্রদান, ক্ষোভ, দুঃখ, ঘৃণা - কিছুই নিয়ে মরে না মানুষ। যেটা থেকে যায় সেটা হল ভালবাসা। সেটাই অমূল্য।’

 

পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে গান,‘ সদা দীপ্ত রহে…. ’। বহ্নি কখন যেন রেওয়াজ করতে উঠে চলে গিয়েছে। আহা ! আজ বেশ গাইছে। এই, এই কথাটাই তো মালবিকাকে বলা হল না। আমি তো এই টুকুই চাই, চেয়েছি এতকাল। আমার সন্তান দুটি যেন, সদা দীপ্ত রহে। আনন্দধারা ….

‘তোমার চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ ভুল।’ ওই তো ওই তো মালবিকা।

‘ কী বললে? ভুল? আমার বহিঃপ্রকাশ ভুল? ঠিক কী তবে? বলে যাও...বলে যাও বলছি। কী হল? থামো। যাবে না। যাবে না। যাবে না, বলছি ! কোথায় গেলে ?’

‘ বললাম না, আমার যাওয়া আসা তোমার হাতে নেই আর…’

 হা হা হা ! খুব জোরে হাসতে হাসতে মালবিকা চলে গেল। ফের কবে ফিরবে, কে জানে ! মাথা ফেটে যাওয়ার কয়েক দিন আগেই চোখের ছানি অপারেশন করলাম। কী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তার পর থেকে। কিন্তু, এখন, এখন...এই মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে গেল কেন চোখটা? কোথায় গেলে মালবিকা। এসো, এসো বলছি। আর কত অপেক্ষা বাকি আমার জীবনে মালবিকা ? বলতে পারবে?

0 Comments

Post Comment