পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কবিতা কুকুর ও জানালার কাচ

  • 19 November, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 973 view(s)
  • লিখেছেন : কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
সরনায়েকের বাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতে কবিতা বলল," কুকুরটার এবার একটা কিছু করা উচিত"। রাস্তা উঁচু-নিচু, জায়গায় জায়গায় ইটের টুকরো, খোয়া নাক উঁচিয়ে আছে। ঠোক্কর খেলে নখ উড়ে যেতে পারে,মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেও পারি। গত শনিবার পড়ে গেছিলাম প্রায়। কবিতাই আমায় ধরে ফেলে।

শক্ত হাতে হেঁচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দেয়। বলে,  "একটু দেখেও চলতে পারো না"! আবার কবিতা বলে, "কুকুরটাকে একটা ভালো রকম শাস্তি দিতে হবে যাতে আর এরকম অসভ্যতা না করে"। আমি গর্ত বাঁচিয়ে পা ফেলি। উত্তর দিয়ে উঠতে পারি না। হঠাৎ কবিতা আমার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেয় "কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছ না কেন, তোমার কি মনে হয় কুকুরটা ঠিক কাজ করে"? আমি বোঝাতে চেষ্টা করি যে, উত্তর দিতে পারছি না কারণ রাস্তাটা খারাপ। আর আমি অবশ্যই মনে করি কুকুরটা শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু কবিতা এত রেগে গেছে যে বুঝতেই চায় না। উল্টে বলে, "আসলে কুকুরটা এসে যখন আমার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে শোঁকে, তখন তুমিও মজা পাও। আর তোমার বসটা অসভ্যের মতো দাঁত বার করে হাসে। আমি বলি, "কিন্তু কুকুরদের ওরকম শোকার তো একটা স্বভাব আছেই।
আর ওরা তো অত ভদ্রতা অভদ্রতা বোঝেনা"। কবিতা বলে," কুকুরটা নয়, শোনো সরনায়েক যে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, সেটা বুঝে অসভ্যতা নয়!" আমি কবিতাকে এক মিনিট দাঁড়াতে বলে সরনায়েকের বাড়ির দিকে হাঁটা দিই। কবিতা পিছন থেকে চেঁচায়, "এই শোনো পাগলের মত কি করছো? তুমি আবার তাকে কিছু বলবে নাকি, এই পাগলামি করো না। উনি কি ভাববেন বলতো"! আমি চেঁচিয়ে উত্তর দিই, "আমি শুধু কুকুরটাকে বলতে চললাম"। সরনায়েকের  বাংলোর বাইরে দাঁড়িয়ে একটা ঢিল তুলে ওর ড্রয়িং রুমের কাঁচের জানলাটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ি। ঝন ঝন করে কাচ ভেঙে পড়ে। আর পরক্ষণেই হাউ হাউ করে দাঁত বের করে তেড়ে আসে সরনায়েক। আমি নির্বিকার ভাবে দ্বিতীয় ঢিল টা ছুঁড়ি। আরো একটা কাচ ভেঙে পড়ে। সরনায়েক উজবুকের মত দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে। আমি তৃতীয় ঢিলটার দিকে হাত বাড়াই ।

 

 


তারপর থেকে কবিতা একটু বেশি চুপচাপ। আমিও আর বেশি ঘাটাই না। ইতিমধ্যে আমি অন্য বিভাগে স্থানান্তরিত।  সরনায়েক আমাকে ডেকে বলেছে যে, ইচ্ছে করলেই আমার সম্পর্কে ডিসিপ্লিনারি কমিটিকে সে জানাতে পারতো, কিন্তু কবিতার মুখ চেয়ে  সে আমার নিশ্চিত সাসপেনশন আটকে দিয়েছে। শুধু পারচেজ বিভাগ থেকে আমার বদলি হয়েছে। আমি ইদানিং সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা অব্দি নিজের টেবিলে বসে মাথা গুঁজে কাজ করি। কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলি না। গত এক মাসে আমার ওজন পাঁচ কেজি কমেছে। কবিতা এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে কয়েকবার খুঁটিয়ে দেখেছি, আমার মাথার চুল বেশ পাতলা হয়েছে। ইতিমধ্যে কবিতা আরো একটু সুন্দর হয়েছে। হয়তো সে কম হাসে, উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু একটু বেশি যত্ন করে সাজে বলেই আমার মনে হচ্ছে। হয়তো সে আমার মতই একা বোধ করে। রাত্রে ওর পাশে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে আমি আরো একলা হয়ে যাই। কোন কোন দিন অনেক রাতে চাঁদ ওঠে, খোলা জানালা দিয়ে এক চিলতে জোৎস্না বিছানার উপর পড়ে। আমি আড়চোখে কবিতাকে দেখি, মনে হয় সে সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছে। তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। একদিন সকালে কবিতা জিজ্ঞেস করল, "আজকে তুমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে"? আমি একটু অবাক হলাম। ইদানিং সে আমার অফিস সংক্রান্ত কোনো কথাই বলে না। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো, ইদানিং কয়েকটা কুকুর বাড়ির মধ্যে যখন তখন ঢুকে পড়ে। বাইরের বারান্দায় গ্রিল লাগাতে হবে। আর ঘরে জানালায় কাচ। নইলে ধুলো ঢুকে ঘরের সব ফার্নিচার খারাপ হয়ে যাবে। আমি একবার বলতে গেলাম যে মাসের শেষে এইসব বাড়তি খরচ করা মুশকিল, কিন্তু কবিতা এসব কথা কানে তুলল না। অতঃপর অফিস থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ড লোন নিয়ে আমি গ্রিল লাগানোর উদ্যোগ নিলাম। জানালায় কাচও লাগানো হলো। একদিন অফিস থেকে ফিরতে খুব দেরি হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখলাম জানালার কাচ বন্ধ করে কবিতা দাঁড়িয়ে আছে। শার্সিতে তার প্রতিবিম্ব কেঁপে কেঁপে উঠছে। বারান্দার বাইরে অনেকগুলো কুকুর। আমার হাতের কাছে এখন একটাও ঢিল নেই।

0 Comments

Post Comment