বি.টেক ফাইনাল ইয়ার চলছে আমার, ক্যাম্পাসিং নিয়ে বেশ একটু চাপেই আছি। যদিও একথা শুনলে সহপাঠীরা মুখ বেঁকিয়ে বলে – " ঢঙ যত ! তোর আবার চাকরির দরকার কি! কলকাতা শহরে তিন তিনটে বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স উপচোচ্ছে, উত্তরাধিকার সূত্রে যা পাবি তাতেই তোর আর তোর পরের দুটো জেনারেশনের চলে যাবে !"
অভিষেক বচ্চন বা রোহন গাভাস্করের জীবনটা যতটা মসৃণ আমরা ভাবি ততোটাও হয়ত না – এখন ভালোই বুঝি সেটা ! পরিবারের মানুষের ওভার এক্সপেকটেশন, প্রতি মুহূর্তে চূড়ান্ত সফল বাবা বা দাদার সাথে তুলনা যেমন থাকে, তেমনি " ইস! ডক্টর উজ্জ্বল বসুর মেয়ে হয়ে সরকারি কলেজে চান্স পেলি না!", "অবশ্য, তোর তো চাকরি না করলেও চলে" ইত্যাদি গা জ্বালানো কমেন্টও সহ্য করতে হয়। ডাক্তার বাবা বা দাদার মত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট না হলেও আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, উপার্জন করতে চাই। বাবার শো-পিস মেয়ে বা বড়োলোকের পুতুল পুতুল বউ হয়ে জীবনে তেমন কোন সার্থকতা নেই এতদিনে বুঝে গেছি। এই যে আমার গাড়িটা কলেজে ঢুকতেই কয়েক জোড়া চোখ আমাকে অনুসরণ করে বা আমার সাথে কথা বলার জন্য ছেলেদের মধ্যে কম্পিটিশন হয়, কেন? বাবার টাকা, রূপ, বাহ্যিক ঠাটবাট না থাকলে এদের মধ্যে কি এমন পাগলামী থাকত?
অন্যদিনের মত আজও কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে সায়ন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা একসাথে ক্লাসে যাই, পাশাপাশি বসি, টিফিন ভাগ করে খাই, নোটস শেয়ার করি! গোটা কলেজে ও আমার একমাত্র ভালো বন্ধু। কারণ ও আমাকে সমীহ করে চলে না, অবলীলায় আমার মাথায় চাঁটি মারতে পারে, কারণে অকারণে আমাকে গরু, গাধা, ছাগল বলে । শুধু আমার জন্য যে আমার পাশে থাকতে চায় তাকেই বন্ধু ভাবা যায়, তাই না?
কিন্ত, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। বেশ কিছুদিন হল লক্ষ্য করছি সায়নের চোখমুখের ভাষা, কথা বলার ধরন পাল্টাচ্ছে! আমার কোনোদিন কলেজ আসতে দেরী হলে ছটফট করছে, আমি অন্য কোন ছেলের সাথে কথা বললে রাগ হচ্ছে ওর, আমার জ্বর হলে টেনশন করছে। এসব কেন? বন্ধুত্ব আর প্রেমের বর্ডারলাইনটা কি ভেঙে ফেলতে চাইছে ও? কারোর সাথে ডমিনোজে পিজ্জা খেতে গেলে বা হোলনাইট ঠাকুর দেখলেই কি তার প্রেমিকা হওয়া যায়? দু একবার মনের ফ্রেমে কল্পনা করার চেষ্টা করেছি, মাঝরাতে পার্বত্য উপত্যকায় সায়ন আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে! কিন্ত কেন জানি না, প্রতিবারই উচ্ছের থেকেও তিতো হয়ে গেছে মন। নাহ, ওর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা হয়তো দেওয়া যায়, কিন্ত ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারব না আমি কোনোদিন।
সায়ন তো এত ভালো ছেলে, তবু কেন ওকে ভালোবাসতে পারি না আমি?
২
আমাদের ড্রাইভার বিমলদা ছুটি নিয়েছে আজ। ক্যাবে কলেজ চলে গেলেই ঝামেলা মিটে যেত। কিন্ত গ্যারেজে পিকক ব্লু ইনোভাটার দিকে তাকাতেই আমার শরীরের প্রতিটা রক্তকণা ছটফট করা শুরু করল। মনের মধ্যের দৈত্যটা ফিসফিস করে বললো – " চল, নিয়ম ভাঙি!" বিমলদার থেকেই ড্রাইভিং এর প্রাথমিক পাঠ নেওয়া আমার। নিউটাউনে গিয়ে মাঝে মাঝে সাঁ সাঁ করে গাড়ি ছোটাই, যদিও পাশের সিটে দাদা বসে থাকে। লাইসেন্স হয়নি যে এখনো আমার!
"আজ কুছ তুফানি করতে হ্যায়" মেজাজে গাড়িটা নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম, অবশ্যই বাবা-মাকে না জানিয়ে। বাইপাসে মাখনের মত চালানোর পর মেজাজ আরো শরিফ হয়ে গেল, ঝড়ের মত ফ্লাইওভার পেরিয়ে অরিজিৎ সিংয়ের গানের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে প্রায় যখন মেরে এনেছি তখনই অঘটনটা ঘটলো। পার্ক সার্কাস সিগন্যালের কাছে এসে রাস্তায় পুঁটি আছে কিনা চোখ বোলাতে গেছিলাম, হঠাৎই ছন্দপতন! দোষটা ওভার-কনফিডেন্সের নাকি অকস্মাৎ অন্যমনস্কতার জানি না। দুম করে ব্রেক কষলাম। একটুর জন্য সামনের গাড়ির নম্বর প্লেটটা চুরমার হতে হতে বেঁচে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই রে রে করে ছুটে এসেছে ট্রাফিক পুলিশ।
"গাড়িটা সাইড করুন, লাইসেন্স দেখি !"
একুশ বছরের আমি ভয়ে কাঁপছি তখন। কেস দেবে নাকি আমাকে? যদি থানা থেকে গাড়ি ছাড়াতে হয়? এক পলকের জন্য বাবার রাশভারী মুখটা মনে পড়লো। শেষ আমি! চরম দুঃখ আছে কপালে ! "সরি কাকু, ভুল হয়ে গেছে, এবারটার মত মাফ করে দিন, আর হবে না।" বারবার এসব বলেও যখন কোন লাভ হচ্ছে না, পুলিশকাকু বাবার নম্বর চাইছে, আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছি, ঠিক তখনই কাঁধের কাছে একটা ভরসার হাত, পুঁটি।
–" এই, কি হয়েছে রে?" টেনে টেনে বলে পুঁটি।
পুলিশকাকু একটা বিচিত্র মুখভঙ্গি করে মাটিতে থুতু ফেলে।
–" হিজড়েটা আবার এর মধ্যে আসছে কেন? যা, ভাগ শালী!"
পুঁটির মধ্যে কোন তাপ উত্তাপ দেখা যায় না। এরকম ব্যবহারেই হয়ত ও অভ্যস্ত! পুলিশকাকুকে একপাশে ডেকে কি সব গুজগুজ ফিসফিস করে, তারপর ব্লাউজের মধ্যে থেকে টাকা বার করে দেয় কাকুর হাতে।
" যা, ভাগিয়ে দিয়েছি মালটাকে, লাইন ক্লিয়ার!"
সামনে এসে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলে পুঁটি। সাড়ে তিন বছরের আলাপে এই আমাদের প্রথম কথোপকথন!
–" তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব! আর ইয়ে, মানে বলছিলাম যে কত টাকা দিলে কাকাকে?"
পুঁটি ঘাড় নাড়ায়, কিছুতেই টাকা নেবে না আমার থেকে। অনেক জোরাজুরি করার পরও টাকার অ্যামাউন্ট বললো না। শেষে ওর কাছে ঋণী থাকতে হবে আমায়?
–" ব্রেকফাস্টের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি জানো! বিরিয়ানী খেতে ইচ্ছা করছে সামনের দোকানটার থেকে। খাবে তুমি?"
পুঁটি বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকায়। সারাজীবন ঘেন্না, অপমান, কুমন্তব্যের সাথে যে সহবাস করে এসেছে, এটুকু ভালো ব্যবহারও তার কাছে অপ্রত্যাশিত মনে হয় হয়ত! যে পুঁটির মুখে কথার ফোয়ারা ফোটে, মুড়ি মুড়কির মত খিস্তি বেরোয়, তারও জিভের ডগা থেকে শব্দরা হারিয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য।
সেদিন বিরিয়ানী খেতে খেতে অনেক কথা হয় ওর সাথে। পুঁটি শরীরে ছেলে মনে মেয়ে, বাপে-মায়ে তাড়ানো, মাধ্যমিক পাস! যদিও উচ্চশিক্ষা হয়নি বলে পুঁটির দুঃখ নেই, লেখাপড়া ওর কোনকালেই ভালো লাগত না নাকি! ওর শখ নাচ, ভালো শিক্ষকের কাছে নাচ শিখে নৃত্যশিল্পী হতে চায় নাকি ও, কিন্ত উপায় কোথায়?
–" এইভাবে হাতে তালি দিয়ে আর গাড়ি থেকে টাকা তুলে জীবন কাটিয়ে দেবে তুমি? সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারো তো। "
সেদিন আরো কতকিছু বলেছিলাম ওকে। ওই বয়সের অপরিণত মন এটুকু বোঝেনি যে আমার জীবনের একশো ভাগের এক ভাগ মসৃণতাও পুঁটির নেই। অপারেশনের খরচ বা কষ্ট সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকা না সত্ত্বেও ক্রমাগত ভুলভাল মন্তব্য করে গেছিলাম আমি। পুঁটি প্রতিবাদ করেনি। আমার কথা চুপ করে শুনেছিল আর হেসেছিল শুধু। অট্টহাসি নয়, জোর করে মুখে ফুটিয়ে তোলা মলিন হাসি। ওর হাসির মধ্যে কোথাও কি লুকিয়েছিল চাপা কান্না?
৩
ঢেউ আসে ঢেউ যায়। তারপর ঝড়ের গতিতে কেটে গেছে বারোটা বছর। ক্যাম্পাসিং এর পর চাকরি সূত্রে আমি আর সায়ন দুজনেই মুম্বাই শিফট করেছিলাম। কিছু বছর পর বিয়ে করে ঘর বাঁধি আমরা। এই ক বছরে একদিনের জন্যেও মনে পড়েনি পুঁটিকে। পার্ক সার্কাসের এক হিজড়েকে আমি ভুলে যাব এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?
নাহ, সায়নের মধ্যে আমার পাগলপারা, বাঁধনহারা প্রেমিককে খুঁজে পাইনি কোনোদিন। এত বছরের বন্ধুত্বে ওর প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গিয়েছিল আমার, সেই মায়াকেই প্রেম ভেবে দাম্পত্য সাজাতে গিয়েছিলাম, ভুল করেছিলাম ! সায়ন বড়ই ক্যালকুলেটেড, নিয়মে বাঁধা! ওর সাথে একসাথে দেওয়ালের রঙের শেড পছন্দ করা যায়, ট্যুর প্ল্যান করা যায়,কিন্ত সমুদ্রতটে মাঝরাতে বালি মেখে দস্যু দামাল আদর করা যায় না। তবুও একসাথে থাকতে থাকতে একটা নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরী হয় আমাদের, জোড়াতালি দিয়ে ভালোবাসাহীনতার ফাঁক-ফোকরকে ঢেকে একসাথে টিকে থাকার চেষ্টা করে চলি আমরা, প্রতিনিয়ত।আড়ষ্ট বিছানাকে সাক্ষী রেখেই কেটে যায় অনেকগুলো বছর। সায়ন অভিযোগ করে আমি কোল্ড, কোন পুরুষকে সুখ দিতে সক্ষম নই, ইত্যাদি। আমি চুপচাপ শুনে যাই বিনা প্রতিবাদে।
সায়নকে ভুল প্রমাণ করে দেয় অংশুমান। ছয় ফুট লম্বা, উস্কোখুস্কো চুল, চাপদাড়ি, গভীর চোখ, লোমশ শরীর – অংশু আমার সেই স্বপ্নে দেখা পুরুষ। ওর স্পর্শ আমার মধ্যে নিভে থাকা সবকটা আলো জ্বালিয়ে দেয় একসাথে। ভেসে যাই আমি। অংশুকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে মশগুল আমি সায়নের কাছে বিবাহবিচ্ছেদ চাই, ও বিনা প্রতিবাদে সরে যায় আমার জীবন থেকে। অংশুর বুকে আমি যখন খুঁজছি আশ্রয়ের দ্বীপ, চোখের পলকে অচেনা হয়ে যায় আমার প্রেমিক। আমার শরীরের প্রতি ওর আকর্ষণ কমে গেছে ততদিনে। একদিন মুখের উপর বলেই দেয় যে ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না। চুরমার হয়ে যাই আমি। অসহ্য লাগে জীবন, অসহ্য লাগে মুম্বাই। হয়তো নিজের থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যই কলকাতা ফিরে আসি।
মেয়েদের জীবনের প্রথম পঁচিশ-তিরিশ বছরের পর এতদিন ভাবা নিজের বাড়িটা 'বাপের বাড়ি' হয়ে যায়। কোথায় আগের মত সেই প্যাম্পারিং, মাথায় তুলে রাখা? বরং প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হয় আমি অনাকাঙ্খিত, শুনতে হয় নিজের দোষে নিজের জীবনটা শেষ করেছি। দাদা, দাদার বউ প্রথমে হাবেভাবে, পরে সরাসরিই বুঝিয়ে দেয় আমার এখানে থাকা ওদের পছন্দ নয়। বড় অসহায় লাগে আমার, মনোবিদের কাছে যাই, মুঠো মুঠো অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট খাই। এই কি আমার নিয়তি? ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া?
মনের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে থাকা এমনি একদিনে খবরের কাগজের ছয় নম্বর পাতায় একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে আমার। "প্রজাপতি" নৃত্যসংস্থার আয়োজনে রবীন্দ্রসদনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পরিচালনায় এক রূপান্তরিত নারী, নাম পাপড়ি। খুব চেনা চেনা লাগে পাপড়ির মুখটা। নেহাত কৌতূহলের বশেই গুগুল করে দেখি আমার অনুমানই ঠিক। এ যে সেই পুঁটি! আজ সে সেক্স চেঞ্জ করে পাপড়ি হয়েছে, তৈরী করেছে নিজের ডান্স গ্রূপ, শহর কলকাতার বুকে দাপিয়ে প্রোগ্রাম করে বেড়াচ্ছে, মাথা উঁচু করে সংবাদমাধ্যমকে ইন্টারভিউ দিচ্ছে। ইন্টারনেটে পুঁটির সাকসেস স্টোরি পড়তে পড়তে আমার মনের মেঘগুলো কেমন দূরে সরে যায়।
পার্ক সার্কাসের হাতে তালি মারা জীবন থেকে যদি পুঁটি পাপড়ি হতে পারে, আমিও বা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব না কেন?
৪
পুঁটির স্ট্রাগল আমাকে মোটিভেশন জোগায়। লোন নিয়ে দু কামরার একটা ফ্ল্যাট কিনি আমি, একা থাকি। অফিসের কর্মব্যস্ততার পরও প্যাম্পার করি নিজেকে। ফুলদানিতে গোলাপ সাজাই, রবিবার বিকেলে নিজেই নিজেকে কিনে দি মুক্তোর দুল, সোলো ট্রিপ করি। যখন খুব কান্না পায়, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলি –" তোর কেউ নেই তো কি হয়েছে পাগলী, আমি তো আছি! আমি তোকে খুব ভালোবাসি।"
পুঁটির নাচের অনুষ্ঠানগুলো প্রায়ই দেখতে যাই আমি, ভালো লাগে। যদিও ব্যাকস্টেজে ওর মুখোমুখি হইনা কখনো, পালিয়ে আসি চোরের মত। বারো বছর আগে পুঁটির চোখে আমি ছিলাম রূপকথার রাজকন্যা, আজ এই ভাঙাচোরা ডিভোর্সিকে দেখলে ওর মন থেকে সেই রাজকন্যার ছবি হারিয়ে যাবে যে! তার থেকে এই ভালো!
কিন্ত আমার এই লুকোচুরি খেলা বেশিদিন চললো না। একদিন ধরা পড়েই গেলাম পুঁটির কাছে।
–" আরে-এ-এ-এ-এ দিদি, কেমন আছ?" ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ও। স্বভাবটা ঠিক আগের মতই আছে ওর, প্রাণবন্ত, মুখে এক গাল হাসি, পজিটিভিটিতে ভরপুর। আমাকে একপ্রকার টানতে টানতেই ও নিয়ে যায় মেকআপ রুমে, ওর গ্রূপের বাকিদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। নিউজ চ্যানেল থেকে এসেছে পুঁটির সাথে কথা বলতে, ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে সাফল্যের আনন্দরা উপচে পড়ে ওর চোখের মণি বেয়ে। গুটি গুটি পায়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলাম, কিন্ত ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়া কি এতোই সোজা? কাছে এসে বললো –
" তোমাকে যেতে দিচ্ছে কে এখন? কত কথা জমে আছে! পনেরোটা মিনিট দাও আমায়, তারপর বিরিয়ানী খেতে যাব কেমন? এবার কিন্ত আমার ট্রিট!"
-" বলছি ইয়ে, এই অসময়ে এত ভারী খাবার আর শরীর নিতে পারে না গো।"
-" আচ্ছা বেশ, চলো কফি খাওয়া যাক তবে। "
নামী কফিশপের দামী টেবিলে কোল্ড কফি সহযোগে আড্ডা চলে আমাদের। আগের মতই একটানা বকমবকম করে যায় পুঁটি। কথার মাঝে হঠাৎই টেবিলে রাখা আমার মোবাইলটা হাতে নিয়ে কভারটার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে ও। লাল বেনারসী, এক মাথা সিঁদুর আর গা ভর্তি গয়না পরা এই ছবিটা আমার বড় প্রিয় ছিল – তাই ছবিটাকে প্রিন্ট করে মোবাইলের কভার করেছিলাম। ডিভোর্সের পরেও কেন জানি না, কভারটা ফেলে দিতে পারিনি, শত ব্যস্ততার মাঝেও এই লাল টুকটুকে ঝকঝকে হাসি হাসতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায় আমার।
" কত সুন্দর তুমি, যেমন সামনাসামনি তেমনি ছবিতে! চোখ ফেরানো যায় না! আসল আর নকলের তো একটা পার্থক্য থেকেই যায়, তাই না?" দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুঁটি। ওর গলায় ঈর্ষা না, কেমন যেন অপূর্ণতা আর বিষাদ লেগে থাকে।
" এই যে তুমি এত সুন্দর করে জীবনটা সাজিয়ে নিয়েছ, কজন এমন পারে বলোতো? আমার খুব গর্ব হয় তোমাকে নিয়ে।"
আমার কথা শুনে পুঁটি ম্লান হাসে। ওর চোখে এক মুহূর্তের জন্য উচ্ছাস উঁকি দিয়েও মিলিয়ে যায়।
"দিদি, যতই সফল হই আর যাই হই না কেন, দুনিয়াটা বড়ই কঠিন। রূপান্তরিত নারীকে কেউই নারীর মর্যাদা দেয় না। আমাদের ব্রাকেটে রাখা হয় গো, আমরা নিষিদ্ধ, আমাদের আপনার মানুষ বলে কেউ থাকে না গো।"
আমি চুপ করে শুনি ওর কথা, মধু মেশানো কৃত্রিম সান্ত্বনাবাক্য বলতে ইচ্ছা করে না আমার। আমরা দুজন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা হলেও বাস্তব যে বড়ই নির্মম তা কি আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে শিখিনি?
" আগে ছিলাম শরীরে পুরুষ মনে নারী। এখন শরীরে মনে নারী হয়েও পূর্ণতা পেলাম কই দিদি? আমারও জৈবিক চাহিদা আছে, আমিও ভালোবাসার কাঙাল, কিন্ত আমার এই নকল অস্তিত্বকে, এই প্লাস্টিক শরীরকে কে ভালোবাসবে? মানুষ প্রতি মুহূর্তে গালে চড় মেরে বুঝিয়ে দেয় আসল আর নকলের তফাৎ! জানো দিদি, মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা হয় সঙ্গ করতে, বুকের মাঝটা হু হু করে! বড় শূন্যতা! সারাদিন আলোতে থাকলেও দিনের শেষে তালা খুলে যখন একা বাড়িতে ঢুকি, কোথাও একটা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকায় গো। এমন কেউ নেই যার সাথে দুটো সুখ দুঃখের কথা কইব! তুমি তো ডানাকাটা পরী, তোমাকে কত পুরুষ ভালোবাসতে চায়, সোহাগ করতে চায়, রাজরাণী করে মাথায় তুলে রাখতে চায়! এ কষ্ট তুমি বুঝবে না গো।"
বারো বছর আগে একদিন পুঁটি যেমন বিনা প্রতিবাদে আমার কথা শুনে গেছিল, আমিও চুপটি করে ওর কথা শুনি আর হাসি। আরো কিছুক্ষণ গল্প করার পর ওকে বিদায় জানিয়ে ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরি।
পুঁটিকে বলা হয় না, ডানাকাটা পরী হয়েও সঙ্গ করার পুরুষ পাইনি আমি। একজনের সাথে প্রেমহীন দাম্পত্য কাটিয়েছি, আর একজন যাকে প্রেমিক ভেবেছিলাম সে আমাকে ভোগ করার পর স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। এই ত্রিশোর্ধ্ব বিবাহবিচ্ছিনা আমিকে নিজেদের অসুখী জীবনের গল্প দিয়ে যারা প্রেম নিবেদন করতে আসে, অধিকাংশেরই ফাঁকা ফ্ল্যাটে রগরগে সময় কাটানোর লোভ, আর কিছুই না। এদের কেঁচো-কেন্নোর থেকে উন্নতমানের জীব বলে ভাবতে ঘৃণাবোধ হয় আমার। বিয়ে করতে চায় যারা, তারা চায় ডক্টর উজ্জ্বল বসুর মেয়েকে, ভালো দাঁও মারা যাবে তো, তাই! আমার জন্য আমাকে কেউ ভালোবাসে না। এদের থেকে পালাই আমি, পালাতে পালাতে একলা হয়ে যাই আমার একলা ঘরের দেশে। কেউ নেই যার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে পারি অঝোরে, যাকে মনের কথা বলে হালকা হতে পারি! দুঃখগুলোকে শুকিয়ে নিলেও মাঝেমধ্যেই ঘুমের ট্যাবলেট ছাড়া রাতগুলোতে ওরা শয়তান হয়ে ওঠে। নিকোটিনে পোড়া আমার ঠোঁটে ডার্ক শেডের লিপস্টিকও দরকার হয়না আর। পুঁটিকে বলা হয়না, সঙ্গ করার মানুষ পাওয়াটা আসল নারী বা রূপান্তরিত নারী হওয়ার উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে ভাগ্যের উপর। আমার আর পুঁটির জার্নি আলাদা হলেও কোথাও এসে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আমাদের ডেস্টিনি।
থাক, কিছু কথা না বলাই ভালো। এই যে পড়ন্তবেলায় ঝাপসা হয়ে আসা চোখ, চিনচিনে দুঃখ আর অনাহুত অতিথীর মত উঁকি মারা দু চারটে পাকাচুল – দিনের শেষে এটাই হয়ত রূঢ় বাস্তব। ভালোবাসা কল্পনার প্যাকিং বাক্সে বন্দী হয়ে মনের গুমঘরে ভালো থাকুক।