ভিটে থেকে গরু-বাছুর, আগান-বাগান, পান-সুপুরি, সব আমার। বুড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে অনেক কাল। কতকাল তা বুড়ির স্মরণে নেই। তখন মেয়ের বাবা বেঁচে ছিল, তার বাড়িতেও আম-কাঁঠালের বাগান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল, গাই-বাছুরের ডাক ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল, আর কী ছিল মনে নেই। সব বেচে খেয়েছে মেয়ের বাপ আর তার ছেলে। চিঠি নিয়ে এসেছিল সাইকেলে টিং টিং বাজিয়ে ডাক পিয়ন। লম্বা, রোগা, নাকের নিচে মাছি গোঁফ, ধুতি আর খাঁকি শার্ট। এসে হাঁক মেরেছিল, গুরুবারি দাসী বলে কেউ আছে ?
বুড়ি তখন দাওয়ায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। ভাবছিল আর মেঘের দিকে তাকিয়েছিল। তার বাড়িতে নেই কেউ। পুকুর নেই, বাগান নেই, গাই নেই, বাছুর নেই, নেই বলে তার চিন্তা নেই। আগলে রাখার কিছু নেই। দিনে দুটো ভাত ফুটিয়ে নেয়, সঙ্গে আলু বেগুন সেদ্ধ। নুন আর কয়েক ফোঁটা তেল। একবেলা ভাত আর অন্যবেলা চিড়ে-মুড়ি যা হয়। গুরুবারি দাসী তার নাম বটে, ভুলেই গেছিল একেবারে। সিড়িঙ্গে মাছি গোঁফ লোকটির কথায় তার মনে পড়ল। গুরুবারি মানে বেস্পতি বা বৃহস্পতি। বিস্যুতবারে জন্ম তাই তার নাম রেখেছিল মা বাবা। বাবার নাম মঙ্গলদাস বিশ্বাস, মায়ের নাম সোমবারি বিশ্বাস। বুড়ির স্বামীর নাম, তা বুড়ি বলবে না। কেন বলবে না, তাতে নাকি অকল্যাণ হয়। অকল্যাণ আর হবে কী, তিনি তো গত হয়েছেন, মেয়ে পুঁটুর বাবা চন্দ্রদাস হেতাল।
-ডাক পিয়ন বলল, গুরুবারি কে ?
-আমি তো জানি আমার নাম গুরুবারি ছিল। বুড়ি বলেছিল।
-ছিল, তাহলে এখন নেই, তাহলে তো হবে না।
-কী হবে না ?
-সাইকেল রেখে তাল ঢ্যাঙা লোকটি বলল, চিঠি হবে না, আমি ফেরত দিয়ে দেব ডেড লেটার অফিসে।
-সে আপিস কী আপিস ?
-যেখেনে মরা চিঠি সব রেখে দেওয়া হয়। লম্বা লোক বলল।
-মরা চিঠি কী চিঠি ?
-পিয়ন বলল, যে চিঠির দাবিদার নেই, ঠিকানা ভুল, নাম ভুল, লেখাও ভুল।
-বুড়ি গুরুবারি জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমার নাম কী ?
-আমার নাম, শ্রীযুক্ত নানুরাম বৈতাল।
-বেশ, নানুরাম, বসো, কী হয়েছে বলো ?
নানুরাম বলল, জল মিষ্টি থাকে তো দাও গুরুবারি পিসি, অনেক গাঁ ঘুরেছি, অনেক বাড়ি খুঁজেছি, তারপর যেতে যেতে মনে হলো হলদিডাঙাটা ঘুরে যাই, চিঠিটা মরা চিঠির অফিসে না পাঠানোই ভালো।
-হুঁ, ভালো করেছ। গুরুবারি বুড়ি বলেছিল।
-তাহলে একটু জল-বাতাসা দাও, অনেকটা সাইকেল চালিয়েছি, সব চিঠি দিয়ে এইটি নিয়ে ফিরছিলাম, তোমার মেয়েরে বলে দিও, ভালো করে ঠিকানা না লিখে যেন চিঠি ডাক বাক্সে ফেলে না। নানুরাম বলল।
জল আনল ঘটি করে, বাতাসা আনল বোয়েমভরে। নানুরাম ঢকঢক করে জল খায়, চিবিয়ে চিবিয়ে বাতাসা খায়, তারপর বলে, দুটাকা লাগবে গো বুড়ি মা, বেয়ারিং চিঠি, মানে স্ট্যাম্প দেয়নি খামে।
-তাহলে ওটা নিয়ে যাও। বুড়ি বলল।
-নিয়ে যাব, যাচ্ছি, কিন্তু মেয়ের চিঠি বলে কথা, না নিলে তোমার পাপ হবে বুড়ি মা।
বুড়ি গুরুবারি ভাবে দুটাকা দিয়ে নেবে চিঠি, না নিলে মেয়ের কথা শুনতে পাবে না। তাই বলল, তুমি যদি পড়ে দাও তো দুটাকা দেব আমি।
নানুরামকে এই কাজ কত করতে হয়। চিঠির ভালো-মন্দ পড়ে দিয়ে কিছু পায়। খুব মন্দ খবর মানে মৃত্যু সংবাদ কিংবা জমি বিক্রির সংবাদ, পরীক্ষায় ফেল মারার সংবাদ এলে তার হয় অসুবিধে। হাতের লেখা খারাপ, পড়া যাচ্ছে না, তাই বলে রেহাই। নানুরাম খামের মুখ আগেই খুলেছে, এবার পড়বে বলে গলা খাঁকারি দিল। বুড়ি নিজের কপালে হাত ছুঁইয়ে নিল। কী আছে লেখা কে জানে ?
-নানুরাম বলল, শুনো গুরুবারি দাসীর নামে চিঠি দিয়েছে তার মেয়ে।
-পুঁটু ?
-উঁহু, পুঁটু কেন হবে, পূর্ণিমা দাসী।
-পুঁটুর নাম পুন্নিমে ?
-তুমি গুরুবারি দাসী তো ?
-হুঁ, আমি গুরুবারি, বিস্যুতবার জন্ম হয়েছিল, তাই।
-মেয়ের কি পুন্নিমের দিনে জন্ম হয়েছিল ?
-বুড়ি বলল, হ্যাঁ বাবু, মনে পড়ল, তাই ওর নাম পুন্নিমে দিয়েছিল ওর বাবা।
-সুন্দরপুর বিয়ে হয়েছিল।
-হুঁ, মনে নাই।
-মেয়ের খোঁজ নাই নাকি ?
বুড়ি বলল, তাইই, খোঁজ নাই অনেক দিন, মা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তা জানতিও চায় না।
নানুরাম বলল, আমি চিঠিটা ফেলেই দিতাম, কিন্তু কী রকম মায়া হলো, তোমার জামাইয়ের নাম ?
জামাইয়ের নাম ! মাথা নাড়তে থাকে বুড়ি, মনে নেই।
নানুরাম চুপ করে থাকে। আসল কথাটা বলবে কি বলবে না বুঝে উঠতে পারছে না। এই চিঠিটা খুব গোলমেলে। ভালো মন্দয় মেশানো। মন্দ খবরটি আবার মন্দ কি না, তা জানে না নানুরাম। মন্দ তো নিশ্চয়, কিন্তু কতটা মন্দ, তা বুঝে উঠতে পারছে না। বুড়ি জিজ্ঞেস করল, কী লিখেছে মেয়ে ?
-লিখেছে তো অনেক কিছু।
-ওর কডা ছেলে মেয়ে ?
-তুমি তা জান না ? নানুরাম অবাক হয়।
-না, একটা মেয়ের পর আর একটা মেয়ে হয়েছিল জানি। গুরুবারি বলল।
-না, চার মেয়ের পর এক ছেলে। নানুরাম বলে।
-তুমি কী করে জানলে বাপু, আমি জানিনে।
নানুরাম বলল, জানতি হয়, না জানলি কী করে আর এই কাজ করতে পারি।
গুরুবারি চুপ করে থাকে, তারপর বিড়বিড় করে বলে, দুই মেয়ের খবর পেইছিলাম, তারপর আর যোগাযোগ নাই, পত্তর করেছিলাম, জবাব পাইনি।
নানুরাম বলল, শেষ পর্যন্ত ছেলে হলো, ধন্যি জামাই, আবার ছেলে করতে গে মেয়ে, চার মেয়ের পর এক ছেলে, তারপর আবার মেয়ে, তার নাম ক্ষ্যান্ত।
বুড়ি চুপ করে শোনে, তারপর বলে, আমার এক মেয়ে এক ছেলে বেঁচেছিল, পুন্নিমে আর অষ্টম, অষ্টমীর দিনে হয়েছিল ছাওয়াল, তাই অষ্টম।
নানুরাম ঘটি উপরে তুলে হাঁ করে আবার জল খায় ঢকঢক করে। তার কন্ঠনালী দপদপ করে জলের স্পর্শে। জল দিয়ে সে মুখমন্ডল সিঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করে, মাত্তর দুইটা ?
-না, আর ছিল কডা, বাঁচে নাই, সব তো বাঁচে না বাবা। বুড়ির চোখ ছলছল করতে লাগল।
-পুন্নিমের সব বেঁচে আছে কি না লিখেনি।
-বালাই ষাট, সব বেঁচে আছে, থাকলি মহাপুণ্যি! বিড়বিড় করল গুরুবারি, কিন্তু এতগুলা মেয়ে, বিয়ে দিতিই ফতুর হয়ে যাবে দেখতিছি।
-হুঁ, সে সব কিছু লেখে নাই।
-কী লিখেছে তাহলি ?
নানুরাম বলল, লিখেছে গাই বাছুর, বাগান, ফল-ফলারি, পুকুর, মাছ, ধান, পান,সুপুরি, সব্জি, এই সব নিয়ে, তার এত আছে।
-আহা, স্বস্বামীর এত আছে, আছে দেখেই ওর বাপে বে দিছিল, আমার কিন্তু আপুত্তি ছিল।
-কেন, আপুত্তি কেন ? নানুরামের কৌতুহল হলো।
-দোজবরে, বয়সটা বেশি, আগের পক্ষ গলায় দড়ি দিছিল।
-তুমি জানলে কী করে তা ?
-মেয়ের দাদা, আমার ছেলে খবর এনেছিল।
-তবু বিয়ে দিলে ?
- ওর বাপে দিল, ধান, পান, সুপুরি, গাই বাছুর, পুকুর, মাছ…, যার এত আছে, তার এসব বদনাম হয়, আগের পক্ষর মাথা খারাপ ছিল।
বেলা ফুরিয়ে এল প্রায়। ডাক পিয়নের ফিরতে হবে অনেকটা। অন্ধকার হয়ে গেলে সাইকেল চালানো অসুবিধে হয়ে দাঁড়ায়। সে বলল, তোমার মেয়ে অনেক লিখেছে, অতটা পড়ে দিবার টায়েম নাই আমার।
- তা বললি কী করে হয়, তুমি না পড়ি দিলি পড়বে কেডা?
-আমার তো ফিরতি হবে অনেকটা, অন্ধকার হয়ি গেলি আমার দিক ভুল হয়ে যায়।
-তাহলি থেকে যাও।
নানুরাম বলল, তা কী করে হয়, আমার বউ চিন্তায় ঘুমোবে না।
-ফোন করে দাও। বুড়ি ফোকলা মুখে হাসল।
নানুরাম বলল, মুবাইল ফোনে চার্জ নেই, তোমার ঘরে কি ইলেক্টিক আছে ?
বুড়ি গুরুবারি মাথা নাড়ে। নেই। তবু সে বলল, মেয়েছেলের একা থাকা অভ্যেস করতি হয়, আমারে রেখে আমার সোয়ামী গেল শহরে, দু-মাস ফেরে নাই, আমি ছেলে মেয়ে নিয়ে একা, দুয়ারে খিল আঁটা কিন্তু উঠনে মানষে চলে ফেরে, আমি তো ছিলাম।
-দু-মাস সে কী করতিছিল শহরে ?
-ফুত্তি, জমি বেচে গিয়েছিল শহর দেখতি, শেষে পকেট ফাঁকা হলি ফিরত এল।
-তুমি একা থাকলে দু-মাস ? নানুরাম জিজ্ঞেস করল।
-হুঁ। গুরুবারি বলল, একা থাকলাম, মাসুল দিলাম।
-কী দিলে ?
-দুইটা লোক ভর দুকুরে আমার মুখ বেঁধে পাটক্ষেতে নিয়ে ফেলল।
নানুরাম মাথা নামায়, বলল, থাক।
-ছেলে মেয়েরা ওর বাপ ফিরলে কিছুই বলেনি। গুরুবারি ম্রিয়মান কন্ঠে বলল।
- তাদের বাপ জানতি পারেনি ?
-কী জানি, জানলি আমি ঘরে থাকতি পারতাম না, তুমি চিঠির কথা বলো।
নানুরাম বলল, বলতিছি, কিন্তু তুমার সোয়ামী কি জানতি পারেনি ?
-জানলিও কিছু করার ছিল না তার, কিন্তু সে আর শহরে যায়নি, বদলে তার ছাওয়াল গেল প্রায় সব বেচেবুচে।
-নানুরাম দেখছিল ছায়া পড়ে গেছে উঠনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। বুড়িকে সে বলল, হেরিকেনের চিমনি মুছে আলো জ্বালাতে। বুড়ি বলল, আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় কাজ হবে।
-চিঠি পড়তি হবে যে। নানুরাম বলল।
-চাঁদের আলোয় ভালো পড়া হবে।
তারা অপেক্ষা করতে লাগল চন্দ্রোদয়ের। নানুরাম কোনোদিন চাঁদের আলোয় চিঠি পড়েনি। লম্প, হেরিকেন, টেমি, মোমবাতির আলোয় পড়েছে। ইলেকট্রিকে তো বটেই। লোকের চিঠি পড়তে তার ভালো লাগে। স্ত্রীর পত্র, স্বামীর পত্র, কন্যার পত্র, প্রেমিকের পত্র, প্রেমিকার পত্রও। বুড়ি তার মেয়ে পূর্ণিমার কথা বলতে লাগল। কী আশ্চর্য! আজই পূর্ণিমা। আজই তার চিঠি নিয়ে সে এসেছে এই ভিটেয়। বুড়িও বলল, তাই। মেয়ের গায়ের রঙ ছিল পূর্ণিমার মতো ? উহুঁ, পূর্ণিমায় মেঘের আড়াল ছিল। আজ মেঘ নেই তো, তাহলে কেন আর চিঠি পড়া হবে না ? নানুরাম আসলে একা মানুষ। সে প্রথমে একটু আপত্তি করে, তারপর থেকে যায় ভিটের বাইরে লোকের ঘরে। নিজের ঘরে তালা দেওয়া। আছে কী যে চোরে নেবে ? বুড়ি গুরুবারির মেয়ের চিঠি সে পড়েছে আগেই। নানুরাম বসে দেখতে লাগল চন্দ্রোদয়। চাঁদ পুব আকাশ থেকে আর একটু উঠে এলে জোছনা হবে। বুড়ি আচমকা জিজ্ঞেস করল, সে আছে কেমন ?
চমকে ওঠে নানুরাম, জিজ্ঞেস করল, কেডা, কার কথা বলতেছ গুরুবারি দাসী ?
গুরুবারি বলল, পুন্নিমে।
-তার অত আছে, সে ভালো আছে, অনেক সম্পত্তি নিয়ে আছে।
-মেয়েমানুষের কি থাকে, থাকে তার সোয়ামীর।
-তোমার কি নেই ?
-গুরুবারি জিজ্ঞেস করে, এই ভিটে ?
-হুঁ, এই ভিটে।
- সে লোক তো তার বেটার নামে লিখে দিয়ে গেছে, বেটা আমারে থাকতে দেছে।
-তোমার ছেলে তো ? নানুরাম জিজ্ঞেস করে।
-হুঁ, কিন্তু তার বাপের পুত্তুর।
- ছেলে গেছে কোথায় ?
-বনে। বলে বুড়ি গুরুবারি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, শহর বন ছাড়া কী ?
-কী যে বলো তুমি ? নানুরাম ম্লান মুখে হাসল। সে কবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আর বাপ-মার কাছে ফেরেনি। মনে পড়ল। সে অনেক দূরের পথ। রেলগাড়ি ছাড়া যাওয়া যায় না। দুটো ব্রিজ পেরুতে হয়, কত গ্রাম, ধুধু মাঠ আর হু হু বাতাস পেরিয়ে যাওয়া। গুরুবারি বলে, সে কেমন আছে ?
-বললাম তো। নানুরাম জবাব দেয়।
-কী লিখেছে ? জিজ্ঞেস করল বুড়ি।
-সব শুনবা তুমি ?
-না শোনবো তো তুমারে বললাম কেন থেকি যেতি, আমি ভাত চাপাই, তুমি উঠনে বসে চিঠি শুনাও।
-তুমি শুনতি পারবা তো ? নানুরাম জিজ্ঞেস করে।
-পারব, কেন পারব না ?
-চোখের জল ফেলবা না তো ?
-কেন ফেলব, আমার চোখে জল নেই, কী হয়েছে ? বুড়ি জিজ্ঞেস করে, বেঁচেবত্তে আছে তো ?
-তুমার মেয়ে পুন্নিমে ! কথাটা বলতে বলতে থেমে যায় নানুরাম। দেখল জোছনা ছড়িয়ে পড়ছে উঠনে। বুড়ির মেয়ে লিখেছে তার কত সম্পত্তি ! সব তার। স্বামীকে দিয়ে সে লিখিয়ে নিয়েছে। স্বামী তার ছেলের নামে দানপত্র দলিল লিখছিল। সে বলেছিল, তাকেই দিতে হবে সবটা, ছেলেকে দিলে সে দেবে। নইলে বুড়োকে ভাত রেঁধে দেবে না। সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ মানুষটির বয়স হয়েছিল। রোগে বিছানায় পড়েই থাকত প্রায়। লাঠি ছাড়া দাঁড়াতে পারত না। তখন তার বউ পূর্ণিমা শোধ নিয়েছিল। পাঁচ মেয়ের ভিতরে তিনটে বাঁচেনি। আর একটা শ্বশুর ঘরে গিয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল, যেমন দিয়েছিল তার বুড়োর প্রথম পক্ষ। সব লিখে নিয়ে সে স্বামীর উপর শোধ নিল। ভিটে বাগান পুকুর, ধান জমি, পানের বরজ, সুপুরির বন-----সব তার হয়ে যেতে, সে বুড়োকে একদিন ঘর থেকে বের করে বটতলায় রেখে এল। ভিক্ষে করে খাও। আমার কটি মেয়ের মুখে নুন ঠেসে দিয়েছিলে জন্মের পর, তা কি মনে পড়ে ?
-আহা, পুন্নিমে এমন করল! বুড়ির চোখে জল গড়াল জামাইয়ের কথা ভেবে। জামাই বিয়ে করা বউকে ঠ্যাঙাত কত। সে তো অমন হয়। তার স্বামী চন্দ্রদাস হেতাল কি শহর থেকে ফিরে তাকে পিটায়নি। তাই বলে কি তার মুখে সে জল দেয়নি শেষ সময়ে ?
-আর কি লিখেছে সব্বোনাশী মেয়ে ? বুড়ি গুরুবারি জিজ্ঞেস করে।
-লিখেছে তুমারে যেতে।
-আমি যাব কী করে ?
-নানুরাম বলল, যাবা গাঙ পেরিয়ে।
-জামাইয়ের কী হলো শেষে ? গুরুবারি বুড়ি জিজ্ঞেস করে।
-একদিন পর আর তারে দেখা যায়নি। নানুরাম বলল।
-দেখা যায়নি তো গেল কোথায় ?
-মনে হয় গাঙে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে আপদ। বলল নানুরাম।
-আপদ কারে বলতিছিস ?
-আমি বলব কেন, তুমার মেয়ে লিখেছে। বলল নানুরাম।
-আহারে, মেয়ে আমার বিধবা হলো। কাঁদল গুরুবারি বুড়ি।
মাথা নাড়ে নানুরাম, বলল, না, কেন বিধবা হবে, সে পথ বন্ধ, লোকটার কোনো খোঁজ নেই, বিবাগী হয়েছে ধরে নাও, শাস্ত্রে আছে দাহ না হলি বেধবা হয় না।
-বললি যে গাঙে ডুবে মরেছে।
-বডি তো পাওয়া যায়নি, মরেচে বলে প্রমাণ নাই। বলে নানুরাম বিড়ি ধরায় খ্যাঁচাকল ঘষাঘষি করে।
-আহা, মরে আগুন পেলনি। বুড়ির চোখে জল এল।
-মরেনি এমনো হতে পারে, পালিয়েছে।
-পালিয়েছে মানে ? বুড়ি জিজ্ঞেস করে।
-নৌকোয় করে সে চলে গেছে ভিন গাঁয়ে।
-আমার বুড়ো জামাই, জামাইডারে তাড়ায়ে দিল ভিটে থেকে , হায়।
-হ্যাঁ, এমন হতি পারে সেই বিষধর আবার ফণা তুলছিল, তারে তুলে নিয়ে গাঙে ফেলে দেছে তুমার মেয়ে পুন্নিমে।
-কী বলতিছিস তুই ?
-মনে হচ্ছে তাই। নানুরাম বলল, বুড়ো তার তিনটে মেয়ের মুখে নুন দিল জন্মের পরই…...।
-আহা, আর বলিসনে। বুড়ি গুরুবারি আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোণ মুছল। দেখল কত জ্যোৎস্না। কত আলো। এমন এক পূর্ণিমায় তার মেয়ে জন্মেছিল। প্রথম সন্তান। স্বামীর মুখ অন্ধকার হয়েছিল। চাঁদের আলো ঢেকেছিল মেঘে। সেই মেঘ যেন উড়ে গেছে চাঁদের ত্রিসীমানা থেকে। বুড়ি জিজ্ঞেস করল, কী করে যাব মেয়ের কাছে ?
-যাবা তুমি ? জিজ্ঞেস করল নানুরাম।
-যাব, শোক পেয়েছে, সোয়ামী অমন করে গেল! বিড়বিড় করে বুড়ি।
নানুরাম বলল, তুমার মেয়ের চিঠি পড়ে আমি অবাক হইছি, যারে বলি, সে বলে, সত্যি না।
-তাহলে কি মিথ্যে লিখেছে ?
-মিথ্যে হলিও সত্যি। বলল নানুরাম, যাও তুমি গাঙের ওপার।
-গাঁয়ের নাম ?
-সুন্দরপুর। জবাব দিল নানুরাম।
-কোন পাড়া ?
-দক্ষিণ পাড়া।
-কার ঘর ?
-পুন্নিমে রায়ের ঘর। নানুরামের যেন সব মুখস্ত।
-তার নামে ভিটে ?
-হ্যাঁ, তার নামে ভিটে, স্থাবর অস্থাবর, সব। নানুরাম উঠল। যেমন আলো হয়েছে চাঁদের সে যেতে পারবে অনায়াসে। টিংটিং বাজালো সাইকেলের ঘন্টি। যেমন এসেছিল হঠাৎ বিকেলের আগে, তেমনি চলে গেল হঠাৎ জ্যোৎস্না ভেদ করে। তার যা বলার ছিল, বলে গেল। বুড়ি ঝিম মেরে বসে থাকে। বুঝতে পারে না, কথাগুলো সত্যি না মিথ্যে? মিথ্যে দিয়ে সত্যি ঢাকল ডাক পিয়ন নাকি সত্যি দিয়ে মিথ্যে? চিঠিটা গেল কোথায় ? দিয়ে তো যায়নি। তাহলে চিঠি কি সত্যিই এসেছিল ? তবু সুন্দরপুর যাবে বলে, পরদিন সে গাঙ পাড়ে চলল। পুটুলি বগলে। পাড়ে গিয়ে বসে থাকল। গাঙ পার হওয়া তার ইচ্ছেয় ঘটবে না। খেয়ার মাঝি কোথায় ? গাঙের ঢেউ দেখতে লাগল বুড়ি। এই গাঙে ডুব দিয়েছে তার জামাই। যদি না মরে মাথা তোলে আবার ? পুরুষ মানুষ তো। ভয় করে।
সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত।