ক্ষীরসার মতো পরত যার এই সাধারণ মিলের চেয়ে হিম ও সাগরেরকনট্রাস্টিং মিলমিশ অ্যাপিলিং ঠেকে। যদিও এখান থেকে হিম ও সাগর দুই-ই বহু দূর। যাই হোক গল্প থেকে আমি সরে যাচ্ছি। গল্পে ফিরে আসি। এখানে খুব কমন প্র্যাকটিস লোকের নামে আম গাছ। লোকের নামে কি খালি? ঘটনা, মিথ, এইসবও জড়িয়ে থাকতো। হ্যাঁ, একটা কমন ক্রাইটেরিয়া অবশ্যই রয়েছে যা ফলো করা হয় এইসব নামটাম দেওয়া-টেওয়ায় সময়। সেইটা কী যেন… ও হ্যাঁ কলম না করে আমের গুঠি থেকে এই গাছগুলো হয়। বেশিরভাগ এমন গাছই হয় মরে যায়, নইলে বাঁদর খাওয়ার অযোগ্য আম ফলায়। খুব অ্যামিউজিং নাম হয় এইসব অখাদ্য আমের গাছের। গিধড়-কটকট। শেয়াল এই আম খেয়ে ফেললে সেই বাগানের চারপাশ আর মাড়াতো না। ফলে অখাদ্য হলেও গিধড়-কটকটের ইউটিলিটি ছিল। কিন্ত ভূদ্দোল গুঠঠির অ্যাস সাচ সেভাবে কোনো ইউটিলিটি ছিল না। ভূদ্দোল গুঠঠির গল্প শুনবে? আচ্ছা শোনো। ঠাকুমার কাছ থেকে শুনেছিলাম গল্পটা। আমার ঠাকুমা তখন ঠাকুরমার মায়ের উম্বে। কাঠের চুলা জ্বলছে। খড়িতে জাড়ের সাঁঝের আগের ওম। চাকতা-বেলনায় রুটি বেলছে একটা ভারী শরীর । একটু দূরে বঁড়শিতে কাঠকয়লা দিয়ে পা সেঁকতে সেঁকতে আফিম টানছে তার শাশুড়ি। আমার ঠাকুমার নাম জোছনবালা, হ্যাঁ… উম্বে যখন ছিল তখনই ডিসাইড হয়ে গিয়েছিল এক্স ওয়াই হলে জোছন , এক্স এক্স হলে জোছনবালা। তা জোছনবালার উড-বি ঠাকুমা আফিমগভীর চোখে জলের গলায় বলে উঠলো, “ হদদ্যাখজোছনকা মাঈ! পেড়মেভূতদোলখাতিছেও!” একজন আফিমজ্ঞানীকে পাত্তা না দেওয়ার ফল খানিক বাদেই বুঝেছিল আমার ঠাকুমার মা। সবে চল্লিশটা রুটি হয়েছে আর পাঁচ-ছবার আফিম গলায় “পেড়েমে ভূত দোল খাতিছেও!” … পিছন থেকে বছরের পর বছর আম গাছের শিকড়ে লেগে থাকা মাটির মতো গলায় কে যেন বলে উঠলো, “ইঃ! পেড়মেভূতদোলখাতিছেও! উদিনকাছুকড়ি! যাইকরআপনেপুতাহুকাসাথরোটিবেলেমেলাগ ”। পুতাহু মিনস ডটার ইন ল। ভূতের দোল থেকে সময় শ্যাওলা মিশতে মিশতে ভূদ্দোল। কী বলছো? আগেও বলেছি গল্পটা? মে বি হতে পারে। গল্প তো সেই ঘুরে ফিরে এক। যাই হোক যা বলছিলাম আরেকটা কমন ফিচার এই প্রপার নাউনীয় গুঠঠিগুলোর এদের সাথে জুড়ে থাকা মানুষদের নাম। যেমন ধরো ধনঞ্জয় গুঠঠি, বিপিনশা গুঠঠি। জোনাগুঠঠির এমন কোনো হিস্ট্রি নেই। হিস্ট্রি থাকলে তা আমার কাছে আসতোই। আর বাগানের ওই কোণের পাশের কবরখানার পাশ দিয়ে যে রাস্তা তার পিছনে কিছু সাব-অল্টার্নদের বসতি ছিল বটে। বাট দে ওয়্যার টু মাচ কনসার্ভেটিভ। তাদের ভিতর জোনাকী নাম কেউ রাখতে পারে না। কেউ পারতেও পারে? নো। পারে না । আমি বলছি । আব্রাহামিক রিজিডিটি যে কী জিনিস তা কি আর জানো না! দেখো এই প্রাইভেট পরিসরে আমি পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার দায় বহন করব না। যারা এই জায়গা ছেড়ে গিয়েছিল তারা পাকিস্তানে যাওয়া চুজ করেছিল। চয়েস ইজ নট আ কম্পালসন লাইক দ্য আদার সাইড অফ দ্য স্টোরি। বাই চয়েস দেশ ছাড়লো, তারপর “ এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি?” করে কী মেলোড্রামা! বিলিভ মি এইটা শুধু ‘আত্মজা ও করবী গাছ’-এর মতো ফিকশনেই হয়। আমিও চাইলেই ফেলে যাওয়া আমবাগান নিয়ে নিম্নবর্গ, ইকোফেমিনিজম , মুসলমানও বুকে কষ্ট নিয়ে দেশছাড়া হয়েছিল এইসব মশলা দিয়ে একটা গপ্প ফেঁদে দিতেই পারি। একটা চলে যাওয়া মুসলমান বউ, তার ফেলে যাওয়া পরকীয়ার হিন্দু প্রেমিক এবং অবশ্যই মায়া ভরা চোখে গোডোসম অপেক্ষায় থেকে যাওয়া একটি গরু নিয়ে ছলছল নদী বইয়ে দেবো।এমন গপ্প হাসান আজিজুল হক’কে উৎসর্গকরলে কেমন হয়? এই রেগো না প্লিজ। জাস্ট ব্ল্যাক হিউমার। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। ঠিক আছে, নো মোর ফান। কিন্তু গপ্প বাদ দিয়ে রিয়ালিটি যদি কনসিডার করিএইসব এলিমেন্টের নামে স্মৃতি এই দেশে রাখবে কে! রাখবেই বা কেন! আর সত্যি বলতে অতটুকু অংশের লোকের চলে যাওয়া নিয়ে বৃহত্তর সাহিত্য, গ্রেট সাহিত্য সম্ভবই না । সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট বাদই দিলাম, লিটেরারি কোনো সিগনিফিক্যান্সই নেই এমন দেশ ছাড়ার গল্পের। দেখেছো আবার মূল গল্প থেকে সরে যাচ্ছি। জোনাক গুঠঠির গায়ে বা পাতায় কিছু একটা ছিল বুঝলে। যখন ছোটোবেলায় কোনো কোনো সন্ধ্যায় বাবার হাত ধরে বাগানে আসতাম…। বউল থেকে টিকোলি হওয়ার মাঝখানে আমের বাগান যে গন্ধ ছড়ায় স্বর্গ তখন সত্যিই হামি আস্তো হামি আস্তো। সাধে এখানকার নাম জন্নতাবাদ দেন নি হুমায়ুন ! ডু ইউ থিংক বই ভালোবাসা এক সম্রাট জিভকে নাকের উপর বসাবে? প্র্যাকটিক্যালিও আগে নাকই আসবে। নাক উপরে, জিভ নিচে। তা সেই নস্ট্রিল নকটার্নালে আমি চোখ মেলে দেখতাম গাছটা জোনাকি হয়ে জ্বলছে। গোটা গাছ জুড়ে এত জোনাকি যে গাছটা থেকে জোনাকি ঝুরছে মনে হচ্ছে। জোনাকির পাতা, জোনাকির ছাল, জোনাকি বউল, এমনকি গাছে থাকা মাকড়রা অব্ধি জোনাকিরঙ নিয়েছে মনে হতো। আমার আগেও এই দৃশ্য নিশ্চিত বহু লোক দেখেছে তাই হয়তো এই নাম। ইমপ্রব্যাবল মনে হল? বলতে বলতে আমারও তাই ঠেকছিল খানিক। বাট ওইযে…এলিমেন্টাল…তাই। ঠিক আছে নো মোর মিথিফিক্যাশন । গাছটার সাথে আমার একটাই স্মৃতি। মেমোরির চেয়ে নস্টালজিয়া শব্দটাই মোর অ্যাপ্ট এইক্ষেত্রে। শবেবরাতের আলোয় গাছটা দাঁড়িয়েছিল । একবার। বারবার। ইন্ডিয়ান ইয়েলো তৈরি হত গলতে থাকা মোম আর ধিমতালের কুপির দৌলতে। গাছটা ভিনসেন্ট হলুদ হয়ে আছে। ছোটোবেলায় প্রথম প্রথম তো জানতামই না শবেবরাত কী। কবরখানা জুড়ে দীপাবলী লেগে গেছে যেন। অথচ দীপাবলীর মতো আনন্দ লাগছে না। ভয় আসছে। দেখে ভাবতাম কবরে থাকারা উঠে আসবে আর একটু পর ওই আলোগুলো বেয়ে। পাণ্ডুর আলোয় গাছটাকে দেখে খুব ভয় লাগতো।তারপর আস্তে আস্তে শবেবরাত বুঝলাম। বাবা করতো সিপিএম। ফলে কবরখানার ধার দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটা আসতে আসতে চেনা হচ্ছিল। হলুদ আলোর গাছ পেরিয়ে একটা হালুয়া রুটির সময় আসছে খানিক পর। গাছটা আমার ছোটোবেলার হালুয়া-রুটির নরম হলুদ আলো। গাছটার দিকে তাকালে আমি ফুরফুরা হয়ে যেতাম। গাছটাও ফুরফুরে হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে থাকতো। এখনো তাকিয়ে আছে, দেখছো? তুমি অমন করে তাকাচ্ছো কেন? কীসের গল্প বলছিলাম যেন…
উৎসর্গ ঃ হাসান আজিজুল হক’কে
----------------------------