দু’টি দলেরই জন্ম এক বছরে, ১৯২৫। একশো বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, বহু সংখ্যক কর্মীর বিপুল আত্মত্যাগের পরেও, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ অবধি কমিউনিস্ট পার্টি গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়লেও, তারা আজ বহুধা বিভক্ত, গ্রামের কৃষক, কারখানার মজুর, শহরের মধ্যবিত্ত কারওরই মধ্যে দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি, কোনও-কোনও দল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকৃতি ঘটিয়ে শ্রেণি-সংগ্রাম বর্জন করে, আর পাঁচটা ভোট-পন্থী দলের মতোই হতমান অমল-বিমল-কমল হয়ে, গতানুগতিকতার কানাগলিতে করে চলেছে অলক্ষ্য ঘোরাফেরা। সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্নও আজ উজ্জীবিত করে না কবিদের!
পাশাপাশি, ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাড়তে বাড়তে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের আজ ৬২০০০ শাখা, ২০১৪ সালেও যা ছিল ৪১০০০!
অথচ, এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির সূচনার পরেই, সাম্যবাদী চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। যার ফলে, ব্রিটিশরা সতর্ক ছিল প্রথম থেকেই। ষড়যন্ত্রের আভাস পেলেই ব্রিটিশরাজ তার বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে। আপত্তিকর বক্তৃতা, রচনা বন্ধ করবার চেষ্টা তারা করেছে প্রধানত ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২৪-এ ধারা প্রয়োগ করে, যার পরিণাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এরই সঙ্গে, প্রজাদের মধ্যে সরকারের প্রতি, বিভিন্ন শ্রেণির প্রতি ঘৃণা, বৈরিতার মনোভাব জাগানোর অভিপ্রায়ে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে প্রয়োগ করা হয়েছে ওই দণ্ডবিধির ১৫৩-এ ধারা, যার পরিণাম দু-বছর সশ্রম কারাদণ্ড। এছাড়া ছিল ইণ্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট, সী কাস্টমস অ্যাক্টের ১৭৮ নং ধারা, পোস্ট অফিস অ্যাক্টের ২৫ নং ধারা। কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচারে বাধা দেওয়ার এইসব আইনি উপায়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই সভাসমিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ১৪৪ ধারা জারি, সভা-মিছিলে লাঠি-গুলি চালাবার মতো চিরাচরিত দমন ব্যবস্থা তো ছিলই!
তা সত্ত্বেও সাম্যবাদীরা এদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রসার ঘটেছে কমিউনিস্ট পার্টির। পরিণামে ১৯৩৪ সালের ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে সাম্যবাদী পুস্তক-পুস্তিকা-সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু এত দমন সত্ত্বেও কমিউনিস্টদের উত্থান অব্যাহত, দাবি আদায়ে দেশজুড়ে বিভিন্ন আন্দোলন, ধর্মঘট শুরু হয়।
এইরকম এক রূপকথার মতো উত্থানের পরে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধল কী করে? কবে? আসলে, ব্রিটিশ যা করতে পারেনি, তা করেছে কমিউনিস্টরা নিজেই। তার জন্মের সময়েই দলের গভীরে সুপ্ত থেকেছে ধ্বংসের বীজ!
খতিয়ে দেখলে চোখে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই অসংগতিতে ভরা ঘটনাগুলিকে। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে কানপুরে বিভিন্ন প্রদেশের কমিউনিস্ট নেতাদের এক প্রকাশ্য সম্মেলন হয় এবং সেই প্রকাশ্য সম্মেলনেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়ে দলের গোড়াপত্তন। কে আহ্বান করেছিলেন এই সম্মেলন? মোহনদাস করমচাদ গান্ধীর সবরমতী আশ্রমের এক ব্যক্তি, যার ছদ্মনাম সত্যভক্ত। মজার ব্যাপার, এই সত্যভক্ত নাকি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন আর মস্কোফেরৎ কমিউনিস্ট সহ দেশি কমিউনিস্ট সবাই ছুটে গেলেন পার্টি গঠনের জন্য কানপুর সম্মেলনে। আরও মজার ব্যাপার, যে ব্রিটিশ শাসক মাত্র এক বছর আগে কানপুরে কমিউনিস্ট কর্মীদের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল, যে ব্রিটিশ ১৯২৯ সালে ভারতের সব কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে বিশ্বের বৃহত্তম ষড়যন্ত্র মামলা (মীরাট ষড়যন্ত্র) শুরু করেছিল, সেই তারাই, ওই কানপুরেই বিনা বাধায় প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে পার্টি গঠন করবার সুযোগ করে দিল!
তবে যেভাবেই শুরু হোক, ১৯৩০ সালে রচিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির খসড়া কর্মসূচি কিন্তু দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে দিয়েছিল--ব্রিটিশ মূলধনী শ্রেণি আর জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষি বিপ্লবই হবে ভারতের বৈপ্লবিক মুক্তি সাধনের ভিত্তি; ভারতবর্ষের ইতিহাস ও শ্রেণিসংগ্রাম থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, ভারতের জনগণের মুক্তিসাধনের ঐতিহাসিক কর্তব্য কেবল শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বেই পালিত হতে পারে।
এই বিঘোষণার পর থেকে ভারতের কমিউনিস্টরা যেমন আত্মত্যাগ করে, মহারাষ্ট্র, মাদুরাই, হায়দরাবাদ, কেরল, পঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেভাবে আন্দোলন, সশস্ত্র বিপ্লবের রণধ্বনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা তুলনারহিত। এই ১৯৩০ সালেই শোলাপুরের শ্রমিক সাতদিন ধরে শোলাপুর আর পেশোয়ারের শ্রমিক-কৃষক দশদিন দিন ধরে পেশোয়ার নিজেদের অধিকারে রেখে জণগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জয় ঘোষণা করেছিল। এমনই আরও কিছু ঘটনার পরিণতিতেই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ।
তবু সেদিন তারা অদম্য। প্রায় প্রতিদিনই দলে নাম লেখাচ্ছেন মেধাবী ছাত্রছাত্রী। সত্যি বলতে কী, বিগত শতাব্দীর তিরিশ থেকে পঞ্চাশ এই কুড়ি বছর, বিশেষত তিনের দশক, কমিউনিস্টদের সুবর্ণসময়। একের পর এক ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠছে, আর তারা শ্রমিকদের সংহত করবার প্রয়াস নিয়েছে। পাশাপাশি, কৃষকসভা গঠিত, তারা ক্ষেতমজুরদের নিয়ে নামছেন নানান আন্দোলনে। দলের নানাবিধ ভ্রান্তি সত্ত্বেও মোটের ওপর তাদের তরঙ্গ অব্যাহত। সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষের সম্মান পেয়েছেন তাঁরা।
এরই পাশাপাশি, ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৬৪ এই ৩৪ বছরের ইতিহাস দেখলেই পাওয়া যাবে লালপার্টির অবনমনের সূত্রগুলিকে।
১৯৩০ সালের কর্মসূচিতে গান্ধী নেতৃত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনের কথা থাকলেও ১৯৩৯ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শ্রমিক-কৃষকের স্বাধীন সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে গান্ধীর হাতেই শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলন তথা জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব অর্পণ করেছিল। ১৯৪২ সালে তো তারা জনযুদ্ধের অপব্যাখ্যা করে; পার্টি নিষ্ক্রিয় করে ব্রিটিশ সহযোগিতার পথ নেয়। সে-সময় কমিউনিস্টদের অন্তত দু’টি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী--রিভলুশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়া (আরসিপিআই) আর ট্রটস্কিপন্থী বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অফ ইণ্ডিয়া (বিএলপিআই) তাদের সর্বশক্তি দিয়ে নিয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধিতার পথ।
১৯৪৩ সালের ২৩ মে থেকে ১ জুন পার্টির প্রথম কংগ্রেস। সাধারণ সম্পাদক পিসি যোশী কংগ্রেসিদের সম্পর্কে বলেন ওরা আমাদের রাজনৈতিক পিতা। এক শ্রেণির কমিউনিস্টদের বলা হতে থাকে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট! এই কংগ্রেসেই কমিউনিস্ট পার্টি পাকিস্থান প্রস্তাব মেনে নেয়। পরে অবশ্য এর বিরোধিতাও করে। কিন্তু প্রথমে যে তা মানা হয়েছিল, তা সর্বৈব সত্যি!
১৯৪৬ সালে যখন দেশ গণবিদ্রোহে ফেটে পড়ছে, নৌবিদ্রোহ, বিমান-বাহিনীর বিদ্রোহ, স্থলবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে, নৌবিদ্রোহের নেতাদের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও বিপ্লবভীরু কমিউনিস্ট নেতারা নেতৃত্ব না দিয়ে বিদ্রোহীদের পাঠান কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট আর বল্লবভাই প্যাটেলের কাছে। সে-সময়ও অবশ্য আগস্ট আন্দোলনের সময়ের মতোই সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরসিপিআই আর ট্রটস্কিবাদী বিএলপিআই বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর পার্টি রণদিভের নেতৃত্বে ঝাঁপায় অতিবাম হঠকারিতায়। তত্ত্ব অনুযায়ী প্রথমে সামন্ত্রতন্ত্র-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে পুঁজির শাসনের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবার কথা। রণদিভে আওয়াজ তুললেন এক ধাক্কায় দুটি স্তর পার করবার; যা অবাস্তব।
এর পর থেকে একটির পর একটি পর একটি পার্টি কংগ্রেস গেছে, আর দল ক্রমশ বামপন্থা থেকে, শ্রেণিসংগ্রামের পথ থেকে সরতে শুরু করেছে দক্ষিণে!
১৯৬৪ সালে যে পার্টিভাগ, সিপিআই আর সিপিআই-এম, তা কিন্তু কোনও আদর্শগত মতভেদের জন্য নয়, বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া কোনও কারণেও নয়, এ সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের সংঘাত! পার্টি ভেতরে কে কোন পদে থাকবেন, অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তগত করবার প্রয়াস থেকে এর জন্ম!
পার্টিভাগ হওয়ার পরেও দুটি পার্টিই দেশের সমস্যার দেশজ সমাধান না খুঁজে, নিজের দেশের সমাজের দ্বন্দ্বগুলির সঠিক সমাধান না করে, নিজের দেশের প্রেক্ষিতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বের সৃজনশীল প্রয়োগ না ঘটিয়ে তারা বলেছেন এমন সব কথা, যার সঙ্গে শ্রোতার উপস্থিত মুহূর্তের পৃথিবীর কোনও সংযোগ নেই। ফলত, দূরত্ব; পরিণামে ঔদ্ধত্য--আমার কথাগুলি বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু তুমি কথা খসালেই তা প্রতিক্রিয়া! শ্রেণিসংগ্রামের জায়গা নিল সমন্বয়, খয়রাতির রাজনীতি! ফলত, একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা গেল, দলের নেতাদের একাংশ একই সঙ্গে চাইছেন দক্ষিণপন্থী হওয়ার আরাম আর আত্মত্যাগী বামপন্থীর সম্মান!
এইসব বুঝতে পেরেই কি চারু মজুমদার স্বতন্ত্র সশস্ত্র বিপ্লবী দল গড়বার প্রস্তুতির সময় নতুন দিনের তরুণ বিপ্লবীদের সামনে আত্মগতভাবে বলে উঠেছিলেন,‘সংশোধনবাদ আমরাও করেছি, তাই আমাদের কাজ হল পুরনো ভুলগুলিকে খুঁজে বার করা।’ তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেছিলেন,‘আমাদের (দলের) অতীতকে ঘৃণা করতে শেখো,তবেই তোমরা ভাল বিপ্লবী হতে পারবে।’
আজ যখন দেশের অবস্থা নিম্নগামী, অর্থনীতি বেহাল, ধনবণ্টনের অসাম্য আরও বেড়েছে, এতটাই যে, মাত্র ১ শতাংশ বড়লোকের হাতে দেশের ৪০.১ শতাংশ সম্পদ! মধ্যবিত্ত তীব্রভাবে আক্রান্ত, বস্তুত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ লোপ পাওয়ার মুখে, এখনই তো, তত্ত্ব অনুযায়ী এখনই তো, জেগে ওঠবার সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের; সময়, দেশ কাঁপান আন্দোলনের। কিন্তু তারা ম্রিয়মাণ! যেন কোনও মায়াবী জাদুকর তাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে!
কমিউনিস্ট পার্টিগুলিতে যখন ক্ষয় অব্যাহত, স্বয়ং সেবকদের বাড়বৃদ্ধির কৌশল কী? সূচনার সময় আরএসএস কখনওই হইহই করে বাড়ে নি, তবে মন্থর গতিতে বাড়লেও অগ্রগতি অব্যাহত থেকেছে, হ্রাস পায় নি কখনও।
এর প্রথম যে কারণ তা হল, ব্রিটিশের বিদেশি বিজাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে এরা দাঁড় করিয়েছে হিন্দুত্ব বা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে। বিদেশি পণ্য বর্জন, শিক্ষা বর্জনের যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল ১৯০৫-১৯০৬ এর স্বদেশি আন্দোলনের পর্যায়ে, সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে স্বয়ং সেবকরা একটা নতুন ধরণের স্বাজাত্যভিমান চেষ্টা করে গেছে। এবং মজার ব্যাপার দেশের একটা বড় অংশকে নাড়া দিতে পেরেছে! আরও যা করতে পেরেছে, মূল দর্শনটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রচারের কথাগুলি ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক রাখা--জাতীয়তার বোধ, অর্থনীতির প্রগতি, সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্রতা, সব ক্ষেত্রেই। একই সঙ্গে এ-কথাও বলবার আগস্ট আন্দোলনের, কুইট ইণ্ডিয়া আন্দোলনের সময় তারা দলগতভাবে অতীব নির্লজ্জের মতো ব্রিটিশ সহযোগিতার পথ নিয়েছিল।
প্রথম দিন থেকেই, কমিউনিস্টদের মতোই, আঁটোসাঁটো সংগঠন গড়বার দিকে নজর দিয়েছিল আরএসএস। গ্রাম-নগরে তৃণমূল স্তরের সংগঠন ‘শাখা’ আর নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তারা পৌঁছে যেতে চেয়েছে ঘরে ঘরে। আর, এই উদ্দেশ্যই, অবিকল বামপন্থীদের মতোই, শুরু করেছে নানান সমাজসেবামূলক কাজকর্ম--গ্রামোন্নয়ন, স্কুল-স্থাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ ইত্যাদি।
আরএসএস নানান নামে হরেক কিসিমের সংগঠন গড়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে তার শাখাপ্রশাখা--বিজেপি, এবিভিপি, ভিএইচপি বিএমএস। এর ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার মতবাদ।
ভারতীয় জনতা পার্টিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আরএসএস। কেউ ব্যক্তি হিসাবে দলকে ছাপিয়ে ওঠবার চেষ্টা করলেই তার ডানা ছাঁটতে প্রয়াসী হয়েছে আরএসএস। ১৯৯০ সাল থেকে এই ব্যবস্থার ফল পেতে শুরু করেছে তারা। ওই বছরই বিজেপি ভালোই সাফল্য পায় ভোটযুদ্ধে!
আর একটি কারণ, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হল গণমাধ্যমের ব্যবহার। দেশের প্রতিটি গণমাধ্যমকে মোটামুটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আরএসএস; ফলে লাগাতার বারংবার নিজেদের বানান কথা, রাজনৈতিক দর্শন গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রচার করে যেতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিজেদের শিবিরে টেনে এনে নবোদিত সামাজিক মাধ্যমের চূড়ান্ত ব্যবহার, অপব্যবহার করে চলেছে তারা। আর এইভাবেই তারা পৌঁছে যাচ্ছে দেশের তরুণদের কাছে, সরাসরি। একই সঙ্গে বিরুদ্ধপক্ষকে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাওয়াটাও সহজ হয়েছে। আরএসএস-এর আওতায় থাকা স্কুল-কলেজের মাধ্যমে তারা প্রতিদিন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছে, তাদের নিজস্ব দর্শন। এ কাজে তাদের প্রধান সহায় অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ।
বাধাকে সুযোগে পরিণত করে এগিয়ে চলবার চেষ্টা করেছে তারা। জনগণ দেখেছে ১৯৭৫-৭৭ এর জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা সরকার যে সব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, তার মধ্যে কোনও ভোটপন্থী কমিউনিস্ট দল ছিল না, ছিল সিপিআই(এমএল) সহ নকশালপন্থীদের নানান গ্রুপ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, প্রাউট ও তাদেরই নানান নামধারী দক্ষিণপন্থী সংগঠন। এবং ওই সময়েই আরএসএস এর বিস্তার ঘটে।
বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক আবহাওয়ায়, যেখানে নিজেদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অস্তিত্ব রক্ষা, এলাকার ভারসাম্য রক্ষা, অনুপ্রবেশ রোধ করবার মতো বিষয়গুলির গুরুত্ব বেড়েছে, সেই প্রেক্ষিতে, সঠিক বা বেঠিক যাই হোক, আরএসএস-এর কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনছে জনতা।
বিভিন্ন গ্রুপ-সংস্থা, ধর্মীয় সংগঠন, নামী ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কৌশলগত সমঝোতা করে চলেছে আরএসএস। এর ফলে, তাদের সভ্য না হয়েও, তৈরি হচ্ছে তাদের হয়ে কথা বলবার মতো মতগঠনকারী ব্যক্তিত্ব। মার্কেটিং-এর পরিভাষায় যাদের বলা হয় ইনফ্লুয়েন্সার।
কমিউনিস্টরা যখন প্রতিদিন হীনবল, আরএসএস প্রতিদিন বিগতদিনের থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, রেজিস্টার্ড কমিউনিস্টরা যখন সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ভোট বাড়াবার অঙ্ক কষে চলেছে, আরএসএস তখন ভোট নয় দেশজুড়ে তার রাজনীতির (পড়ুন, বিষ-লতার) চারা রোপণ করতে ব্যস্ত। দেশের প্রতিটি অভিঘাতময় ঘটনার সঙ্গে, প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে, আরএসএস নিজের প্রাসঙ্গিক রাখতে চেয়েছে।
আমরা যারা ১৯৬০-৭০ এর কলকাতায় বড় হয়েছি, তারা বুকের গভীরে জানতাম, আমরা যে সাম্যবাদী চিন্তাধারা সমর্থন করি, সেই আদর্শের পতাকা বহন করেছেন কার্ল মার্কস, ভ্লাডিমির লেনিন, শহিদ ভগৎ সিং এমনকী আলবার্ট আইনস্টাইন। হ্যাঁ, মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন। যিনি বলেছিলেন, ধনতন্ত্র ব্যক্তির সমাজচেতনায় পঙ্গুত্ব নিয়ে আসে; ধনতন্ত্রের জঘন্যতম কুফল হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের এই অধঃপতন। যে মানুষটিকে হিটলার নির্বাসন দিয়েছিলেন জার্মানি থেকে, আমেরিকাতেও যাঁকে ম্যাকার্থিবাদের বহু নিপীড়ন সইতে হয়েছিল, পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কশাস্ত্রের সেই মহারথী যে সাম্যবাদী চিন্তাধারার সমর্থক, তা নিয়ে বড় গর্ব ছিল আমাদের। সত্যি বলতে কী, সত্তর সালে তো মনেই হত, কাল বাদে পরশু দেশে বিপ্লবে ঘটে যাবে, আর আমরা কোনও শ্রমিক মহল্লার শিশুদের লেখাপড়া শেখাব!
আজ চোখের সামনে দেশের লালপতাকাবাহীদের তাসের ঘর ভেঙে পড়ে যখন গেরুয়া আদর্শ সামাজিক মান্যতা আদায় করতে শুরু করেছে, যখন উচ্চবিত্ত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, নিম্নবিত্ত চাকুরে, বাড়ির কর্মসহায়িকা থেকে শুরু করে হলুদ ট্যাক্সি ড্রাইভার অবধি এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উদ্দেশে গাল পেড়ে বলে, ওদের হটালেই দেশে রাম-রাজত্ব ঘনিয়ে আসবে, তখন মনে হয় এই একশো বছর ধরে লাল আদর্শ প্রচারকারীরা করলেনটা কী? গাছের শিকড়ে ঘুণ ধরে গেল কী করে?
তবে, একটি কথা শুনে রাখুন, পরিবর্তিত রাশিয়াতেও লেনিনের স্বপক্ষে আবার লালপতাকার জমায়েত শুরু হয়েছে।