ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ছিল রোকেয়ার স্বপ্ন৷ তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন - দেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন দেশের নারীদের "স্বাধীনতা"৷ আর এই নারী স্বাধীনতা আসতে পারে না নারীশিক্ষার প্রসার ব্যতিরেখে৷শিক্ষা যে কোনো মানুষের মৌলিক অধিকার। মেয়ে হোক বা ছেলে হোক, শিক্ষার কোনো সীমারেখা নেই। শিক্ষা আত্মাকে আলোকিত করে এবং মানুষকে অন্যায় ও ন্যায়, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করে। শিক্ষা একটি প্রয়োজন নয়, বরং এটি জীবনের প্রয়োজন। একটি জাতি তখনই সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষমতায়িত বলে বিবেচিত হয় যখন দেশের নারী জনগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতায়িত এবং নিরাপদ হয়। মহীয়সী রোকেয়া বুঝে ছিলেন শিক্ষা বিস্তারই নারীমুক্তির একমাত্র পথ৷ তাই নারীশিক্ষা বিস্তারকে তিনি জীবনের ব্রত হিসাবে গ্ৰহণ করেন৷ কারণ সেই যুগেও তিনি নারীজীবনের দু:খ বেদনা অসহায়তা ও সমস্যাকে যে দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন এবং তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নারীসমাজকে সচেতন ও জাগ্ৰত করতে চেয়েছেন তা এই সময়েও প্রাসঙ্গিক৷ তিনি বলতেন সমাজ বা দেশ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যা তাদের জীবন ও কার্যপ্রণালির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কবি নজরুল তার নারী কবিতায় লেখেন- 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' কবিতার পঙ্ক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায় মানবকল্যাণে নারীর ভূমিকা কতটা জরুরি ও তাৎপর্যবহ। পৃথিবীকে আরও সুন্দর-অমলিন করতে নারী-পুরুষ এমনকি কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের মধ্যে ভেদাভেদ না করে সবার জন্য পাঠ অনুশীলন অর্থাৎ শিক্ষা অর্জন একান্ত প্রয়োজন। কোনো জাতিকে বিদ্বান হতে হলে সে জাতির নারীদেরও বিদ্বান হতে হবে। কারণ নারীদের বাদ দিয়ে একটি জাতি কখনো পূর্ণ হতে পারে না।দেশের নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাদের পুত্রকন্যারাও ঠিক শিক্ষা পাবে। নারীদের উপযোগী ও আলাদা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হলে দেশ-জাতি আর্থিকভাবে সচ্ছল ও উপকৃত হবে। আবার মনে পড়ে কবি নজরুলের সেই অমর পঙক্তিমালা 'কোন কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়া-লক্ষ্ণী নারী৷'
নারীকে পেছনে রেখে উন্নতির আশা করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। এখনই উপযুক্ত সময় অ-বিদ্যার অশনিসংকেত থেকে নারীদের মুক্ত করার। একমাত্র রোকেয়াচর্চাই দেখাতে পারে নারীদের মুক্তির সুনিয়ন্ত্রিত উপায়। বর্তমানে দেশে নারীশিক্ষার মূল প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছে কুসংস্কার। আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। সেটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হোক ও সামাজিক৷ একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ সত্য উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না যে, আগের থেকে অনেক বেশি নারীশিক্ষার প্রচলন হলেও এ অভাগা দেশে সর্বত্র নারীদের মধ্যে শিক্ষা আজও পৌঁছায়নি৷ পৌঁছনোর পরিবর্তে ধর্মের অজুহাতে বা রাষ্ট্রীয় আইনের অজুহাতে বাধা দেওয়া হয়েছে ; হচ্ছেও৷ সাম্প্রতিক আমরা দেখছি রাষ্ট্র যদি বিভিন্ন নিয়ম ও আইন জারি করে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে পোশাক পরার অজুহাতে৷ ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেক হচ্ছে মহিলা তবুও রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব নগণ্য, গণতান্ত্রিক চর্চাকারীদেশেও একই ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে। ধর্ম- সম্প্রদায় নির্বিশেষে গোটা দেশের ছবি একই৷ কতজন মহিলা সাক্ষর স্বাধীনতার এত বছর পর, এই প্রশ্নে রাষ্ট্র মুখ লুকাবে কোথায়? উল্টে রাষ্ট্র শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দায়ভার ঝেড়ে দিচ্ছে, বেসরকারীর হাতে৷ ধর্মের নামে প্রচলিত অজ্ঞতা ও কুসংস্কার নিয়ে সেই যুগে বসে আলোকপাত করেছেন ভারত তথা বাংলার শিক্ষাব্রতী রোকেয়া৷ ভারত তথা বাংলা নারী শিক্ষার অগ্রদূত, সমাজ সংস্কারক, নারী রাষ্ট্র ধারণার নির্মাতা, নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তগত পায়রাবন্দ ইউনিয়নে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন৷ তিনি বৃহত্তর সমাজে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতির ক্ষেত্রে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে ছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন "আমরা প্রথমেই ভারতবাসী তারপর হিন্দু বা মুসলমান বা খৃষ্টান ৷" আরও লক্ষ্য করার বিষয়, ঐ যুগে বসে মহীয়সী রোকেয়া এমন এক উন্নত জাতীয়তাবাদী চিন্তা করতে পেরেছিলেন৷ মহীয়সী রোকেয়া মানুষের মর্যাদায় নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্ৰাম করেছিলেন৷আজ রোকেয়ার ১৪৩ তম জন্মবার্ষিকীর পর দেশে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নেই৷ কিন্তু রয়েছে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী, পিতৃতন্ত্রী ব্রাম্মণ্যবাদী সমাজ৷ আজও আমরা দেশের স্বাধীনতাবোধ অর্জন করতে পেরেছি কি? পারিনি! এই নিয়ে রোকেয়া চিন্তা ও ভাবনার গভীর দরদবোধ আর দায়বদ্ধতা ছিল সমাজের প্রতি৷
তিনি ধর্মকে ঠিক আঘাত করেননি ধর্মের সামাজিক বিধানকে ও প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থাকে আঘাত করেছেন৷ ধর্মের আদেশের যাঁরা বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন এবং মনে করিয়েও দিয়েছেন৷তিনি আরও বলেন " বিদ্যার দ্বারা আল্লাহ্তায়লার বিপন্ন দাস পুণ্যের সর্ব্যেৎকৃষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়৷"তিনি হযরত মুহাম্মদ সা:এঁর শিক্ষা সম্পর্কে উপকারিতা আওড়েছেনও৷ আজও মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত দেশের নাগরিক সমাজ৷ দেশে সচেতনতা তৈরি করতে হলে দরকার রোকেয়ার চিন্তা ও চেতনা নির্ভরশীল শিক্ষা৷ শিক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ রোকেয়া ১৯১১ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের(ভাগলপুরের পর) কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন "সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়"৷ এই বিদ্যালয়ে নানা ধর্মের বালিকাদের প্রবেশাধিকার রেখেছিলেন বাধাহীনভাবে৷শিক্ষিকা নিয়োগ করেছিলেন বহু সম্প্রদায় থেকেও৷ তিনি মনে করতেন
শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে জ্ঞানের আলো৷ তাঁর চোখে প্রকৃত শিক্ষা বলতে গিয়ে বলেছেন" শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে৷ ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে আনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা৷" আজ থেকে কত বছর পূর্বেই তিনি বলেছিলেন "ডিগ্ৰিধারী বিদ্যা প্রকৃত শিক্ষা নয় এবং বলেছিলেন চিন্তাশক্তির বিকাশই প্রকৃত শিক্ষা৷" আর শিক্ষার প্রকৃত উপলব্ধি মানুষের মনে সামাজিক দায়বদ্ধতার চেতনাবোধ সৃষ্টি করে৷ তিনি বলেছেন শিক্ষার আলো, জ্ঞানের আলো নারীপুরুষ উভয়েরই জীবনকে বিকশিত করবার জন্য প্রয়োজন৷ গোটা সমাজের বিকাশের জন্যই এটা প্রয়োজন৷তাই পূরুষের স্বার্থ, নারীর স্বার্থ ভিন্ন নহে৷জগতের যে সকল পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্ৰসর হইতেছেন, তাহারা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন৷ তিনি আরও বলেছেন "শিক্ষার স্ফুরণ, জ্ঞানচক্ষুর উম্মীলন ঘটায়৷ বিবেককে জাগ্ৰত করে"৷ মহীয়সী রোকেয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন গোটা সমাজের বিকাশের প্রয়োজনে মেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা কত জরুরী৷ তিনি বলেছেন..."...প্রকৃত সুশিক্ষা চাই যাহাতে মস্তিষ্ক ও মন উন্নত হয়৷ আমরা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না৷ যতদিন আমরা আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই, ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র৷ আমাদিগকে সকল প্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে৷"
এখনও নানা ধরনের নির্যাতন, নারী পাচার ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন পিতৃতান্ত্রিক সমাজে৷ রোকেয়া সাখাওয়াতের জীবনে বহু কাজ আজও অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে৷ তিনি ছিলেন সে যুগের সমাজের সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষের প্রতি গভীর দরদবোধ ,দায়বদ্ধতা ও সমাজ সেচতনতার মূর্ত প্রতীক৷ তাঁর আমৃত্যু কর্মময় জীবন ,অমূল্য চিন্তা ও সাহিত্যভান্ডার তার সাক্ষ্য বহন করছে৷"সুলতানার স্বপ্ন" উপন্যাসে তার উন্নত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়৷তিনি বৈজ্ঞানিক ভাবে চাষাবাদ, সৌরচুল্লি কল্পনা, কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর কথা,নারী বৈজ্ঞানিকের কথাও বলেছেন৷ শেষ সময়ে তিনি "নারীর অধিকার" প্রবন্ধ অসমাপ্ত রেখে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন৷ চলে যাওয়ার পর তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজকে বাঙালি হিসেবে আমাদের সমাপ্ত করতে হবে৷ মহীয়সী রোকেয়ার অমূল্য চিন্তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে চলার প্রেরণা দেবে৷ এমনকি শিক্ষাব্রতী হিসেবেও "শিক্ষা" তাঁর কাছে উপায় ছিল, লক্ষ্য নয় ৷ লক্ষ্যটা ছিল নারীমুক্তি, নারী -পুরুষের সমানাধিকার৷ নারী আজ শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও পণ্যে পরিনত হচ্ছে৷ অতীত কে ভুলে গিয়ে কোন জাতি এগোতে পারে না বাঙালি শুধু নয় আন্তর্জাতিক স্তরে এই রকম শিক্ষাব্রতী বিরল৷নারী শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্বল ইতিহাস ৷আমরা বাঙালি হিসেবে কিছু দাবী তুলতে ও দায়িত্ব পালন করতে পারি যেমন- এপার বাংলায় মহীয়সী রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা, সদপুরে উনার পৈতৃক সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা " পানিহাটি বালিকা বিদ্যালয় " এর নাম পরিবর্তন করে মহীয়সী রোকেয়া বালিকা বিদ্যালয় রাখা৷ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের পাঠ্য সিলেবাসে রোকেয়ার জীবনী পড়ানো এবাং রোকেয়া জন্মদিন ও মৃত্যুতিথিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে উৎযাপন করা৷ এছাড়া নিউটাউনে রোকেয়ার নামে রাস্তার নাম করন করা ইত্যাদি৷
বাংলার আকাশে এই রকম একটি উজ্বল নক্ষত্র কে বাঙালির জাতীয় শিক্ষক হিসেবে গ্ৰহণ করা সমস্যা থাকার কোথায় নয়৷ আসুন ১৪৪ তম জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুতিথি উপলক্ষে ৯ ডিসেম্বর " বাঙালির জাতীয় শিক্ষক দিবস উদযাপন করি৷ শেষে বলি, তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালিত্বের জাগরণে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন : সাওগাত কবিতায় বলেন':
"জাগো বঙ্গবাসী
দেখ, কে দুয়ারে
ঐ শুনো শুনো
কেবা তোমাদের
সুমধুর স্বরে বলে ; সুপ্রভাত!"