কোনো ব্যাক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া ঘোঁড়াইয়া কত দূর চলিবে?' -- মহীয়ষী নারী বেগম রোকেয়ার এই প্রশ্ন বাংলার নারী জাগরণের নেপথ্যে তাঁর কলমে উঠে এসেছিল। বেগম রোকেয়া একজন বাঙালি মুসলমান নারী। ইসলাম ধর্মে নারীর মর্যাদা, অধিকার দেড় হাজার বছর পূর্বে যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তা পালন করা হচ্ছিল না বাঙালি মুসলিম সমাজে। 'নারী' জগতের অর্ধেক আলো। সেই আলোর সামনে আড়াল হয়ে কোনও এক অজ্ঞতার আঁধার তৈরি হয়েছিল। নারীশিক্ষা বিষয়ে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল সমাজ। বেগম রোকেয়া ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত করেছিলেন। না; তিনি ধর্মের মৌলিক বিশ্বাসকে আহত করেননি।
উনিশ শতক বাংলার সার্বিক নবজাগরণে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সেই নবজাগরণের পথিকৃৎ অবশ্যই রাজা রামমোহন রায়কে বলা যায়। হিন্দু ধর্মে নারী ছিল সবচেয়ে অসহায়। তাদের লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল না। জীবন্ত মানুষকে ধর্মের নামে পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। নারী বিধবা হলে আর তার বিয়ে দেওয়া হতো না। তাদের পিতার সম্পত্তিতে কোনও রকম অধিকার ছিল না। রামমোহন রায় কিংবা পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমূখ মানুষেরা এগিয়ে আসেন ধর্মের সংস্কার করতে। কিছুটা পরিবর্তন ঘটে হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে। একদিন যারা সতীদাহকে মহান পূন্যের কাজ বলে মনে করতেন, আজ তারাই এই প্রথার নিন্দা করছেন। এই কাজটি সহজ কাজ নয়।
মুসলিম সমাজে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কোনও জায়গা ছিল না। কারণ, ইসলাম নারীর অধিকার সম্পর্কে প্রথম থেকেই সচেতন। তাদের নারীদের সহকবরস্থ করা, বিধবা বিবাহ না হওয়া, কিংবা সম্পত্তির অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত রাখা -- এগুলো ছিল না। তাহলে বেগম রোকেয়া কি করলেন? কেন তাঁকে আমরা স্মরণ করছি? তাঁর গুরুত্ব ঠিক কোথায়? এই কথাটাই বলার জন্য লিখতে শুরু করেছি।
দীর্ঘ একশো বছর (১৭৫৭--১৮৫৭) পরাধীনতার গ্লানি ও অসন্তোষ নিয়ে যখন মহাবিদ্রোহ শুরু হলো। তখন ব্রিটিশদের মূল শত্রুতে পরিণত হলো মুসলিম সম্প্রদায়, কারণ অধিকাংশ মুসলিম এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদিও তার অনেক আগে থেকেই নানা রকম ফন্দি ফিকির, আইন-কানুন তৈরি করে মুসলিমদের কোনঠাসা করে দেওয়া হয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে সরকারি কাজে ফার্সি ভাষার বিলোপ পর্যন্ত অনেক ভাবেই তারা বিধ্বস্ত হয়েছিলেন। তাই খণ্ডখণ্ড আকারে ফকির বিদ্রোহ, ওহাবি আন্দোলন, ফরাজী আন্দোলনের মতো বিদ্রোহগুলি হয়েছিল। সবশেষে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। কিন্তু শেষমেষ সেইসব বিদ্রোহ ব্যর্থ হলো। শিরদাঁড়া ভেঙে গেলো। আর সেখান থেকেই গণচেতনার দিক থেকে আরও বেশি পিছিয়ে পড়লো তারা। প্রবেশ করলো এক একটি সংকীর্ণ ধর্ম মনোভাবের বৃত্তে। সেখানে মাজহাবি দ্বন্দ্ব, মাশলা-মাশায়েল নিয়ে তর্কবিতর্ক এমন জায়গাতে পৌঁছেছিল যে ইসলামের আসল রূপ, আসল উদ্দেশ্য ঠিকঠাক বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়লো। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক সব দিক থেকেই পিছিয়ে পড়লো। একটি শ্রেণীর কাছে 'নারী'দের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা উপেক্ষিত হলো। হস্তক্ষেপ করলো তাদের ইসলাম প্রদত্ত অধিকারে। তাদের ধারণা -- নারী থাকবে গৃহের ভিতরে, ঘেরাটোপের মধ্যে। পারিবারিক কিছু ধর্মীয় শিক্ষা ব্যাতীত তার আর কোনও ভূমিকা নেই। রান্নাঘর আর আঁতুড়ঘর তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। কারণ, বিদেশি শাসনে নারীর ইজ্জত-আব্রুর দায়িত্ব কে নেবে? অনেকে এই বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেন যে মুসলিম নারীদের কঠোর অবরোধের মধ্যে রাখা বাধ্যতামূলক ধর্মীয় কারণেই। মোটেই না। ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, তা উনিশ শতকের অন্য ধর্মের সংস্কারকগণ বরং চমকিত হয়েছেন। অনেকে অবাক হয়েছেন থিওরিক্যাল আর প্রাকটিক্যাল প্রভেদ দেখে। আজকের দিনেও সেই সমস্যা আছে। নারী ইচ্ছে করলে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারেন, ধর্ম সেই অধিকার দিয়েছে। অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে। কিন্তু এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে নারীদের যেন মসজিদে ওঠাও নিষিদ্ধ।
ইসলামের প্রাথমিক যুগেও দেখা যায় যে নারীরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান চালনা করছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন -- এমন কি ভারতীয় ইতিহাসে মহিলা সুলতান সিংহাসনে বসে দেশ পরিচালনা করছেন -- অথচ সেই মুসলিম নারীরা অশিক্ষা আর অবরোধের পর্দায় বন্দি হয়ে গেলেন কেন? বেগম রোকেয়ার ছিল ঠিক এই জায়গাতেই প্রশ্ন। রাজা রামমোহন যেমন বৈদিক সূত্র ধরেধরে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছিলেন যে সনাতন হিন্দু ধর্ম আসলেই একেশ্বরবাদ, সতীদাহ শাস্ত্রসম্মত নয়, তেমন বেগম রোকেয়া দেখাতে চেয়েছিলেন ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে অন্তত সেখানে অন্তরায় সৃষ্টি করে মাতব্বরি কেউ না ফলাক। শিক্ষার অধিকার তার মধ্যে অন্যতম। বুঝে ছিলেন যে আত্মপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম শিক্ষা।
সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। ইজ্জত-আব্রু রক্ষার কারণে কন্যা সন্তানকে গৃহ অভ্যান্তরে বন্দি রাখার মানসিকতা সমাজের জন্য হিতকর হতে পারে না। এই মানসিকতা কেবল মুসলিম সমাজেই ছিল; তা নয়। অন্য ধর্মের মধ্যেও ছিল। যদিওবা কিছু মানুষ বুঝেছিলেন নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু স্ত্রী-শিক্ষার বিষয়বস্তু কি হবে, এটা নিয়ে ভাবতে গিয়েও সময় ব্যয় হয়েছে অনেক।
বাঙালি মেয়েদের স্কুলে গিয়ে সাধারণ পাঠ্যক্রম অনুযায়ি পড়াশোনার ক্ষেত্রে মিশনারি ও ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। তারাই এ বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৮১৮-১৮২৮ সময়কালের মধ্যে কলকাতা ও তার অশেপাশে বিশেষত হুগলিতে অনেক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সময়েই জনৈক মুসলমান নারী কলকাতার শ্যামবাজারে আঠারোজন মুসলিম মেয়েদের নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও সঠিক তথ্য এখন পাওয়া যায় না। তবে মুসলমান নারীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পেতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
১৮৯৬ সালে বেথুন কলেজে একটি মুসলিম মেয়েকে ভর্তির বিষয় নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। বেথুন কলেজে তখন পর্যন্ত মুসলমানদের ভর্তির কোনও সুযোগ ছিল না। ডাক্তার জহীরুদ্দিন আহমেদের কন্যা ভর্তির আবেদন করে ব্যর্থ ও অপমানিত হন। সমাজে একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ব্যারিস্টার ই এ খন্দকারের বাড়িতে বৈঠকে বসেন মুসলিম শিক্ষিত ব্যাক্তিবর্গ। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুর্শিদাবাদের নবাবের বেগম শামসি জাহান ফেরদৌস এর অর্থানুকূল্যে ১৮৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয় 'মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়'। ১৯০৯ সালে খুজিন্তা আকতার বানু আরও একটি মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯১১ সালে বেগম রোকেয়া 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল' প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতায় দু'দুটি মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ মুসলিম নারী শিক্ষায় আগ্রহ আগেই তৈরি হয়েছিল, এ কথা বলা যায়। কিন্তু বেগম রোকেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একটু ভিন্ন। এই ভিন্নতার কারণেই মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ বলা হয় তাঁকে। কি সেই দৃষ্টিভঙ্গি? তিনি ছাত্রীদের মধ্যে এই দর্শন প্রবেশ করাতে পেরেছিলেন যে -- স্বামী নারীর প্রভূ নন, স্বামী হলেন স্ত্রীর জীবনসঙ্গী। গ্রাসাচ্ছদনের জন্য কেবলমাত্র তাদের উপরেই নির্ভরশীল হতে হবে, এমন না। নারীকে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে হবে। সামাজিক মঙ্গল নিহিত আছে তাতে। এই দেশ, এই সমাজ পুরুষের একার নয়। নারীকে আসতে হবে রাজনীতিতে, ভূমিকা রাখতে হবে দেশ গঠনে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পর্দার একটা সীমা আছে, তিনি নিজেও কখনও তা লঙ্ঘন করেননি। তাই বলে আপাদমস্তক ঘোমটা টানা জড়তাকে সমর্থন করেননি। ফলে একটি শ্রেণীর কাছে তিনি অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তবু তিনি দমে যাননি। আমরণ চালিয়ে গেছেন তাঁর মিশন। তারই ফলশ্রুতিতে এই ধারণার জন্মলাভ করে যে সমাজের দুটি পা। একটিকে বেঁধে রাখলে সমাজ সোজা হয়ে চলতে পারে না। অভিজাত ঘরের কন্যারাও পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক হয়। অভিভাবকদের মানসিকতার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটে।
বেগম রোকেয়ার এই বলিষ্ঠ ভাবনার উৎস কি? কোথায় পেলেন এমন মনের জোর? নিজের দাদা ইবরাহিম সাবের সাহেবের কাছে অপ্রাতষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন। পড়লেন নানান বই-পুস্তক। বাংলা এবং ইংরাজিতে। পাঠ করেছিলেন নানান ধর্মীয় গ্রন্থাদি। সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে উচ্চমানের সাহিত্য রচনা করলেন তিনি, সাহিত্যেই ব্যক্ত করলেন তাঁর নিজস্ব মতামত। এমন কথা লিখলেন যা আগে কখনও কোনও বাঙালি মুসলিম কন্যার কলমে আসেনি।
রোকেয়ার অনন্যতা এই যে কেবলমাত্র সাহিত্য রচনা করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, সেই ভাবনাকে বাস্তবের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এবং পেরেছিলেন সফলভাবে। মতিচূর -- গ্রন্থে তিনি যে কথা লিখেছিলেন, তাকে মান্যতা দিয়ে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন 'আঞ্জুমানে খাতুনে মজলিস' বা মুসলিম মহিলা সমিতি। এই সংগঠনের মাধ্যমে অসহায় বিধবাদের ভাতা, অত্যাচারিত নারীদের সাহায্য-সহযোগিতা, নারীদের উপার্জন করার দক্ষতা তৈরি ইত্যাদি কর্মকুশলতার মধ্য দিয়ে নারীবাদী স্বরকে তিনি তুলে ধরেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। স্বামী সাখাওয়াত সাহেবের অর্থ ও সমর্থন পেয়েছিলেন আগেই। ভাগলপুরেই চেষ্টা করেছিলেন তাঁর ভাবনার বীজ রোপন করতে। পারিবারিক সমস্যার কারণে চলে আসেন কলকাতায়। পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব নয়, পুরুষদের সহযোগিতায় নারী শক্তির উত্তরণ ঘটানোই তাঁর ছিল মূল লক্ষ্য। সে কাজে তিনি সাফল্য অর্জন করেছিলেন। 'ফেমিনিস্ট' বলতে যা বোঝায় -- তার অধিকাংশ ভাবনাই ছিল বেগম রোকেয়ার। অন্তত বাংলার মাটিতে।
বেগম রোকেয়া চেষ্টা করেছেন, তার সুফল পেয়েছে বাংলার মানুষ। কিন্তু যে সংকীর্ণতা, যে বিরুদ্ধবাদিতার সামনে তাঁকে পড়তে হয়েছিল, এখনও রয়ে গেছে সেই শক্তি। এখনও কিছু অংশ আছে যারা কুরআন-হাদিস অস্বীকার করেননা, বিশ্বাস করেন 'শিক্ষা' সকল মানুষের জন্য ফরজ। এই নির্দেশ নর-নারী আলাদা করে লেখা নেই কোথাও। তবু শংসয় প্রকাশ করেন -- নারী শিক্ষা ফেতনা সৃষ্টি করবে। এই যে বিশ্বাসের দ্বিচারিতা এটাকে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই বেগম রোকেয়া আজও প্রাসঙ্গিক। আজও তাঁর বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ প্রয়োজন।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে ওপার বাংলায় চর্চা হয়। কিন্তু এপার বাংলায় তেমন কিছুই হয় না। এই সংকটকে দূর করতে হবে।