আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ঋত্বিক ঘটকের মুখ থেকে শেষ বারের মতো রক্ত গড়িয়ে পড়ে। আর আমরা যখন তাঁকে স্মরণ করি অনেকদিন পর্যন্ত আমরা যা ভেবেছি তা হচ্ছে তিনি আমাদের দেশভাগের ধারাভাষ্যকার – এক তুলনারহিত বাঙালি যিনি আমাদের দেশভাগের যন্ত্রণা, আমাদের বাস্তুহারা জীবনের অভিব্যক্তিগুলোকে সেলুলয়েডে বা অন্যত্র রূপায়িত করেছেন। তাঁর ব্যর্থতা আমাদের জীবনের অন্তর্গত মেলোড্রামাকে আরো পত্রপুষ্পে পল্লবিত করেছে। ঋত্বিক ঘটক মোটামুটিভাবে একজন বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্রকার যিনি দেশভাগের যন্ত্রণা এবং অভিশাপের দলিলকে মূর্ত করেছেন সেই হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে গেছেন। আজ কিন্তু মনে হয় আমাদের একটা ভুল হয়েছিল। আমরা তাঁকে ভেবেছি তিনি শুধু সমসাময়িক ঘটনার বিবৃতিকারক। কিন্তু সমসাময়িক ঘটনা থেকে অনেক দূরে যে তিনি সরে যেতে পারতেন তা আজকের ভারতবর্ষকে দেখলে বোঝা যায়। এইযে আজকে আমাদের জাতীয় নায়ক সন্ধানের এত চেষ্টা হচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বসু নাকি শ্রীরামচন্দ্র তা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হচ্ছে তার মধ্যে প্রবেশ না করেও বলা যায় ঋত্বিক এক অন্য রামচন্দ্রকে কিন্তু নায়ক হিসাবে দেখার কথা ভেবেছিলেন।
তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগরিক’, এই নামটাই স্মরণীয় কেননা স্বাধীনতা-উত্তর দেশে নাগরিকতার সন্ধানে একজন শিল্পী ব্যাপৃত আছেন এটা আমরা যারা আধুনিক তাদের পক্ষেও চিরস্মরণীয় কেননা তিনি গ্রামজীবন থেকে শহর, সামন্ততান্ত্রিক জীবনপ্রণালী থেকে নগরযাত্রার বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। এবং সেই ছবিতে তিনি একইসঙ্গে খেয়াল করছেন যে একটি অর্থাভাবে ক্লিষ্ট ভাড়াটের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং নগরীতে দুর্গা প্রতিমার আগমন একই সঙ্গে ঘটছে। তিনি হিন্দু প্রতিমাকে ব্যবহার করছেন, হিন্দু উপকরণ ব্যবহার করছেন, হিন্দু নুড়িপাথর ব্যবহার করছেন কিন্তু কিভাবে করছেন সেইটা আমাদের ভাবতে হবে। যদি আমরা অন্য প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে শুধু ‘সুবর্ণরেখা’র দিকেই তাকাই তাহলে দেখব ‘সুবর্ণরেখা’র শুরুতে একটি ছেলে তার মাকে হারিয়েছে এবং খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় সাধারণ কথাবার্তা থেকে টেলিপ্রিন্টারে ভেসে আসে “হে রাম”, গান্ধীজী নিহত। সাধারণ স্থানীয় সত্য থেকে জাতীয় সত্য এবং সেই জাতীয় সত্য থেকেই অনতিকাল পরেই বাস্তুহারা পল্লীতে প্রত্যাবর্তন, এক বৃদ্ধের প্রলাপে আবার শুনি যদুবংশ ধ্বংসের প্রতিধ্বনি।
স্থানীয় সত্য থেকে জাতীয় সত্য এবং জাতীয় সত্য থেকে পৌরাণিক তথ্য এই যে সময় থেকে সময়ান্তরে পরিভ্রমণে ঋত্বিকের অলৌকিক দক্ষতা তাই দেখে আমরা বুঝি চলচ্চিত্রে সময় ব্যবহারে ঋত্বিকের অত্যাশ্চর্য দক্ষতা। কিন্তু আজ আমি সে বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই “হে রাম”কে তিনি তাঁর ছবিতে চলচ্চিত্রিয় নিষ্পত্তির মতো ফিরিয়ে এনেছেন যখন ঈশ্বর চক্রবর্তী, মত্ত ঈশ্বর চক্রবর্তী, সুরাসক্ত ঈশ্বর চক্রবর্তী রেসুরে ঈশ্বর চক্রবর্তী ভুলক্রমে তার বোনের ঘরে মধ্যরাতে প্রবেশ করে এবং সেই সময় তার বোন সীতা যে আত্মহত্যা করে সেই আত্মহত্যার পরে, অনেক পরে তার স্থির চক্ষুর দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ দূরাগত প্রপাতধ্ব্নির মতো, প্রায় দৈববাণীর মত বলে – হে রাম। খেয়াল করুন এই একই ‘হে রাম’ গান্ধী হত্যার প্রসঙ্গে ব্যবহার হয়েছিল এবং এই একই ‘হে রাম’ ব্যবহার হলো একজন মত্ত ভাই যখন মধ্যরাত্রে তার বোনের ঘরে ঢুকে পড়ে, বলাবাহুল্য অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে।
অর্থাৎ সীতার অগ্নিপরীক্ষাকে তিনি অন্যভাবে ব্যবহার করছেন এবং জাতীয় ট্রাজেডির সঙ্গে আবার ফিরে আসছেন ব্যক্তিগত ট্রাজেডিতে তার ফলে আমাদের মানচিত্রে রামচন্দ্র সম্পূর্ণ অন্যভাবে স্থাপিত হচ্ছেন। শুধু অন্যভাবে স্থাপিত হচ্ছেন না রামকে ঋত্বিক ঘটক মনে করেন যদি জাতীয় নায়কও তিনি হন তাহলে তিনি কাদের জাতীয় নায়ক? তিনি কি আর্য উচ্চবর্গীয় সমাজের মানুষ যিনি আজানুলম্বিত নব দূর্বাদল শ্যাম ইক্ষাকু বংশের রাজপুত্র? আমরা দেখি ঘাটশিলার স্টেশনে, ছাতিমপুরের প্লাটফর্মে এক মহিলা পড়ে আছেন। অভিরাম যখন মাতৃ আবিষ্কার করে অভিরামের “মা” আর্তনাদ এবং ওই মহিলার সঙ্গিনীর “বাগদী বউ রে” ডাকের সমাপতন হয়। এইযে কৌশল্যা বাগদী বউ, তিনি অসূর্যস্পর্শা রাজনন্দিনী নন এই সত্য দাবি করার সঙ্গে সঙ্গে সাউন্ডট্র্যাকে একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণ হয়। ঋত্বিক ভিজুয়াল থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে একটা প্রচন্ড ক্যাকোফোনির দিকে নিয়ে যান এবং আমরা বুঝতে পারি যে এই সত্য মেনে নেওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হবে – রামচন্দ্র যদি জাতীয় নায়ক হন তিনি মূলত দলিত। যে দলিতরা আর্যদের আসার অনেক আগে থেকে ভারতবর্ষে আছেন তিনি তাদের প্রতিনিধি, ঋত্বিক এখানে সত্য গোপন রাখেননি।
অভিরাম যখন সীতাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে তখন ছবিটা দেখলে দেখবেন যে আমাদের চিৎপুর পাড়ার বটতলার বইগুলোতে যে রামায়ণ ছাপা হয়, রামায়ণে ‘বনবাসে রামচন্দ্র’ যে ছবিটি দেখা যায় এখানেও একেবারেই তাই। সীতা এবং রামচন্দ্রের ভূমিকায় এখানে সীতা ও অভিরাম আছে। এই সীতা কে? আজকে যে আমাদের চাষী আন্দোলন হচ্ছে, আন্দোলন নিয়ে আমরা এত কথা বলছি ঋত্বিক জানেন ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে যদি কথা বলতে হয় যা তিনি বলছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার অনুষঙ্গে তাহলে ভারতের চাষীদের নিয়ে কথা বলতে হবে। চাষবাসই আমাদের একমাত্র রূপকথা, আমাদের একমাত্র আখ্যান। এই যে বাচ্চাটি ভয় পেয়ে ওঠে বহুরূপীর সামনে, মা কালীর সামনে আর তার ভয় মোচনে বৃদ্ধ ম্যানেজার তাকে বলেন, সে আর এক সীতার গল্প। সীতা মাটিরই কন্যা, আবার একদিন সে মাটিতেই ফিরে গিয়েছিল। তারমধ্যে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ। এই যে চাষের উপাখ্যান এইটাকে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে ঋত্বিক ঘটক ধরেন মৃত্তিকার গন্ধ এবং একটা জাতির যে ইতিহাস লেখা নেই সেই ইতিহাসের কথায়। রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ থেকে সে নেয় আমাদের অভিশাপ, মন্বন্তর এবং দুর্যোগের কাহিনী।
আজ আমাদের মনে হয় অনেক বড় একটা অভিপ্রায় তাঁর ছিল এবং একটা বড় প্রকল্প তিনি নিয়েছিলেন। যারা তাঁকে হিন্দু ভাবেন বা হিন্দু উপাখ্যানগুলি থেকে নুড়িপাথর সংগ্রহ করেছেন বলে তাঁকে ব্যবহার করার কথা ভাবেন তারা এটা বুঝতে পারেন না যে হিন্দু ধর্মের ভেতর এত বড় অন্তর্ঘাতক আর কেউ নেই। বুনুয়েল ওফেলিনি রোমান ক্যাথলিক কালচার কমপ্লেক্সকে যতটা আক্রমণ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, হিন্দু ঋত্বিক ঘট্ক, ব্রাহ্মণ ঋত্বিক ঘটক তার থেকেও বেশি হিন্দু ধর্মের মধ্যে সরাসরি ভার্টিক্যাল ইনভেডারের মতো প্রবেশ করেছেন। তিনি হিন্দুধর্মকে তছনছ করে দিয়েছেন তার প্রকৃত সত্য আবিষ্কারের জন্য।
আজকে যদি আমরা ঋত্বিক ঘটককে সত্যিই ব্যবহার করতে চাই তাহলে দেখা যাবে ঋত্বিক ঘটক একজন চলচ্চিত্রকারমাত্র নন একজন দার্শনিক এবং সত্যিই বিপ্লবের এক ইশতেহার তাঁর মাত্র আটটা ছবি বহন করে চলেছে। এই আটটামাত্র ছবি নিয়ে মহাকালের দরজায় প্রবেশ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তারকোভস্কি তাঁর সাতটা ছবি নিয়ে ঋত্বিক তাঁর আটটা ছবি নিয়ে কিভাবে মহাকালের দরজায় কড়া নাড়লেন তা আমরা জানিনা কিন্তু এখন অনেক সময়েই আমার মনে হয় ‘ভারত আবিষ্কার’ বইটা জহরলাল নেহেরুর লেখা হলেও ভারত আবিষ্কার ভিন্নভাবে – প্রকৃত ভারত, ছোটলোকের ভারত, গরিবের ভারত – যে ভারত তার দশ হাজার বছর ধরে তার রক্তধারা প্রবাহিত করে চলেছে সেই ভারতকে সত্যিই চিনতে পেরেছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
সেই জন্যই আজ তাঁর ছবিগুলোর দিকে তাকালেই মনে হয়, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী ওগো মা। ঋত্বিক বলেছিলেন কেন চেয়ে আছ গো মা, যদি আপনি ভাবেন রবীন্দ্রনাথের গানের বিপরীতে ঋত্বিক ঘটককে তাহলে দেখতে পাবেন, সত্যি মা তার জীর্ণ-বস্ত্র পরিত্যাগ করে এক উজ্জ্বল ঝলমলে দিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আমরা যারা ঋত্বিককে সেদিন বুঝতে পারিনি তারা খেয়াল করছি যে আমাদের অজান্তেই আমাদের নতুন প্রজন্মের ইতিহাসকার আজ আমাদের আবিষ্কার করছেন।