পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আগুন পাখির শরীর পোড়ে, ভাবনা তবু অবিক্ষত

  • 22 February, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 339 view(s)
  • লিখেছেন : সিতাংশু চক্রবর্ত্তী
"মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি" এই আশাবাদ থেকে শুরু করে "আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর, আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর" এই যে কালের যাত্রাপথের পথিক প্রতুল মুখোপাধ্যায়। রেখে গেলেন তাঁর গান,- জীবনের জন্য, মানুষের জন্য।

২৫ শের ফেব্রুয়ারির ১৫তে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আমাদের প্রতুলদা চলে গেলেন আয়নোস্ফিয়ার পেরিয়ে দূরে বহুদূরে, এক অজানালোকে। রেখে গেলেন তাঁর গান,- জীবনের জন্য, মানুষের জন্য।

মূলতঃ ৮০র দশক থেকে প্রতুলদা কলকাতা সন্নিহিত বাংলার শহর ও শহরতলীর পথে ঘাটে, গান নিয়ে পথ চলতে শুরু করেন। সময়টি কেমন? নকশাল বাড়ির আন্দোলন পিছু হটেছে। চারিদিকে আবার নতুন করে চলার জন্য ছোট ছোট গ্রুপে কিছু মানুষ জোট বাঁধছে। বিশেষ করে ধাক্কার মুখে, আদ্যন্ত রাজনৈতিক লোকেরাও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু নড়াচড়া করার মরীয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শহর ও শহরতলীতে কিছু নাটক-গানের দলও গড়ে উঠছে। সময়ের এই ক্ষণে, কণ্ঠে গান নিয়ে প্রতুলদার আশ্চর্য আবির্ভাব। গান নিয়ে প্রতুলদা ছিল ভীষণ স্বয়ংসম্পূর্ণ।কোন কিছু নেই, না হারমোনিয়াম, না তবলা; শুধু শরীর, সুর আর কথা। গানের ওয়ান ম্যান আর্মি।আমার মনে আছে- আমরা প্রথম "শ্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি" গানটি শুনি স্টুডেন্টস হলে প্রতুলদার কণ্ঠে।এরকমভাবেই "ডিঙ্গা ভাসাও"; "আমার মাগো কে বলে তুই সন্তান হারা"; "আলু বেচ, ছোলা বেচ"; "ভিনদেশী পাগল" ইত্যাদি ইত্যাদি কত গান। প্রতুলদা এক একটা গান লিখত, আর তা ছড়িয়ে পড়ত সারা বাংলায়। তবে কিছু গান ছিল প্রতুলদার নিজস্ব। সে সব গান প্রতুলদা ছাড়া আর কেউই গাওয়ার সাহস দেখাত না যেমন "ছোকরা চাঁদ জোয়ান চাঁদ" এবং কবিতায় সুর দেয়া গানগুলি। সেইসময় বাদল সরকার নাটককে গ্রাম বাংলার ঘরের অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার জন্য অঙ্গন মঞ্চের নাটকের এক রুপ তৈরি করলেন। প্রতুলদাও গানকে কৃষকের উঠোনে নিয়ে যাওয়ার সুবিধার কথা ভেবেই বোধহয় এই অডিও-ভিসুয়াল গানকে হাজির করেছিলেন। মিষ্ট ভাষী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান রসিক মানুষটির কথা বলার মধ্যে যে শিল্প ছিল, তা তাঁর গানের সৃষ্টি-সৃজনেও প্রভাব ফেলত।এক একান্ত আলাপচারিতায় তাঁকে বলতে শুনেছি-"আমাদের সময়ে ছেলেবেলায় অভাবের কোন অভাব ছিল না"। এই কথাটির বিষয় নিয়ে বলা ততটা উল্লেখযোগ্য নয়, যতটা উল্লেখযোগ্য এই কথা বলবার ভঙ্গিমা। এই গুণই প্রতুলদার সৃজনকে করেছে মহিমান্বিত।

এইভাবেই পেরিয়ে গেল দুইটি দশক। প্রতুলদা জীবন আশাবাদের গান লেখে, আমরা শুনি, বাহবা দিই।বেলা বয়ে যায়, এদিকে বাংলায় তৃতীয় ধারার রাজনীতির কোন উত্থান নেই, শুধু পতনের শব্দ শোনা যায়। জনাধার শুকিয়ে যায়, প্রগতি শিবিরে খন্ডীকরণ বাড়তেই থাকে। পাড়া ঘরের সাংস্কৃতিক দলগুলি আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর কর্পোরেট অর্থনীতি ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির করাল গ্রাসে প্রগতি চিন্তার পরিসর ক্রমাগত ছোট থেকে ছোট হয়ে যায়। এইসময়ই প্রতুলদাকে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বলতে শোনা যায়- "তোরাতো আমাকে পাত্তাই দিস না"। প্রতুলদা তো আদ্যন্ত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, খুঁজে ফেরে বৃহত্তর এক শ্রোতার পরিসর। এখান থেকেই সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম পর্বের পরবর্তীতে প্রতুলদা শুধু শ্রোতার গণ্ডী ভাঙ্গেনই না, বাম মতাদর্শর গণ্ডী ভেঙে এক অখন্ড বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশের সাস্কৃতিক আদর্শকেই তাঁর সৃজনের মূল পাথেয় করে নেন। প্রতুলদা ভাবলেন একভাবে। বাংলার আজকের শাসক তাকে দেখল অন্যরূপে। স্থুল ভোটের বাক্স ভরানোর শাসক সংস্কৃতি প্রতুলদার এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নেয় এতটাই যে ১৪ই আগস্ট, ২০২৪ এর মধ্যরাত্রির পর "দ্রোহের বাংলা"ও প্রতুলদার অবস্থানকে টলাতে পারে না। এ বড় বিস্ময়েরই ব্যাপার।

যাই হোক, সলিল চৌধুরী, ভূপেন হাজারিকা, গদর, প্রতুলদা সবাইকেই দেখা গেল কোন না কোন ভাবে, কোন না কোন মাত্রায় ঐ একই পথের যাত্রী। তাই বিস্ময় কিংবা বিস্মরণ নয়, ব্যক্তি সমালোচনা বন্ধ হোক, আগামী ভোরের জন্য- আসুন যে টুকু শক্তি আছে তাই নিয়েই আমরা বাঁচিয়ে রাখি তাঁর গান, আমাদের গান; কারণ প্রতুলদার ভাষায় আমরাই চূর্ণ করেছি পাহাড়, টুকরো করেছি বোল্ডার।

"মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি" এই আশাবাদ থেকে শুরু করে "আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর, আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর" এই যে কালের যাত্রাপথের পথিক প্রতুলদা- তাঁর প্রতি রইল আমাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা।          

0 Comments

Post Comment