পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তালাশনামা - উপন্যাস পাঠের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা

  • 15 April, 2022
  • 1 Comment(s)
  • 2301 view(s)
  • লিখেছেন : মিলন দত্ত
ইসমাইল দরবেশের ‘তালাশনামা’ বাংলা কথাসাহিত্যে নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এ আখ্যান পাঠককে পৌঁছে দেয় প্রতিবেশীর অন্দর মহলে। ইসলাম আর মুসলমানকে জানার বড় সুযোগ করে দিয়েছেন লেখক। হাজারো উপন্যাসের ভিড়ে কখনও হারিয়ে যাবার নয় অনন্য এ ‘তালাশনামা’।

মুসলমান সমাজ ও জীবনের বৈষয়িক, অধ্যাত্মিক এবং একই সঙ্গে প্রাত্যহিকতার অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান এ উপন্যাস। দুই বাংলা বিবেচনায় রেখেই দাবি করা যায়, এমন উপন্যাস দুর্লভ— আখ্যান, বয়ান এবং সমাজানুন্ধানের দিক থেকেও বটে। উপন্যাসের কেন্দ্রে দর্জি-ওস্তাগার অধ্যুষিত গ্রামীণ হাওড়ার মুসলিমপ্রধান সাদনাহাটি গ্রামের মসজিদটি। আছে শিক্ষিত, বিচক্ষণ, নির্ভীক, সুন্দরী তরুণী রিজিয়া, মসজিদের ইমাম তাহিরুল মাওলানা আর স্বশিক্ষিত, যুক্তিবাদী, বুদ্ধিদীপ্ত, ধর্মনিষ্ঠ মারুফ এবং ওই গ্রামেরই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উদার, শিক্ষিত, ধর্মে মতিহীন সুমন— মারুফের বাল্যবন্ধু সুমন। মূলত এঁদের ঘিরেই গল্প।

কাহিনীর পরতে পরতে লেখক সাদনাহাটির মুসলমানদের হজ, জাকাত, ইদ, কুরবানি, খতনা, বিয়ে, তালাক, গোসল, দাফন, শেরেক, পিরভক্তি ইত্যাদির অনুপুঙ্খ বয়ান করেছেন। ইসলাম আর মুসলমানকে জানার বড় সুযোগ করে দিয়েছেন। উপন্যাস পড়তে পড়তে আমরা জেনে যাই মুসলমানদের ধর্মীয় কৃত্যাদি এবং উৎসব অনুষ্ঠান বিষয়ে। বিয়ে এবং তালাকের মতো ইসলামের সরল এবং সাধারণ মানুষের বোধগম্য একটি বিষয়কে সমাজ জটিল করে তুলেছে। সে কাজে স্বার্থন্বেষী কিছু মানুষ যেমন আছে তেমনই রয়েছে বহু ইমাম-মৌলানা-মুফতি। তালাকের নিয়মকানুন নিয়ে তাহিরুল মওলানা আর ফুলসুরার উকিলমামার মধ্যে ধর্মীয় এবং আইনি বাহাসের মধ্যে দিয়ে তালাকের তত্ত্ব আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়। তাহিরুল মওলানা এমনকি ফুলসুরার ‘হালালা’ বিবাহের প্রস্তাবও দেয়। তাহিরুল ইঙ্গিত দেয়, তিন মাসের জন্য কাওকে বিয়ে করে ফের ফুলসুরাকে আগের স্বামীর কাছে ফেরত দেওয়ার মতো লোকও যোগাড় করা যাবে। মেয়েদের জন্য অত্যন্ত অপমানের ওই বিবাহ পদ্ধতিতে ফুলসুরার উকিলমামা বা রিজিয়ারা রাজি হননি। তাহিরুল চান যেনতেন প্রকারে তালাকটা সিদ্ধ করাতে আর রিজিয়া বা উকিলমামার প্রচেষ্টা বিয়েটা টিকিয়ে রাখায়। দুই তরফই মুফতিদের কাছ থেকে নিজ নিজ পক্ষের অনুকূলে ফতোয়া লিখিয়ে এনেছেন। তাহিরুল মওলানা শেষপর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেন— ফুলসুরার বিয়েটা টিকে যায়। কঠোর শরিয়তপন্থী এই মওলানা আবার অসহায় অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের অসুখ-বালাই সারানোর নামে জলপড়া আর দোয়া-তাবিজ দিয়ে দুটি পয়সাও রোজগার করেন।

সাদনাহাটিতে পালাগান, যাত্রা, মর্শিয়া বা জারির মতো বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি চর্চার কোনও অস্তিত্ব নেই— অতীতে ছিল কিনা তাও জানা যায় না। সে গ্রামের সংস্কৃতি বলতে কেবলই ইসলামি জলসা, ওয়াজ ইত্যাদি। ধর্মসম্পর্ক রহিত সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে মুসলমান সমাজের মধ্যে যে পিছুটান বা বিমুখতা রয়েছে তা ধরা পড়েছে এ উপন্যাসে। সমাজের অতি কঠিন এক ব্যথার জায়গা ছুঁয়েছেন লেখক, আল আমিন মিশনের প্রক্তনী সদ্য ডক্তারি পাশ করা তরুণ জসীমের সঙ্গে মারুফের কথোপকথনে— ‘মুসলমান সমাজের আত্মপরিচয়ের প্রবল অভাব।… বুদ্ধিজীবী চাই, বৌদ্ধিক একটা সমাজ চাই। কীভাবে সেগুলো তৈরি হবে? বিকাশের মুহূর্তে কি প্রতিভার গলা টিপে ধরা হয় না আমাদের সমাজে ?’ …‘যেমন ধরো, একটি মুসলিম ছেলে ভলো ফুটবল খেলে। … সে যখন কলকাতার বড়ো টিমে সুযোগ পাবে, ঠিক তখনই ফতোয়া আসবে হাঁটুর ওপরে কাপড় পরে খেলাধুলো করা হারাম।…’ আবার ‘একজন মুসলিম মানুষ ভলো লিখতে পারে। কথাসাহিত্য মূলত কল্পনানির্ভর হয়। আর কল্পনা তো আসলে মিথ্যা। সেখানেও ফতোয়া আসবে, ইসলামে মিথ্যের কোনো জায়গা নেই। মিথ্যে দিয়ে কোনো মহৎ কাজ হয় না। একজন ছবি আঁকে। বেশ আঁকছে ফল-ফুল-পাতা, প্রকৃতি, ঠিক আছে— কিন্তু যখনই কোনো প্রাণীর ছবি এঁকে ফেলে, তখনই নিদান দেওয়া হবে— প্রাণীর ছবি আঁকা হারাম।’ এ সব কথা জসীমের। মারুফ জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে?’ জসীমের জবাবে তীব্র শ্লেষ, ‘তাহলে আর কি? চলো মাদ্রাসায়। পড়ো দ্বীনিয়াত। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। দ্বীন ও দুনিয়ার সওয়াব হাসিল হবে ইনশাল্লাহ্।’ মারুফ অবশ্য একমত হতে পারেন না জসীমের সঙ্গে।

লেখকের মতে, এ রাজ্যে মুসলমান সমাজকে পিছন থেকে টেনে রেখেছে মানুষের ভ্রান্ত ধর্মবোধ— তার জন্য দায়ী আলেম-ওলামা কৃত ধর্মের মনগড়া ব্যাখ্যা। সাদনাহাটির সমাজেও শেষ কথাটা বলেন মওলানা-মৌ‌লবিরা। তাই আজীবন কমিউনিস্ট হাসান আলির, যিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করে দিয়েছেন সমাজের কাজে, মৃত্যুর পরে তাঁর দাফন হয় না সদনাহাটিতে। কারণ তাহিরুল মাওলানার নিষেধ।

গ্রামে দাঙ্গা রোধ করার জন্য বৃদ্ধ সাদেক আলির দুঃসাহসী চেষ্টা মনে থাকবে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা অশক্ত সাদেক আলি ‘থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে বলে চলেছে— ‘মুই সাদের আলি। মোকে মেরে তবে যোগীপাড়ার দিকে যেতে পারবি তোরা। মার মোকে, মার। এরাম রায়টে মরার জন্যেই মুই বেঁচে আচি। মোর বাপ-মা দাঙ্গায় মরেছে, পাড়া-প্রতিবেশী সব এই হিন্দু-মোসলমান করে। মুই বেঁচে থাকতে এটা করতে দেব না, আল্লার কসম।’ নীবিড় পর্যবেক্ষণ আর দক্ষ কথাকারের মুসনসিয়ানা ইসমাইলের কলমে।

৪৬২ পৃষ্ঠার উপন্যাসের কাহিনী এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বলা সম্ভব ছিল না। সে চেষ্টাও করিনি। গ্রাম সমাজের সারল্য, সজিবতা, জটিলতা, সংঘাত, সংকীর্ণতা সবই পাওয়া গেছে গল্পের পরতে পরতে। বাংলার মুসলমান সমাজে মেয়েদের অবস্থা ও অবস্থান যেন পরিস্কার হয়ে ফুটে ওঠে জেদি মেয়ে রিজিয়া এবং অন্যদের সঙ্গে তার সংলাপ ও সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। ইসমাইল দরবেশ যে কাহিনী সাজিয়েছে তা কখনই সমাজসম্পর্কহীন অবাস্তব নিরালম্ব হয়ে থাকে না। কাহিনীকারের সঙ্গে চলতে চলতে সাদনাহাটির বাড়িগুলোর সদর দরজা অন্দর মহল, সিঁড়ি বেয়ে উঠে বইয়ে ঠাসা মারুফের ঘর, মসজিদের নকসা আর গ্রামের পথঘাট সব হাতের তালুর মতো চিনে নেওয়া যায়। কখনও মনে হয়, একটা নিপুন ডকুমেন্টারির খসড়া চিত্রনাট্য যেন লিখে রাখছেন ইসমাইল। গ্রাম্য রাজনীতির সদর এবং চোরাপথ তাঁর অতি পরিচিত। ‘তালাশনামা’য় গ্রাম্য রাজনীতির বাস্তবতা রূপায়ন তাই এতোটাই নিপুন ও নিখুঁত।

উপন্যাস শেষ হয় খানিকটা ইচ্ছেপুরণের মধ্যে দিয়ে— সমাজের অন্ধকার কাটাতে মারুফের উদ্যোগে মসজিদ ঘিরে দাতব্য চিকিৎসালয়, লাইব্রেরি, কম্পিউটার শিক্ষার উদ্যোগ শুরু হয়। সে কাজে মারুফের সঙ্গী সেই তাহিরুল মাওলানা। ইতিমধ্যে শিক্ষিত যুক্তিবাদী যুবক মারুফ তারই গ্রামের তবলিগ জামাতের একটি দলের সঙ্গে চল্লিশ দিন ধরে বিভিন্ন মসজিদে ঘুরে ঘুরে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়িয়েছেন। মারুফ গ্রামে ফিরেছেন ‘পরিবর্তিত মানুষ হয়ে’— ‘ফরসা চওড়া গালে হাফ দাড়ি। গোঁফ কামানো। গায়ে ফুল শার্ট-এর বদলে লম্বা ঝুল পাঞ্জাবি।’

উপন্যাসে ধর্ম এবং ধর্মীয় কৃত্যাদির অনুপুঙ্খ বর্ণনা যতটা গুরুত্ব পেয়েছে গ্রামের মানুষের জীবন ও জীবীকার দিকটি নিয়ে যেন একটু কার্পণ্য থেকে গেছে। আথচ উপন্যাস পড়তে পড়তে বোঝা গিয়েছে, সাদনাহাটির দর্জি সমাজের পেশা-শিল্প-বাণিজ্য— সবটাই লেখক চিনেছেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে।

লেখকের কাছে একটা প্রশ্ন: কিন্তু বাংলার মুসলমান সমাজ কি এতটাই ধর্মসর্বস্ব— সাদনাহাটির মতো ?

তালাশনামা। ইসমাইল দরবেশ। অভিযান পাবলিশার্স, কলকাতা। ফেব্রুয়ারি ২০২১। ৫০০ টাকা।

1 Comments

একরামূল হক শেখ

15 April, 2022

একটি চর্চিত উপন্যাসের সুন্দর মূল্যায়ন করেছেন মিলন দত্ত। এবং সঙ্গে তাঁর শেষ প্রশ্নটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

Post Comment