আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসার। বিশেষ করে যদি আমেরিকার অসংখ্য কলেজ-অশিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ ভোটার বিশাল সংখ্যায় ভোট দিতে বেরিয়ে আসে, এবং সেই একই সময়ে যদি কলেজ-শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কৃষ্ণাঙ্গ, ব্ল্যাক অথবা ল্যাটিনো ভোটাররা জো বাইডেনকে বিশাল সংখ্যায় ভোট না দেয়।
বাঙালি অথবা ভারতীয় আমেরিকান ভোটারদের সম্পর্কেও সেই একই কথা। যদি তারা প্রবলভাবে বাইডেনকে ভোট না দেয়, তাহলে ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনাই প্রবল।
তারপরে যে প্রশ্ন থেকেই যায়, তা হলো, ভোটে যদি ট্রাম্প পরাজিতও হয়, তার পরেও সে যদি গদি না ছাড়ে? তার নতুন সুপ্রিম কোর্টের রক্ষণশীল বিচারকদের সাহায্যে, অথবা তার বর্বর, হিংস্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী পদাতিক সৈন্যদের সাহায্যে সে যদি এক সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করে?
এখনো পর্যন্ত একবারও তিনি বলেননি, ভোটে হেরে গেলে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। এখনো পর্যন্ত তাঁর মুখ থেকে একবারও একথা শোনা যায়নি।
ট্রাম্প জানতেন এই অতিমারীতে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হবে। সেকথা তিনি ওয়াটারগেট-খ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডকে এ বছরের গোড়ার দিকেই বলেছেন। কিন্তু তার পরেও সাধারণ দেশবাসীর কাছে সে তথ্য গোপন করে রেখেছেন ট্রাম্প।
কারণ? ওয়াল স্ট্রিটের, মার্কিন কর্পোরেট জগতের, এবং স্টক মার্কেটের বেলুন তিনি ফুটো করতে চাননি। তাঁর নিজের অতি-ধনিক অর্থদাতাদের কাছে আগেই সতর্কবাণী পৌঁছে দিয়েছেন, কিন্তু আমেরিকার ৯৯ পার্সেন্টের কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর বিপদের কথা লুকিয়ে রেখেছেন।
আর কী কী তিনি করেছেন এখনো পর্যন্ত? হিসেব নেওয়া যাক।
একনজরে ডোনাল্ড ট্রাম্প
(১) নিজের সরকারের বিজ্ঞানীদের মূর্খ বলেছেন, এবং জনপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিত্ব ডাক্তার এ্যান্থনি ফাউচিকে বিপর্যয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেন?
কারণ, ডাক্তার ফাউচি করোনাভাইরাসের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে বারবার সাবধান করে দিয়েছেন। আমার মনে আছে, মার্চ মাসের প্রথম দিকে আমি যখন কলকাতা থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসি, তখন ডাক্তার ফাউচি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, এই বছরের মধ্যেই দু লক্ষ মানুষ আমেরিকায় এই রোগে মারা যাবে। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বারবার করে মুখাবরণ পরা ও শারীরিক দূরত্ববিধি বজায় রাখার ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প ও তার চারপাশের বিজ্ঞানবিরোধী এবং নিষ্ঠুর শাসকসম্প্রদায় তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি।
(২) সম্প্রতি ট্রাম্প তার ক্যাবিনেট সেক্রেটারি উইলিয়াম বার প্রমুখদের ভর্ৎসনা করেছেন, কেন তারা ওবামা, বাইডেন এবং হিলারিকে বিভিন্ন চার্জে গ্রেফতার করেনি। অর্থাৎ, এ ধরণের গ্রেফতার করলে ডেমোক্রেটিক পার্টির বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো আরো বেশি সম্ভব হতো। বিশেষ করে, অতি-দক্ষিণপন্থী রেডিও, টিভি ও ইন্টারনেট শোগুলোতে এই নিয়ে প্রবল ঘৃণামূলক প্রোপাগাণ্ডা চালানো সম্ভব হতো। যা ট্রাম্পের অশিক্ষিত সমর্থক গোষ্ঠীকে আরো উত্তেজিত করে তুলতে পারতো।
(৩) বিজ্ঞান ও জলবায়ু-পরিবেশ সম্পর্কে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই নেতিবাচক। তিনি বরাবরই পরিবেশ ও জলবায়ু সঙ্কটকে হোক্স অর্থাৎ মিথ্যা গুজব বলে অভিহিত করে এসেছেন।
আমেরিকার এক বিশাল শ্রেণীর মানুষ বিজ্ঞান বোঝেনা, এবং ধর্মান্ধতা তাদের মধ্যে খুব বেশি। এরাই ট্রাম্পের আসল সমর্থক। এরা পরিবেশ সঙ্কটের মতো, বিশ্বায়িত উষ্ণায়নের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই করতে চায়না। এবং ফসিল ফুয়েল অর্থাৎ কয়লা, তেল, পেট্রোলিয়াম জাতীয় জীবাশ্ম-জ্বালানির নির্বিচার ব্যবহার আমাদের পৃথিবীকে যে কতখানি বিপজ্জনক করে তুলেছে, সে সম্পর্কে এদের কোনো ধারণাও নেই, বা জানার ইচ্ছেও নেই।
পেনসিলভ্যানিয়া, ফ্লোরিডা, মিশিগান এই ধরনের রাজ্যগুলো -- যেখানে সুইং ভোটারের সংখ্যা খুব বেশি, অর্থাৎ যারা দুই প্রার্থীর যে কোনো একজনকে ভোট দিতে পারে -- সেখানে আবার এসব শিল্পে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজ করে। তারা জানেওনা, পৃথিবীতে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যে এক বিশাল আন্দোলন চলছে, এবং তাদের কর্মচ্যুত না করেও নৈতিকভাবে ফসিল জ্বালানি থেকে সবুজ শক্তিচালিত শিল্পে তাদের স্থানান্তরিত করা সম্ভব।
কর্পোরেট মিডিয়াতেও এসব কথা কখনো বলা হয়না, আর শিক্ষার অভাবহেতু আমেরিকানরা এসব বিষয়ে ভালো বুঝতেও পারেনা। ট্রাম্প এদের ভোটকেই আজ পাখির চোখ করেছেন। আমেরিকার মাত্র এক তৃতীয়াংশ মানুষ কলেজ শিক্ষিত।
(৪) রাশিয়ার পুটিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন জাতীয় অত্যাচারী স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের ট্রাম্প প্রকাশ্যে সমর্থন করে এসেছে। এছাড়া ভারতে মোদী এবং ব্রেজিলের বলসেনারো ধরণের আধা-স্বৈরতান্ত্রিক এবং ধর্মান্ধ শাসকদের ভূয়সী প্রশংসা করে এসেছেন। সৌদি আরবের রাজপরিবারের তিনি একজন বড় পৃষ্ঠপোষক -- যেহেতু তারা ট্রাম্পের প্রচুর সম্পত্তি কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে কিনেছে, ফলে তারা নিশ্চয়ই খুব ভালো লোক। মানবাধিকার লঙ্ঘন? বিরোধীদের গলা কেটে ফেলা? ওসব নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন।
(৫) ট্রাম্পের আরো অনেক গুণ ও উক্তি আছে। যেমন, তিনি ইমিগ্রেন্টদের ধর্ষক ও খুনি বলে চিহ্নিত করেছেন বহুবার। নারীদের সম্পর্কে কুৎসিত কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলেছেন অনেকবার। কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর ঘৃণার শেষ নেই। মুসলমানদের তার খ্রিস্টান হিংস্র জাতিবিদ্বেষী বাহিনী চরম শত্রু বলে মনে করে। প্রাউড বয়েজ অথবা কেকেকে জাতীয় ভয়ঙ্কর সুপ্রিমেসিস্ট দলের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা আছে -- এ কথা সবাই বলে থাকে।
(৬) আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে তিনি ধ্বংস করে দিতে চান। সমস্ত জনমুখী, কল্যাণমুখী আইন এক এক করে শেষ করে দিচ্ছেন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকা সরে এসেছে। ফলে, পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংস আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। নিজের ও কর্পোরেট আমেরিকার মুনাফা ছাড়া ট্রাম্প কিছুই বোঝেন না।
এই হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংক্ষিপ্ত পরিচয়।
আর একবার ট্রাম্প নির্বাচিত হলে কী হবে আপনারাই ভেবে দেখুন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম
আমাদের দেশের কাগজগুলো আমেরিকার ভোট সিস্টেম নিয়ে তেমন কিচ্ছু জানেনা। ব্যাঙের ছাতা টিভি নেটওয়ার্কগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম। অথচ, বিদগ্ধ আলোচনা ও বিশ্লেষণে তাদের জুড়ি নেই। ভুলে ভরা আলোচনা, এবং ফালতু বিশ্লেষণ। আমার মনে আছে, আমি যখন কলকাতায় থাকতাম এবং আরএসএস ও এবিভিপির উঠতি তারকা ছিলাম, তখন এই লেখাগুলো পড়েই নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মনে করতাম। এখন মনে হলে হাসি পায়।
বামপন্থী তাত্ত্বিক ছিলেন সত্যিকারের জ্ঞানী কয়েকজন -- যেমন হীরেন মুখার্জী, নরহরি কবিরাজ, ভূপেশ গুপ্ত, এস এ ডাঙ্গে। আমি হীরেন মুখার্জীর বক্তৃতা শুনেছি। নরহরি কবিরাজ অনেক পরে আমাকে তাঁর স্নেহধন্য করেছিলেন। কিন্তু সে হলো আমেরিকায় আসার পরের কথা। এখন নরহরিবাবুর সুযোগ্য পুত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক সুদীপ্ত কবিরাজ আমাকে অগ্রজের বন্ধুত্ব দান করেছেন।
কলকাতার ব্যাপারটা হাস্যকর। বড় বড় নামজাদা কাগজের নামজাদা সব সাংবাদিক। অনেক টাকা উপার্জন তো করেনই তাঁরা, তাছাড়া লোকের মুখে মুখে তাঁদের নাম ঘোরে -- এমনই তাঁদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁদের উপস্থিতি সে অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। আমাদের মতো অর্বাচীনেরা যেমন সে সময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো, আর তাঁদের মুখনিঃসৃত দুচারটে বচন শুনে নিজেদের ধন্য মনে করতাম।
অথচ, আজ এই পঁয়ত্রিশ বছর আমেরিকায় থাকার পরে, এবং রাস্তার ধুলো খেয়ে রাজনীতি করার পরে, হাজার হাজার মার্কিন শ্রমিককে রাজনীতি-অর্থনীতি-মিডিয়ার পাঠ দেওয়ার পরে বুঝতে পারি, এই সমস্ত এলিট ক্লাসের ফাঁপা সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্যেই আমাদের শিক্ষা এতো কম ছিলো। সে রাজনীতির ব্যাপারেই হোক, সাহিত্য সঙ্গীত সিনেমা থিয়েটার সংস্কৃতির ব্যাপারেই হোক, কিংবা চিত্রকলা। এঁরা একটা জ্যোতির্বলয় দিয়ে নিজেদের ঘিরে রেখেছেন, এবং তাঁদের মালিকদের প্রশ্রয়ে পুষ্ট হচ্ছেন। এবং তাঁদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে আমাদের আরো সীমিত করে তুলছেন বংশ পরম্পরায়। এঁরা শাসকশ্রেণীর তাঁবেদারি ছাড়বেন না, কিন্তু নিজেদের নিরপেক্ষ ও অবজেক্টিভ বলে ঢাক পেটাতে এঁদের জুড়ি নেই।
আমি আমেরিকায় এসেছিলাম ১৯৮৫ সালে। তখন রোনাল্ড রেগানের দ্বিতীয় মেয়াদ। মনে আছে, রেগানের দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশাল নির্বাচন বিজয় হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। আমি সুন্দরবন কলেজে সহ-অধ্যাপক মদনমোহন রায়ের কুঁড়েঘরে হ্যারিকেনের আলোয় সে নির্বাচনের ফলাফল শুনেছিলাম। এবং বলতে গেলে সেই আমার প্রথম সজ্ঞানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়।
এর আগে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় যে যুদ্ধবিরোধী মিছিল হতো, সে সময়ে আমি স্কটিশ ইস্কুলে পড়ি। দোতলা বাস থেমে যেতো মিছিলের আঘাতে। আমরা জানলা থেকে মাথা গলিয়ে দেখতাম মনুমেন্টের স্টপে। বুঝিয়ে দেওয়ার কেউ ছিলোনা, এবং দক্ষিণপন্থী মার্কিনপন্থী রাজনীতির আশ্রয়ে থাকার কারণে সে প্রতিরোধ আন্দোলনের মর্ম আমি বুঝতামনা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করে কলকাতার রাস্তায় মানুষ যে প্রাণও দিয়েছে পুলিশের গুলিতে, তা আমি তখন জানতে পারিনি। নকশালবাড়ি আন্দোলনের তাৎপর্য আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। ওদিকে আরএসএস জনসঙ্ঘ পরিবারের পিতৃতান্ত্রিকতা, আর এদিকে মাতুলালয়ে জোড়া বলদ থেকে ইন্দিরা কংগ্রেসের তেরঙ্গা হাত -- এর মধ্যেই আমার রাজনীতির পাঠ সীমাবদ্ধ ছিল। বাড়িতে আসতেন দেওরাস আর রানাডে জাতীয় বিশাল আরএসএস নেতা।
আমেরিকার রাজনীতি আমি উপলব্ধি করেছি বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বুশ-ডুকাকিস নির্বাচনের খেলার সময় থেকে। সেই থেকে আজ এই বাইডেন-কমলা হ্যারিস। আর ট্রাম্প নামক ক্লেদচরিত্র মিথ্যাচারী ফ্যাসিস্ট। এর মধ্যে ক্লিন্টন, ৯/১১ সন্ত্রাস, দ্বিতীয় বুশ ও চেনির নারকীয় ইরাক গণহত্যা, এবং বারাক ওবামা নামক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের আমেরিকা বিজয়। যে বিজয়ের তাৎপর্য এখনো আমেরিকা ও বিশ্ব ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেনি।