প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর "মহাস্থবির জাতক" এ ১৮৯৮ সালে কলকাতার প্লেগ এর বর্ণনা পাওয়া যায়। তার কিছুদিন আগে থেমে মুম্বাইতে মারাত্মক প্লেগের সঞ্চার হয়, সেই প্লেগ কলকাতার দিকেই ছুটে আসতে পারে সেই আতঙ্কে কাঁটা হয়েছিল কলকাতা। ঠিক এই মুহুর্তে এক ভয়ানক গুজব গেল রটে। মুম্বাই মেলে করে হাওড়া নেমে, এক মহিলা এক ঠিকে গাড়ি ভাড়া নেন। হ্যারিসন রোডের কাছে এসে চালক মহিলাকে গন্তব্য জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন "আমাকে চিনিস না? আমি প্লেগ দেবী," এই বলেই তিনি উধাও হন। ব্যাস এই গুজবের সাথে দাবানলের মত আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে কলকাতা জুড়ে।
আর অদ্ভুত ঠিক এই সময়ে প্লেগ ছড়াতেও থাকে। কর্পোরেশন থেকে এসে ঢেঁড়া পেটাতে লাগল শহর জুড়ে "বোম্বাইসে আদমী আনেসে থানামে খবর দেনা হোগা"। ব্যাস দুদিনে কলকাতা খালি হতে আরম্ভ করল। যাদের কোথাও যাওয়ার নেই তারা ছাড়া সবাই কলকাতা ছেড়ে পালাতে আরম্ভ করে। সেই সময়ের ঠিকে গাড়ির দারোয়ানরা সেই উপচে পড়া যাত্রীদের জন্য আকাশ ছোঁয়া ভাড়া চাইতে আরম্ভ করল, শুরু হল তুমুল অরাজকতা। ঘোড়ার শক্তিক্ষয় সংক্রান্ত আইন তখনও কলকাতায় শুরু হয় নি ফলত মানুষ নিংড়ে নিতে থাকল।
কর্পোরেশন প্লেগের টিকা নেওয়ার অনুরোধ করতে থাকল মানুষকে। কিন্তু আবার গুজব রটল। কেউ বলল টিকে নেওয়ার দশঘন্টার মধ্যে মানুষ মরে যাচ্ছে, কেউ।বলল এক পয়সার মাপের মাংস পেট থেকে তুলে তাতে নাকি প্লেগের বীজ ভরে দেওয়া হচ্ছে। এসব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হতে থাকল মানুষের মনে। এর মধ্যে ঘৃতাহুতি হল, কর্পোরেশন জানালো যারা টিকে নেবে না তাদের আইসোলেশনে যেতে হবে, জোর করে তাদের হাসপাতালে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। প্লেগের হাসপাতাল তৈরি হল মেছোবাজারের মার্কাস স্কোয়ারে। এসব নানান ক্ষোভ মিলিয়ে শহরে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হল। সে সময় কলকাতায় স্বাস্থ্যরক্ষকদের প্রধান ছিলেন ইংরেজ কুক সাহেব। তাকে পেটাবে বলে মানুষ খুঁজতে লাগল। প্রশাসন পড়ল মহা বিপদে।
এই সময়ে সরকার এক জবরদস্ত পরিকল্পনা করে। সমাজের সমভ্রান্ত পরিবার গুলি যদি টিকা নেয় তাহলে সবাই তা দেখে সাহস পেতে পারে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে তখন হিন্দু ও মুসলমান ছেড়ে সরাসরি ব্রাহ্মদের সাথে কথা বলে প্রশাসন। কারণ তারাই ছিল বিদ্যাশিক্ষায় সর্বাগ্রে এবং সম্মানীয়ও বটে। এরা সব কাজেই অগ্রনীও ছিলেন। সাথেসাথেই ভারত মহাসভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় সহ বেশকিছু বাড়ি ব্রাহ্ম রাজি হন। তাদের টিকে দেওয়া হয়, এবং তার অব্যবহিত পরে সবার জ্বর আসে। পরবর্তীকালে তাঁরা কর্পোরেশনের থেকে এই মর্মে শংসাপত্র পান যে যদি আক্রান্ত হন তাদের আইসোলেশনে যেতে হবে না। কিন্তু এতেও কাজ হয় না। বাকিদের মধ্যে কোন প্রভাবই বিস্তার করতে পারেন না ব্রাহ্মরা। টিকে নেওয়ার ভীতি,অনীহা অব্যাহত থাকে। বাঁচোয়া প্লেগ তার যাত্রা অব্যাহত রাখেনি সেযাত্রা। কলকাতা রক্ষা পায়, তবে তা জনসচেতনতার জন্য নয়, নেহাতই প্লেগের অনীহায়।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার দিকে ফিরে দেখতে গেলে হাসির উদ্রেক হয় না, বরং মিল পাওয়া যায়। সেই সময় কলকাতায় যা যা হয়েছে, আজকেও তাই তাই হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে আমরা সকলেই অপেক্ষায় আছি করোনার অনীহার।