ভূমিকা
আমাদের দেশ এখন এক ঘোর সংকটে নিমজ্জিত। খুবই অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলেছে ভারত। প্রকৃতপক্ষে দেশের সংবিধান বিপন্ন। মানুষের দৈনন্দিনতার উপর সরাসরি আঘাত হানছে দেশের সরকার আর সরকারের দল। কে কী খাবে বা কী পরবে কিংবা কে কাকে ভালোবাসবে অথবা বিয়ে করবে, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে এই দল। এবং এই দল পরিচালিত গোটাকতক রাজ্যসরকার ইতিমধ্যেই এই মর্মে আইনও করে ফেলেছে। দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার ফন্দি এঁটেছে সরকার। এই হিন্দুত্ববাদীরা এখন বাংলাকে 'টার্গেট' করেছে। বিষ ছড়িয়ে বাংলার সংস্কৃতিকে উচ্ছন্নে পাঠাতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা।
এই সময়ে বিপন্ন সংস্কৃতিকে অস্ত্র করেই রুখে দিতে হবে সবরকম অপচেষ্টা। বাঙালির মনে আর শরীরের কোষে কোষে বহুকাল ধরেই যে 'ধর্মীয়'প্রেক্ষিত জীবন্ত আছে তাকে উন্মুক্ত করেই দাঙ্গাবাজদের মুখোমুখি শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। এই লক্ষ্যেই আগমন ইশতিহারের।
বাংলাদেশ কেবল সজল সবুজই নয়, সুরেলাও বটে। এর হাওয়ায় হাওয়ায় সংগীত। গান। বাংলার মনে গান। প্রাণে গান। শরীরময় গান। যত উৎসব-পালা-পার্বণ--- সবটাই সংগীতমুখর। আর সেইসব গানে গানে ছড়িয়ে রয়েছে মিলনের মাধুর্য, যা বাংলার অন্তরের সত্য। অস্তিত্বের ভিত্তি। দাঙ্গাবাজদের ফন্দি ফিকির এই ইমারতকে টলাতে চাইছে। আমাদের অন্তরের সেই সত্যটাকে এইবার প্রকাশ করার সময় হয়েছে।
কেবল নির্বাচনের জন্য আমাদের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতিহার হাজির হয়। এই রীতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। ইশতিহার সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা আছে। সেই ধারণাকে পাথেয় করেই আমিও এখানে এই ইশতিহারের অবতারণা করেছি। তবে, খানিক তফাৎ আছে। এই ইশতিহার মিথ্যাচারের ফুলঝুরি নয়। এ হল বাঙালির অন্তরের রক্তক্ষরণের আক্ষরিক দলিল--- রক্ত-মাংসের ইশতিহার অথবা লোকমুখে বাঙালির ধর্মচিন্তা।
গম্ভীরায় হিন্দু-মুসলমান
মালদা জেলার লোকনাট্য গম্ভীরা। চৈত্র সংক্রান্তির সময় গম্ভীরার রমরমা। শিবকে কেন্দ্র করে আচার অনুষ্ঠান ও পালাগান। তবে, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসেও পালাগান পরিবেশনার রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু, চৈত্র সংক্রান্তিতেই গম্ভীরার আসল আচার-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই উৎসবের জন্য রচিত গানই গম্ভীরার পালাগান। শিবের উদ্দেশে গান গেয়ে নানান অভাব-অভিযোগ জানাবার প্রথা রয়েছে এই গানে। আমাদের দেশে, রাজ্যেও এখন রামচন্দ্র আর হনুমানেকে নিয়ে খুব জোর তরজা চলেছে। এর জেরে সংঘর্ষ-দাঙ্গা-মৃত্যুর খবরও আসছে। রাজনীতির কৌশলেই মুখোমুখি দুই পক্ষ ময়দানে মজুত। একই বৃন্তে দুইটি কুসুম এখন লড়াইয়ে মত্ত। এই প্রেক্ষিতেই একটা গম্ভীরার গান খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে---
ওহে শিব নিরঞ্জন,
কুন ফ্যাসাদে ফেললা তুমি হায়!
এযে মিলন দড়ি ছিঁড়্যা দিয়্যা
তাজিয়াতে কাজিয়া লাগায়।।
এই গানটা গেয়েছেন গম্ভীরার পালাগানের এক গায়ক-কবি, শিল্পী শমীর খলিফা। সামাজিক সম্বন্ধে যে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে কাছাকাছি পাশাপাশি থেকে এসেছেন, তাঁরা কেন হাঙ্গামায় জড়াবেন? এতেই অবাক হয়েছেন গায়ক---
এযে হিন্দু-মুসলমান
ছিল এক আসনে থান
গলাগলি পিরীত করতো
গাইতো গম্ভীরা গান।
এখন দেখছি ঢাকাভাঙ্গা
আর তাজিয়া টানা
ডাঙাতে ডিঙা ডুবায়।।
গম্ভীরার গায়ক-কবির এই বিস্ময় এখন একটা সর্বজনীন চেহারা নিয়েছে। একেকটা সংঘর্ষের পর আমরাও এমনটাই ভাবতে বসি,"কেন এমন হল?" এটা আমাদের একদম একটা চিরাচরিত ব্যাপার হয়ে গেছে এখন। কিন্তু এই গানে কবি-শিল্পী কেবল বিস্ময় প্রকাশ করেই থেমে যাননি। হানাহানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন---
ধর্মের ভাই বলিহারি
ধর্ম নিয়ে চলছে কিসের আড়াআড়ি?
আল্লা ঢাকের বোলে চাট্টি তোলে
আজানে কীষ্ট পালায়।
কুন্ঠে আল্লা ভগবান
কুন্ঠে আছে আদ্যের থান
মন্দিরে কি মসজিদেতে
পূজা সিন্নি খান।
তোমার নূরে কি
টিকিতে বয়স্যা
তসবীর কি
মালা ঘুরায়?
বাঙালির ধর্মীয় অঙ্গনে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে থেমে যাননি শরীর খলিফা। উত্তর খুঁজেছেন নিজেই। আর উত্তর তো এই সমাজেই আছে। কবি গেয়েছেন---
শুন্যাছি যবন হরিদাস
ছিল চৈতন্য গোঁসার দাস
হরি আল্লা একই ভাব্যা
নস্যাৎ করলে বাস।
শ্যাষে কাজীর বিচার হার মান্যাচে
দেখা আর উপাসনায়।।
এই বাংলার মাটি-জল-হাওয়া-আকাশ ভেদাভেদে ইন্ধন দেয় না। বাঙালির সামাজিক ইতিহাস হানাহানির কথা বলে না। গায়ক-কবি শমীর খলিফা তা বিস্মৃত নন। তারই নির্যাস ছড়িয়ে আছে গানের শরীরময়---
যত ওপরে যাব ভাই
জাত কোহতে নাই
একের জন্য সবাই পাগল
একে চাহে সবাই।
যত নীচের পাগল হয়্যা
ছাগল ধর্মেতে শুধু ধাঁধায়।
চাঁদ সুরজ তোমার এক
নদীর বাতাস আগুন এক
দুনিয়ার মানুষ দ্যাখছে
শুনছে খাছে নিছে।
ঐ একজনেরই সিজ্জন করা
সারা দুনিয়ায় একজনাই।।
এই সহজ সরল সত্যিটা বাঙালি মানসে, বাঙালি সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমারা এমনি অভাগা যে, মাঝেমাঝেই সত্যিটাকে হারিয়ে ফেলি। গম্ভীরার পালাগান তাই আকুল হয়ে গেছে---
শিব মির্চাও গণ্ডগোল
লাগাও আজান
ঢাক আর ঢোল
আল্লা আল্লা হরি হর
ধর সবাই বোল
একলা শমীরকে হাজির রাখো
তোমার গম্ভীর রায়।।
প্রতিদিন সন্ধেবেলা আজান আর শাঁখ একই সঙ্গে অনুরণিত হয় বঙ্গীয় সমাজের ধর্মীয় প্রাঙ্গণে। এখানে আল্লা-হরি-হর--- সবাই একসাথে ঢাক আর ঢোলে বোল তোলেন।
গম্ভীরার এই আশ্চর্য অনুভূতিই বাঙালির মর্মে জাগরুক থাকুক। এখন সময় বড়ই হিংস্র। বড়ই রক্তাক্ত। বাঙালির এই পালাগান সুস্থতার পথ দেখাক।
এমন অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে আছে। আসুন! সবাই মিলে খুঁজে বের করি।