সেদিন ভাইফোঁটা। বেলা ১১ টা। পোস্ট অফিসে চেনা ভিড় নেই। ২ নং কাউন্টারে বছর তিরিশের এক যুবা। কম্পিউটারে একমনে কাজ করে চলেছেন। খামটা কাউন্টারের ভেতরে দিয়ে বললাম, রেজিস্টার্ড পার্সেল হবে। খাম হাতে নিয়ে ডিজিটাল দাঁড়িপাল্লায় মেপে বললেন, ৪২ টাকা লাগবে। বললাম, রেজিস্টার্ড পার্সেল। একই উত্তর, ৪২ টাকা।
— সেকি! এই তো সেদিন ৩৬ টাকা লাগলো।
— হ্যাঁ, খরচ বেড়েছে। ১৮ % জি এস টি। কয়েকদিন হলো লাগু হয়েছে।
ভারতীয় ডাক বিভাগে পরিসেবায় সরকার চুপিসারে জিএসটি লাগু করে জনগণের পকেট খালি করছে। এমনকি ডাক বিভাগের কর্মীদের কাছেও পোস্টাল চার্জে জিএসটির লাগু হওয়ার খবর আগাম ছিল না। আশঙ্কা, ডাকবিভাগের অবস্থা আগামীতে বিএসএনএলের মতো হতে চলেছে। জোঁক যেমন মানুষের রক্ত চুষে নেয়, মানুষ তা জানতে পারে না, জিএসটিও তেমন। ভারতবর্ষে বিশ্বায়নের পর বাজার সর্বস্ব অর্থনীতির মানদণ্ডে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এল পরিবর্তন। এল VAT বা মূল্যযুক্ত কর ব্যবস্থা, যা চালু হয় ২০১০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে। এর পরে ‘Make in India’ কে সাফল্য দিতে গিয়ে এল জিএসটি। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত পরোক্ষ করকাঠামোতে এল পরিবর্তন। জিএসটির পুরো নাম হল Goods and Service Tax অর্থাৎ উৎপাদিত সামগ্রীর উৎপাদন ও ক্রয়ের জন্য অভিন্ন কর ব্যবস্থা। ১লা জুলাই, ২০১৭ তারিখে রাত ১২ টায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ঘটা করে সংসদ হলে জিএসটি চালুর ঘোষণা করে দিলেন এবং এর ফলে পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় এক দেশ, এক কর ও এক বাজার নীতি লাগু হল। এই বিলের মুখ্য উদ্দেশ্য হল দেশে সমস্ত পরোক্ষ কর, তা রাজ্য বা কেন্দ্র যেক্ষেত্রেই হোক না কেন, সেগুলিকে বিলোপ করে পরোক্ষ কর ব্যবস্থায় গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনা। এরফলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের কোষাগার ভর্তি হবে।
কিন্তু জিএসটির কিছু সীমাবদ্ধতা ও তার অপপ্রয়োগের ফল জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জিএসটি এখন মধ্যবিত্তের গলায় ফাঁশ। সাধারণ মানুষ যেহেতু উৎপাদিত সামগ্রীর খরচ ও পরিষেবা কর সম্বন্ধে সম্যক অবহিত নয়, তাই তাদের ক্ষেত্রে অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি এই অভিন্ন কর ব্যবস্থা প্রয়ােগের জন্য যে পরিকাঠামাে দরকার তারও একান্ত অভাব। সর্বোপরি সাধারণ জনসাধারণ এ ব্যাপারে এতটাই অজ্ঞ যে সরকার যে পথে তাদের নিয়ে যাবে বা যাচ্ছে তা তাদের মেনে নিতে হচ্ছে—‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র ‘খুড়োর কল’কে সার্থকতা দানের জন্য।
সামনে ২০২৪ এর নির্বাচন৷ নির্বাচনকে চাঁদমারী করে বিজেপি ভোট প্রচারের ঢাক পেটানো শুরু হয়ে গিয়েছে। মুখে মারিতং জগৎ, দেশে এখন বিজেপির শাসনে এটাই ভবিতব্য। আবার ক্ষমতায় এলে ‘উন্নয়নের বান’ ছোটাবে! এদিকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে জিএসটির হুমকি। করোনার সময় থেকেই অনেকেরই আয় কমেছে, টান পড়েছে রুটি-রুজিতে। কেন্দ্রের অবিবেচনাজনিত সিদ্ধান্তে রান্নার গ্যাস থেকে পেট্রোল-ডিজেলের লাগাতার দামবৃদ্ধি ও নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল-তেল-নুন থেকে গরিবের সামান্য মুড়িরও বাজারদর হু হু করে বাড়ায় প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্তের জীবনে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত। দৈনন্দিন যাপন জীবনে সাধারণ মানুষ চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। জিএসটি বসিয়ে কেন্দ্র আদায় করে নিতে চাইছে মানুষের কষ্টের রোজগারের অনেকটাই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে নেমে এসেছে দরকারি ওষুধপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। বাড়তি জিএসটির বোঝা চাপিয়ে চিকিৎসা খাতে ব্যয়কেও মানুষের সাধ্যের বাইরে নিয়ে গিয়েছে মোদী সরকার। চিকিৎসার বিলের সঙ্গে সঙ্গেই অতিরিক্ত জিএসটির বোঝায় ভারাক্রান্ত স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামও। হাসপাতালের বেড ভাড়া, চিকিৎসার উপকরণসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কিছু পরিষেবার ক্ষেত্রে জিএসটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজও স্বাস্থ্যবিমার ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ জিএসটি চালু রয়েছে। এবার হাসপাতালের বেডেও নতুন ৫ শতাংশ জিএসটির বোঝা চাপালো মোদী সরকার। বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে আবার ১২ শতাংশ জিএসটি বসেছে। সাধারণ মানুষের উপর আর কত বোঝা চাপাবে মোদী সরকার?
মূল্যবৃদ্ধি ও জিএসটির কোপে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ৫০ শিল্পপতির ব্যাঙ্কঋণ মুকুব করে দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে নিয়ে বিদেশে গা ঢাকা দিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন বিজয় মালিয়া, লোলিত মোদিরা। ক্ষমতায় আসলে বিদেশে রক্ষিত কালো টাকা উদ্ধার করার বুলি এখন ফিকে। আম আদমির ব্যাঙ্ক একউন্টে ষোলো লাখ টাকা ঢুকিয়ে দেওয়ার ধোঁকাবাজি গালগল্পও মানুষ আর গিলছে না। মানুষ বুঝে গিয়েছে, সব কা সাথ সব কা বিকাশ, মুখে এই বুলি দিলেও মোদি সরকার আসলে পুঁজিপতিদের পক্ষে। আদানি আম্বানির স্বার্থরক্ষার্থে ব্যস্ত মোদির দল। ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে আর ফেরত দেননি ৫০ শিল্পপতির একটা তালিকা ও তাদের ঋণ খেলাফির পরিমাণের কথা প্রকাশ করেছে কেন্দ্র। ওই টাকার অঙ্ক কত তা জানলে চোখ কপালে উঠতে পারে। গত বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত একটি হিসেব অনুযায়ী ৫০ জনের কাছ থেকে দেশের ব্যাঙ্কগুলি পাবে ৯২,৫৭০ কোটি টাকা। সংসদে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভগত কারাদ জানিয়েছেন, গীতাঞ্জলি জেমসের মালিক মেহুল চোকসির ঋণের পরিমাণ ৭,৮৪৮ কোটি টাকা। সরকার এদের বলছে ইউলফুল ডিফলটার। কার এরা? অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী যারা ঋণ নিয়েছেন, ফেরতও দিতে পারেন কিন্তু ফেরত দিচ্ছেন না। তারাই উইলফুল ডিফলটার। মেহুল চোকসি বর্তমানে বিদেশে। তাঁকে দেশে ফেরাতে ব্যর্থ কেন্দ্র। এদিকে অনায্যভাবে জিএসটির বোঝা চাপিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। রাজ্য থেকে করের টাকা তুলে কেন্দ্রীয় কোষাগার ফুলেফেঁপে উঠছে। অন্যদিকে একশো দিনের টাকা ও অন্যান্য অনেক সামাজিক প্রকল্পে রাজ্যের পাওনা প্রাপ্য বকেয়া টাকা দিতে মোদি সরকারের টালবাহানা চলমান। ফলে আমার রাজ্যে সামাজিক প্রকল্প থেকে শুরু করে জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের গতি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
যেখানে দেশের অর্থনীতিতে জিডিপি নিম্নমুখী, বেকারত্ব চরমে, দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের স্বপ্ন অধরা, কর্মসংস্থান তলানিতে,জিএসটির কোপে নাজেহাল মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সেখানে মোদি সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখানো রাজনৈতিক প্রচার ও কৌশল ছাড়া আর কী হতে পারে? আসন্ন ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে ইভিএম-এ এর জবাব কি সাধারণ মানুষ দেবে?