১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র বসুকে এক চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন : ‘যদি আমার বলশেভিক এজেন্ট হইবার ইচ্ছা থাকিত, তবে আমি ... প্রথম জাহাজেই ইউরোপ যাত্রা করিতাম। তথায় স্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্তির পর বলশেভিক দলে মিশিয়া সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার উদ্দেশে প্যারিস হইতে লেনিনগ্রাড পর্যন্ত ছুটাছুটি করিতাম; কিন্তু আমার সেরূপ কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নাই।’
কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার যে উপরোক্ত চিঠির বছর সাতেক আগে চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন : পাশ্চাত্য জগৎ দেখিয়ে দিয়েছে ‘জনশক্তি কী করতে পারে, আর এক উজ্জ্বলতর দৃষ্টান্ত’ হচ্ছে রাশিয়া। একথা লেখার পর তিনি আরও লিখেছিলেন : ভারতের উন্নতি একমাত্র সম্ভব সেই ‘জনশক্তি’ উত্থানের মাধ্যমেই।—দেখা যাচ্ছে বিশ শতকের বিশের দশকের প্রত্যুষলগ্নে ‘জনশক্তি’ এবং সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের যে আগ্রহের বিষয়টি এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা পরবর্তী সাত বছরের মাথার অপসৃত হয়েছিল। এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও তার কাজকর্মের অনুশীলন তরুণ সুভাষচন্দ্রকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পণ্ডিচেরি স্কুলের বলশেভিক বিরোধিতা এবং শিবরাম চক্রবর্তীর ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি’র মতো ঐতিহাসিক রচনাও সুভাষচন্দ্রকে আকৃষ্ট করেনি বলেই মনে হয়। তথাপি সুভাষচন্দ্র ছিলেন সমসময়ে বিদ্রোহী তারুণ্যের প্রেরণা, একজন জঙ্গি আন্দোলনের মুখপাত্র।
তিনি ছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে জঙ্গি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। বিদেশি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁর অপরিসীম বিরূপতা ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তাঁর ঘৃণা তাঁকে ‘কোনও আপস নয়’-এর অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেমে কোনও খাদ ছিল না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিগড় থেকে দেশমাতৃকার মুক্তি অর্জন তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা হয়ে উঠেছিল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 'সরকারি উপাধির মুকুট’ পরে ‘মন্ত্রিত্বের গদিতে আসীন’ হওয়ায় সুভাষচন্দ্র তাঁর ক্ষোভ গোপন করতে পারেননি।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসে যোগ দেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু কংগ্রেসে গান্ধীজির নেতৃত্ব-এর প্রতি তিনি বারবার বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন, তাঁর আন্দোলনের পথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে জঙ্গি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু গান্ধীজির প্রতিবন্ধকতায় তিনি বারবার বিপর্যস্ত হয়েছেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবিলম্বে জঙ্গি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে সওয়াল করেন, কিন্তু গান্ধীজি ‘কংগ্রেস এখনও তার জন্য প্রস্তুত নয়’ বলে সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব খারিজ করেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসকে আপসহীন পথে চলার কথা বললে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃবর্গ এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ততা দেখান এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস রফার পথে হাঁটতে চান। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করেন। এই নির্বাচনের ফল একদিকে যেমন দক্ষিণপন্থীদের হতাশ করে, তেমনই অন্যদিকে দেশের সমস্ত বামপন্থীদের মনে ‘আত্মবিশ্বাস ও আনন্দের শিহরণ’ জাগিয়েছিল। কিন্তু গান্ধীবাদীরা ‘সহজে নিরস্ত’ হননি। স্বয়ং গান্ধীজি প্রকাশ্যে আক্ষেপের সঙ্গে ঘোষণা করলেন: পট্টভি সীতারামাইয়া-র এই পরাজয় তাঁর নিজেরই পরাজয়। ফলে নির্বাচনে জয়ী হয়েও সুভাষচন্দ্রের পক্ষে প্রেসিডেন্ট-এর পদ আঁকড়ে থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করেন।
সুভাষচন্দ্র চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে ছ'মাসের চরমপত্র দিয়ে ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের’ জন্য চাপ সৃষ্টি করে অবিলম্বে লড়াইয়ের পথে নামতে। তিনি মনে করতেন গান্ধীজির মতো জনবরেণ্য নেতৃত্বের তরফে এমত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত এবং সঙ্গত। সুভাষ 'বামপন্থী' সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে গান্ধীজিকে একথা জানান। কিন্তু গান্ধীজি রাজি হননি।
সুভাষচন্দ্র শেষপর্যন্ত ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করে বামপন্থীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে থাকেন। তাঁর কথায় : ‘মহাত্মা গান্ধীর নামের প্রভাব সত্ত্বেও সন্মিলিত দক্ষিণপন্থীদের থেকে সম্মিলিত বামপন্থীদের অনুগামীর সংখ্যা অনেক বেশী।’ সুভাষচন্দ্র গান্ধীজির নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন দল গঠন করে বামশক্তিসমূহকে সংহত করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই আন্দোলনের কথা বলা সত্ত্বেও গান্ধীজি সম্পর্কে মোহমুক্ত হতে পারেননি। তিনি ব্রিটিশ সরকারবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি বারবার দুর্বলতা দেখিয়েছেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই হুগলি জেলা ছাত্র সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন : ‘যে 'গণবাণী' মহাত্মা গান্ধীর মুখে শোনা যায়, তাহা ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নূতন কথা।’ ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পর সুভাষচন্দ্র বামপন্থীদের সঙ্গে সংহতি রক্ষা করে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৩৯-এর ৫ অগাস্ট 'ফরওয়ার্ড ব্লক'-এর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন : দক্ষিণপন্থীরা যখন বামপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতায় অনিচ্ছুক, তখন ঐক্যের জন্য দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার প্রশ্ন আর ওঠে না।
সুভাষচন্দ্রের এই কথাবার্তার মধ্যে বামপন্থী শক্তিকে সংহত করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার বার্তা থাকলেও, সুভাষচন্দ্র এখানে বামপন্থীদের (বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের) ওপরে করণীয় কাজের বিষয়ে নির্দেশিকা চাপিয়ে দিতে প্র্যাসী হয়েছিলেন। এই সব নির্দেশিকা ও পরামর্শ কি বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের নিকট সম্মানের বিষয় বলে গণ্য হতে পারে? সুভাষচন্দ্রের বক্তব্য অনেকটা কর্তৃত্ববাদের প্রতিফলক হয়ে এখানে প্রকাশ পেয়েছে। তবে সুভাষচন্দ্র একথা জানতেন এবং বিশ্বাসও করতেন যে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যদি ভারতের বামপন্থীদের উপর 'আঘাত হানে' তবে দক্ষিণপন্থীরা তাতে বিচলিত হবে না। এতদসত্ত্বেও তিনি বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযোগ জানাতে থাকেন বাচিক ও লিখিত বয়ানে। এমনকি তিনি একথাও বলেন : বামপন্থীদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ছাড়া সম্মানজনক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এর ফলে দেখে গিয়েছে বামপন্থী বিশেষত কমিউনিস্টদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পি সি যোশি সরাসরি অভিযোগ করতে গিয়ে বলেছিলেন : নীতিহীন সুবিধেবাদের কারণেই সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে ‘বিতাড়িত’ হয়েছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ আকবর শাহ সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। আকবর শাহ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। তবে পার্টির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি সুভাষচন্দ্রের পার্টিতে যোগ দেওয়ায় মুজফফর আহমদরা ‘বিস্মিত’ হয়েছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আদর্শগত বিরোধের কারণেই সুভাষচন্দ্র সম্ভবত কমিউনিস্টদের প্রতি কোনওদিন খুব একটা নমনীয়তা দেখাতে পারেননি। সুভাষচন্দ্রের মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাব তাঁর তরুণ বয়স থেকেই লালিত হয়েছিল। তবে তা কখনও প্রকাশ্য ও আক্রমণমুখী ছিল না।
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর জওহরলাল নেহেরু একটি প্রেস বিবৃতিতে বলেছিলেন : আজ বিশ্বের সামনে ফ্যাসিবাদ আর কমিউনিজম এর মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর এক্ষেত্রে তিনি কমিউনিজমের পক্ষে। ফ্যাসিবাদকে তিনি ঘৃণা করেন। ফ্যাসিবাদ আর কমিউনিজমের মধ্যবর্তী কোনো রাস্তা খোলা নেই। এই দুটোর মধ্যেই একটাকে বেছে নিতে হবে, এবং এক্ষেত্রে তিনি অবশ্যইবেছে নেবেন কমিউনিজমকে। সুভাষচন্দ্র নেহেরুর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে এই বক্তব্যকে ‘মূলগতভাবে ভুল’ বলে আখ্যাত করেছিলেন।
১৯৪০-এর ১৩ মার্চ ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’-এর সম্পাদক সুভাষচন্দ্র আবার লিখেছিলেন : জার্মানি ফ্যাসিস্ট হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী হতে পারে, নির্মম বা নৃশংস হতে পারে, তা সত্ত্বেও এই গুণগুলির জন্য তাকে প্রশংসা না করে পারা যায় না—যেমন কীভাবে আগেভাগে পরিকল্পনা করতে হয়, সেইমতো প্রস্তুত হতে হয়.... বিদ্যুৎগতিতে আঘাত হানতে হয় তা তাঁরা ভালোই জানেন। উত্তরকালে তাঁর ‘দিল্লি চলো’ আহ্বানটিও তিনি নাৎসি বাহিনীর মুখে শোনা ‘না পারিস’ অর্থাৎ ‘প্যারিস চলো’ থেকে নিয়েছিলেন। ১৯৪২-এর ৬ এপ্রিল সুভাষচন্দ্র জেনারেল তোজোর প্রশংসা করেন, কেননা তোজো ভারতের ‘স্বাধীনতার সম্পর্কে খোলাখুলি ঘোষণা’ করেছেন। ১৯৪০-এর ১৯ মার্চ রামগড়ে নিখিল ভারত আপস বিরোধী সম্মেলনে ভাষণ প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্র ১৯২২-এ ‘সমাজতন্ত্রের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত' ইতালি কীভাবে 'ফ্যাসিস্টে পরিণত হল’ তার কথা বলতে গিয়ে মুসোলিনির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন : ‘তিনি তাঁর নিজের মনকে জানতেন এবং কাজে এগোতে তিনি ভয় পেতেন না, নেতৃত্বের সার কথা এই।’
১৯৪১-এর ১৭ জুলাই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করার পর জার্মান সরকারকে ভোরমানে যে রিপোর্ট দেন, তাতে বলা হয়েছিল : ‘স্বাধীন ভারতবর্ষ ঘোষণার লক্ষ্যে আমরা দৃঢ়সংকল্প’। এ-কথায় সুভাষচন্দ্র পুলকিত হয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতবর্ষ সম্পর্কে জর্মন কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত ডোরম্যানের রিপোর্টের সংযোজন অংশ থেকে জানা যায় : অক্ষশক্তি এবং জাপানের জয় ভারতবর্ষের ভাগ্যে প্রকৃত স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এনে দেবে। জার্মান, ইতালি ও জাপান আন্তরিক শুভেচ্ছার সঙ্গে ভারতবর্ষের সংগ্রামের সঙ্গী হচ্ছে।— অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র অক্ষশক্তির সপক্ষতা করে মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধের শরিক হয়ে ফ্যাসিস্ত দেশসমূহের সাহায্য নিয়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মাধ্যমে।
বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার বিষয়টিকে প্রাধান্যে রাখতে গিয়ে দেশীয় ক্ষেত্রে অক্ষশক্তির বিরোধী-শক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির নরম তথা আপসজনক মনোভাব সমসময়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য ফ্যাসিস্ত শক্তির সহায়তায় সামরিক অভিযানের নেতৃত্বকারী শক্তি হিসেবে সুভাষচন্দ্র জনবরেণ্য হয়েছিলেন। এ সময় ‘কমিউনিস্টরা’ সুভাষচন্দ্রকে বলতেন ‘দেশদ্রোহী’, ‘ফ্যাসিস্তদের অনুচর’। উত্তরকালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অজয় ঘোষ বলেছিলেন : কমিউনিস্টরা নেতাজীকে দেশদ্রোহী বলেছিল। ‘আমরা’ তাঁর সম্পর্কে এধরনের কথা বলার জন্য দুঃখিত। ১৯৪২ সালে অন্যান্য দেশপ্রেমিক দলের সঙ্গে ‘আমাদের’ অনুসৃত নীতির বিভেদ ছিল। জাপানের সাহায্যে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের যে নীতি নেতাজী গ্রহণ করেছিলেন সে নীতি ঠিক নয়। কিন্তু তাঁকে এজন্যে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া ‘আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ ভুল’ হয়েছিল। ‘আমরা’ এর জন্য দুঃখিত। সুভাষ সর্বোপরি দেশপ্রেমিক এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন যদিও অক্ষশক্তি সম্পর্কে তাঁর নীতি ও পথ ভুল ছিল এটাই আমাদের ধারণা।
সুভাষচন্দ্রর সঙ্গে নাৎসিদের সম্পর্ক নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছিল, তেমনই ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর হিসেবে সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে। সুভাষচন্দ্রের অনুসৃত পথ গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়ার সমসময়ে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ত সমর্থকদেরও সংখ্যাস্ফীতি ঘটেছিল।
সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। পরাধীন দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার মধ্যে কোনোরকম প্রশ্নের সুযোগ নেই। প্রশ্ন তাঁর অনুসৃত পথ নিয়ে। কংগ্রেসের মধ্যে যে লড়াই তিনি শুরু করেছিলেন, তা শেষপর্যন্ত তিনি ছেড়ে দিলেন কেন? পরাধীন দেশের মুক্তিকামী জনগণের অপরিমেয় সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চরম সাফল্যলাভের পথ ছেড়ে বিদেশি অক্ষশক্তির সহায়তায় দেশের বাইরে থেকে সামরিক অভিযানের পথকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-এর শত্রুকে নিজের মিত্র হিসেবে পেতে গিয়ে তিনি তাঁর মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও ফ্যাসিস্ত শক্তির খপ্পরে গিয়ে পড়েছিলেন। এদেশের বামপন্থীদের একটা অংশ, খুব নির্দিষ্টভাবে কমিউনিস্ট পার্টি, ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আপস করছে বলে অভিযোগ করতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র নিজেও বিস্মৃত হয়েছিলেন যে তিনিও ব্রিটিশবিরোধিতার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের শত্রুকে নিজের মিত্র বিবেচনায় তাদের সংস্পর্শে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যসাধনের শিকার হয়ে উঠেছিলেন। রমাঁ রল্যাঁ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন যে সুভাষচন্দ্র কমিউনিজম সম্পর্কে কোনো কথাই শুনতে চান না, তাঁর এই বিরাগের পেছনে সম্ভবত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘বর্তমান প্রতিনিধিদের’ বিরুদ্ধে কোনও ‘ব্যক্তিগত’ অভিযোগ থাকতে পারে। এতে করে তো দেশপ্রেমিক হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় না।
সুভাষচন্দ্র আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক। বিদেশি নিগড় থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে কোনোরকম আপসমুখীনতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। গান্ধীজির আপসমুখীন রাজনীতির তীব্র বিরোধিতা কংগ্রেসের মধ্যে তিনি করেছিলেন। ফ্যাসিস্ত শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সঠিক হওয়া সত্বেও তাঁর অনুসৃত পথটি ঠিক ছিল না। তাঁকে তোজোর কুকুর, দেশদ্রোহীর তকমাভূষিত করাটা আদৌ ঠিক হয়নি। এসব কথা বলার অর্থ তাঁর দেশপ্রেমকে খাটো করা।
এই সুভাষচন্দ্রই বলেছিলেন : ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। রাত্রির পরে যেমন দিন আসে, তেমনি স্বাধীনতাও আসবে।—এই স্বপ্নদ্রষ্টার মতো দেশপ্রেমিক কজন হয়?