কবিতায়, সাহিত্যে বা শিল্পে বরাবরই পড়ে এসেছি অনুভূতি, আবেগ এসবের কোনও কাঁটাতার হয় না। দুঃখের কারণ আলাদা হলেও আমাদের সকলের কান্না এক। আনন্দের ক্ষেত্রেও তাই। আবেগের ক্ষেত্রেও। কাঁটাতার আসলে লড়াইয়েরও হয় কি? বহু আগে সুমন লিখে গিয়েছিলেন, 'যেখানে যে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া।' সত্যিই কি তাই? ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কায় যে মেয়েটি বোরখা পরতে চান এবং ইরান, মরক্কো, সৌদির যে মেয়েটি বোরখা পরতে চান না, তাদের লড়াই কি কোথাও গিয়ে এক? চয়েস আর চোখরাঙানির এই পাল্টা যুক্তিতে কে ঠিক কে ভুলের চেয়েও কোথাও গিয়ে বড়ো করে দেখতে হয় ব্যক্তি স্বাধীনতাকে। অন্যের অধিকারকে সন্মান না দিতে পারলে তুমি কীসের রাষ্ট্র (পড়ুন সংখ্যাগুরু) হে?
এক্ষেত্রে ভারত আর ইরান নিয়ে আলোচনা করতে বসলে সেই একই প্রশ্ন বারবার মাথায় আসে। ভৌগোলিক দূরত্বের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুই লড়াইয়ের নাম বা দাবী আলাদা হলেও কোথাও গিয়ে একসাথে মিশে যায় ভারত বা ইরান। একসাথে মিশে যায় মুসকান খান বা মাহসা আমিনি। যেখানে একজনের মুঠো ছিল হিজাবের পক্ষে এবং অন্যজনের হিজাবের বিপক্ষে৷ এখন অনেকেই প্রশ্ন করবেন তাহলে দুই লড়াই এক হয়ে যায় কীভাবে? আপাতভাবে লড়াইয়ের পক্ষ আলাদা মনে হলেও, আদতে লড়াইয়ের কারণ এক। পোশাকের স্বাধীনতা। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ উদ্ধার করতে নামা নীতি পুলিশ, প্যাট্রিয়ার্কিকে তোল্লাই দেওয়া অমুক জেঠু কাকু, উপচে ওঠা টিআরপিযুক্ত মেইন্সট্রিম কন্টেন্ট, এই কোনওকিছুই ঠিক করে দেবে না, কে কী পরবে! কতটুকু পরবে! কীভাবে পরবে! কেন পরবে! এই কী কেন কীভাবে কতটা সবকিছুর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেসব নাম একের পর এক উঠে এসেছে দশক শতক ধরে তাদের মধ্যে অন্যতম কর্ণাটকের মুসকান খান, তেহরানের মাহসা আমিনি। একজন কর্ণাটকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। একদল উন্মত্ত লেঠেলবাহিনীর জয় শ্রী রাম স্লোগানের বিপরীতে একাকী তাঁর মুঠো উঁচিয়ে 'আল্লাহ আকবর' বলা নিয়ে চর্চা কম হয়নি। দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়া জনতার এক দল পক্ষ নিয়েছিল মুসকানের। পক্ষ নিয়েছিল পোশাকের স্বাধীনতায়। জোরালো বক্তব্যে জাহির করেছিল, 'আমার পোশাক, আমার অধিকার।' কিন্তু সেই একই অধিকার আমরা কতটুকু নিজেদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করেছি তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এমনও উদাহরণ আছে, যারা তখন পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে গলা ফাটিয়েছিল, তারা নিজেরাই পোশাক চাপিয়ে দিয়েছে তাদের নিজ নিজ গন্ডীতে। এমনকি বাকিদের পোশাক নিয়ে সেম করতেও ছাড়েনি। সেক্ষেত্রে চয়েস নয়, চোখ রাঙানিই সত্য। আর এই অপ্রিয় সাম্প্রদায়িক সত্যের সঙ্গে উঠে এসেছে মাহসা আমিনি। চয়েস, চোখ রাঙানি, অধিকার, অনাধিকার এই সমস্ত প্রশ্নচিহ্নের উত্তর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ইরানের মাহসা আমিনি।
মাহসা আমিনি বাইশ বছর বয়সী একজন ইরানী মহিলা। সরকারি মানদণ্ড অনুযায়ী হিজাব বিধি মেনে না চলার জন্য জনসাধারণের মধ্যে হিজাব বিধিমালা বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আইন প্রয়োগকারী কমান্ডের একটি সহ-স্কোয়াড গাইডেন্স পেট্রোল দ্বারা মাহসা আমিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ বলেছে যে কারাগারের মধ্যে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, তিনি মেঝেতে পড়ে যান ও দুই দিন কোমায় থাকার পর মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা যদিও বলেছেন অন্য কথা। যা শোনার পর তোলপাড় হয়েছে গোটা বিশ্ব। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তাঁকে মারধর করা হয় এবং তাঁর মাথাটিকে একটি পুলিশের গাড়ির পাশে ধাক্কা দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হল, হিজাব পরা আমার অধিকার হলে হিজাব না পরা আমার অধিকার হবে না কেন? তাহলে কি মুসকান খানের পাশে দাঁড়ানো অধিকারের পক্ষ নিয়ে গলা ফাটানো চয়েস আদতে মিথ? কাঁটাতার, সীমান্ত সব পেরিয়ে সমস্ত সংখ্যাগুরুদের চাপিয়ে দেওয়া চোখ রাঙানিই সত্যি? তবে কি রাষ্ট্রযন্ত্র, ক্ষমতা, পুরুষতান্ত্রিকতা বা সংখ্যাগুরুই ঠিক করে দেবে কোথায় কে কী পরবে, কে কী খাবে, কে কী মাখবে বা কে কতটুকু যাবে?
আর এই সব চাপিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে দারুণ উদাহরণ সাম্প্রতিক চলতে থাকা ফিফা আয়োজিত ফুটবল বিশ্বকাপ। যেখানে আয়োজক দেশ কাতার। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। যেখানে ফুটবল ওপেনিং সেরেমনিতে ধর্মীয় বাণী দিতে যান কোনও ধর্ম প্রচারক। যেখানে একটা লম্বা বিধিনিষেধমালা। অমুক করা যাবে না। তমুক বলা যাবে না। ওইটা দেখানো নিষিদ্ধ। যদিও এই এত কিছু বিধিনিষেধকে তুড়ি মেরে গ্যালারিভর্তি ইরানের ম্যাচে দেখা গেছে জার্সিতে লেখা মাহসা আমিনির নাম। পাশে ক্যাপিটাল লেটারে লেখা 'WOMAN LIFE FREEDOM'।
লড়াই সব চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই বুঝিয়ে দিয়েছে নিজের পক্ষ। বুঝিয়ে দিয়েছে নিজেদের অধিকার। তেহরান থেকে ঢাকা, কাবুল থেকে কর্ণাটক, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যেভাবে নারী-পুরুষ-ট্রান্সজেন্ডার নির্বিশেষে অন্যের যাপনে মাথা ঢুকিয়েছে, যেভাবে নিজের রাক্ষুসে দাঁতচোখমুখ উঁচিয়ে তেড়ে এসেছে সংখ্যালঘুর দিকে, যেভাবে নিজেদের ফ্যাসিবাদকে উদযাপন করতে জারি করেছে একের পর এক ফতোয়া, তা কতটা আশার বা আলোর তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকলেও এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুসকান খান বা মাহসা আমিনি যে আদতে এক তীব্র স্ফুলিঙ্গ তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এই ক্ষমতাসীন দানবীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে মুসকান, মাহসাদের এই লড়াই আদতে যে এক সে নিয়েও কোনও দ্বিমত নেই। এবং এই সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু, সীমান্ত-কাঁটাতার, সাদা-কালো, ধর্ম-অধর্ম সবকিছু নির্বিশেষে আমার পক্ষ, আমার পোশাক, আমার অধিকার, আমার লড়াই আদতে এক। মুসকান বা মাহসাদের মতোই। ভারত বা ইরানের মতোই। নাহলে খেলা শুরুর আগের জাতীয় সঙ্গীতে গলা না মেলানো এই অভিনব প্রতিবাদের জন্য ইরানের খেলোয়াড়দের এত কুর্নিশ আমরা ভারতীয়রা কেনই বা দিচ্ছি?