পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তোতাকাহিনী এবং বৃথাকাহিনী

  • 04 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 500 view(s)
  • লিখেছেন : শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
বারুইপুরের চম্পাহাটি নীলমণিকর বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা চরিত্রা দাশগুপ্ত ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে বই-খাতা ছিঁড়ে উল্লাস করার প্রসঙ্গে এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, "আধুনিকতার এই যুগে শিক্ষার প্রতি যেন শ্রদ্ধাটাই চলে গিয়েছে অনেক পড়ুয়ার। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বইয়ের গুরুত্ব কমেছে। বই পড়ে জানার আগে ছাত্রছাত্রীদের একাংশ গুগল সার্চ করে প্রশ্নের উত্তর জানতেই বেশি উৎসাহী। স্বভাবতই বইয়ের প্রতি আগের মতো আগ্রহ থাকছে না।"

সত্যি তাই? যদি সত্যি হয় তাহলে কেন? সামান্য পিছিয়ে যাই গত শতাব্দীর আশী-নব্বই-এর দশকে? গুগল সার্চ ছিলো না তখন। কিন্তু ছাত্রদের মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক সহায়িকা ছিল। দশ বছরের প্রশ্ন ধরে ধরে তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে সম্ভাব্য প্রশ্নের এবং উত্তরের ব্যবস্থার বন্দোবস্ত ছিল। ছিল মাইক্রোজেরক্স থেকে হাতের লেখায় ছোট্ট একটা কুটি কাগজে বই-এর পাতার পর পাতা লিখে ফেলা, যা নকলের কাজে লাগবে। তখন তাহলে আগ্রহ ছিল বই-এর প্রতি?

আরো পিছনে যাব? জীবনানন্দ একসময় এই ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে, চলতি কথায় মানে বই-এর আধিক্য দেখে, আপশোস করেছিলেন। তারও পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। ক্ষোভে-দুঃখে শুধু বিকল্প প্রতিষ্ঠান বিকল্প ভাবনাতে গড়ার চেষ্টাই করেননি, লিখে ফেলেছিলেন 'তোতাকাহিনী'।

কাহিনীর সবটাই আজও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবু কিছু অংশকে এখানে উল্লেখ করতেই হবে।

এক-যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে।

রাজা বলিলেন, “এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।”

মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, “পাখিটাকে শিক্ষা দাও।”

এই শিক্ষা দিতে গিয়ে দেখা গেল পাখির ঠোঁটে, পায়ে আনা খড়কুটোর বাসাই আসলে তার অবিদ্যার জন্য দায়ী। তাই তার সোনার খাঁচা তৈরী হল। পণ্ডিতে শিক্ষা দেবেন বলে অজস্র পুঁথিপত্র নকল হতে থাকলো। শেষে তা হল পর্বত প্রমাণ। খাঁচার দেখভালে লোক লাগলো অনেক। সেই সব ভাগিনেয়র দল মাসে মাসে মোটা তনখাও পেতে থাকলো। অর্থাৎ পাখির বিদ্যার প্রয়োজন কী না এ কথা বোঝার চাইতে বিদ্যার আয়োজনে অঢেল অর্থ ব্যয় হতে থাকলো। অঢেল লোক সেই অর্থে আমোদে গড়াগড়ি খেলো। কিন্তু পাখির কি প্রয়োজন ছিল মানবের বিদ্যার?

আদত প্রশ্নটা এখানে। আমরা উপনিবেশকালের আগে যখন বিদ্যাচর্চা করেছি, তার কতগুলি স্তর ছিল। সাধারণ কাজ চালানোর বিদ্যা ছিল একস্তর, অন্যস্তরে ছিল জমিদার-রাজা-নবাব-বাদশাদের দরবারে কাজ করার বিদ্যা। ছিল বিদ্যাদান করার জন্য ব্রাহ্মণ্য থেকে মোল্লা-মৌলবীর স্তরের শিক্ষা।

মানুষ যবে থেকে পশুপালন করছে, ফসল উৎপাদন করছে, ব্যবসা করছে তাকে একপ্রকার গাণিতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হোতো। নতুবা বিনিময় করার উপায় থাকতো না। তার বাইরে থাকতো নানা সামাজিক-ধর্মীয় রীতি-নীতির শিক্ষা যা সে পরিবার এবং সমাজ থেকেই পেতো। থাকতো শ্রমজ কর্মের বিশেষ বিশেষ শিক্ষা যা পরিবারক্রমে বা পরম্পরায় মানুষ শিখতো। বিশেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষা না-থাকলে সেই শিক্ষা দিয়ে চলে যেত জীবন। অন্তত জীবনের আনন্দের তাতে কমতি হোতো না। বস্তুত কারিগর-শিল্পী-কৃষকদের জীবনে খাদ্যাভাবের মতনই প্রাচুর্য্যেরও সময়কাল ছিল। যখন যেমন সময় তেমন ব্যবস্থা শাসনকে নিতে হোতো। অথবা সে শাসন অচল হয়ে যেত, বহিরাক্রমণেই হোক কিম্বা আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে।

এই যে সমাজ-পরিবার-গোষ্ঠী ইত্যাদি থেকে বিযুক্ত করে উচ্চতর শিক্ষার আয়োজন সেও তো ছিল সেইকালে। ব্রাহ্মণ্যই হোক কিম্বা বৌদ্ধাদিদের, কঠিন শৃঙ্খলা প্রকরণ ছিলো। বেদ পড়তে গেলেও লাগবে ব্যাকরণ। কাব্য পড়তেও লাগবে। এভাবেই একেকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একাধিক বিষয় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা হত। তারপরে সে সব যাঁরা অতিক্রম করতেন তাঁরা রাজ্যকাঠামোর মধ্যে বা রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে স্বীকৃত হতেন পণ্ডিত হিসেবে। কিন্তু আনন্দ কি সর্বদা ছিলো এতে? ছিল সামাজিক ইত্যাদি সংযোগ? 

যদি লক্ষ্য করে দেখেন মহাভারতাদির মধ্যেকার শিক্ষাদানের কাহিনীগুলিকে, সে বেদই হোক কিম্বা ব্রহ্মজ্ঞানলাভ, দেখবেন শিষ্যকে শারীরিক শ্রমের কাজ করতে হচ্ছে এসব বিদ্যা লাভ করতে। গুরুর হয়ে গুরুর সম্পদবৃদ্ধি যদি একদিক হয় তার অন্যদিক হল সমাজ-সংশ্লিষ্ট থেকে জ্ঞানার্জন করা, নতুবা সে শিক্ষা শুধু জপ-তপে কাজে লাগবে। শিষ্য গো-পালন করতে গেলে গরুর চরার জমি, জমির অধিকার, তার পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা থেকে তার অসুখ-বিসুখ বোঝা ইত্যাদি সবই কালে কালে বুঝে যেতেন। ফলে ব্রহ্মচর্যাশ্রম ছেড়ে গার্হস্থ্যে গেলে নিজ সম্পদের তদারক করতে তাঁর অসুবিধে হোতো না। কিন্তু রাজারাজড়ার সন্তানদের জন্য আবার সম্পূর্ণ শিক্ষাটাই বেদাদি জ্ঞান ও যুদ্ধবিদ্যাশিক্ষা। অর্থাৎ বর্ণে বিভাজিত শিক্ষা প্রণালী, যার যার কর্তব্যের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত। বৈশ্যের শিক্ষা ফসল থেকে ব্যবসার বিষয় হোতো, কিন্তু শূদ্রের শিক্ষা যতটুকু প্রভুর কাজে লাগে ততটুকুই হোতো।

অর্থাৎ শিক্ষা যত বর্ণাশ্রমী হয়ে উঠলো তত তা সংরক্ষিত হয়ে উঠলো এবং সামাজিক স্পর্শ সেখানে নেতিবাচকরূপে (যুদ্ধ থেকে প্রভুর সেবা) এসে উপস্থিত হল। আদিম মানবসমাজের শিক্ষার স্বাভাবিক যে আনন্দ ছিল তা কালে কালে খর্ব হয়ে সংরক্ষিতজনেদের প্রভুত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। স্বাভাবিকভাবেই যাতে চিত্তের স্পর্শ লাগে না সে শিক্ষা শুধু বিত্তের দিকে বয়ে যায়, নইলে রিক্ত হয়ে যায় একসময়। ইসলামের আগমনে ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়নি, হয়েছে সমাজচ্যূত অতিকায় উপরিকাঠামো বানিয়ে তাকে অসামাজিক করে তোলার ফলে। আপাতত কথাটা সরলীকরণ মনে হবে, কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যাবে যে যদি সমাজের সঙ্গে সংযোগ থাকতো তাহলে কয়েকটা মঠ অথবা কিছু পণ্ডিতের টোলের মধ্যেই এ আটকে পড়তো না। হাটে-মাঠে-ঘাটে নতুন নতুন করে বেঁচে উঠতো।

সামান্য কিছু কথাও আবশ্যিক ইসলামের আগমনের পরেরকালের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে। অরুণ ঘোষ, তাঁর 'শিক্ষার ভাবধারা, পদ্ধতি ও সমস্যার ইতিহাস'- গ্রন্থে বোর্নিয়ের লেখা থেকে আওরঙ্গজেবের কিছু কথা উদ্ধৃত করেছিলেন। "বোর্নিয়ের বিবরণ পাঠে জানা যায় যে আওরঙ্গজীব একবার তাঁর এক প্রাক্তন শিক্ষককে তাঁকে সঙ্কীর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন বলে তিরস্কার করেন। আওরঙ্গজীবের অভিযোগ হল যে শিক্ষক তাঁকে আরবী ভাষার ব্যাকরণের খুঁটিনাটি শিখিয়েছিলেন কিন্তু বৃহত্তর জগতের বিভিন্ন দেশের ভূগোল, শাসনব্যবস্থা, রাজাদের শক্তি ও ঐশ্বর্যের পরিমাণ ও অর্জনের বিবরণ--এ সব কিছুই তিনি শেখান নি। বিভিন্ন দেশের সমাজ ব্যবস্থা, তাদের রীতি নীতি, সে সব দেশের বিপ্লব ও পরিবর্তনের ধারা এর কিছুই শিক্ষক মহাশয় তাকে শেখান নি। তিনি অভিযোগ করেন যে শিক্ষক মহাশয় তাকে ধর্মের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ আচার আচরণ সবই শিখিয়েছেন কিন্তু জীবনকে সহনীয় করে তোলার মত চিন্তা ও নিজের মতামতকে যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার মত কোন দার্শনিক শিক্ষা বা মানুষের চরিত্র ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য বোঝবার মত কোন গূঢ় শিক্ষা কিছুই তিনি তাকে দেন নি। তাছাড়া রাজপুত্রদেরও রাজার কর্তব্য, যুদ্ধবিদ্যা - এই সব তাঁকে শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল। কঠিন আরবী ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম না করে মাতৃভাষাকেই শিক্ষার ধাহন করা প্রয়োজন ছিল।"

এই উক্তির সঙ্গেই যদি মনে করেন আকবরের শিক্ষানীতির কথা, তাহলে আমাদের ভাবনা আরো প্রসারিত হতে পারে। "পরিবর্তনশীল সময়ের প্রয়োজনানুসারে শিক্ষার পরিকল্পনা গঠন করার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন এবং কেউ যাতে যুগোপযোগী শিক্ষাকে উপেক্ষা না করে সেই মর্মে আদেশও তিনি দিয়েছিলেন। তিনি মাদ্রাসার জন্য যে পাঠক্রম নির্ধারিত করেছিলেন তাতে নীতি, গণিত, কৃষিবিদ্যা, জরীপ, জ্যোতির্বিদ্যা, শাসন বিদ্যা, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা, চিকিৎসা, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত ছিল। সংস্কৃত শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি ব্যাকরণ, ন্যায়, বেদান্ত ও পতঞ্জলী পাঠের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাদ্রাসায় হিন্দু ছাত্রদেরও প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। আকবরের নির্দিষ্ট পাঠক্রমে বিজ্ঞান ও বৃত্তিমূলক শিক্ষারও স্থান ছিল।" শুধু তাই-ই নয় তিনি মনে করতেন শিক্ষক ছাত্রকে কিছুটা পথ সাহায্য করতে পারে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছাত্র যাতে নিজে নিজে শিখতে পারে সেই ব্যবস্থা।

আধুনিক চিন্তাধারা কিন্তু উভয়েরই। তাতেও কেন ইসলামের আগমনের পরে আরো বেশী করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার হোলো না? এর নানাবিধ উত্তর আছে। তার একটি উত্তর আওরঙ্গজেবের থেকেই আমরা পাই। মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম না-করা। ভারতের নানা প্রান্তে নানা ভাষা। সেখানে আরবী এবং ফার্সি দিয়ে, এমনকী উর্দু দিয়ে শেখানোর চেষ্টাও ভিন্ন ভাষা আগে শিক্ষা করা, তারপরে শিক্ষালাভ করার মত দুরুহ বিষয়। এতে অবস্থাপন্নের বা সাহায্যপ্রাপ্তের চেষ্টার হয়তো ত্রুটি হবে না, কিন্তু মাতৃভাষার স্ফূর্তি কোথায় পাবে? এর বাইরে রয়েছে সে যদি কিছু না-শেখে তাহলে পেট চালাতে পারবে না, কারণ সে অন্য কোনো বিদ্যায় - কারিগরী থেকে কৃষি - দক্ষ নয়। অতএব শিক্ষা নিতান্তই পেটের দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আনন্দের স্থান ছিল না। তাছাড়া সাম্রাজ্যও এমন মানবিক বিষয় নয় যে সে দিকে দিকে অজস্র মানুষকে শিক্ষালাভে সাহায্য করবে। 

মুঘল বা তার আগের সুলতানি শাসন, পরের দিকের নানা নবাবী শাসনও চলেছে নানা ভূখণ্ডে। শক্তিকেন্দ্রের থেকে যে অঞ্চল যত দূরবর্তী সে ততই স্বাধীনভাবে শাসন করেছে। সেখানে কেন্দ্রিক নীতি প্রযোজিত হয়নি সর্বত্র। কিন্তু সমস্যাগুলো যে একেবারে বোঝা যাচ্ছিলো না এমনটা নয়। বাংলায় নবাব-সুলতানদের মহাভারত ইত্যাদির বাংলায় অনুবাদ করানোর চেষ্টা কিন্তু দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গত। কিন্তু চাইলেই তা হওয়া সম্ভব ছিল না। গোঁড়ারা দীর্ঘকাল তো কুরানেরই অনুবাদ করতে দেননি বাংলা ভাষায় (যেমন বেদের অনুবাদও ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামিতে বাংলায় হতে অনেক দেরী হয়েছে), তাহলে বাকীদের ক্ষেত্রে তাঁরা দেশীয় ভাষায় জ্ঞানচর্চা নির্বিরোধে মেনে নেবেন?

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানকে শাসন করতে, যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে, নিজেদের নীতিকে স্থিরভাবে প্রয়োগ করতে যথেষ্ট সময় গিয়েছে ইসলামধর্মীয় শাসকদের। ইসলামি জ্ঞানচর্চার যে বিস্তৃত ইতিহাস এশিয়া এবং ইউরোপে ছড়িয়ে ছিল, সেই উচ্চশিক্ষাকেও কিন্তু এখানকার শাসকেরা আনতে পারেননি। পারলে ব্রিটিশরা আসা অবধি গ্রীক দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদিদের জানতে এবং পড়তে অপেক্ষা করতে হোতো না। তা হয়েছে, এবং যখন ব্রিটিশেরা এলো তারাও শিক্ষার কাজকে তাদের সাম্রাজ্যসেবার কাজে লাগাতেই চাইলো শুধু। মুঘল বা সুলতানি আমলেও ক্রীতদাসদের শিক্ষা দেবার চল হয়েছিল, তেমনই চল ঘটালো ব্রিটিশরা, রক্তে ভারতীয় কিন্তু সংস্কৃতিতে ব্রিটিশ দাস তৈরী করার জন্য। দীর্ঘকাল সেই শিক্ষানীতিই চললো। অবশেষে যখন ১৯৪৭-এ পৌঁছোনো গেল তখন আমরা ব্রিটিশ শাসনকে আপাতভাবে ঝেড়ে ফেললেও, নীতিগতভাবে পারলাম না তাকে ভেঙে নূতন ব্যবস্থা গড়তে।

আবারও তাই ফিরে যেতে হয় সেই প্রশ্নে যে পাখিটার কি মানবীয় বিদ্যায় প্রয়োজন ছিল? না, ছিল না। আমরা যখন শিক্ষানীতি বানালাম তথাকথিত স্বাধীনতার নামে তখন বানালাম সেই পুরোনো বিপুলাকৃতি এক খাঁচার ব্যবস্থা। বানাতে গিয়ে আমরা ভুলে গেলাম মানুষ শুধু সংখ্যা নয়, তারা ব্যক্তিও। একের প্রয়োজন বা ইচ্ছা অন্যের সঙ্গে না-মেলাই স্বাভাবিক। একের শেখার পদ্ধতিও অন্যের সঙ্গে মিলবে না। এও ভুলে গেলাম, জন্মগত ভাবে শিশু যখন পৃথিবীতে আসে সে এক কঠিন জীবন-যাপন করতে হবে জেনে আসে না। বস্তুত আসার জন্য তার অনুমতি কেউ কখনো নেয়নি, নেবেও না। এসে তাকে পড়তে হয় কঠিন জীবনাবর্তের মধ্যে। সেখানে যদি কোনো বস্তুতে রস না পায়, আনন্দ না পায়, তাহলে সে স্বাভাবিকভাবে নেবে কেমন করে তাকে? শিশুরা তো প্রাথমিকভাবে সবকিছুই বোঝে স্বাদ দিয়ে। শিক্ষার জন্য তার স্বাদকোরক কেমন ভাবে কাজ করছে আমরা কি বুঝতে চাইলাম? না। আমরা কলের পুতুলের মতন কিছু মানবরূপী যন্ত্র তৈরী করতে চাইলাম।  

সে সব যন্ত্র যতদিন কল-কারখানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে যন্ত্রের চাইতে মানবসম্পদের গুরুত্ব ছিল ততদিন কিছু হলেও পেতো। তারপরে তার আর ঠাঁই নাই। ছোটো সে তরী, মালিকের মুনাফাতে গিয়েছে ভরি। এইবারে? শিক্ষা যে আসলে জীবনকে জানতে-বুঝতে সাহায্য করে এবং সবচেয়ে কঠিনতমকেও জানা-বোঝার যে আনন্দ তা তো আমরা শিক্ষাব্যবস্থাতে রাখিইনি। মেকলের কেরানী তৈরীর কারখানা স্বাধীন বলে সগৌরবে চালিয়েছি? আজ সে কারখানা থেকে যা উৎপাদিত হয় (মানুষ হয় লিখতে পারলাম না বলে দুঃখিত) তা বাজারে কাটছে না, সেই উৎপাদনেরা যাবে কোথায়, করবেই বা কী, এই শিক্ষা দিয়ে?

মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বইগুলোকে ছিঁড়ে কুচি কুচি করে উড়িয়ে দিচ্ছে বলে রাগ করছেন? কেন ভাই? একটুও ভাবছেন না, সমস্যাটা শুধু ওখানে নয়, টোকাটুকিরও নয়, সমস্যাটা অনেক অনেক গভীরে?

 

যে কোনো বিষয়কে ভালবাসতে গেলে লাগে আনন্দ। খেলাধুলোর আনন্দ, সিনেমা দেখার আনন্দ, মোবাইলে গেম খেলার আনন্দ - এমন অজস্র আনন্দ লাগে। কিন্তু যে কাজে আনন্দ নেই সে কাজ আপন হবে কেমন করে? হ্যাঁ বলতে পারেন কৃষক কিম্বা শ্রমিক কি প্রত্যক্ষ আনন্দ পেয়ে কাজ করেন? হ্যাঁ, আংশিক আনন্দ পেয়ে থাকেন। প্রত্যক্ষত তাঁদের মরা-বাঁচা ঐ ঐ কাজের উপর নির্ভর করছে। আর হ্যাঁ, যখন ফসল ফলে ওঠে তখন আনন্দ করেন, উৎপাদন বিক্রি হলে, ঠিকঠাক মাইনে এবং বোনাস পেলে আনন্দ করেন, তাই আমাদের এত উৎসব সব ফসলের মরসুমের উপর নির্ভরশীল। কল-কারখানার উপরে বিশ্বকর্মার পুজোও নির্ভর করেছে। এখন করে রিকশা, টোটো, অটো, বাস ইত্যাদির চালকদের উপর। গণেশ চলে ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। অর্থাৎ সামান্য অর্থ এলে বা সম্ভাবনার কথা ভাবলেই একপ্রকার আনন্দ এখনো সামাজিক জীবনে আছে। বই পড়াতে কি তাই হচ্ছে?

 

ধরুন যদি বই পড়লেই সবার উপার্জনের সম্ভাবনা খুলে যেত তাহলেও লোকে বই পড়তে চাইতো। তা হয় না। যদি বই পড়তে আনন্দ পেত, নাম্বারের দিকে তাকানোই শিক্ষা বলে তাদের না-বোঝানো হতো, তাহলেও অনেকে বই পড়তো। বইকে জীবন গড়ার হারিয়ার ভাবতো। যে কাজই করুক তাতেই বই লাগবে বলে ভাবতে পারতো। আমি পড়েছি পড়ার আনন্দে, আমার মতন অনেকে পড়েছেন এবং পড়েন। এখনো বই পড়তে পাগলের মত ভালবাসি।

 

হ্যাঁ, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার জোয়াল আমাদের কাঁধেও ছিল। কেমন করে যেন তাকে পাত্তা না-দিয়ে চলেছি। অবাধ্য বলে। কিন্তু এও সত্যি, যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার মানে অনেক টাকা আর সমাজে প্রতিষ্ঠা না-বুঝিয়ে ওগুলোর মানে মানুষের ভালো করা, সমাজের ভাল করা বোঝানো হোতো, সামাজিক-পারিবারিক সম্মান-শ্রদ্ধা পাবার রাস্তা বলে বোঝানো হোতো তাহলে হয়তো ওগুলোও আরো আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। আরো আনন্দ নিয়ে পড়তাম। একই কথা বলা চলে অন্য অন্য পেশার ক্ষেত্রেও। মুচি, মেথর, কুলি ইত্যাদি বলে যাঁদের শ্রেণীগতভাবে ঘৃণা করতে শেখাই আমরা, ছোটো করে দেখতে শেখাই, শ্রমের কাজকেও, তার ফলে আমাদের সন্তানেরা শ্রমজ কাজকে ঘৃণ্য বলে ভাবে। সমাজে সম্মানজনক নয় বলে ভাবে। অথচ একটি পেশার মানুষও যদি কাজ বন্ধ করে দেয় আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হবে। শুধু এটুকুই ভাবুন, আপনার নগর থেকে ময়লা সংগ্রহকারীরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। ভেবে দেখুন, বুঝে যাবেন কেন এঁদের সম্মান না-করে আসলে আমরা শ্রেণীঘৃণায় উচ্চবিত্ত এবং তাদের পেটোয়াদের মধ্যে নিজেদের মিলিয়ে নিয়েছি।

 

যাই হোক, সত্যি কথা হল বহু বহুকাল হল শিক্ষা থেকে রাষ্ট্র এবং আপনারা আনন্দ কেড়ে নিয়েছেন। বইগুলো বন্ধু নয়, শত্রু। অস্ত্র নয়, কারাগার। তাই সুযোগ পেতেই ছিঁড়ে উড়িয়ে দিচ্ছে ওরা। মৌলিক সমস্যা শিক্ষার সমস্যা, সমাধানে কারো আগ্রহ দেখি না। উপর চালাকি করে রাষ্ট্র চালাচ্ছে নির্বোধ আরো তৈরী করার দিকে, আমরাও চলছি। তাতে রাষ্ট্রের শাসনে সুবিধে। কুম্ভ নিয়ে কোটি কোটি কথা হবে, মানুষ বাঁচতেই পারছে না তা নিয়ে কথা হবে না।

 

অথচ এখনো আনন্দ আছে। এখনো কত মানুষকে দেখি নিজের ইচ্ছেতে বই কিনছেন। কিন্তু এই সব বই পড়ে চাকরী পাবেন বলে পড়ছেন না। টাকা কামাবেন বলে পড়ছেন না। এই সব বই পড়ে প্রাথমিকভাবে আনন্দ পেতে চান। সম্ভব হলে কিছু এমন শিক্ষা যা তাঁর জীবনকে আরো সমৃদ্ধ করবে। ইনি তো বই ছিঁড়ছেন না? তারমানে প্রশ্নটা অতটা কঠিনও নয় যে বোঝা যাচ্ছে না। আসলে উত্তরটা কঠিন বলে আমরা সিলেবাসের বাইরে ফেলে দিয়েছি। শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে দেবার মতন দীর্ঘ কঠিন লড়াই আমরা লড়তে চাই না। এ আমাদের অপারগতা মাত্র, শিক্ষার্থীদের নয়।

 

0 Comments

Post Comment