লোকসভার বিজেপি সাংসদ শ্রী রমেশ বিধুরি, নতুন লোকসভা ভবনে, চালু বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় বহুজন সমাজ পার্টির সাংসদ দানিশ আলির উদ্দেশ্যে কুরুচিপূর্ণ, আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করে আক্রমণ শানিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সারা দেশ দেখেছে সেই দৃশ্য । সেই আক্রমনের ভাষায় ধরা পড়েছে চিরাচরিত মুসলিম বিদ্বেষ, ঘৃণা, ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা। বিধুরির দলের অন্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা, বসে বসে হেসেছেন, বিরোধী দলের সাংসদরাও সে মুহূর্তে তাকে বহিষ্কার করার দাবি তুলতে পারেননি আর স্পিকার মহাশয়ও সভার গুরুত্ব ও সম্মান রক্ষায় ব্যর্থ। অবশ্য এই ঘটনার পরেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বহু মানুষ এই কদর্য কাণ্ডের নিন্দা করেছে। দেশের নেটিজেন ও নাগরিক সমাজ এই নিয়ে আলোচনায় মেতেছেন, কেউ বা ক্ষুব্ধ, কেউ বিব্রত আবার এক অংশ বিধুরির সমর্থক। ভাষণের আপত্তিকর অংশ লোকসভার রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, স্পিকার মহাশয় রমেশ বিধুরিকে সামান্য তিরস্কার করেছেন (বহিষ্কার নয়) ও বিজেপি তাঁকে ১৫ দিনের মধ্যে এহেন ব্যবহারের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। এই হলো ঘটনা।
কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় এমন কি নতুন কথা বলে ফেলেছেন বিধুরি মহাশয় যা নিয়ে এত হইচই? যে যে শব্দ তিনি আক্রমণ কালে ব্যবহার করেছেন, আমরা কি সেগুলোর সাথে পরিচিত নই? আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক সংলাপে, মুঠোফোনের ওয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডে, চায়ের দোকানের রাজনৈতিক আলোচনায়, ট্রামে বাসে আমরা কি এই শব্দগুলোই বারবার শুনিনি? এমনকি বন্ধুমহলেও ঠাট্টার ছলে মুসলিম বন্ধুদের সম্বোধন করতে এরকমই শব্দ ব্যবহার করি না? তাহলে হঠাৎ এত বিষ্ময় কিসের? প্রতিদিনের জীবনযাপনে যে ঘৃণাকে আমরা নেহাতই 'স্বাভাবিক' করে তুলেছি; সেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের এই নগ্ন প্রকাশ কি আমাদের এখনো লজ্জা দেয়? আমাদের বিবেকদংশনের কারণ হয়ে ওঠে? আয়নায় নিজেদের দ্বিচারিতার প্রতিচ্ছবি কি আমাদের সত্যিই বিচলিত করে? হয়তো জাতি হিসাবে এখনো আমরা ঘৃণার সেই স্তরে নামতে পারিনি, যেখানে নামলে স্বাভাবিক - অস্বাভাবিক এর প্রভেদ লুপ্ত হয়। কিন্তু সেই পথেই কি আমরা হাঁটছি না? রমেশ বিধুরি কাণ্ড আমাদের সামনে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নই তুলে ধরে। ঘৃণাপূর্ণ ভাষায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ রমেশ বিধুরির জন্য প্রথম নয়, আর মনে হয় শেষও নয়। তিনি যাকে বলে সিরিয়াল অফেণ্ডার।
অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের ছাত্রনেতা শ্রী বিধুরি ২০১৪ ও ২০১৯ এ সাউথ দিল্লি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ হন। নানান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বারবার সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। জি ২০র প্রস্তুতিকালে শহরের সৌন্দর্য বাড়াতে বস্তি উচ্ছেদ ও ঢেকে দেওয়ার মতন ঘটনা আমরা তার সংসদীয় ক্ষেত্রে এই কিছুদিন আগেই তো দেখেছি। এছাড়া কিছুদিন আগে তাঁর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে বামন বা dwarf বলে সম্বোধনের কথা এখনো অনেকের মনে থাকবে। মহিলা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে কটুক্তি করার বহু অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। ২০১৫ তে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পাঁচজন মহিলা সাংসদ, তৎকালীন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের কাছে রমেশ বিধুরির বিরুদ্ধে অভব্য আচরণের অভিযোগ দায়ের করেন। শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী ও মায়াবতী দেবীকে অশালীন আক্রমণ করার জন্য তিনি কুখ্যাত। সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে তার আক্রমণ ও মানসিকতা সর্বজনবিদিত, এটাই তার রাজনীতির।
তবে ঘৃণার রাজনীতিতে শুধু তিনি কেন, তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরাও কম যান না। পরিধেয় কাপড় থেকে বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চিনে নেওয়ার কথা বলা, প্রকাশ্যে এক বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষদের গুলি মারার হুকমি, মুসলিম মহিলাদের অনলাইনে নিলাম করানো, কবর থেকে তুলে এনে মৃত মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি, দলিত বা মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণের অপরাধে সাজা পাওয়া অপরাধীদের অমৃতকালে মুক্তি ও মালা পরিয়ে বরন, সংখ্যালঘুদের জন্য বুলডোজারের ন্যায়, গণপিটুনিতে হত্যা ও তার ন্যায়বিচার না হওয়া ইত্যাদি উদাহরণ অনেক দেওয়া যায়। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরে দেশে ধর্মের নামে বিভাজনের রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি জনমানসে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এটাই বর্তমানের বাস্তব।
আজ সংসদের ভিতরে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে এক সাংসদ আরেক সাংসদকে গালিগালাজ করছেন, সেই একই ভাষার মুখোমুখি হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশু থেকে বয়ষ্করা, ইস্কুল থেকে কর্মস্থলে, রাস্তাঘাট থেকে পরিচিত 'বন্ধু মহলে' প্রতিদিন । আমরা চলার পথে বহু অপ্রীতিকর ঘটনা দেখেও না দেখার ভাণ করে চলি, আমরা সামাজিক ঘৃণার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠি না। মাঝেমধ্যে বড়সড় ঘটনা নাড়া দিলে আমরা Not In My Name - বলে একরকম এড়িয়েই যাই। নিজেদের অজান্তেই আমরা অনেকে ঘৃণার ফাঁদে জড়িয়ে গেছি। মুসলমানদের সম্পর্কে নানান রটনাতে আমরা বিশ্বাস করি আর সেই ভ্রান্তি দূর করার দায়িত্বটিও নিজেরা নিতে আমরা নারাজ, সে গুরুভার আবার মুসলমানদের উপরেই ন্যস্ত করেছি। কত সহজেই আমরা এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় সকলকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় তুলেছি; সেখানে অভিনেতা থেকে খেলোয়াড়, সাংসদ থেকে সব্জি বিক্রেতা কেউ বাদ নেই, এমনই আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের নিস্পৃহতা আর এটাই সংখ্যাগুরু মৌলবাদের উর্বর চারণভূমি।
তাই শুধু রমেশ বিধুরিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কি লাভ আছে? আমরা কি নিজেদের অজ্ঞতা ও সংস্কার প্রসূত মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ঘৃণা ও সংকীর্ণতাকে কাঠগড়ায় তুলতে প্রস্তুত? যদি দেশের বৃহদাংশ মানুষ প্রথমদিন থেকেই ধর্মের অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ শানানোর রাজনীতির বিরোধিতা করতো, তাহলে কি কোন রাজনৈতিক দল ঘৃণার রাজনীতিকে ভোট বৈতরণী পারের উপায় হিসেবে আঁকড়ে ধরত? অনেকে বলবেন আজকের এই পরিস্থিতি তৈরী করার পিছনে তো রাজনৈতিক দলের অবদানই সব থেকে বড়; এ কথা অবশ্যই সত্যি। কিন্তু এই অবস্থা রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। ধর্মের নামে রাজনীতিকে আমরা কখনোই সার্বিকভাবে প্রত্যাখান করিনি।
ধর্মের নামে যে সব নেতারা বিভাজন সৃষ্টি করেন, তারা কত সহজেই নির্বাচনে লড়াই করার টিকিট পান, আর তাদের আমরাই নির্বাচিত করি আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে। প্রঙ্গত উল্লেখ্য বর্তমানের সংসদে ২৯ জন সাংসদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা হেট স্পীচের মামলা, এর মধ্যে অনেকেই রমেশ বিধুরির দলের সাংসদ। রমেশ বিধুরিও তো জনপ্রতিনিধি, কারা সেই জনগণ যারা এই রকম সিরিয়াল অফেণ্ডারকে দু - দুবার তাদের প্রতিনিধি করে সংসদে পাঠিয়েছেন? এক অর্থে রমেশ বিধুরি যে কাজটি করেছেন তা হলো, জনপরিসরে যে কদর্য সংকীর্ণতা আজ এক স্বাভাবিক বাস্তব, তাকে তিনি সংসদের কক্ষে এনে ফেলেছেন; এই হলো তার অপরাধ! কাজেই রমেশ বিধুরির বক্তব্যর সমালোচনায় অনেকের মুখে বারবার শুনছি সংসদের গৌরব নষ্ট করার কথা, কিন্তু একই ঘটনা যখন নিরন্তর সমাজে ঘটে চলে তখন কি সমাজের গৌরব নষ্ট হয়না? আর সমাজে যদি এই বিকৃত মানসিকতা প্রাধান্য লাভ করতে থাকে, সংসদকে কতদিন আর তার বাইরে রাখা সম্ভব? সংসদ তো সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
অনেকে আবার বলবেন দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো ঘৃণার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। আমার এ কথা বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করে অথচ দেখি আজ চারপাশে জনগণের প্রতিবাদের থেকেও বেশী বাঙ্ময় জনগণের নীরবতা। ইতিহাস সাক্ষী, দেশ যখন রমেশ বিধুরিদের মতন জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, তখন দেশবাসীর নীরবতা, সেই যাত্রায় ইন্ধনই যোগায়, তাকে প্রতিহত করতে পারে না।
এতকিছুর পরেও অবশ্য আমাদের ভরসা রাখতেই হবে জনগণের শুভবুদ্ধির উপর। আমাদের বড় ভরসা সংবিধান প্রদত্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর। সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা ও ধর্মের নামে রাজনীতিকে পরাস্ত করতে, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো, নাগরিক কর্তব্যের বোধ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সদর্থক উদ্যোগ বাড়ানোর কোন বিকল্প দেখি না।