পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গল্প ঠিক না

  • 08 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 337 view(s)
  • লিখেছেন : ব্রতী মুখোপাধ্যায়
গল্প এখন একটাই। দাদু বলল। নাতিনাতনিদের বয়েস কম। দাদুর কাছে গল্প শুনতে ভালবাসে সবাই। দাদু আবার বলল, গল্প এখন একটাই। শোনো তাহলে।

সকালের গল্প। 

তখন সমুদ্রের দিকে পঞ্চান্ন ডিগ্রি কোণ করে সূর্য। তখন একটা দুধশাদা বাস আসছে। বাসভর্তি বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞরা এসেছে মার্কিন মুলুক থেকে। 

বিশেষজ্ঞ মানে?

বিশেষজ্ঞ মানে যারা বিশেষভাবে জানে। সেই বাসটিকে পাহারা দিতে সামনে পেছনে তিন-তিনটে জিপ। জিপভর্তি পুলিশ। 

 

সত্তরজন মানুষ তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। বেশিরভাগই মেয়ে। বেশিরভাগই বাচ্চা। বাসটির মুখোমুখি সবাই মিলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। 

ফ্রান্সিস তাদের একজন। গ্রামের প্রান্তে ফ্রান্সিসের ফার্নিচারের দোকান। সে বলল, যেতে দেব না। 

ফ্রান্সিস কিন্তু চিৎকার করেই বলল। 

মারিয়ানা ছুটে এসেছে রাজমার ক্ষেত থেকে। মারিয়ানাও বলল, যেতে দেব না। 

মারিয়ানাও কিন্তু চিৎকার করেই বলল। 

বাসভর্তি বিশেষজ্ঞ আর জিপভর্তি পুলিশ। বাস থমকে গেল। জিপ থমকে গেল।

 

নাতনিদের ভেতর থেকে একজন এবার জিজ্ঞেস করল, ভিয়েতনামের গল্প বলছ?

দাদু বলল, ভিয়েতনামের গল্প না। 

 

বিকেলের গল্প। 

বন আর পাহাড়। কিছু দূরে সমুদ্র, সমুদ্রের তীর। সমুদ্রের তীরে সারি সারি নারকেল গাছ। এইসময় দীর্ঘ আর দীর্ঘতর গাছগুলির ছায়া। গাছগুলো সমুদ্রের এলোমেলো নোনা বাতাসে পাগলপাগল দুলছে।

 

এইবার আরও দুটি বাস ছুটে আসছে। বাসভর্তি পুলিশ। পুলিশের কাঁধে কাঁধে রাইফেল, কোমরে কোমরে পিস্তল। সামনে সেই সত্তর জনের পাশে এইসময় আরও আরও মানুষ। বেশিরভাগই মেয়ে। বেশিরভাগই বাচ্চা। 

তাদের একজন আফনসো। আফনসোর ওষুধের দোকান আছে। আফনসো চিৎকার করে বলল, যেতে দেব না। বেশ জোরেই চিৎকার করে বলল। 

 

এই গল্প কেমন যেন। নাতিনাতনিদের ভেতর কেউ কেউ উসখুস করছে।

 

দাদু আবার শুরু করল, পুলিশ কিন্তু একটা কথাও বলল না। 

কেউ কোথাও চেঁচিয়ে উঠল, ফায়ার!

একবার মাত্র। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের গুলি। হাত লক্ষ্য করে। পা লক্ষ্য করে। পেট, বুক আর মাথা লক্ষ্য করে। 

আর্তনাদ করে উঠল কেউ। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল কেউ। বুকে গুলি লাগায় ততক্ষণে একজনের মৃত্যুও হল।

 

নাতিনাতনিদের ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, নিকারাগুয়ার গল্প? গুয়াতেমালার গল্প?

দাদু বলল, নিকারাগুয়া-গুয়াতেমালা না। 

 

যে গল্প শেষ হয়নি। 

কাছে পিঠে গ্রাম। গ্রামে গ্রামে সাথে নেই পাছে নেই সহজ সরল নিরীহ সব মানুষ। কী যে হল তাদের, একজন বলল, পেট্রোল?

একজন বলল, দেশলাই?

সবাই মিলে তিনটে বাস আর একটা জিপ জ্বালিয়ে দিল। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকল বাস আর জিপ। 

গ্রামে কেউ কথা বলছে না। গ্রামলাগোয়া শহরে কেউ কথা বলছে না। পাশের লম্বা ব্রিজ দিয়ে আসছে যাচ্ছে কেউ। অভূতপূর্ব নৈঃশব্দ্য। গ্রাম-শহর পুরোপুরি অচল হয়ে গেল। 

 

বরাবরের শান্তিপ্রিয় মানুষ। কী যে হল তাদের, সবাই মিলে জোর করে কারখানায় ঢুকে পড়ল। কারখানায় ঢুকে দপ্তরের ফাইলপত্র,কম্পিউটার, ফ্যাক্স মেশিন, স্যুটকেস, তিনটে পিস্তল একসঙ্গে জড়ো করে পুড়িয়ে দিল। কারখানার জিপ আর দমকলের গাড়ি আগুনের স্পর্শ থেকে রেহাই পেল না। 

 

যারা শুনছিল তাদের ভেতর থেকে একজনের গালে সবে সবুজ সবুজ আভা। একটু বড় সে। সে-ই জিজ্ঞেস করল, সানলাইট সেনাদের গল্প? মেক্সিকোর ওই সানলাইট সেনা?

দাদু বলল, মেক্সিকোর সানলাইট সেনাদের গল্প না। 

তাহলে?

প্রশ্ন উঠে এল। ।

দাদু বলল, এই গল্প ভারতবর্ষের। এই গল্প গোয়ার। ছোট্ট রাজ্য গোয়া। রাজধানী পানজিম। পানজিম শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরে কেরি বলে অখ্যাত এক গ্রাম, সেই গ্রামের নাম কেউ জানতই না। এই গল্প সেই ছোট্ট গ্রামের।

নাতনিদের একজন বলে উঠল, কী সব বলছ? গল্প এমন হয়?

দাদু বলল, হয়, হয়েছে তো। এই গল্প বছর পঁচিশ আগের।

নাতিদের একজন বলল, গল্প? কেমন যেন লাগছে। 

 

এই গল্প শুরু হয়েছে বাজারে। 

ভারতবর্ষের বাজারে টায়ারের রমরমা শুরু হয়েছে সবে। রাস্তাঘাট বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে। একদিন নিউ ইয়র্কে আমেরিকার দু পঁ বলে এক কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ এক্সিকিউটিব মিটিং ছিল। একজন টেবিল চাপড়াল, ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার। সবার ঠোঁটে দামী মদের গ্লাস। একসাথে বলে উঠল, চিয়ার্স!

 

টিডিএলের জন্ম হল। টিডিএল মানে থাপার-দু পঁ লিমিটেড। থাপার ভারতবর্ষের বাণিজ্য সংস্থা। পানজিমের কাছে দু পঁর প্রকল্প সিনথেটিক লাইলন সিক্স পয়েন্ট সিক্সের কারখানা। গোয়া সরকার তার মাত্র ১১ শতাংশ অংশীদার। জমিতে লিজ, জলে ছাড়, বিদ্যুতে ছাড়। ছাড় বলে ছাড়! ছাড় আর ছাড়। একেবারে চার চাঁদ দু পঁর আকাশে। 

 

থাপার দু পঁ বিলবোর্ডে লিখলঃ We Bring Good Things to Life 

 

তদ্দিনে কেরি গ্রামে টিডিএলের দপ্তর তৈরি হয়ে গেছে। মাটির অনেক নিচ থেকে জল তুলতে হবে বলে তৈরি হয়ে গেছে অনেক বেশি গভীর নলকূপ। 

 

টিডিএলের রিটা হিক্রোট বলল, সিনথেটিক লাইলন সিক্স পয়েন্ট সিক্স সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। 

মারিয়ানা জানতে চেয়েছিল, দূষণমুক্ত? কেমন?

রিটা হিক্রোট উত্তরে বলেছে, পাউরুটি তৈরি করা যেরকম। 

ফ্রান্সিস বলল, আপনারা আমেরিকার নবম সর্ববৃহৎ কর্পোরেশন। 

রিটা হিক্রোট কাঁধ ঝাঁকাল, সবাই তো তাই বলে। 

ফ্রান্সিস ফের বলল, আপনদের বলা হয়েছে পরিবেশ দূষণকারী।

মিথ্যে কথা। রিটা হিক্রোটের চোখমুখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছে। 

 

টিডিএলের প্রেসিডেন্ট ইউজিন ক্রউএজবার্জার বলল, We will not handle, use , sell, transport or dispose of a product, unless we can do in an environmentally sound manner... 

অগাস্টিন প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়, সে বলল, তবে যে ফরচুন পত্রিকায় দু পঁকে দশটি পরিবেশ দূষণকারী সংস্থার মধ্যে প্রথম বলছে?

 

শ্রোতা বলতে নাতি আর নাতনিই শুধু। তাদের কেউ কেউ ছটফট করছে এবার। নাতিই বলল, এসব কী গল্প বলছ, দাদু? গল্পের মতো লাগছে না। 

দাদু বলল, বাজারের গল্প এইরকমই হবে। শোনোই না আরও একটু। 

 

আমেরিকায় ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ বলে যে সংগঠন আছে তাদের সঙ্গে কেরি গ্রামের মানুষজনের কীভাবে যেন যোগাযোগ হয়ে গেল। ভাবো দেখি ব্যাপারটা। কোথায় আমেরিকা, কোথায় পানজিমের কাছে কেরি, একটা গ্রাম যার নাম দুনিয়ার কেউ কদিন আগেও জানত না। 

ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ জিজ্ঞেস করল, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন একটা ভয়ংকর কেমিক্যাল। এই কেমিক্যাল আমাদের ওজন স্তর ধ্বংস করছে। আপনার কি ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের প্রোডাকশন বন্ধ করেছেন? করেননি। এই কেমিক্যাল দুনিয়ার বাচ্চাদের ব্রেনের বারোটা বাজাচ্ছে না?

 

নাতনিদের একজন জিজ্ঞেস করল, তারপর?

 

তারপর যুদ্ধ শুরু। 

কেরি একটা গ্রাম। পাশাপাশি আরও চারটে গ্রাম রয়েছে। সেসব গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে টিডিএলের কর্তৃপক্ষ মুখোমুখি আলোচনায় বসতে বাধ্য হল। লন্ডন থেকে অনিল দিশাই এসেছেন। অনিল দিশাই ক্যানসার রোগের বিশেষজ্ঞ। 

টিডিলের কর্তৃপক্ষ বলল, সিক্স পয়েন্ট সিক্স দূষণমুক্ত। 

অনিল দেশাই বলল, দূষণমুক্ত?

 

কথা কাটাকাটি চলছিল অনেকক্ষণ। অনিল তখন বলল, সিক্স পয়েন্ট সিক্স তৈরিতে এডিপ্টিক অ্যাসিড লাগে কি লাগে না? হেক্সা মিথাইল ডায়ামাইন লাগে কি লাগে না? এই রইল পেপার্স। দেখুন আমেরিকার সরকার এসব ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। হ্যাঁ কি না?ইয়েস অর নো?

 

টিডিলের যারা এসেছিল সবাই মুখ নিচু করে বসে রইল তখন। একজন আরেকজনকে বলল, এইরকম সুদূর গ্রামের লোকজন এত সব খবর জোটাল কেমন করে?

পঞ্চায়েত থেকে যারা এসেছিল তাদের চোখে তখন সন্দেহ, মনের ভেতর রাগ। পঞ্চায়েতের প্রধান বলল, আপনাদের কারখানায় দিনে কত জল লাগে?

টিডিএলের অফিসার মাথা চুলকোতে লাগল। বলল, কত আর? এই ধরুন---

পঞ্চায়েতের প্রধান তার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিল, ধরার কিছু নেই। প্রতিদিন আড়াই লক্ষ লিটার জল আপনারা মাটির তল থেকে তুলে নিচ্ছেন। আমরা এখানে চাষাবাদ করার জল কোথায় পাব? আমরা এখানে চাষবাস করব কি করব না? কী চাইছেন আপনারা?

 

নাতিদের মধ্যে যে সবার চেয়ে মাথায় উঁচু তাকে খুব অস্থির লাগছিল। সে জানতে চাইল, তারপর?

তারপর তো মিটিং ভেস্তে গেল। 

 

সরকার টিডিএলকে যে জমি দিয়েছিল তার মধ্যে গ্রামের মানুষদের কবরখানা ছিল, সেখানে মানুষ বংশপরম্পরায় পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সমাধি দিত। বারবার বললেও সরকার কোনো কথা কানে নিচ্ছিল না। সেবার দসেরার পরের দিন গ্রামের সব মানুষ মিলে সিক্স পয়েন্ট সিক্স কারখানার দেয়াল ভেঙে ফেলল। সিকিউরিটি যেখানে থাকত সেসব পুড়িয়ে দিল। বুলডোজার আর অন্য অনেক মেসিন অকেজো করে দিল। শুধু তাই না। কারখানায় যাবার রাস্তায় বড় বড় গর্ত খুঁড়ে দিল।

 

সরকার আর কী করবে? টাডা বলে আইন ছিল, নেতাদের কজনকে সেই আইনে গ্রেপ্তার করল রাতারাতি। পুলিশের গাড়ি পেট্রোল পুড়িয়ে ঘুরতে লাগল গ্রামের পথে পথে, কেরি আর শেভয় ভেরমের অপ্রশস্ত পথে, টিডিএল নিয়ে এসেছে ৭৫ জন বাউন্সার যারা দরকার বুঝলেই গুণ্ডামি করবে। কথা নেই বার্তা নেই শুরু হল বাউন্সারদের গুণ্ডামি। 

 

অগাস্টিনের মুদির দোকান, সে দেখল নতুন খদ্দের, মুখ দেখেই চিনে ফেলল বাইরের কেউ, বলল, আটা নেই, ময়দা নেই, তেল নেই, লবণ নেই, আমার দোকানে কিচ্ছু নেই। 

গঞ্জালেসের হোটেল। সে বলল, ফুড নেই, ড্রিঙ্কস নেই। কিচ্ছু নেই। 

ভিক্টর টিডিএলের পাবলিক রিলেশন ম্যানেজার। সুজেটের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে। সুজেটই একদিন রাত্রে ভিক্টরকে ঘুম থেকে তুলল, ঘুম থেকে তুলে বলল, টিডিএলের কাজটা ছেড়ে দাও, কালকেই।

ভিক্টর বলল, তা কেমন করে সম্ভব? 

সুজেট বলল, টিডিলের কাজ ছেড়ে দাও, এক্ষুনি। অন্য কথা শুনতে চাইছি না। 

ভিক্টর বলল, সে কিছুতেই হয় না। 

সুজেট বলল, কাজ ছেড়ে দাও, নাহলে, আমাকে ছেড়ে দাও। এক্ষুনি

নাতনি বলল, উরি ব্বাস! তারপর?

দাদু বলল, তারপর আমি ভাল জানি না। গোয়া ফাউন্ডেশনের ক্লদ আলভারেম বলতে পারবে। তবে দু পঁ গোয়ার মাটি ছেড়ে দিয়ে কর্নাটক ছেলে গেছে। 

 

যে নাতির গালের দুধারে সবুজ সবুজ আভা এই সবে, সে বলল, সরকার দু পঁর পক্ষ নিয়েছিল। 

নাতনিদের একজন বলল, আমি ইছুতেই বুঝতে পারলাম না সবকিছু জেনে বুঝে সরকার কেমন করে দু পঁর মতো কোম্পানির পক্ষ নিতে পারে।

0 Comments

Post Comment