পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রাইত-চরা

  • 09 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1503 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
কান্টু রাতে ঘুমায় না। কান্টুর নাকি রাতে ঘুম আসে না! কান্টু সারারাত রাস্তা রাস্তা কান্টা কান্টা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কান্টু রাতের আঁধারে যার তার বাড়ির শোবার ঘরের দরজাজানালায় উঁকি মারছে। কান্টুর জন্য গাঁ-ঘরে কেউ ঘরের দরজাজানালা খুলে রাখতে পারছে না। কান্টু হয়ত পাগল হয়ে গেছে! কিংবা তাকে জ্বিনে পেয়েছে!

 

গ্রামে সবাই এমন সব কথা বলে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে কান্টুর ইয়ারদোস্তরা। একদিন কান্টুর বাপ রোবান সেখের কানেও এসব কথা ভেসে এল। তার খুব দুশ্চিন্তা হল। তার একমাত্র বেটার চোখে ঘুম নেই! সত্যি সত্যি ছুঁড়া পাগল হয়ে গেল! নাকি ছুড়াকে জ্বিনে পেল? সে কিছু বুঝতে পারছে না। সত্যি যদি এসবের কিছু একটা হয়ে থাকে, সে তাহলে কাকে নিয়ে বাঁচবে? কার জন্য বাঁচবে?

না না, এসব হতে দেওয়া যাবে না। দিনের বেলা যা ইচ্ছে করে বেড়াক, রাতে অন্তত ছুঁড়াকে বাড়িতে আগলে রাখতে হবে। রোবান সেখ ভাবছে। কিন্তু বাড়িতে আগলে রাখতে হলে কিভাবে আগলে রাখবে? সে বুঝতে পারছে না। সেয়ানা বেটাকে জোর করে বাড়িতে আগলে রাখা খুব মুশকিলের কাম। জোর করে আগলে রাখলে হিতে বিপরীত হয়। গাঁ-ঘরে এমন নমুনা আছে। তার ছেলেবেলার সাথী আক্রামই তো বাপ আনসার মোল্লার শাসনে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছিল। আজ পর্যন্ত ফিরে আসেনি। যদিও আনসার মোল্লার আক্রামই একমাত্র বেটা ছিল না। আক্রামের ওপরে নীচে দুই দুই করে আরও চারটে ভাই ছিল। তবু লোকটা বেটা আক্রামের শোকে পাগল হয়ে দুম করে একদিন মরে গেল। তাহলে কান্টু যদি কিছু করে বসে, একমাত্র বেটার বাপ হয়ে তার কী অবস্থা হবে?

‘ এ কী শুননু জী দোস্ত! আপনার বেটা কান্টু নাকি রাইত চরে বেড়াইছে? ’

রোবান সেখের এমন দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায় পাশের গ্রামের তার আর এক দোস্ত নূর মিঞা। রোবান সেখ তখন সবে মাঠ থেকে ফিরে বাহিরবাড়ির বারান্দায় বালতিতে তোলা ইঁদারার পানিতে মুখ, হাত-পা ধুচ্ছে। নূর মিঞার কণ্ঠ শুনে সে যেন খানিকটা ধাতস্থ হয়। বলে, ‘ কে জী দোস্ত নাকি? তা এতদিন বাদ ! হামি তো ভাবছিনু ভুলেই গেলছেন বোধায়? ’

‘ না জী দোস্ত না! ভুলবো ক্যানে? আসলে এমুন একটা ফ্যাসাদে পড়ে আছি যে সুমায় করে উঠতে পারিনি খো। কিন্তুক যখুন শুননু যে কান্টুর এমুন খারাপ অবস্থা, না এসে পারনু না। ’

একেবারে নিজের মনের কথা বলে নূর মিঞা। সত্যি যে সে ফ্যাসাদে পড়ে আছে, তার চেয়ে বেশী ভালো আর কে জানে ! কাউকে বলে কোনও লাভ নেই বলে কাউকে বলেনি। তাছাড়া তার ফ্যাসাদের কথা সবাইকে বলারও নয়। বললে নিজের, সেই সঙ্গে বংশেরও বদনাম হবে। সেই ভয়ে দোস্ত রোবান সেখকেও খুলে বলে না কিছু। বরং জিজ্ঞেস করে, ‘ তা কান্টুর কথা তো সব শুননু। ব্যবস্থা কিছু লিয়াছেন? ’

রোবান সেখের মুখ, হাত-পা ধোওয়া হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঘাড়ের গামছায় মুখ, হাত-পা মুছছে। উত্তর করে, ‘ কী ব্যবস্থা লিব? কিছুই বুঝতে পারছি না দোস্ত। ’

‘ বুলছিলাম কী দোস্ত! কান্টু যা করে বেড়াইছে অর বিহা দিলে মুনে হয় উ ঠিক হুই যাবে। বহুর টানে ঘর ছেড়ে বাহিরে বেরহাবে না আর ! ’     

একটু ভয়ে ভয়ে বলল নূর মিঞা। এমন দাওয়ায় দোস্তের যদি না-পসন্দ হয় !

‘ কী বুল্লেন? ’

আন্দাজ সত্যি মনে হয় নূর মিঞার। দোস্তের কণ্ঠ শুনে ভয় পায়। বলে, ‘ না মানে- আপনার ইচ্ছাই সব! আপনি যখুন অর বাপ! হামি খালি কথার কথা বুলনু দোস্ত ! ’

রোবান সেখের মুখ, হাত-পা মোছা হয়ে গেছিল। বাড়ির দিকে মুখ করে সে হাঁক ছাড়ল, ‘ কে আছিস রে! জলদি দু’কাপ চা লিয়ে আয় তো ! ’ তারপর চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ ভালো কথা বুল্যাছেন দোস্ত। তবে তারপরেও যদি বেটার হামার ব্যারাম না সারে ! ’

সাহস পায় নূর মিঞা। পাশের চেয়ারে বসে বলে, ‘ সারবে না মানে ! হাজার বার সারবে। লক্ষ বার সারবে। আপনি বোধায় জানেন না হামারঘের গাঁয়ের আজাহারের বেটা জুলফিকার কী করে বেড়াইতো ! ’

‘ কী করে বেড়াইতো? ’

‘ ওই আপনার কান্টুর মুতোন। মানসম্মান লিয়ে টানাটানি ! তা আজাহার মানসম্মান বাঁচাতে কী কর‍্যাছিল জানেন? ’

‘ কী কর‍্যাছিল? ’

‘ জুলফিকারের বিহা দিন দিয়াছিল। ’

‘ তারপর? ’

‘ তারপর আবার কী? সেই থেকে জুলফিকার ভালোই আছে। আজাহারচাছা কবেই মরে গেলছে। কিন্তু ওই জুলফিকার আর সব ভাই-ভাতিজাদের সুথে লিয়ে এক হাড়িতে আজাহারচাছার জোত আজ পর্যন্ত আগলে রেখ্যাছে। বহিন, বিটি, ভাতিজিগিলার বিহা দিয়াছে ভালো ঘরে। ’

রোবান সেখের মনে পড়ে আজাহার বিশ্বাসকে। জ্বিনের টাকা পেয়ে নাকি লোকটা হোলার মাঠে বত্রিশ বিঘা জমি কিনে বড় গেরস্থ হয়েছিল! তার বেটা জুলফিকারকেও মনে পড়ে। তার চেয়ে ক’বছরের বড়ই হবে। ওই সময় এলাকায় একটা কথা রটেছিল খুব। আজাহার জ্বিনের টাকা পেয়াছে তাই জুলফিকার পাগল হইয়াছে। কিন্তু সে নিজে তো বনেদি ঘরের ছেলে। জ্বিনের নয়, সে তার বাপের এক হালের জোত হাতে পেয়ে মেহনত করে তবেই আজ চার হালের গেরস্থ হয়েছে। যদিও সে এখন হাল-বলদে চাষ করে না। দু-দু’খানা ট্রাক্টর আছে তার। তাহলে তার বেটা কান্টুর এমন পাগলামির কারণ কী? তবে কি ছুঁড়া বাপ কোরবান সেখের রোগ পেল? বাপ কোরবান সেখ কান্টুর মতো এমনি রাত চরে বেড়াত। রাতের অন্ধকারে যার তার ঘরে ঢুকে পড়ত। তখন সে খুব ছোট ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে খুব লজ্জ্বার, বুঝতে পারত। যাইহোক, মা শুকতারা বিবি ছিল বিচক্ষণ মানুষ। বোলপাড়ার দুলহা বুড়ির কাছ থেকে গাছ-গাছড়া এনে বাপকে খাইয়েছিল। বাপের রোগ সেরে গেছিল তাতেই। বাপ তারপর থেকে ছিপ হাতে বসে থাকত নয়নজলির পাড়ে নারকেল গাছের গোঁড়ায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা।

বাপের সবকিছু মনে পড়ছে। কিন্তু বেটার ব্যাপারে কোনও কিছুই মাথায় ঢুকছে না রোবান সেখের। দোস্ত নূর মিঞার দিকে তাকাচ্ছে। বলছে, ‘ আপনি যা বুলছেন ঠিকই বুলছেন দোস্ত। কিন্তুক হামার কী মুনে হোছে জানেন? ’

‘ কী? ’   

‘ ছুঁড়াকে বোধায় হামার বাপের ব্যারামে ধর‍্যাছে ! ’

নূর মিঞার মনে পড়ে দোস্ত রোবান সেখের বাপ কোরবান সেখকে। সে যাকে দোস্তবাপ বলত। সেই কবে দেখেছিল ! চেহারা মনে পড়ে না। তবে দোস্তবাপ বলে একটা লোক ছিল সেটা মনে পড়ে। সারাদিন নয়নজলিতে লোকটা ছিপ ফেলে বসে থাকত। খরা, বর্ষা, শীত। লোকে বলত, “ কোরবান সেখের মাছ ধরার নেশা খুব। সে ওই নেশাতেই মরবে! ”

সত্যিই যে লোকটার মাছ ধরার নেশা ছিল, লোকটা মরে সেটা প্রমাণ করেছিল। ওই নয়নজলির পাড়েই মরে পড়েছিল একদিন। আর তার ফেলা ছিপের বঁড়শিতে একটা দেড় কেজি ওজনের কাতলা বিঁধে নয়নজলির পানি তোলপাড় করেছিল।

কান্টুর রোগ ভুলে গিয়ে কান্টুর দাদো কোরবান সেখের রোগ নিয়ে কৌতূহল জাগে নূর মিঞার। জিজ্ঞেস করে, ‘ দোস্তবাপের আবার কী রোগ ছিল জী দোস্ত? ’

‘ কেনে আপনি জানেন না? বাপের হামার রাইত-চরা রোগ ছিল। ’

‘ রাইত-চরা রোগ বুলতে? ’

‘ দিনে নয়নজলিতে ছিপ ফেলে মাছ ধরত। আর রাইতে নিঁদ আসত না বুলে পাড়া পাড়া ঘুরে বেড়াইত। মা নিঁদ থেকে উঠে দেখত বাপ বিছানায় নাই। মা তখুন কাদঁত। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদত। হামার নিঁদ চটকে যেত। মা’র কাঁদন হামি সহ্য করতে পারতুম না। তখুন হামি ওই আঁধার রেতেই বাড়ি থেক্যা বেরহিয়ে বাপকে ধুঁড়ে বেড়াইতুম। কে জানে এখুন আবার এই মওতকালে বেটাকে ওরকম ধুঁড়ে বেড়াইতে হবে কিনা! ’

রোবান সেখের শেষের আক্ষেপটা শোনে না নূর মিঞা। প্রশ্ন করে বসে, ‘ আপনি কত ছোটো ছিলেন তখুন? ’

‘ এক্কেবারে ছোট্ট ছিনু। কিন্তুক বাপের ওই রোগ হামাকে বড় করে দিয়াছিল। বাড়িতে তো আর কেহু ছিল না! কামকাজের লেগে ছিল যারা তারা সব দিনের বেলা কামকাজ শ্যাষ করে নিজ নিজ বাড়ি চলে যেত। রাইতে মা একলা মেয়া মানুষ! ওই অবস্থায় পড়ে কুন্ঠে যাবে? কী করবে? অগত্যা এট্টুখানি হামিই ছিনু মা’র ভরসা। ’

এতদিনের দোস্ত রোবান সেখ যেন নূর মিঞার কাছে হঠাৎ অচেনা মনে হয়। সে তার দোস্তের মুখ থেকে গল্প শুনছে না অচেনা কোনও মানুষের মুখ থেকে, বুঝতে পারছে না। তবে সে গল্প শুনছে, বুঝতে পারছে। গল্প শুনে তার কৌতুহল বাড়ছে। অগত্যা সে জিজ্ঞেস করল, ‘ তা আপনি দোস্তবাপকে ওই আঁধার রেতে কুন্ঠে ধুঁড়ে পেতেন? ’

‘ সে পরে শুনবেন। এখুন বুলেন তো, বেটার যে বিহা দিব তা মেয়া পাবো কুন্ঠে? ’

যে মতলবে দোস্ত রোবান সেখকে কান্টুর বিয়ে দেবার কথা বলেছিল নূর মিঞা, তার সেই মতলব যেন পূরণ হতে দেখতে পাচ্ছে সে। হঠাৎ তার গল্প শোনার কৌতুহল হারিয়ে যায়। বদলে অন্য কৌতূহল জাগে। ঠিক কৌতূহল নয়, মতলব পূরণের সুপ্ত ইচ্ছাটা চেগে ওঠে। যে ইচ্ছা নিয়ে সে দোস্তের দূয়ারে এসেছে আজ বহুদিন বাদে। তার ইচ্ছা পূরণ হলে সে তার ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু সেই ইচ্ছার কথা দোস্ত রোবান সেখকে বলবে কী করে? নূর মিঞা নিজের ভাবনার মধ্যে ডুবে যায়। সে যে দোস্ত রোবান সেখের বৈঠক-বারান্দায় রোবান সেখের পাশেই বসে আছে, মনে থাকে না।

রোবান সেখের কিন্তু চায়ের কথা মনে আছে। নেশা বলে কথা! তার ওপর অনেকক্ষণ হল দোস্ত পাশে বসে আছে। সেই কোন কালে হাঁক ছেড়ে বাড়িতে দু’কাপ চায়ের কথা বলেছিল, তার কী হল? এখনও চায়ের পাত্তা নেই। অগত্যা আবার হাঁক ছাড়ে রোবান সেখ, ‘ কুন্ঠে গেলিরে সব? চায়ের কী হল? ’

রোবান সেখের হাঁক শেষ হতে না হতে চা আসে। এক হাতে চায়ের কেটলি, অন্য হাতের আঙুলে আঁকড়ে দু’টি কাপ নিয়ে আসে বাড়ির কাজের খালা নয়িমা বেওয়া। তার বাপের আমল থেকে এই বাড়িতে কাজ করে। আগে স্বামী ছিল, সংসার ছিল। তবু সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় কোরবান সেখের সংসারের কাজ করে দিয়ে যেত। কিন্তু স্বামী মরার পর বেটা, বেটাবহু বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । সেই থেকে এই বাড়িতেই সর্বক্ষণ থাকে। সেকারণেই হয়ত খানিকটা অধিকার জন্মেছে। সেই অধিকার থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলছে, ‘ একটুও রহাসহা নাই, খালি চিল্লানি ! বাপ কোরবানভায়ের এমুন স্বভাব ছিল না। ঠান্ডা মানুষ ছিল তুমার বাপ। আর তুমি? বুলছি কী, বয়স হোছে সেই খিয়াল কি আছে তুমার? আখুনো সুমায় আছে, রহেসহে চলতে শিখো। দু’দিন বাদে গোরে যাবা ! ’

রোবান সেখের মা নেই। তার মায়ের অভাব কিছুটা হলেও মেটে এই নয়িমা খালার কথায়। নূর মিঞা বুঝতে পারে। রোবান সেখের মা শুকতারা বিবি ঠিক এভাবেই কথা বলত। ছোটবেলায় দু-চারবার এই বাড়িতে আসার সুবাদে নূর মিঞা সেটা জানে। তাই জিজ্ঞেস করে, ‘ খালা কেমুন আছো? ’

নয়িমা বেওয়া এতক্ষণ আপন খেয়ালে কাপে চা ঢালছিল, নূর মিঞার কথায় ঘুরে তাকাল। তারপর অবাক হয়ে বলল, ‘ কে- নবাবের জামাই মুনে হোছে ! তা, এত্‌দিন কুন্ঠে ছিলা গো? ’

‘ আর বুলিও না খালা। ঘরসংসার! নিঃশ্বাস ফেলার জো আছে নাকি? ’

‘ সংসার ! বড় বালার জিনিস বাপ এই সংসার। করলেও অশান্তি। না করলেও অশান্তি। ’

বাড়ির কাজের মেয়ে হলেও দোস্ত রোবান সেখ যখন নয়িমা বেওয়াকে মায়ের মান দেয়। তাহলে সে মান দেবে না কেন? নূর মিঞা যখন এমন ভাবছে, নয়িমা বেওয়া তার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে অন্দরে চলে গেল।

দুই দোস্তের হাতে গরম চায়ের কাপ। নূর মিঞা রোবান সেখের প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে ভাবছিল, হঠাৎ করে চায়ের প্রসঙ্গ এসে পড়া এবং চা নিয়ে নয়িমা খালার আগমনে সেই ভাবনাটা গলায় এতক্ষণ আটকে ছিল। নয়িমা খালা চলে যেতেই বেরোবার জন্য ছটফট শুরু করেছে। কিন্তু দোস্ত রোবান সেখ যে-প্রশ্ন করেছিল তা কি তার মনে আছে?

হ্যাঁ, মনে আছে। ওই তো রোবান সেখ আবার জিজ্ঞেস করছে, ‘ বুলছেন না জী দোস্ত- বেটার জী বিহা দিবো তো মেয়া পাবো কুন্ঠে? ’

এটাই সুযোগ। এই সুযোগেই তার ইচ্ছার কথাটা বলে ফেলা উচিৎ। নূর মিঞা দেরী করে না। বলে, ‘ লতিফাকে কি আপনার মুনে পড়ে দোস্ত? ’

লতিফা! কোন লতিফা? না, রোবান সেখ মনে করতে পারে না। জিজ্ঞেস করে, ‘ কে লতিফা? ’

‘ কেনে হামার বেটি লতিফা! বাহাদুরপুর এম. এস. কে-তে কেলাস এইটে পড়হে। ’

লতিফা! হ্যাঁ, লতিফা। রোবান সেখের মনে পড়ে এবারে। দোস্ত নূর মিঞার তিন বেটার পর একটা মেয়ে জন্মেছিল। পাঁচ গাঁয়ের লোককে জিয়াফত করে ধুমধামে সেই মেয়ের আকিকা দিয়েছিল। তাহলে সেই মেয়ের কথায় বলছে তার দোস্ত। কিন্তু সেই মেয়ের স্বভাব চরিত্র ভালো নয় বলে! লোক মুখে শুনেছে ...

মনে মনে দুয়া পড়ার মতো আওড়ায় রোবান সেখ। নূর মিঞা দোস্তের মুখ-নড়া দেখে। ভাবগতি কিছু বুঝতে পারে না। নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ভুল কিছু করল না তো? তাও মেয়ে ভালো হলে কথা ছিল। কিন্তু মেয়ে তো তার প্রেম করে কোন এক লাফাঙ্গা ছোঁড়ার সঙ্গে। ছোঁড়া মোটরসাইকেল চালিয়ে আসে। আর মেয়ে তার স্কুলের নাম করে বেরিয়ে পন্ডিতের লিচুর বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। মোবাইলেও কথা বলে। মোবাইলটা সে নিজেই কিনে দিয়েছিল দেওয়ানসরাই মোড়ের শামিমের ভিভো’র শোরূম থেকে। সিয়ানী বিটি স্কুলে পড়তে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে যদি কিছু ঘটে ! দিনকাল তো ভালো নয়। কিন্তু মেয়ে তার ওই মোবাইল নিয়ে গুল খেলিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রথম যেদিন ব্যাপারটা জানতে পারে, মাথায় বাজ পড়েছিল তার ! মাঠঘাটে পড়ে থাকা মানুষ সে। মাহিন্দার কালামের কাছে শুনছিল? প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু যেদিন নিজের চোখে দেখল, সেদিন থেকে নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে। আজও ভুলে আছে। তাই তো কান্টুর ব্যারামের বাহানায় দোস্ত রোবান সেখের কাছে ছুটে এসেছে। যদি কোনও হিল্লা হয়!     

ছুটে এসে ভুল যে করেনি, নূর মিঞা প্রমাণ পায় হাতে হাতে। রোবান সেখ বলছে, ‘ দোস্ত আপনার বেটি থাকতে হামি আর কুন্ঠে যাবো হামার কান্টুর লেগে! কবে মজলিশ ডাকছেন বুলেন তাহলে? পাকা কথা হয়ে যাক। ’

নূর মিঞা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার বেটির তাহলে বিহা হবে! সে তাহলে ফ্যাসাদ থেকে মুক্তি পাবে?

 

দুই

কান্টু আপত্তি করে না। খুব ধুমধাম করে পাঁচ গাঁয়ের লোককে খানা খাইয়ে লতিফার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। আর দুই দোস্ত রোবান সেখ আর নূর মিঞা বিহাই ব’নে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে। এর চেয়ে সুখ আর কীসে আছে? এক কালের দোস্ত আর এক কালে যখন বিহাই হয় !

কিন্তু এই সুখ রোবান সেখের সহ্য হয় না। মাস ঘুরতে না ঘুরতে কান্টু আবার যে কে সেই। পাগল আবার পাগলামি শুরু করে ! না, এই খবর রোবান সেখকে অন্য কারও কাছ থেকে শুনতে হয় না। একদিন মাঝরাতে হঠাৎ কার কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় তার। ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। কে কাঁদে এত রাতে? একেবারে যে তার মা শুকতারা বিবির কান্নার স্বর !

রোবান সেখ বিছানায় বসে থাকতে পারে না। বিছানা ছেড়ে, নিজের ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। কোথা থেকে কান্না ভেসে আসছে, বুঝতে চেষ্টা করে। তখনই চোখে পড়ে বেটার ঘর খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে। সেই আলো চুঁইয়ে পড়ছে বারান্দায়। বারান্দা পিছলে আঙিনায়। না, সে আলো লক্ষ্য করে আঙিনায় নামে না। কান্নার আওয়াজ লক্ষ্য করে বেটার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজা থেকে দেখে বেটাবহু লতিফা একা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে। রোবান সেখের মনে পড়ে তার মা শুকতারা বিবি ঠিক এভাবেই কাঁদত। বাপ রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত যখন !

তার কান্টুরও ওই একই রোগ তাহলে । কান্টু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কান্টুরও পাত্তা নেই। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? রোবান সেখ বেটাবউয়ের কান্না সহ্য করতে পারে না। মাকে মনে মনে ভাবে। অনেকদিন আগে মায়ের এমন কান্না সহ্য করতে না পেরে বাপের খোঁজে সে একদিন বেরিয়ে পড়েছিল। তখন সে খুব ছোট ছিল। মনে ভূতের ভয় ছিল। রাস্তাঘাটে সাপখোপের ভয় ছিল, কুকুরের ভয় ছিল। আরও কত রকমের ভয় যে ছিল তার ইয়াত্তা নেই।

যদিও আজ সেই সব ভয়গুলির একটিও নেই। বদলে আক্রোশ আছে। তাই বোধহয় মাঠ-ঘোরা লাঠিটা হাতে নিয়ে বেটা কান্টুর খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু কোথায় খুঁজবে কান্টুকে? গ্রাম তো আর সেদিনের মতো ছোট নেই। মাটির বাড়ির বদলে সব পাকা বাড়ি। কংক্রীট ঢালাই রাস্তা। রাস্তার পাশে ঝোপজঙ্গল কিছু নেই। সব ঝকঝকে, তকতকে পরিষ্কার। তার ওপর ল্যাম্পপোস্টের আলো আছে। সবাই কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এমন কী, কুকুরগুলি রাস্তার ওপর শুয়ে আছে নির্বিকার। খালি তার চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই বলেই সে দেখছে, রাস্তার ধারের পুকুরগুলিকে। কোনও পুকুরে এক ফোঁটা পানি নেই। আশ্চর্য ! রাস্তার ধারে যেসব বড় বড় গাছগুলি ছিল, সেগুলিও নেই। কোথায় গেল সব? কে নিয়ে গেল? কোথায় নিয়ে গেল?

রোবান সেখ তার মায়ের কান্নার কথা ভুলে যায়। বেটাবউ লতিফার কান্নার কথা ভুলে যায়। বাপ কোরবান সেখকে মনে পড়ে না। এমন কী যাকে খুঁজতে বেরিয়েছে, বেটা কান্টু, তাকেও মনে পড়ে না। কিন্তু বাপ কোরবান সেখ যে নয়নজলির পাড়ে নারকেল গাছের গোঁড়ায় বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরত সেই জায়গাটাকে মনে পড়ে। সে আর অপেক্ষা করে না, সেদিক পানে হাঁটতে শুরু করে।

 

তিন

রাত কত, রাতেরই খেয়াল নেই। দূরে মাঠে শুকনো ঝোঁপের আড়াল থেকে শেয়াল কিছু বলছে। কোন মরা গাছের মরা ডালে বসে প্যাঁচা কিছু বলছে। নয়নজলির পাড়ে যেখানে বসে কোরবান সেখ মাছ ধরত রোবান সেখ সেখানেই বসে আছে চুপচাপ। সে কিছুই শুনছে না। কিংবা শুনতে পাচ্ছে না। সে একদৃষ্টে নয়নজলির পানির দিকে তাকিয়ে আছে। গাঁয়ের কোনও পুকুরে পানি না থাকলেও এই নয়নজলিতে প্রচুর পানি। তার মায়ের চোখের পানি না বেটাবউ লতিফার চোখের পানি, সে বুঝতে পারছে না। তবে সেই পানিতে সে মনে মনে কিছু খুঁজছে। কী খুঁজছে? তার কাছে কেউ কিছু জানতে চাইছে না। সে কাউকে কিছু বলছেও না। নয়নজলির পানিতে সে শুধু দেখছে পাশে আসমান ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার মাটির দিকে ঝুলে থাকা একটা ডালে বসন্তের চাঁদটাকে পিছলে পড়তে। নীচেই একটা গজগজে কাঁটা ভর্তি বাচ্চা খেজুর গাছ। যার সব কাঁটাগুলি আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে চাঁদটার খসে পড়ার অপেক্ষা করছে যেন। খসে পড়লেই সে তার মুখ উঁচিয়ে থাকা ওই তীক্ষ্ণ কাঁটাগুলিতে চাঁদটাকে গেঁথে নেবে। রক্তাক্ত করবে। অথচ চাঁদটার কোনও ভয়ডর নেই। চাঁদটা যেন মজা করতে করতে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে হিম-পিছল নারকেলের ডাল থেকে পিছলে পড়ছে। ব্যাপারটা আসলে কী, বুঝতে চেষ্টা করছে। কিছু বলছে না।

রোবান সেখ রাইত-চরা হয়ে সবকিছু চুপচাপ দেখছে ...

 

0 Comments

Post Comment