আগের লেখা সূত্র ঃ নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি : শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ নয় বাণিজ্যিকীকরণই লক্ষ্য পর্ব ১
উচ্চ শিক্ষায় পরিবর্তন
নতুন শিক্ষানীতিতে, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন গুলি হল স্নাতক স্তরে তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের পাঠ্যক্রমের সূচনা। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়তে হবে দু’বছরের বদলে এক বছর। চার বছরের স্নাতক পাঠ্যক্রমে ৭৫% নম্বর পেলে মিলবে সরাসরি পিএইচডি করার সুযোগ। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যে কোনও সময়ে ফিরে এসে পুনরায় যোগ দিতে পারে কলেজে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সর্বশেষ মূল্যায়নে প্রাপ্ত গ্রেড জমা থাকবে ‘ডিজিটাল লকার’-এ। শিক্ষার্থী যখন ছেড়ে যাওয়া পাঠ্যক্রমের বাকি অংশ শেষ করার লক্ষ্যে পুনরায় যোগ দেবে তখন সেই প্রারম্ভিক গ্রেডকে সে ব্যবহার করতে পারবে। সুতরাং উচ্চ শিক্ষায় চালু হল ‘ওপেন এন্ট্রি ওপেন একজিট’ ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তিন বছরের স্নাতক কোর্সের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সঠিক সময়ে পরীক্ষা নেওয়া ও রেজাল্ট বের করার ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা দেখাতে পারেনি। সেই একই পরিকাঠামোয় ‘ওপেন এন্ট্রি ওপেন একজিটের’ মত জটিল ব্যবস্থা পরিচালনা করা বেশ কঠিন। এর পাশাপাশি কে কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাবে এবং আবার কবে ফিরে আসবে তা অজানা। কিন্তু শিক্ষার্থী সমস্ত তথ্য প্রতিষ্ঠান কে সংরক্ষণ করতে হবে। এই বিষয়টিও কতটা বাস্তবসম্মত তা সময়ই বলবে।
নয়া শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা হল ‘হায়ার এডুকেশান কমিশন অব ইন্ডিয়া’। এই আয়োগের অধীনে ‘ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশান রেগুলেটারি কাউন্সিল’, ‘ন্যাশনাল অ্যাকরিডিটেশন কাউন্সিল’, ‘হায়ার এডুকেশান গ্রান্টস কাউন্সিল’ এবং ‘জেনারেল এডুকেশান কাউন্সিল’ - এই চারটি সংস্থা দেশের উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে - রিসার্চ ইনটেনসিভ ইউনিভার্সিটি, টিচিং ইনটেনসিভ ইউনিভার্সিটি, এবং অটোনমাস ডিগ্রি গ্র্যান্টিং কলেজেস। রিসার্চ ইনটেনসিভ ইউনিভার্সিটি প্রাথমিক কাজ হবে গবেষণা। এর পাশাপাশি এখানে অল্প বিস্তর পঠন-পাঠনের কাজও পরিচালিত হবে। টিচিং ইনটেনসিভ ইউনিভার্সিটি প্রধানত পঠন-পাঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করবে এবং অল্প কিছু গবেষণার কাজও পরিচালনা করবে। দেশের সমস্ত মহাবিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে অটোনমাস ডিগ্রি গ্র্যান্টিং কলেজেসের অধীনে। অর্থাৎ দেশের কোথাও কোনও অন-অনুমোদিত মহাবিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকবে না। দেশের সমস্ত মহাবিদ্যালয়কে ২০৩০ সালের মধ্যে অনুমোদিত স্বশাসিত ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হতে হবে। যারা পারবে না সেগুলি প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মিশে যাবে। আশঙ্কা এই যে এর ফলে সরকারি অনুদানে পরিচালিত দেশের বহু উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০৩০ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। পরিণতিতে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে ভারতীয় উচ্চশিক্ষাঙ্গনে।
গবেষণার জন্য ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশান’ নামের পৃথক একটি সংস্থার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের গবেষণার পরিসরকে সঙ্কুচিত করতে বদ্ধপরিকর। নয়া শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি নির্ভরতার পরিবর্তে প্রাচীন ভারতীয় কলাবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি দেশের বহুত্ববাদের উপর এক চরম আঘাত।
আন্তর্জাতিক স্তরে ব্রিটেন, চীন এবং ইউরোপের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগ এবং ‘পেনশন’ প্রক্রিয়াকে শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বজায় রেখেছে। ভারতবর্ষ মার্কিন ‘মডেল’ অনুসরণে বদ্ধপরিকর, যা অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের নীতিকেই নির্দেশ করে। এই মডেল মেধাবী শিক্ষিত সম্প্রদায়কে শিক্ষাঙ্গন থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে শিক্ষার অবনমনের পথকেই প্রশস্ত করবে।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও ভারতে শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার বুনিয়াদ শক্ত হবে, নাকি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরন ত্বরান্বিত হবে প্রশ্ন সেটাই । প্রশ্ন যাই থাক, কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বেসরকারি পুঁজির হাতে সঁপে দেবে এ নিয়ে দ্বিমত নেই। এই সুযোগে ভারতীয় শিক্ষার বাজারে ‘প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজির’ প্রবেশ ঘটবে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখানে তাদের শাখা খুললেও, সেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশের পাঠ্যক্রম মেনে পড়াশোনা যে হবেনা তাতে সন্দেহ নেই। তাই এই ধরণের প্রতিষ্ঠান উচ্চ বিত্ত পরিবারের ভারতীয় ছাত্র ছাত্রীদেরই আকৃষ্ট করবে বেশি। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রকট হবে ধনী দরিদ্র্যের বৈষম্য। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এদেশে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ ভারতে পশ্চিমী দেশগুলির পাঠ্যক্রম পড়ানোর বিষয়টি মেনে নেওয়া, সেখানে ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস চর্চা ব্রাত্যই থেকে যাবে। দেশের ঔপনিবেশিক অতীত সম্পর্কে ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে না।
দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র দাদাভাই নওরোজি কিংবা রমেশচন্দ্র দত্তের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে জানলেও যে ভারতীয় ছাত্রটি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় শাখায় উন্নয়নের অর্থনীতি পড়বে কিংবা অর্থনীতির ইতিহাস পড়বে তার কাছে অজানাই থেকে যাবে দেশের জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদদের চিন্তা ভাবনা।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির হাত ধরে, ভারতবর্ষ ২০৪০ সালের মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’-এ বসবে, সরকারের ভাবনা সেইরকমই। এই নীতি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্যকে দূরে রেখে দেশে সর্বোচ্চ গুণসম্পন্ন শিক্ষাক্রম প্রতিষ্ঠা করবে এমনই মত তাঁদের। এই শিক্ষানীতিতে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ৫০ % বেশি পডুয়াকে সেই ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করবে বলে সরকার পরিকল্পনা করেছে৷ এমনকি ১০০ % অনলাইন শিক্ষা ভিত্তিক স্নাতক–ডিগ্রি প্রদানের কলেজও তাঁরা খোলার অনুমতি দিচ্ছেন৷ যেখানে কম্পিউটার ও ল্যাপটপ-ই হবে শিক্ষার একমাত্র ভিত্তি। ফলে নতুন করে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে হবে না, লাইব্রেরী–ল্যাবরেটরি তৈরি করতে হবে না, শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে না৷ অনলাইন শিক্ষার ‘অ্যাপ’ অথবা পাঠদানরত শিক্ষকদের লেকচারের ভিডিও থাকলে, ইন্টারনেট সম্পন্ন কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থেকেই তার সুযোগ নেওয়া যাবে। সরকারের আর্থিক দায়িত্ব অনেক কমবে৷
এখন প্রশ্ন হল, এই অত্যাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ বিত্তশালী ছাড়া অন্যরা কেউ পাবে কি? লকডাউনের সময়ে দেখা গিয়েছে প্রযুক্তির অভাবে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে হতাশায় আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে অনেক পডুয়া ও তাদের অভিভাবকেরা। সরকারি প্রচার যাই হোক না কেন, নয়া শিক্ষানীতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের বীজ। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় সবার কাছেই কম্পিউটার ও ল্যাপটপ থাকবে তাহলেও প্রশ্ন থেকেই যায় অনলাইন শিক্ষা কি শ্রেনীকক্ষ শিক্ষার বিকল্প হতে পারে? অনলাইন শিক্ষায় যন্ত্রই হল শিক্ষক, যা কিশোর মনে ‘প্রানের সঞ্চার’ করতে পারে না, নিরসন করতে পারে না তার মনে ভিড় করা হাজারও কৌতূহলের। যান্ত্রিক শিক্ষা শুধুমাত্র কিছু যন্ত্র মানবের জন্ম দিতে পারে। যেখানে শিক্ষক - ছাত্রের আত্মার নিবিড় যোগ অনুপস্থিত।
যান্ত্রিক শিক্ষার আরো যে দিকটিতে আলোকপাত করা জরুরী তা হল ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ ডিজিটাল ডিভাইডের জন্ম দেবে। যাদের কম্পিউটার, ল্যাপটপ–স্মার্টফোন কেনার আর্থিক সামর্থ্য আছে তারাই শিক্ষার সুযোগ নিতে পারবে অন্যরা বঞ্চিত হবে। উপরন্তু দেশের কয়েক কোটি ছাত্রকে যদি কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন কিনতে এবং ‘ডেটা’ সিম ব্যবহার করতে বাধ্য করানো যায় তাহলে আখেরে লাভ কর্পোরেট সংস্থাগুলির। সরকার সম্ভবত সচেতন ভাবেই শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্পোরেটের বাড় বাড়ন্ত কে প্রশয় দিচ্ছেন।
নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির গভীরে প্রবেশ করলে অনুভব করা যায় এই শিক্ষানীতি ‘সাম্প্রদায়িক-ও’ বটে । যে বছরে এই শিক্ষানীতি এবং পাঠ্যক্রম শুরু হল, সে বছর থেকেই রাম মন্দির উদ্বোধনের প্রস্তুতি তুঙ্গে। আর একটি তথ্য সামনে আনলে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। ২০২৩ সালে সরকার যখন জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করছেন সেই বছরটি বিনায়ক দামোদর সাভারকারের 'এসেনশিয়ালস্ অফ হিন্দুত্ব' নামের গ্রন্থ প্রকাশের শতবর্ষ। এই বইতে সাভারকার সর্বভারতীয় স্তরে হিন্দুত্বের এক আশ্চর্য সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। আগামী ভারতকে ঠিক কেমন দেখতে চান তৈরি করে ছিলেন তার কাঠামোও। ইতিহাসের ছাঁচে, কোন কোন পৌরাণিক কাহিনি ভারতবাসীকে বিশ্বাস করতে হবে তাও লেখা আছে বইটিতে। সেই হিন্দুত্বের ধারণা ও পরিকল্পনার শতবর্ষ পূর্তির কালেই আত্মপ্রকাশ করেছে নয়া শিক্ষানীতি। যার পরতে পরতে সাভারকারের স্বপ্ন ফুটে রয়েছে । শিশুকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত আবশ্যিক ভাবে পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যেন পড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় তার সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নয়া শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে। এই কারণেই বিজ্ঞানের আর ইতিহাসের পাঠ্যক্রম রচিত হয়েছে সুপরিকল্পিত ভাবে। একদিকে যেমন যুক্তি নির্ভর, আধুনিক জ্ঞানচর্চার বৃহদংশকে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্র হিসেবে তুলে ধরে প্রথা ও পরম্পরার উপর আস্থা রাখার নিদান দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে 'ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম' কিংবা 'সংস্কৃত নলেজ সিস্টেম' নাম দিয়ে চরম বর্ণবাদী ও অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলিকে 'পরম বিজ্ঞানসম্মত' হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছেন মুসলমান শাসকদের কীর্তি কাহিনী। বাদ পড়েছেন সম্রাট আকবর। ভারতের সমগ্র ইতিহাসে যিনি শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম ।
এতদিন রাজনীতির ক্ষেত্রে কর্পোরেট-হিন্দুত্ব জোটের দাপাদাপি চোখে পড়েছে। এখন শিক্ষা ক্ষেত্রেও এই জোটের বাড় বাড়ন্ত । কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং হিন্দুত্ববাদের মিলের জায়গা হল এরা দুজনেই সত্যকে ঘোলাটে করে দিতে চায়। এটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র যুক্তিহীনতাকে আশ্রয় করে। সংক্ষেপে বললে, নয়া শিক্ষানীতি হল এমন একটি দলিল যা যুক্তিহীনতাকে প্রশ্রয় দেয় । এই শিক্ষানীতি আগামী দিনে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভুত ক্ষতিসাধন করবে তা এখনই বলে দিয়ে যায়।