যতই ভালোবাসাকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করো, উলটো চাপে নিজেদের ঘৃণা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
সোনা জেতার সেই দিন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলছিল কি ক'রে খোঁচানো যায়। কি ক'রে নীরজ চোপড়াকে বড় দেখানো যায় আর্শাদ নাদিমকে ছোটো ক'রে। নীরজের ত্যাগ তিতিক্ষা পরিশ্রম নিয়ে কথা বলার অত মাথাব্যথা নেই, আছে কেবল নিরন্তর চটকের খোঁজ। নীরজকে ব্যবহার ক'রে টি.আর.পি বাড়িয়ে মুনাফায় লাফ মারার খোঁজ।
আর এর সাথেই আছে খেলাকে তথা খেলোয়াড়ের সাফল্যকে তথা খেলার প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে মূলধন ক'রে উগ্র জাতীয়তাবাদের 'মাহোল' তৈরী করার অসুস্থ চেষ্টা। আছে খেলোয়াড়ি সাফল্যের আবহে তৈরী হওয়া জন-উন্মাদনাকে ব্যবহার ক'রে খেলাকে militarize করার অপচেষ্টা। তুমি পদক জিতলে বা তোমাকে নিয়ে sensation তৈরী হলে ক্যামেরার সামনে আমি হাততালি মারবো, তোমাকে ফোন করব আর জনগণকে বলব তোমাদের স্থান দেশের সৈনিকদের মতোই। এই আবহাওয়াতেই ব্র্যান্ডের গুডউইল তৈরী ক'রে নিতে বিজনেসওয়ালারা কেউ থর দেবে, কেউ পিৎজা দেবে, কেউ কোটি টাকা দেবে, কেউ ফ্রীতে সিনেমা দেখতে দেবে... সাভারকর সেই কবে ১৯৪১ সালে বলেছিল, আগে রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ করতে হবে, তারপর সেই 'হিন্দুত্বের রাজনীতি'ওয়ালা সমাজের সামরিকীকরণ.. গুরুজি কি আর সাধেই গুরুজি!
যাই হোক, আপাতত সবকিছু জলে যাওয়ার জোগাড়! হয়তো আসলি 'মন কি বাত' এটাই যে "বৃথা এ পণ্ডশ্রম!" হতচ্ছাড়া সৈনিকটাই কিনা একেবারে সপাটে থাপ্পড় মেরে দিল থোঁতামুখে! কিভাবে আর সেই ভোঁতামুখ ক্যামেরায় দেখানো যায়!
একেবারে নিজে থেকে লাইভে এসে কিনা ব'লে দিল যে "খেলা ঐক্যের শিক্ষা দেয়, একসাথে বেঁচে থাকতে শেখায়"! ব'লে দিল নাদিম আর তাকে ব্যবহার ক'রে "নোংরা প্রোপাগাণ্ডা" যাতে ছড়ানো না হয়!
"मेरी आप सभी से विनती है की मेरे comments को अपने गंदे एजेंडा को आगे बढ़ाने का माध्यम न बनाए। Sports हम सबको एकजूट होकर साथ रहना सिखाता हैं और कमेंट करने से पहले खेल के रूल्स जानना जरूरी होता है।"
https://twitter.com/Neeraj_chopra1/status/1430816302415843331?s=19
নীরজ চোপড়া আসলে হাজারটা সোনা জিতে গেছে। শুধু নীরজ একা না। গোটা "টীম ইন্ডিয়া"। মেডেল তালিকায় এই সোনাগুলোর কোনো হিসেব থাকবে না। কিন্তু গোটা "টীম ইন্ডিয়া" ফ্যাসিস্ট ভারতরাষ্ট্রের খেলাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার প্রোপাগাণ্ডায় একেবারে ঝামা ঘষে দিয়েছে! একজন সাধারণ আর্মি পার্সোনালের আত্মত্যাগকে চাইলেই অনিবার্যভাবে এক রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রবিরোধী যুদ্ধ-সংস্কৃতিতে টেনে আনা যায়-- আসলে এই মতকে জোরালো ধাক্কা দিয়ে দিয়েছেন নীরজ। নীরজ আর নাদিম যে ভালো বন্ধু, এটাই তাদের সহ্য হচ্ছে না!
শুধু নীরজ না। যে "টীম ইন্ডিয়া"কে মিলিটারাইজ করার চেষ্টা চলছে, সেই "টীম ইন্ডিয়া"। দেখা যাক, কে কী বলেছেন?
বজরং পুনিয়া বলেছেন, "ভারত থেকে আসুক কিংবা পাকিস্তান থেকে, একজন অ্যাথলিট তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথমতঃ সে একজন খেলোয়াড়। কেউ পাকিস্তানি বলেই তার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, এ কেমন কথা! সমস্ত অ্যাথলিটকে সম্মানের চোখে দেখা উচিত... খেলা আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়, বিভাজন করতে নয়। আমার সাথে যখন রাশিয়া বা আমেরিকার কুস্তিগিরদের দেখা হয় তখন খুবই সৌভ্রাতৃত্ব বোধ করি। মনে হয় আমরা সকলেই ভাই ভাই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো শুধু ঐ ম্যাটের মধ্যেই।"
রিও অলিম্পিকের ব্রোঞ্জ মেডেলিস্ট কুস্তিগির সাক্ষী মালিককে মনে আছে? সাক্ষী মালিক বলেছেন,"খেলাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কিংবা ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার আমি ঘোরালো বিরোধী। যা হচ্ছে তাতে নীরজেরই খারাপ হচ্ছে... খবরের চ্যানেলে ঐসব কি প্রশ্ন করা হচ্ছিল! আমি ফ্যানদের বলব ভারতীয় অ্যাথলিটদের আরও বেশী ক'রে সমর্থন করতে এবং একইসাথে এটাও মাথায় রাখতে বলব যে মাঠের ভেতর আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী মানে এই নয় যে মাঠের বাইরেও তাই। তারা আমাদের বন্ধু আর আমরা সকলেই বৃহত্তর স্পোর্টস ফ্র্যাটার্নিটির অংশ। যে কোনো অ্যাথলিটেরই অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর প্রোপাগাণ্ডায় ব্যবহৃত হতে খারাপ লাগবে।" সপাটে দুটো, না দু'শোটা থাপ্পড়!
শরৎ কমল বলেছেন, "২০০৪ সালে ইসলামাবাদে যখন SAFF গেমসে প্রথম যাই তখন আমাদের সাথে এসকর্ট করার জন্য একই পুলিশ বা আর্মি থাকতো। ফলে অনেক কথাবার্তা হত। কথা বলতে বলতেই আমরা দু'জনই অনুভব করি যে আমাদের যা ছবি দেখানোর চেষ্টা হয়, তার সাথে মাটির ছবির অনেক অনেক ফারাক। আমরা সকলেই আসলে একই মানুষ... যখন দোকানে কিছু কিনতে গিয়েছিলাম তখন উনিই আমায় গাইড করেছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কোনটা ভালো, কোনটা নিলে ভালো। তখনই বুঝি যে মানুষকে কতটাই না ঘৃণা গেলানো হয়, যা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।"
ভারতের পুরুষ হকি দলের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন বীরেন রাসকুইনহা বলেছেন, "আমরা যখন পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া বা জার্মানির সাথে খেলি, তখন সকলকেই একই মনে হয়। খেলার আগেও হাত মেলাই, পরেও হাত মেলাই। মাঠে যা কিছু হয় তা মাঠেই রেখে আসি। আমার মনে হয়, খেলায় পবিত্র মন নিয়েই অংশগ্রহণ করা উচিত। খেলার মাঠে দেশের জন্য নিজেকে উপুড় ক'রে দিই আমরা। কিন্তু খেলার সাথে নোংরা রাজনীতিকে মেলানো কখনোই উচিত নয়।"
টোকিয়ো অলিম্পিকে মেয়েদের ডিস্কাস থ্রোয়িংয়ে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করা কমলপ্রীত কউর বলেছেন, "নাদিম খুবই ভালো মানুষ। সবসময় ও শিখতে আগ্রহী থাকে... মাটগের বাইরে আমরা সকলেই ভালো বন্ধু। খেলার কোনো সীমানা হয় না। ভারতই হোক কিংবা পাকিস্তান... খেলাকে সবসময় খেলোয়াড়ি স্পিরিট আর আদর্শ দিয়েই দেখা উচিত।"
চাক দে টীম ইন্ডিয়া!
পুরো ঘেঁটে দিল প্রোপাগাণ্ডাকে আর কি! নাদিম আর নীরজ এতটাই ভালো বন্ধু যে ফাইনালের দিন অ্যাথলিট ভিলেজ থেকে যে বাসে অ্যাথলিটরা ফিল্ডে এসেছিলেন তাতে দুই বন্ধু নাকি পাশাপাশি ব'সে খোশমেজাজে নানা স্মৃতিচারণ করতে করতে যাচ্ছিলেন।
অনেকেই হয়তো জানেন না, কিন্তু খেলার ভেতর দিয়ে এই যে সীমানা ভাঙার আদর্শ এবং শিক্ষার কথা 'টীম ইন্ডিয়া' বলছে, তা আজকের নয়। আমরা বাংলার মানুষরা সেই ইতিহাসের উত্তরসূরিতা বহন করি। 'ভারতীয় ফুটবলের জনক' নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর ২৭শে অগাস্ট জন্মদিন ছিল। নগেন্দ্রপ্রসাদ যখন দেখেছিলেন নিজের হাতে বড় ক'রে তোলা ওয়েলিংটন ক্লাব তথাকথিত নীচুজাতের কুমোর পরিবারের ছেলে মণি দাসকে জাতের কারণে রিক্রুট করাচ্ছে না, তখন নিজে সেই ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রায় ৫০০ জন সদস্য সমর্থক নিয়ে শোভাবাজার ক্লাব তৈরী করেছিলেন। মোহনবাগান ক্লাবেরও আগে তৈরী হয়েছিল সেই ক্লাব। আর তার প্রথম রিক্রুটমেন্ট ছিল মণি দাস।
কোনো রাখঢাক নয়, নগেন্দ্রপ্রসাদ সাফ সাফ বুক বাজিয়ে বলতেন যে, তিনি ফুটবল খেলার মধ্যে জাত ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠার আদর্শ দেখেন; তিনি চান ফুটবলার জাত তৈরী করতে। নগেন্দ্রপ্রসাদ আসলে ভ্রূণাকারে এক সামাজিক বিপ্লবের জন্ম দেওয়ার দোরগোড়ায় ছিলেন সেদিন। আমাদের ক্ষমতাহীনের হীনম্মন্যতায় ভোগা উচিত নয় কখনোই। সেদিনের নগেন্দ্রপ্রসাদ থেকে আজকের 'টীম ইন্ডিয়া' কিন্তু আমাদের ভেতর থেকেই উঠে এসেছে।
আর এটা শুধু আমাদের দেশের ব্যাপারও নয়। গত সপ্তাহে অ্যাথলেটিকসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ডায়মন্ড লীগের খেলা ছিল প্যারিসে। ছেলেদের পোলভল্টে মাত্র ২১ বছর বয়সেই সুইডেনের আর্মান্দ ডুপ্লান্টিস ইতোমধ্যেই অ্যাথলেটিক সার্কিটে খুবই জনপ্রিয়। সের্গেই বুবকার বিশ্বরেকর্ডও সে ভেঙে দিয়েছে। এবারের টোকিয়ো অলিম্পিকেও সোনা জিতেছে। টুর্নামেন্টের দিন যখন নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙার জন্য শেষ ভল্টটা দিতে যাচ্ছে ডুপ্লান্টিস তখন ট্র্যাকের পাশে তার প্রতিদ্বন্দ্বী পোলভল্টাররা সকলে হাততালি দিয়ে চিয়ার করছে। সক্কলে। এসব দৃশ্য দেখলেও যেন ক্লেদ হতাশা ক্লান্তি মুছে যায়। এতটাই সুন্দর ও নান্দনিক!
ডায়মন্ড লীগের প্রসঙ্গ আসায় এটাও ব'লে রাখি যে নীরজ চোপড়া ভারতীয় মিডিয়া নিয়ে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। কারণ তাদের এইসব খাজা প্রোগ্রাম attend করার জন্য তার ওপর এত চাপ আসছে যে এর মাঝে বেচারি প্র্যাক্টিসও করতে পারলো না আর ইউজিন, লুজান আর প্যারিস-- তিন তিনটে ডায়মন্ড লীগে নামতেও পারলো না। নীরজ ধারাবাহিক ভাবে খেলায় উন্নতি করতে চাইলেও মিডিয়া একটা সোনাকেই ভাঙিয়ে খেতে ব্যস্ত। নীরজের খেলে যাওয়ার স্পৃহা আর ইচ্ছার থেকেও তাদের মুনাফা আর ব্র্যান্ডিং বেশী দামী কিনা! সেই 'মহাপুরুষ' তো এবেলায় ক্যামেরার সামনেই ফোন ক'রে নিজের চামচা মিডিয়া অ্যাঙ্করদের ব'কে দিয়ে নীরজের সমর্থন কুড়োতে পারতেন! তাদের কাছেও নীরজের অধ্যবসায় আর ক্রীড়াপ্রেম বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার তার সাফল্যকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা যাচ্ছে কিনা সেটা! আমাদের ভুলে গেলে চলব্দ না যে, নীরজের জার্মান কোচ কিন্তু ভারতের সরকারী ক্রীড়া ব্যবস্থাপনাকে বারবার একহাত নিয়ে অভিযোগ করেছেন যে, নীরজকে বহুবার সঠিক ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত থেকে নিজের দমে অনুশীলন ক'রে যেতে হয়েছে।
তাতে অবশ্য 'গোদি মিডিয়া'র কিছু যায় আসে না! নীরজের ব'সে না থেকে লাগাতার ফিল্ডে থেকে আরও ভালো করার ইচ্ছেটার থেকেও তাদের রাজনীতি করাটা বেশী দামী কিনা!