পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আমার নাম ধরে তোরা ডাকিস না আর…

  • 12 February, 2025
  • 1 Comment(s)
  • 449 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
নাম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশে যে কিছু পরীক্ষায় শুধুই রোল নম্বর বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে হয়, যাতে এক্সামিনার নাম দেখে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়েন! রাষ্ট্র থেকে পরিবার সবেতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নাম। নাম হতে পারে ভয়ের কারণও।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ…

  • জীবনানন্দ দাশ

 

আধাঁরে ঢেকে যাচ্ছে সব। ঘৃণা গিলে ফেলেছে পৃথিবীকে আর সেই ঘৃণায় ডুবে যাচ্ছি আমরা সবাই। মানুষের নাম আজ বড্ড বোঝা মনে হয়। আমার নাম আজ আমার বোঝা, আমার ভয়ের কারণ। একজন সংখ্যালঘু, একজন দলিতকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর খুব পরিষ্কার হয়ে যাবে যে ভারতের মতন দেশে নাম এখন বড় ফ্যাক্টর।

কেউ আখলাক, জুনাইদ হবে কিনা কিংবা পাসপোর্টের লাইনে কাউকে নাম দেখেই বাংলাদেশী বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে কিনা সব ঠিক করে দেয় নাম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আখলাখ ও জুনেইদকে এক বিশেষ ধর্মাবলম্বী বলে পিটিয়ে মারা হয়।

কেউ বাড়ি ভাড়া পাবে কিনা, শহরের কেন্দ্রের জমি বিক্রি করা হবে কিনা, কিংবা ঘেটো তে জায়গা হবে কিনা সব ঠিক করে দেয় নাম।

আমার বা আমার সময়ের অনেকের, যাঁদের জন্ম বামফ্রন্ট সময়ে তাঁদের অনেকের নাম ঠিক আমার মতন - মৌমিতা, টুম্পা, লাবনী  ইত্যাদি। নাম নিয়ে আমায় বিস্তর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে সবসময়। সুবিধে যেমন হয়েছে তেমন হয়েছে অসুবিধেও। কলেজ পড়ার সময় সহজে বাড়ি ভাড়া পেয়ে গিয়েছিলাম কারণ বাড়ির মালিক উপাধি জিজ্ঞেস করেনি আমার সাথে থাকা বন্ধুর উপাধি দেখে আর আমার প্রথম নাম শুনে ভেবে নিয়েছিলেন আমি তাদের ধর্মের হবই! আমার চাকরি জীবনের প্রথম চাকুরি মুর্শিদাবাদে। সেই কর্মস্থলে বহু সহকর্মী বহুবছর অব্দি আমার নামের জন্য ধারণা পোষণ করতেন যে আমি বিবাহ সূত্রে ধর্ম পরিবর্তন করেছি, তাই আমার নাম এমন! অথচ আশির দশক ও নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে যাঁদের জন্ম তাদের অনেকের নাম এমনই ছিল আমার কমিউনিটির মধ্যেও। আমার খালাতো, মামাতো ভাই বোনদের নাম ছিল - জিমি, টনি, বাবলু, ইতি ইত্যাদি। তখনও বাবরি মসজিদ এর তালা ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের জন্য বাজারের তালা খুলে দেওয়া হয়নি। নেহেরু এর আপাত ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি তখনও প্রাসঙ্গিক ছিল যেমন কেন্দ্রে তেমনই রাজ্যে ধর্মনিরপেক্ষ বামফ্রন্টের শ্রেণীর রাজনীতি বিরাজমান। বাংলার গ্রামে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের সংস্কৃতিতে তখনও পীরের মাজার এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অতি মুসলিম হবার প্রবণতায় তাবলীগী জামাত বা অন্যান্য কট্টরপন্থীদের হাত ধরার প্রবণতা দেখা দেয়নি। বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়া সংখ্যালঘুদের মনস্তত্ত্বে এক ভয়ের জন্ম দিয়েছিল। তারাও চাইছিল এক আশ্রয়। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্রামে গঞ্জে বাড়ে জামাতের উপস্থিতি ও বাড়বাড়ন্ত।

মৌলভী ডেকে কিংবা মোবাইল, বই ঘেঁটে খুঁজে নেওয়া হয় মুসলিম নাম! সারাজীবন বহুবার এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, অধিক কট্টরপন্থীদের কাছে যে, “তোর আব্বা নামাজ পড়ে তবুও কেন এমন নাম! তোর বাপের ভাগ্যে এজন্যই জান্নাত জুটবে না!” আবার অন্যপক্ষে হিন্দুত্ববাদীদের কাছে শুনতে হয়েছে/হয়, “তোর এমন বাঙালি নাম কেন!” ভাবখানা এমন মুসলিম মানে যেন বাঙালি নয়। আমার খালা, মা এদের নামও ছিল একদম আটপৌরে বাঙালি নাম - রীনা, মীরা, লতা, হিনা ইত্যাদি।

 

১৯৯২ বা তার আগে থেকে চলা সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় ২০১৪ সালে। ২০১৪ এর পর পাল্টে গেছে রাজৈতিক ভাষ্য। আমার নামের ভার আমার প্রথম নাম থেকে সরে এসে পড়েছে আমার পদবি  - “আলম” এ। শুধুই নামের জন্য লিঞ্চ হতে হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। দোকানের নাম লিখতে হবে নিজের ধর্মের সাথে মিলিয়ে এই মর্মে হুশিয়ারি দিয়েছে কিছুদিন আগে বিজেপির দিল্লির কাউন্সিলর রাবিন্দর সিং নেগী। বাড়ছে ঘেটো তে বাস করার প্রবণতা।

 

নাম দেখে লিঞ্চ করার প্রবণতা বিরুদ্ধে ২০১৭ সাল থেকে চালানো হয় #NotInMyName ক্যাম্পেইন। নাম দেখে প্রেম, নাম দেখে ভোট, নাম দেখে খাবার, নাম দেখে রাজনৈতিক দল, নাম দেখে সরকারি সুবিধে বা অসুবিধে সবই হচ্ছে এই সময়ে। যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন পোশাক দিয়ে চেনা যায় চেনা!

নাম দিয়ে কি শুধুই যায় ধর্ম চেনা? নারীদের ক্ষেত্রে নারীদের নাম অনেকসময় সমস্ত পরিচয়ের সার্বভৌমত্ব মুছে যাওয়ারও প্রতীক। সালটি ২০১৯-২০। আলোচনায় তখন মুখ্য বিষয় এনআরসি ও সিএএ। ডিভোর্স পরবর্তী ঝামেলায় কাগজপত্র ঠিক করার জন্য হাজির হলাম আধার অফিসে। লম্বা লাইন বলাই বাহুল্য। সেটা মুর্শিদাবাদ জেলা। যে জেলা সম্পর্কে নানান রকমের ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে বাজারে শুধুমাত্র ঘৃণার বাজার গরম করার জন্য। লাইনে দাঁড়িয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট অফিসার বললেন সব স্লট বুকড, পরের বছর খোঁজ নিতে। আমি ভুল শুনেছি ভেবে আবার জিজ্ঞেস করাতে বললেন, এই জেলায় একশো শতাংশ বিবাহিত মুসলিম মহিলাদের নাম ভুল! ব্যাপারটা বুঝতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের কাছে জেনে বুঝতে পারলাম আসলে বিয়ের আগের কাগজ ও বিয়ের পরের কাগজের মধ্যে নামের অমিল। বিয়ের পর নামের উপাধি পাল্টে “বিবি” করে দেওয়া দস্তুর। বিয়ে নামক দানব গিলে খায় মেয়েদের অস্তিত্বকে। পারভিন, খাতুন, বেগম, আলম থেকে “বিবি।” স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া, যেন সিলমোহর যে কারও বউ, কারও সম্পত্তি! তেমনই বিধবা হলে লিখে জুড়ে দেওয়া “বেওয়া!” তাই এন আর সি নামক বিপন্নতা ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতেই  বিবাহিত নারীরা ছুটেছে নাম সারাই করতে, নামের মেরামতি, কিন্ত বিবাহ নামক যে প্রতিষ্ঠানটি গিলে ফেলে মহিলাদের নাম তার মেরামতি করবে কে? জানা নেই।

 

নাম নিয়ে বিড়ম্বনা শুধু ধর্ম ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে নয়। নামকরণের মধ্যে নিহিত থাকে কোনো ব্যক্তির সামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানও। একটি সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করার সুবাদে শিক্ষার্থীদের নথিপত্র প্রায়শই হাতে আসে। আর তাতে চোখে পড়ে নানারকমের ভুল। বলাবাহুল্য আমার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। আর প্রায় নব্বই শতাংশের বেশি পড়ুয়ার বাবা মা পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের নানি - দাদি , বা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে রেখে মা বাবা যায় ভিনদেশে কাজ করতে। স্কুলে, কলেজে বা আধারের নাম নথিভুক্ত করতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই যায় কিংবা নানি দাদিরা যায়। আর অনেকের নাম আরবী বা পার্সিয়ান বা উর্দু হওয়াতে নাম নথিভুক্ত করণের জন্য নিযুক্ত আধিকারিক প্রায়শই ভুল করেন। তারপর আছে পড়শীকে না জানা, না চিনতে চাওয়ার অভ্যেস। আর স্থানীয় উচ্চারণও একটা সমস্যা বটে। তাই রোজই সরকারি নানারকম প্রকল্পের সুবিধে পেতে হন্যে হয়ে নাম সংশোধনের জন্য বিডিও থেকে নানারকম অফিসে ঘুরে বেড়ান সাধারণ মানুষ। ছেলের নাম “তৈমুর” রেখে বিস্তর ঘৃণার শিকার হন করিনা কাপুর ও সাইফ আলী খান।

 

আবার নামকরণের মাঝে লুকিয়ে থাকে আভিজাত্য প্রকাশের  সুপ্ত ইচ্ছেও। মালদায় খুব বড় একটি নাম এ বি এ গনি খান চৌধুরী। সেই নাম দেখে নিজের আভিজাত্য প্রকাশের সুপ্ত ইচ্ছেয় আমার কাকা শ্বশুর তাঁর ছেলেদের  নাম শুধু একটি নাম রেখে সন্তুষ্ট হননি। তাদের প্রত্যেকের নাম তিন চারটি নামের সংমিশ্রণ। আর তাতেই মাধ্যমিকের এডমিট কার্ডে ভুল ও তারপর বিড়ম্বনা।

শুধু তাই নয় নাম এতটাই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশে যে কিছু পরীক্ষায় শুধুই রোল নম্বর বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে হয়, যাতে এক্সামিনার নাম দেখে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়েন! রাষ্ট্র থেকে পরিবার সবেতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নাম। নাম হতে পারে ভয়ের কারণও। সেটা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা, তিস্তা তোর্শা এক্সপ্রেসে চেপে যাচ্ছি মুর্শিদাবাদ। ভোটের আর কয়েক মাস দেরি। ময়নাগুড়ি থেকে ট্রেনে চাপা এক ভদ্রলোক শুরু করলেন ঘৃণার উদ্গীরণ। যোগ দিলেন সেই কম্পার্টমেন্টে থাকা বাকিরাও। মুসলিমদের বেশি বাচ্চা থেকে লাভ জিহাদ, বাদ যাচ্ছিলনা কোনোকিছুই। এই রকম পরিবেশে আমি যখন প্রায় সিঁটিয়ে আছি, টিকিট চেকার এলেন টিকিট চেক করতে। আমার মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত। বুদ্ধি করে শুধুই মুখে প্রথম নামটি বলে এগিয়ে দিয়েছিলাম টিকিট চেকারকে মোবাইলটা।  সেদিনও আমায় বাঁচিয়েছে আমার মামার দেওয়া নাম!

 

আবার এই ফেব্রুয়ারি। এই ফেব্রুয়ারি নেলি, গুজরাট, দিল্লি গণহত্যার সাক্ষী। ভয় হয়, আবার নাম ধরে ডাকবে না তো ফেব্রুয়ারি!

অন্ধকার ঘন হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে…

 

 

1 Comments

শুদ্ধসত্ত্ব দাস

13 February, 2025

পড়তে শুরু করার আগে ভেবেছিলাম বিষয়টা দু:খজনক হলেও জানা কথা। আপনি অনেকগুলি জিনিসের প্রতি নজর টেনেছেন যার থেকে বোঝা যায় যে রোগটা আমাদের অনেক গভীরে প্রোথিত। শুভেচ্ছে নেবেন, আরো লেখা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম। শুদ্ধসত্ত্ব দাস

Post Comment