দিনটা ৩০ জানুয়ারি, ২০২০। করোনার লকডাউন আসতে তখনও পাক্কা ৮ সপ্তাহ। আর পরের সপ্তাহে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সামনে চলছে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৯ - বিরোধী লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি। মুহূর্মুহু স্লোগান উঠছে - 'হাম কেয়া চাহতে - আজাদি, মনুবাদ সে আজাদি'। হঠাৎই পড়ুয়াদের দিকে রিভলবার তাক করল এক হিন্দুত্ববাদী যুবক। চেঁচিয়ে বলল - 'হাম দেঙ্গে আজাদি!' গুলি ছুঁড়লো, আহত হলেন জামিয়ার ছাত্র শাদাব নাজার। তারপরে ১১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির নির্বাচনের ফলাফলে ধুয়েমুছে গেল বিজেপি। কিন্তু কে ছিল এই বন্দুকধারী। কোন বিশ্বাস ভর করে সে পৌঁছে গেল রিভলবার হাতে? কোন ঘৃণা তার সাহস যোগালো? কোন বিদ্বেষ তাকে করে তুলল এই রকম হিংস্র?
এ গল্পের অনু-পরমানুতে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। দেশের কোণায় কোণায় চলতে থাকা সংখ্যাগুরুর আধিপত্য। যার শেষ আনুষ্ঠানিক টার্নিং পয়েন্ট ২৬ মে, ২০১৪। যে দিন বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও গুজরাট দাঙ্গার রেশ ধরে প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদি। এরপর, ইসলামোফোবিয়ায় ভর করে মাত্রা ছাড়া হল মুসলমান-বিদ্বেষ। শুধু, ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর, গণপিটুনিতে মারা গেল একের পর এক সংখ্যালঘু নাগরিক। আখলাক শেখ, আবদুল গফ্ফর কুরেশি, আনিফ, আরিফ, নাজির, মজলুম আনসারি, জাহিদ ভাট, পহলু খান, জুনেইদ, নাসিরুদ্দিন-সামিরুদ্দিন-নাসির, আসগার আনসারি বা উমর মহম্মদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে কবেকার বহুত্বের দেশ। উত্তরপ্রদেশের দাদরি, সাহারানপুর, ফরিদাবাদ, মহারাষ্ট্রের নাগপুর, ঝাড়খণ্ড, গুজরাট, রাজস্হানের আলাওয়ার, দিল্লি, আসামের নগাঁও, পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর, হরিয়ানার মিরাট - রক্তাক্ত হল নানান জনপদ। কী সেই বিদ্বেষের বীজ? কোন সে আদর্শ? যার ঘটনা পরম্পরায় জামিয়ার সামনে হাজির হল গেরুয়া বন্দুকবাজ?
ফেসবুকে লাগাতার সংখ্যালঘুকে অপমান, মসজিদে মসজিদে গেরুয়া নিশান, আর রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীতে ক্ষমতা প্রদর্শনের নয়া লোকাচারে সংখ্যালঘু কোতলের ডাক দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ভোটে সামিল হয়েছে বিজেপি, দ্বিতীয়বার লোকসভাও জিতেছে। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে ইতিহাস মোছার কর্মসূচি নিয়ে বদলে ফেলেছে শিক্ষা পরিকাঠামো। আধুনিকতার বহু অর্জন মুছতে গিয়ে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করেছে পাঠ্যসূচি৷ বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক তৈরির পাঠচক্রে ঢুকিয়েছে ভ্রান্ত বিশ্বাস। তবু বহুত্ব অর্জন করে, নানা মত ও পথের ভারত শেষমেশ বদলায় না। কাঁদে, অপমানিত হয়, উঠে দাঁড়ায়। চুপ করে থেকে নিষ্ঠাভরে উজার হয় - অপমানিতের ভারত।
বহুপথ পেরিয়ে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখা ভারত ছুঁয়েছে চাঁদের মাটি। কবেকার শিক্ষার প্রাঙ্গণে তিলেতিলে জমেছে আকাশ জয়ের স্বপ্ন। ভারতের নানা প্রান্তের শিক্ষাকেন্দ্রগুলি জুড়ে নির্মিত হয়েছে অনন্য মেধার সমাহার। দরিদ্রের উঠোন বা মধ্যবিত্তের পড়ার ঘর মিলেমিশে গেছে ইসরোর ওয়ার রুমে। ধর্ম ভুলে, জাতপাত ভুলে স্বাধীনতার পর ক্রমশ মেধাসম্পদ বাড়ানো দেশটার বিজ্ঞানীরা একযোগে যেন মন রেখেছিল চাঁদে। নানাভাষায় বড় হওয়া ছাত্ররা কেউ নাস্তিক, কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, বা অন্যকিছু। আসলে সক্কলে বিজ্ঞান, সব্বাই যুক্তি, সব্বাই খুঁজে ফেরে অনন্ত পথ।
মহম্মদ কুরেশি, আরিব আহমেদ আর অমিতকুমার ভরদ্বাজ - ইসরোর বিজ্ঞানী। হ্যাঁ, তাঁদের গর্বিত ক্যাম্পাসের নাম জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া। এনআরসি, এনপিআর, সিএএ নিয়ে বারবার উত্তাল হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। 'জঙ্গি বানানোর কারখানা' তকমাও পেয়েছে এই নয় বছরে। আরেকটি ক্যাম্পাসও আছে, - আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। এখানকার প্রাক্তনী ইশরাত জামাল, প্রিয়াংশু ভার্শনের আর খুশবু মির্জা। চাঁদ-মিশনের বিজ্ঞানী। কাদের দিকে উঠেছিল গেরুয়া রিভলভার? এই সংখ্যালঘু আক্রমণের দিনে কেমন মন নিয়ে ইসরোর অফিসে আসতেন মুসলমান নামধারী তরুণ বিজ্ঞানীরা? তালিকা দীর্ঘ। এই রাজ্যের আমিনুর হোসেন, রৌশন আলি, তসিকুল ওয়ারার, মোশাররফ হোসেনের মত অসংখ্য সংখ্যালঘু নাম, আগামী বহু বহুদিন সাধনায় মগ্ন থাকবেন ইসরোর নানা কক্ষে। কে এরা, মুসলমান? ভারতীয়? বিজ্ঞানী? কে জবাব দেবে, জামিয়া মিলিয়ার সামনে হকের আজাদি রিভলবার দিয়ে দিতে যাওয়া এই ভারতেরই সেই সরল বিশ্বাসের ছেলেটা? বিশ্বাসে যার বিষ ঢেলেছে ঘৃণাবাদের আগ্রাসন! কে দেবে আজাদি? কে দিল আজাদি? ও সব মনে,স্বপ্নে, সাধনায় 'আজাদির স্হায়ী বসবাস।' নইলে চাঁদ ছোঁয় কী করে নানা রকম ভারত?
নির্ঘাত, ভারতের চাঁদ ছোঁয়ার দিনে নেচে উঠেছিল সেদিনের বন্দুকবাজ, উল্লাসে ফেটে পড়েছে তার মত সবাই। নির্ঘাত একদিন তারাও আবিষ্কার করবে - দেশটা সবার তাই, সক্কলে জিতে নেব সারা বিশ্বটা। স্রেফ বাদ যাবে ঘৃণা আর বিদ্বেষের রক্তপাত!