পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন - কিছু সত্য কিছু প্রচার

  • 22 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 814 view(s)
  • লিখেছেন : তন্ময় ইব্রাহিম
বাংলাদেশ জুড়ে চলা কিছুদিন আগে অবধি সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা, বিশেষ করে চট্টগ্রামে, মিথ্যা না, সত্যি। গোটা দেশ জুড়েই সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের উপর আক্রমণ শুরু হয় ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। কিন্তু যে ভাবে ভারতের মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম এটিকে ইসলামী সন্ত্রাসী শক্তির হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে করা আক্রমণ হিসাবে দেখাচ্ছে, ঘটনাটি কি সেরকম?

সামাজিক মাধ্যমে এই সেদিন পর্যন্ত যারা আমার মতন বিরক্তিকর প্রশ্ন করা মানুষকে অনেকেই  “কাংলাদেশী” বলতো, বাংলাদেশীদের নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করতো, পিটিয়ে বাংলাদেশ পাঠাবার কথা বলতো, তারা সবাই হঠাৎ দেখলাম বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হওয়া নিয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে। ভারতে যারা সংখ্যালঘুদের উপর ফি বছর কিছু উৎসবের দিনে হামলা করে, মসজিদ ভাঙে, গির্জা ভাঙে, ধর্ষক ও খুনিদের গলায় মালা পরিয়ে স্বাগত জানায়, তারাই প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে খুব বেশি চিৎকার করছে দেখে মনে মনে সংশয় হলো, সন্দেহ হলো। আর তারপরে, সরেজমিনে তদন্ত করে দেখলাম কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়েছে, তাও যে সে সাপ না, একেবারে জাত গোখরো (কখনো নাকি কলকাতায় জনসভায় দেখাও গেছে ভাষণ দিতে এমন একটি সাপকে)।

বাংলাদেশ জুড়ে চলা কিছুদিন আগে অবধি সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা, বিশেষ করে চট্টগ্রামে, মিথ্যা না, সত্যি। গোটা দেশ জুড়েই সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের উপর আক্রমণ শুরু হয় ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। কিন্তু যে ভাবে ভারতের মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম এটিকে ইসলামী সন্ত্রাসী শক্তির হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে করা আক্রমণ হিসাবে দেখাচ্ছে, ঘটনাটি কি সেরকম?

চট্টগ্রামের কথা

আলাপ হলো সজীব নাথের সাথে। তিনি একজন হিন্দু—বাংলাদেশে তাঁরা নিজেদের সনাতন ধর্মাবলম্বী বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন—এবং আনোয়ারা উপজেলায় সামগ্রিক ভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্যে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে লড়ে চলেছেন। 

যখন হাজার হাজার হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশের রাজধানীর ঐতিহাসিক শাহবাগ চত্বরে জমায়েত করে প্রতিবাদ করছিলেন আগস্ট মাসের ৮-৯ তারিখে, নাথ কিন্তু নিজ এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে যুক্ত ছিলেন। কারণ মানুষের জান মালের নিরাপত্তা কে শিকেয় তুলে পুলিশ তখন নিজের চামড়া বাঁচাতে ধর্মঘটে।

নাথ জানালেন যে ৫ই অগাস্ট থেকে তিনি ও অঞ্চলের যুবরা সার্বিক ভাবে অঞ্চলে শান্তি রক্ষার কাজ করছেন। তাঁর দাবি প্রতিটি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে তিনি ও তাঁর সহযোগী যুবরা পাহারা দিয়েছেন, রাত্রিকালীন পাহারা দিয়েছেন এবং এই অঞ্চলে কোনো ধরণের সমস্যা হয়নি। 

“হ্যাঁ, মানুষ নিরাপদে আছে। এখানে কোনো সমস্যা হয়নি আপাতত। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আমাদের টিম গিয়ে ওদের সহযোগিতা করেছে,” নাথ জানালেন।

অথচ, চট্টগ্রামেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় আটজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। 

তাহলে কি কিছুই হয়নি? 

নাথ জানালেন তাঁদের উপজেলায় সেটা হয়নি। “এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি তবে আমাদের একটি মন্দিরে, সরকারের পতনের পর পরই জোর জবরদস্তি দখলের চেষ্টা করেছিল সেটা আমরা তাড়া করে দিই, এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতা আমরা পাই,” তিনি বলেন।

“তবে চট্টগ্রামের যেসব স্থানে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয়েছে, সেই সব আক্রমণের জন্যে শুধু সংখ্যালঘু (পরিচয়) একমাত্র কারণ ছিল না। রাজনৈতিক কারণ, পূর্বের চলমান বিবাদ (রাউজানে সবচেয়ে বেশি বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, ওখানকার সবগুলোই রাজনৈতিক কারণ, যদিও এলাকাগুলো সংখ্যালঘুদেরই ছিল) এমন কারণ সমূহের জন্য। কিছু জায়গায় আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরী হলে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, কিছু স্থানে স্থানীয়রাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, কিছু জায়গায় আবার আমাদের ভলান্টিয়ার ভাইয়া-আপুরা এগিয়ে গিয়েছে, ইন্সটেন্ট রেস্পন্স এর জন্য,” জানালেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক আদিল রায়হান।

“চট্টগ্রামের বাইরেও উত্তর বঙ্গের দিকে হিন্দুদের উপর আক্রমণের কথা শুনেছি, যেটা ওদের ধর্মীয় কারণে করা হয়েছে এবং কিছুক্ষেত্রে সত্যতাও পেয়েছি,” তিনি জানান। 

কী ভাবে এই তরুণরা পুলিশের অনুপস্থিতিতে রক্ষা করছেন মানুষকে, বাঁচিয়ে রাখছেন বাংলার জাতীয়তাবাদ কে ও লড়ছেন সাম্প্রদায়িকতার সাথে, তাও আবার খালি হাতে?

“আমরা মোটামুটি হাজারের কাছাকাছি ভলান্টিয়ার আছি। আমরা শুরুতে যে কোনো স্থানে আক্রমণের কথা শুনলে বন্ধুদের সাথে ওই জায়গায় দ্রুত গিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করতাম (এখনো কোনোটা আসলে প্রতিহত করতে হয়নি), আর প্রথম দিকে সেন্ট্রালের মন্দির গুলো/ রিস্ক জোনগুলোরে রাতে পাহারা দিতাম। এখন চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা নিরসনে কাজ করছি, পাশা পাশি কোথাও আক্রমণ হলে ইন্সট্যান্ট রেস্পন্স, বড় আক্রমণে পসিবিলিটি থাকলে আর্মিকে নিয়ে আসার মতো কাজ গুলো করছি। এবং কারো বাসায় আক্রমণের হুমকি দেওয়া হলে এলাকাভিত্তিক পেট্রোলিং এর ব্যবস্থা করেছি,” রায়হান জানান।

চট্টগ্রামের ছেলে সামিন ইয়াছার সাদ। তিনি জানালেন যে ৫ই ও ৬ই অগাস্ট সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ও ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটেছে অনেক। তবে তিনি এর পিছনে পুরানো শাসকের হাত দেখছেন। 

“আমরা এখানে যেহেতু শহর অঞ্চলে আছি, এখানে বিচ্ছিন্ন লুটপাট চললেও সংখ্যালঘুদের উপর ওভাবে আক্রমণ হয়নি। যদি হয়নি বলি, ভুল হবে। হয়েছে কিছু জায়গায়, তবে সংখ্যালঘু হিসেবে নয়। তখন আওয়ামী ঘরণার অনেকের বাড়িতে আক্রমণ হয়েছিলো, ওভাবেই হয়েছে। এটা ৫ তারিখের ঘটনা। তবে ৬ তারিখ থেকে মোটামুটি অনেক জায়গায়ই ভয়ভীতি দেখানো ও বিচ্ছিন্ন আক্রমণ হয়েছে। যেহেতু ছাত্রলীগ হোক বা ছাত্রদল, সবই ঘুরেফিরে আশপাশের মানুষ, আমরা বিভিন্ন ফাঁস হওয়া কথপোকথন থেকে জানতে পাই এসব করছিল এলাকায় অবস্থানরত ছাত্রলীগের পাতি মাস্তানেরা,” বললেন সাদ। 

“প্রথমে মন্দিরে মন্দিরে  টহল দেওয়া শুরু হয়েছিলো কারণ দেশের কিছু স্থানে মন্দিরে আক্রমণের খবর এসেছে। আবার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ছাত্রসমাজের কাছে প্রতিনিয়ত খবর দেওয়া হচ্ছিলো কোথাও আক্রমণ হতে পারে নাকি। তখনই সেই অঞ্চলে যত দ্রুত সম্ভব মানুষ ছুটে গিয়েছে,” বললেন সাদ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচ, বিশ্বকাপ, জুয়া খেলা বা নামাজ পড়ার নিয়ম নিয়েও গোষ্ঠী সংঘর্ষের বড় বড় ঘটনা ঘটে, কিন্তু বাংলাদেশে হাসিনার পতনের পর সেখানে একটি সামান্য ঘটনা ছাড়া কিছুই তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটেনি বলে দাবি করলেন সেখানকার যুব স্বেচ্ছাসেবকেরা। 

“এখানে এখন পর্যন্ত কোনো রকমের ঝামেলা সৃষ্টি হয়নি,” ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়া অঞ্চলের বাসিন্দা মিরাজুল হক জানালেন। “তবে একদল লোক এই সময়কে কাজে লাগিয়ে চার-পাঁচ বছরের পুরানো এক জায়গা (জমি-কেন্দ্রিক বিবাদ)  নিয়ে সমস্যা পুনরাবৃত্তি করতে চায়, আমাদের টিম গিয়ে বাধা দেয়,” জানালেন হক।  

তিনি আরও জানান, “আপাতত আমাদের জানমালের রক্ষা সবাই মিলে একসাথেই করার চেষ্টা করছি। এছাড়া প্রতিদিন ট্রাফিক কন্ট্রোল করি, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের খেয়াল রাখি।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরকার পাড়া অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন নর্থ - সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র মোঃ ওয়ালী উল্লাহ। প্রথমে ইতস্ত বোধ করলেও পরে ওয়ালী উল্লাহ জানান, “প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোথাও কিছু হয়নি।” 

“রাস্তায়-রাস্তায় টিম করে আমরা ছাত্ররা রয়েছি যাতে কোথাও কোনো বিপদ না হয় সেই চেষ্টাই করছি প্রথম থেকে,” জানালেন ওয়ালী উল্লাহ। তাঁরা হাসিনার পতনের পরে দুটি টিম বানিয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক ছাত্র জনতাকে নিয়ে। তাঁরা সংখ্যালঘু নিপীড়ন রোধ করতে প্রস্তুত এবং খেয়াল রাখছেন কোনো মন্দির বা চার্চে যেন হামলা না হতে পারে। তিনি জানান যে তাঁদের ফোন নাম্বার সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে কোনো প্রয়োজনে যে কেউই ফোন দিতে পারেন। 

পাইকপাড়ার মন্দির এর জমি সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে ওয়ালী উল্লাহও ওয়াকিবহাল। তিনি জানান পুরানো শত্রুতার থেকে একজন মন্দিরের জমি দখল করে রাস্তা চওড়া করার চেষ্টা করছিলেন বলে বিবাদ শুরু হয় আর তিনি ও তাঁর টিম গিয়ে সেখানে তাঁদের বুঝিয়ে শুধু নিরস্তই করেননি, তাঁরা এই রকম প্রয়াস ভবিষ্যতে করলে যে অভিযুক্ত আইনী ফাঁদে ফাঁসবেন সেই কথা বোঝানোর জন্যে সাথে একজন উকিলকেও নিয়ে যান। 

ঢাকা

রাজধানী ঢাকাতে অবস্থা ৫ই অগাস্ট এর দিন ও তার আগে নানা কারণে খারাপ হয় কারণ ছিল ছাত্র-যুব জনতার সাথে নানা দিকে ছাত্রলীগের দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষ হয়। কিন্তু ৫ই অগাস্ট হাসিনা ঢাকা ছেড়ে পালানোর আগেই নানা জায়গার থেকে জাত-ধর্ম নির্বিশেষে আওয়ামী লীগ কর্মীরা পালিয়ে যান বা কোথাও গা ঢাকা দেন। 

রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর হাতের তালুর মতন চেনেন কাজী মৈত্রী। জানালেন মোহাম্মদপুরের মাঝামাঝি অঞ্চলটিই ওই এলাকার মূল অংশ। এখানে রয়েছে তাজমহল রোড, আওরঙ্গজেব রোড, নূরজাহান রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড, সলিমুল্লাহ রোড, শাহজাহান রোড, বাবর রোড, হুমায়ুন রোড, শের শাহ শুড়ি রোড ও আজম রোড। এই অঞ্চলগুলোর সমস্ত বসত ভিটাই হাউজিং সোসাইটির অন্তর্গত, অর্থাৎ তারা সবই গেটেড কমিউনিটি। ফলে এখানে নিরাপত্তা বেশি। 

“এই এলাকার দুটো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো বাঁশবাড়ি দুর্গা মন্দির এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এর ভবন। গত দুই দিনে এই এলাকায় যে ধাওয়া পাল্টা যাওয়া হয়েছে সেটা মুলত ওয়ার্ড কমিশনার এর ভবনের সামনে পিছে আওয়ামী লীগের কারণে। কিন্তু মন্দিরও একই এলাকায় হওয়ার কারণে স্থানীয় হিন্দুরা ভয় পেয়েছে, মোহাম্মদপুরে হিন্দুর সংখ্যা খুবই কম,” জানালেন মৈত্রী। 

সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা যে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবকরা দল বেঁধে নিয়মিত করে যাচ্ছেন সে কথা জানান মৈত্রী। “বিশেষ উল্লেখ্য যে এই এলাকা থেকে মন্দির কাছে এ জন্যই উত্তেজনা, পলিটিক্যাল সংঘর্ষকে মানুষ ধর্মীয় অশান্তির আশঙ্কা করেছিল কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। আমরা এখন পর্যন্ত চার রাত পাহারা দিলাম। প্রথম দুই রাত উত্তেজনায় গেলেও পরের দুই রাত খুবই উৎসব আর আনন্দের সাথে সবাই বাসা থেকে বের হয়েছে এবং রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছে। এখন রাতের পাহারা প্রায় পুরোটাই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের হাতে, এরা ইউনিফর্মড অর্থাৎ সাদা পাঞ্জাবি, টুপি, আইডি কার্ড হাতে লাঠি,” মৈত্রী জানান। 

পাহারা নিয়ে বিস্তারিত জানাতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক মৈত্রী জানালেন যে মোহাম্মদপুরে আছে মোহাম্মদী ইয়ুথ ক্লাব, স্থানীয় কল্যাণ সমিতির সিকিউরিটি গার্ড, এদের সাথে এসে জুটেছে আশেপাশের তিনটি মাদ্রাসার ছাত্ররা। “অর্গানাইজড গ্রূপের মধ্যে আছে ফায়ার ভলান্টিয়ার, হ্যাম রেডিও গ্রুপ, স্কাউটের দল (এরা রাতে পাহারা দেয় না),” জানালেন তিনি। 

তাঁর মতে মোহাম্মদপুর সম্পূর্ণ ভাবে স্বাভাবিক আছে। বছিলা এলাকা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। “মোহাম্মদপুর এলাকায় সংখ্যালঘু কম, যারা আছে তারা ভালো আছে, তবে প্রান্তিক অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা অবশ্যই হচ্ছে, যেমন পঞ্চগড়। ঢাকা শহরে হিন্দুদের ক্ষতি কেউ করবে না, চার্চ পোড়াবে না,” বললেন মৈত্রী। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ আসিফুজ্জামান রাজধানীর রামপুরা, খিলগাঁও ও বনশ্রী অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি  জানান যে তাঁর অঞ্চলে যে অশান্তি ৫ই অগাস্ট শুরু হয় তা হলো মূলত থানা আক্রমণ ও লুটপাটের ঘটনা। তিনি জানান অঞ্চলে একটি মন্দির সেই সময় আক্রান্ত হয় যা ছিল থানার পাশেই এবং তার উপর আক্রমণ থানার উপর আক্রমণেরই একটি অংশ। তবে আসিফুজ্জামান দাবি করেন যে তাঁরা, স্বেচ্ছাসেবকেরা এই ঘটনার পর থেকে টহলদারি বাড়ান ও সামগ্রিক অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের কাজ করেন।  

অঞ্চলে থানা হামলার সময়ে তিনি ২২ জনের একটি দলকে সেখানে পাঠান বলে জানান আসিফুজ্জামান, এবং তারপরে অবস্থা আয়ত্তে আসে। সেই সময়ে অঞ্চলে মন্দির ও থানার কাছে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দোকানেই ভাঙচুর হয় বলে তিনি জানান। 

“সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যদি আমি বলি, তাহলে এটা একটা প্রোপাগান্ডার অংশ বাংলাদেশে ডিভাইড এন্ড রুল (ভাগ করো এবং শাসন করো) প্রয়োগ করার জন্যে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের যাঁরা অংশ ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ এই সব জায়গায় আঘাত করছেন, এটা বাংলাদেশের জনগণ মনে করে যে এটা আওয়ামী লীগের একটা প্রোপাগান্ডা। তা ছাড়া বেশির ভাগ গুজব, ফেক নিউজ (ভুয়ো খবর) ছড়ানো হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে ছবি এডিট করে, কিছু ক্ষেত্রে পুরানো ঘটনার ভিডিও কে এখনকার বলে চালিয়ে,” জানালেন জলবায়ু এবং বন্যা বিশেষজ্ঞ রিয়াসাত আমিন, যিনি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করছেন ঢাকার খিলগাঁও অঞ্চলে। 

আমিন জানান যে তিনি নিজে ‘সেভ দ্যা টেম্পল’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী দলের সদস্য যাঁরা যখনই কোনো মন্দিরে কোনো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলেই বা কেউ ফোন করলেই তাঁরা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে ছুটে যাচ্ছেন। “কিছু ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়, কিন্তু সেগুলো ঘটছে ভাগ করো ও শাসন করো নীতির জায়গার থেকে, এটা প্রমাণ করতে যে আওয়ামী লীগের শাসন না থাকলে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকবে না,” বললেন আমিন। 

ঢাকার মিরপুরের সাকির নিজে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সাথে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থলগুলো পাহারা দিচ্ছেন। তিনি দাবি করেন যে মিরপুরে মানুষ নিরাপদে আছেন। 

মিরপুরেরই আর এক যুবক ফাহিম বলেন, “সংখ্যালঘুদের সাহায্যের জন্যে সচেতন ছাত্রজনতা মাঠে আছে। দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে যাতে পরিস্থিতি অনূকুলে থাকে। কেউ চাইলেও শিক্ষার্থীরা এই সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হতে দিবে না। এবং ভিন্ন ভিন্ন সময়ের কিছু ধ্বংসাযজ্ঞের কিছু ছবি বা ভিডিও দুর্বৃত্তরা  ছড়িয়ে যাচ্ছে, যেগুলো গুজব, একেবারে হচ্ছে না বললে ভুল হবে, তবে এলাকার লোকজন খুবই সচেতন।”

সাভারে আবার আমরা সাভারবাসী দল একযোগে শুরুর থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্যে সজাগ থেকেছে। এই দলের তরফ থেকে জানানো হলো, “৫ই অগাস্ট কিছু সমস্যা হয়েছিল, তবে সাভারই একমাত্র জায়গা, যেখানে সাম্প্রদায়িক কোন অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি। আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সর্বোচ্চ কাজ করেছি শুরু থেকে।” 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তানভীর ইমতিয়াজ অতুল জানালেন, “ঢাকায় এখন পর্যন্ত কোনো মন্দির ভাঙচুরের খবর পাইনি। এখানে সবাই আমরা যে যেখানেই সম্ভব মন্দির পাহারা দিচ্ছি। দুষ্কৃতিকারীরা এখনো যায়নি বা এরা আছে। এরা কোনো ধর্মের না, এরা যেমন মন্দির ভাঙছে তেমনি মাজার, ভাষ্কর্য, মুরাল ভাঙছে। এরা খোদার পথভোলা নাদান মানুষ। শিক্ষিত সমাজ এদের ধিক্কার জানাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিত্রটা একটু ভিন্ন, সেখানে কিছু মন্দিরে হামলার ব্যাপারটা আমরা শুনছি। তবে সেনাবাহিনীর যত দ্রুত সম্ভব সকল এলাকা কভার করছে আর এই দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেফতার করছে।”

হবিগঞ্জ 

হবিগঞ্জের প্রাক্সিস হবিগঞ্জ নামক আইইএলটিএস সংস্থার ডিরেক্টর হোসাইন আহমেদ সাগর জানান যে সেখানে কোনো ধরণের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। এর সাথে সাথে সাগর জানান যে তাঁরা নিয়ম করে অঞ্চলে পাহারা দিচ্ছেন ও রাতে সংখ্যালঘুদের উপসনালয়ে পাহারা দিচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এর ফলে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। “আমরা আছি আমাদের ভাইদের পাহারায়। আগে আমাদের উপর আঘাত আসবে। তারপর ওদের,” বললেন সাগর। 

হবিগঞ্জেরই সৌরভ আহমেদ জানালেন, “সংখ্যালঘুদের উপর কোনো প্রকার হামলা হয়নি। হামলা হয়েছে শুধুমাত্র স্থানীয় এমপি এবং মেয়রের বাসায়।” আক্রমণের ঘটনা কে নস্যাৎ করে আহমেদ জানান যে সেখানে ছাত্ররা সজাগ রয়েছেন।  “রাত জেগে ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিয়েছে,” বললেন তিনি। 

গাইবান্ধা 

“আমাদের জেলায় বর্তমানে খুবই শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে সবাই মিলেমিশে আছে কারো মাঝে কোনো দাঙ্গা বা ক্ষোভ নেই! দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া গেলেও আমাদের জেলায় এখন পর্যন্ত তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় নি,” উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধার বাসিন্দা ফারহান সাদিক জানালেন। 

তাঁর বক্তব্য গাইবান্ধার নানা অঞ্চলে ছাত্ররা দল বানিয়ে মানুষের সাথে থাকার, অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করছেন ও কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে ঘটেছে তার কারণ পুরোদস্তুর পুলিশ ও প্রশাসনের অনুপস্থিতি।

তবুও কেন হিন্দুরা বিক্ষোভে

রাণা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের (বিএইচবিসিওপি) ডাকে ঢাকার ঐতিহাসিক শাহবাগে কয়েক হাজার হিন্দু ধর্ণা প্রদর্শন করলেন দেশ জোড়া সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে। বিএইচবিসিওপি নেতা অ্যাডভোকেট  দাশগুপ্ত জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে নাকি ২০৫টি সংখ্যালঘু বিরোধী হিংসার ঘটনা ৫ অগাস্ট এর পর থেকে হয়েছে। এর প্রতিবাদে যেমন বিএইচবিসিওপি, পূজা উদযাপন পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা প্রতিবাদ করছে তেমনি তদারকি সরকারের কাছে তাঁরা অনেকগুলো দাবি তুলে ধরেছেন যার মধ্যে অন্যতম হলো সংখ্যালঘুদের জন্যে জাতীয় সংসদে সংরক্ষণ, সরকারে তাঁদের জন্যে মন্ত্রক ও তাঁদের সুরক্ষা প্রদানের বন্দোবস্ত করা। 

এর সাথে দাশগুপ্ত দাবি করেছেন যে যাঁদের উপর হামলা হয়েছে সেই নিপীড়িতদের ন্যায় প্রদান করা, তাঁদের দখল হওয়া জায়গা জমি ফিরিয়ে দেওয়া, প্রভৃতি। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও ছাত্র যুবরা বারবার সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ রোধের বন্দোবস্ত করছেন, পাহারা দিচ্ছেন বলে দাবি করছেন, পুলিশের অনুপস্থিতিতে তাঁদের উপর চরম অত্যাচার হচ্ছে বলে বিএইচবিসিওপি, পূজা উদযাপন পরিষদ ও সংখ্যালঘু ঐক্য মোর্চা দাবি করছে। 

কিন্তু সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা যাচ্ছে হাসিনার শাসন কালে, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান বাদে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় অংশটি সাম্প্রদায়িক, ও মৌলবাদী জামাত-এ-ইসলামীর আতঙ্কে ও সরকারি সুযোগ সুবিধা লাভের আশায় আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়, তাই দেশজোড়া আওয়ামী-বিরোধী আন্দোলনের আবহে প্রাক্তন শাসক দলের নেতা কর্মীদের মতনই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু আওয়ামীদের উপরেও আক্রমণ নেমে আসছে।

কিছু ছাত্র লীগের কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের অতি-দক্ষিণ হিন্দুত্ববাদী শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) স্লোগানের — জ্যায় সিরি রাম — বাংলা সংস্করণ জয় শ্রী রাম ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেকে আবার নিজেদের নাম দেবনগরী অক্ষরে লেখাও শুরু করে দিয়েছেন।

অনেকে ভারতকে তাঁদের রক্ষা করার ও হাসিনা কে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছেন, যার ফলে উত্তেজনা আরও তুঙ্গে উঠছে। এবং এর মধ্যেই কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত হিন্দুত্ববাদী নেতা ও সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ গোবিন্দ প্রামাণিক। একটি টেলিভিশন চ্যানেল কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের এই নেতা হিন্দু নিপীড়নের অভিযোগ নস্যাৎ করেন, এবং আক্রমণ করেন ভারতের রিপাবলিক সহ অন্যান্য মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম কে।

প্রামাণিক বলেন, “আপনাদের শেখ হাসিনার জন্যে যদি এতই কান্না পায় তাহলে তিনি ভারতে গিয়েছেন, আপনাদের কাছে বিরাট সুযোগ আছে নরেন্দ্র মোদী কে সরিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার।”

মূলত ভারতের সরকারি ও সরকার সমর্থক সংবাদ মাধ্যম যে ভাবে বাংলাদেশ নিয়ে খবর পরিবেশন করছে, এবং তাতে যে ভাবে এক শ্রেণীর বাঙালি হিন্দু ও তথাকথিত বামপন্থীও যুক্ত হয়েছে, তাতে দুটো বিপদের সম্মুখীন আমরা। একদিকে দেশজুড়ে বাঙালি মুসলিমদের উপর “বাংলাদেশী” অভিযোগে আক্রমণ শুরু হয়েছে—দিল্লী, উড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্রে—অন্যদিকে এই মিথ্যা আর ঘৃণার ফলে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মতন তার একটি গুরুত্বহীন অঙ্গ রাজ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে।

অনেক খামতি, বিদেশী ষড়যন্ত্র ও বৃহৎ লগ্নি পুঁজির লোভ লালসা জড়িয়ে থাকলেও, বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সে দেশের অরুণ প্রাতের তরুণ দল ভীষণ আশাবাদী। তাঁরা দেশ গড়তে চান, আর তাঁদের চোখে দেখা যায় যে তাঁরা চান সে দেশ সবার হবে, ধর্ম মত নির্বিশেষে। ভারতের ঘৃণার লাভা কি সেই স্বপ্ন কে জ্বালিয়ে দেবে?

0 Comments

Post Comment