বছর পনের বয়সের এক মেয়ে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক খোলা চিঠিতে লিখছে, ‘জলবায়ু সংকট প্রতিরোধে আপনার এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।কেবল কথা নয়,শুধু বাগাড়ম্বর নয়। আপনি যদি এই মুহূর্তে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন তাহলে মানব ইতিহাসে আগামী দিনে আপনি এক খলনায়ক হিসাবে চিহ্নিত হতে চলেছেন।’ এক ‘বিগড়ে যাওয়া কিশোরী’-র (চরমপন্থীদের এমনই নামকরণ গ্রেটার) উত্তাল আবেদনে সাড়া দিয়েই সেদিন কিন্তু ছুটি নেয়নি সে। সে মানে সুইডেনের রাজধানী শহর স্টকহোমের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির পনের বছরের প্রতিবাদী মেয়ে গ্রেটা। গ্রেটা থুনবার্গ। এখন সে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম মুখ। আজকের গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে জনমত গঠনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০১৮ র ২০ অগাস্ট, শুক্রবার গ্রেটা তার স্কুলে যাওয়া ছোট সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে পাঁইপাঁই করে পৌঁছে গিয়েছিল তার সুন্দর দেশের সংসদ ভবনের গেটে। গ্রেটা জানত এই সেই ভবন যেখানে সারা দেশের নেতা নেত্রীরা একসঙ্গে বসে দেশ চালানোর নিয়ম ঠিক করে।সেখানেই তার নিজের কথা সবার কথা জানানো দরকার। সংসদ ভবনের সামনে ছোট্ট সাইকেল রেখে একা বসে পড়েছিল থুনবার্গ। হাতে ছিল সুদৃশ্য পোস্টার। তাতে লেখা ছিল, ‘জলবায়ু রক্ষার জন্য স্কুল ধর্মঘট।’ ঐ টুকু মেয়ের সাহস দেখে চমকে উঠেছিল তার দেশ সুইডেন সহ মায় বিশ্ব। খবরের কাগজ, টিভি থেকে সোসাল মিডিয়া তাত অনুভব করেছিল গ্রেটা থুনবার্গের সময়োপযোগী আন্দোলনের অভিমুখীকরণ লক্ষ করে। তারপর থেকে নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার জনমতের মৌতাতে ভাসতে ভাসতে গ্রেটা পৌঁছে গিয়েছিল তার পরিবেশ রক্ষার কথাকে তুলে ধরতে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে। বক্তৃতা করার ডাক পেয়ে জলবায়ু মহা সম্মেলনে তেজদীপ্ত ভঙ্গিমায় গ্রেটা উচ্চারণ করল, ‘এই গ্রহকে বাঁচাতে পরিবেশ রক্ষায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আমাদের জোটবদ্ধ হতে হবে।’ বিশ্বজুড়ে মথিত হল তার স্লোগান যার উদ্গাতা গ্রেটা থুনবার্গ নিজেই-‘ভবিষ্যতের জন্য প্রতিটি শুক্রবার।’ তার উল্থাপিত দাবি
১)প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে নাও।
২) কার্বন নিঃসরণ কমাও
৩) জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাও।
এতটুকু বয়সে যেন তার পড়া হয়ে গেছে সুকান্তের কবিতা-‘বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।’কিন্তু তার দাবিসনদ কাদের জন্য, কাদের কাছে। উত্তর একটাই কর্পোরেটের কাছে। উন্নত দেশ যারা উচ্চ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মুনাফার লোভে এই পরিবেশকে ব্যবহার করছে তাদের জন্যে ২০১৯-র ২০সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলবায়ু ধর্মঘট পালিত হয়েছে। ২০২০-২১ সালে ভারতের সংসদ যে কৃষি বিল এনেছিল যাতে কৃষকের স্বার্থরক্ষার পরিপন্থী ধারাকে মান্যতা দিয়েছিল রাষ্ট্র এবং এই বিল নিয়ে দিল্লির রাজপথ মুখর হয়েছিল সেই কৃষক আন্দোলনেও গ্রেটা থুনবার্গ সমর্থন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিল।একটি টুলকিট শেয়ার করেছিলেন তিনি।আন্তর্জাতিক এই পরিবেশ কর্মীর টুলকিট প্রচারের আলোয় আনার ফলে দিল্লি পুলিশ দিশা রবি নামে এক তরুণীকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করেছিল
বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের মুখ গ্রেটা এখন অনেক পরিণত; এখন বিশ্বজোড়া নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সে কথা বলে। তার আবেগ ও অনুভূতিকে প্রতিবাদের আঙ্গিকে তুলে ধরে। শারীরিক ও মানসিক ভাবে গ্রেটার এই প্রতিবাদ বিশ্ব ইতিহাসের নজর কাড়ে। তেমনই দায়বদ্ধতার নজির আবার তৈরি করেছে গ্রেটা। ইজরায়েলি হানায় বিধ্বস্ত গাজায় গ্রেটা তার দলবল নিয়ে ত্রাণ সামগ্রী দিতে গিয়ে ইজরায়েলের হাতে আটক হয়েছে। গত বিশ মাস ধরে চলা গাজায় এখনও পর্যন্ত ৫৫ হাজার প্যালেস্তিনীর মৃত্যু হয়েছে। ১ লক্ষ ২৭ হাজার ৩৯৪ জন আহত হয়েছে। ৬৯ হাজারের ওপর মানুষ নিখোঁজ। যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা সর্বাধিক। প্রসঙ্গত বলতেই হয় ইজরায়েল যে লাগাতার গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তা জাতিসংঘের ১৯৪৮ র বিশ্ব কনভেনশনের বার্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। যেখানে গণহত্যার সর্বমান্য সংজ্ঞায় বলা হয়েছিল, “গণহত্যা হল, কোনো গোষ্ঠীর ওপর ইচ্ছাকৃতভাবে এমন জীবনযাত্রার শর্ত চাপিয়ে দেওয়া, যা তাদের শারীরিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।” ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর আগে গাজার জনসংখ্যা ছিল ২২ লক্ষ ৩০হাজার। রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান হিসেবে তা কমে গিয়ে ২১ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার হ্রাস সে দেশের মানব সম্পদ ও অর্থনীতিকে শেষ করে দিয়েছে ও দিচ্ছে। এমনকি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ৪৫০ এর উপর কর্মীদের মেরে দেওয়া হয়েছে। এই বীভৎসার মাঝে দাঁড়িয়ে গাজার শিশু নারী সহ সুনাগরিকেরা। মৃত্যুকীর্ণ খন্ডহরে যাবার পথে ইজরায়েলের জল সীমায় প্রবেশ না করেও গ্রেটাদের আটকে দেওয়া হয়। থুনবার্গ ছাড়াও ম্যাডলিন জাহাজে তাঁর সহযোগী হিসাবে ছিলেন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক ও ইউরোপীয় সংসদের সদস্য রিমা হাসান,জার্মানির ইয়েসমিন আচার,ফ্রান্সের ব্যাপতিস্ত আন্দ্রে, ব্রাজিলের থিয়াগো আভিলা, ফ্রান্সের ওমর ফায়াদ, পাস্কাল মৌরিয়েরাস, ইয়ানিস মোহামদি, তুরস্কের সুলাইব ওর্দু, স্পেনের সার্জিও তোরিবিও, নেদারল্যান্ডসের মার্কো ফন রেনেস ও ফ্রান্সের রিভা ভিয়া।গাজার দুর্গতদের জন্য তাঁরা নিয়ে যাচ্ছিলেন ময়দা, চাল, বেবিফুড, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ডায়াপার নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন, জল বিশুদ্ধকরণের কিটস, শিশুদের কৃত্রিম অঙ্গ, ক্রাচ ইত্যাদি। অপহরণের পর থুনবার্গ তার ভিডিও বার্তায় জানিয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক জলসীমায় আমাদের আটকে রেখেছে ওরা। দখলদার ইজরায়েলি সেনা কিংবা ইজরায়েলকে সমর্থন জোগানো বাহিনী আমাদের অপহরণ করেছে।’ থুনবার্গের মানবিক আবেদন, আমি আমার পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের অনুরোধ করছি, তাঁরা যেন আমাকে এবং অন্যদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য সুইডিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। স্বস্তির কথা দ্য লিগাল সেন্টার ফর আরব মাইনরিটি রাইটস ইন ইজরায়েল (আদালহ) সহ বিভিন্ন মানবিক সংগঠন ঐ মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। গ্রেটার সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোডিলা সব বাধাকে অতিক্রম করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজায় পৌঁছাতে চাইলে এই অমানবিক আটককে বিশ্বের মানুষ ভালো ভাবে নিচ্ছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গ্রেটার উদ্দেশ্যে বলা, ‘তিনি যেন রাগ সামলানোর ক্লাসে যান’, জলবায়ু নিয়ে অতীতে আমেরিকার বিরুদ্ধে বলা গ্রেটার কথার জবাব বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। কিন্তু প্রতিবাদের অন্য নাম তো গ্রেটাই।
সবে স্নাতক হয়েছেন তিনি। আমাদের ভুলে যাবার কথা নয় জলবায়ু আন্দোলনের মুখ হিসাবে গ্রেটা যখন রাস্তায় তখন তার একটি ডাকে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শিশু শিক্ষার্থী নেমে এসেছিল রাস্তায়। সুইডেনের সেই একরত্তি বিশ্বের তাবড় নেতাদের টনক নড়িয়ে দিয়েছিল।এরই মধ্যে তারনানা আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে লেখা, ‘নো ওয়ান ইজ টু স্মল টু মেইক এ ডিফারেন্স’ বিশ্বের জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়েছে। যেখানে থুনবার্গ যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, জাতিসংঘ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জলবায়ু সংক্রান্ত যতগুলি বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার ইংরেজি অনুবাদ গ্রথিত আছে। পরবর্তী বই একটি স্মৃতিকথার আদলে লেখা,‘আওয়ার হাউজ ইজ অন ফায়ার:সিনসেস অব এ ফ্যামিলি অ্যান্ড প্ল্যানেট ইন ক্রাইসিস’ - মা অপেরা সংগীতশিল্পী মালেনা আর্নম্যান,বোন বেটা আর্নম্যান ও বাবা স্যাভন্তে থুনবার্গের সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখা।একাধিক পুরস্কার তাকে সম্মানিত করলেও সবচেয়ে বিস্ময় যেটা আমাদের নাড়িয়ে দেয় তা হল নোবেল পুরস্কারের জন্য গ্রেটার নাম সুপারিশ হওয়ায়।গ্রেটা সহ চার জনকে ইজরায়েল তাদের প্রত্যর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়ে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিলেও বাকিদের তারা বন্দী করে রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাংসদ বামপন্থী নেত্রী রিমা হাসানকে না ছাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় সংসদ।মানবাধিকার কর্মীদের মুক্তির দাবিতে প্যারিসে যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছে তা সাম্প্রতিক অতীতে বিরল।ইজরায়েল গ্রেটাদের এই ত্রাণ নিয়ে যাওয়াকে যেমন ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’বলে দাগিয়ে দিয়েছে তেমনই বিশ্ব জনমত ইজরায়েলের এই আচরণকে ‘সন্ত্রাসবাদী সুলভ’ আচরণ বলে ধিক্কার জানাতে দ্বিধা করেনি।প্রশ্ন হচ্ছে গ্রেটারা কি থেমে যাবে! ইজরায়েল সরকার যতই তাদের এই অভিযানকে গ্ল্যামার,চটক,প্রচার পাওয়ার লোভ বা সামাজিক মাধ্যমে ভেসে থাকা বলে গালমন্দ করুক না কেন গ্রেটার সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া একটি কথাই তাদের আন্দোলনের অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে,যেখানে গ্রেটা বলছে,‘বিশ লাখ মানুষকে পরিকল্পিতভাবে অনাহারে রেখে দেওয়া হয়েছে।এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে শামিল হওয়া বিশ্বের প্রতিটি শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।’