তখন লকডাউন-পর্ব চলছে। পুলিশ ও সরকারি প্রশাসন লকডাউন সফল করতে গলদঘর্ম। অতিমারি নিয়ে সর্বত্র অতিসক্রিয়তা দেখানো চলছে। কিন্তু অতিমারি নিয়ে জনসাধারণে অনেকেরই মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। তাদের মাথা খারাপ যত প্রশাসনের অতিসক্রিয়তা নিয়ে।
লকডাউনের পরিকল্পনায় সরকারি স্তরে অসংবেদনশীল মানসিকতা দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষদের জীবনে অশেষ ভোগান্তি এনে দিয়েছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর বাইরেও তাদের বিচারধারায়, বিশেষ করে গ্রামের দিকে, এমনকি যাদের খাদ্যসামগ্রী, ঘরোয়া বিনোদনের অভাব ছিল না, এমন অনেকের কাছেও, লকডাউন ছিল অনর্থের ব্যাপার।
গ্রামাঞ্চলে লকডাউন কার্যত পুলিশের সঙ্গে পাবলিকের চোর-পুলিশ খেলার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ বাজার গেছে যখন, কাছাকাছি পুলিশ থাকলে নমোনমো করে স্বাস্থ্যবিধির পাট সেরেছে। গ্রামে বা গ্রামের ছোটো ছোটো বাজারগুলোতে সব আগড়বাগড়। এখন আনলক-১’এ কি বাজার, কি গ্রাম, কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। ইতিউতি কেউ কেউ মাস্ক পরে ঘোরে, বোধহয় সসঙ্কোচেই । অথচ স্বাস্থ্যবিধিতে বিমুখ কারো সঙ্গে বসন্ত রোগ নিয়ে কথা বলুন। করণীয় কী, নিখুঁতভাবে বলে দেবে। ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুতে মশারির জুড়ি নেই, সবাই জানে এবং মানে। আবার ডায়েরিয়া হ’লে ও.আর.এস-ই আসল দাওয়াই, ক’জন জানে? আর জানলেই বা মানে ক’জন?
সংক্রামক রোগে রোগীর থেকে সংক্রমণ এড়াতে আমরা রোগীর থেকে দূরে থাকা কিম্বা রোগীকে পৃথক রাখা উত্তম পন্থা হিসেবে দেখে এসেছি। কিন্তু করোনা সংক্রমণ অনেকটাই ভিন্ন ধরণের। ড্রপলেট ইনফেকশনের মাধ্যমে, এমনকি রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগে থেকেই, রোগ ছড়ায়। ফলে নতুন পন্থা-- কোয়ারেন্টাইন, শারীরিক দূরত্ব (ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং), টেস্ট, লকডাউন, এমন সব নতুন ব্যাপার সামনে এসেছে। এখানে জনস্বাস্থ্যের ভূমিকা বিশাল। আমাদের দেশে এখানেই বড় ঘাটতি। এদেশে জনস্বাস্থ্য মানে শিশুদের ক’টা টীকাকরণ ও স্বচ্ছ ভারত মিশনের মতো ঢক্কানিনাদ। জনস্বাস্থ্যে রোগ-নিরাময়ের থেকে রোগের কারণ নির্মূল করা ও রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বেশি। জনস্বাস্থ্যের সমস্ত দায়-দায়িত্ব সরকারের। এই দায়ভার বহনে অনিচ্ছুক আমাদের দেশের সরকারের আগ্রহ রোগ-নিরাময়ে। আর বাজার অর্থনীতির ধুয়ায় শহরে-নগরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠেছে বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল ও নার্সিংহোম। দেশে জনস্বাস্থ্যের দশা এমনই করুণ যে, মানুষের রোগে ভুগে মৃত্যুর ৫৩ শতাংশই সংক্রমণজনিত। ফলে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে জনমনে ধারণা ভাসাভাসা ও খাপছাড়া। সেখানে করোনা অতিমারির রহস্য ভেদ করার মন ও মর্জি বড়ই সঙ্কুচিত।
যে দেশে বেসরকারি চিকিৎসার যত রমরমা, সেই দেশ করোনা অতিমারিতে তত বেশি বিপর্যস্ত। আমেরিকা, ইতালির মতো দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ক্রমাঙ্কের প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, লাওস, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া করোনার বিপদ মোকাবিলা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। কোথাও লকডাউনই হয়নি, কোথাও আংশিক বা সাময়িক লকডাউন হয়েছে। খেয়াল করার বিষয়, ভারতে স্বাস্থ্য-খাতে ব্যয় জিডিপি’র ১.২৯ শতাংশ; সেখানে এই দেশগুলিতে স্বাস্থ্য-খাতে ব্যয় ভারতের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। এবং এই দায়বদ্ধতায় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দেশময় বিছিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে কেরল কিন্তু দলছুট হয়ে এদের দলে ঢুকে পড়েছে।
৩০ জানুয়ারি ভারতে প্রথম কেরলে করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান মিলেছিল। তখন থেকেই কেরলে প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছিল। ১০ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা সংক্রমণ বা কোভিড-১৯-কে অতিমারি ঘোষণা করে। এদিকে ১৩ মার্চ ভারত সরকার বিবৃতি দেয়, কোভিড-১৯ ভারতে হেল্থ ইমর্জেন্সী নয়। কিন্তু কেরল তখন প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনায় অনেকটা এগিয়ে গেছে। সেখানে দ্রুততার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নামানো, করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা, রোগাক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সময়মতো কোয়ারেন্টাইন করা, লকডাউনের সময় মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনগুলির দিকে নজর দেওয়া, সব গুরুত্ব দিয়ে করা হয়। পাশাপাশি মানুষের সহযোগিতার অভাব ছিল না। কেরল এখন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে এসেছে। কয়েক দশক ধরে গড়ে তোলা জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও জনসচেতনতাকে সঙ্গে নিয়ে কেরল এই আপাত অসাধ্য সাধন করেছে।
ভারতে জনস্বাস্থ্যের অপ্রতুল ব্যবস্থাপনার পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ও আর সব রাজ্য সরকারগুলির উচিত ছিল যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ও সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনো, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগোনো। লকডাউন সেখানে অপৎকালীন ব্যবস্থাপনা হতে পারত। তা হ’লে হয়তো আর্থিক ও মানবসম্পদের ক্ষতি অনেকটা এড়ানো যেত। এদিকে না হেঁটে লকডাউনকেই সর্বরোগহর দাওয়াই বাতলে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করা হ’ল। বিপরীতে কেরল মডেলে জনস্বাস্থ্য তো আছেই-- সেই তার প্রাণ-ভোমরা; সেইসঙ্গে মিলে আছে অতিরিক্ত কিছু। সে হ’ল সংবেদনশীলতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ।
প্রথম দফার লকডাউনের সময় কয়েক হাজার অভিবাসী শ্রমিক তাদেরকে ঘরে ফেরানোর দাবি নিয়ে কেরলে কোট্টায়ামে জড়ো হয়েছিল। প্রশাসন থেকে তাদের আর কোনো সমস্যা হবে না বলে আশ্বাস দিয়ে ফিরে যেতে বলা হয়। শ্রমিকরা যে-যার ঘরে ফিরে যায়। এরপর রাজ্য সরকারের তরফে দেরি না করে অভিবাসী শ্রমিকদের খাদ্যসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বিনা পয়সায় তাদের মোবাইল ফোনে আনলিমিটেড কলের সুবিধা সহ নেট রিচার্জ করে দেওয়া হয়। আর তাদের ঘরে ঘরে নিখরচায় পৌঁছে দেওয়া হয় ক্যারাম বোর্ড। কেরলে করোনা অতিমারি মোকাবিলায় জনস্বাস্থ্য রূপায়ণ ও লকডাউনের সাফল্যে এই ঘটনা হ’ল এক খণ্ডচিত্র।