উৎস চিন-এর ওহান শহর , তারপর অপ্রতিরোধ্য গতিতে মানুষে চেপে ধেয়ে গেছে জাপান, আমেরিকা, ব্রিটেন, ইটালি, ইংল্যান্ড,কিউবা, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া সহ সারা পৃথিবীতে I লক ডাউন, হোম কেয়ারেন্টাইনে মনখারাপ নিয়ে বসে আছি একাকি জানলায় I বাড়ি থেকে অদূরে আক্রমন করেছে অতি সংক্রামক মারণ ভাইরাস কেভিট-১৯ ৷ বাড়ি থেকে বেরনো বারণ , মানুষ থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, চারিদিক বন্ধ, বন্ধ, হাহাকার I যা দু'চারটে মানুষ মানুষের প্রয়োজনে বাইরে , তাদের মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস্ , পরণে পিপিই পোষাক ৷ ঘরে জায়গা নেই, গাছে মাচা বেঁধে কোয়ারেন্টাইন যাপন করছে কেউ কেউ , কেউ নৌকোর ছোঁই-এর মধ্যে দিন-রাত I হাত পেতে আছে হতদরিদ্ররা, খাবার ছুঁড়ে দাও ! লাখে লাখে মৃত্যুর খবর দিচ্ছে টেলিভিশান I আমার জানলার বাইরে এক চিলতে নির্মল ঘন নীল আকাশ, গাছেরা অনেক বেশি সবুজ, দূষণহীন স্বচ্ছ বাতাস আর উচ্ছ্বেসিত পাখিদের ওড়াউড়ি ৷ পালক উড়ে আসছে জানালায় ৷ কিছু কি লেখা আছে তাতে ! এ কি কোনও প্রতিশোধের রূপ ! পৃথিবীর সাম্য নীতির কোনও ধারার প্রয়োগ ! বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ৷ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি , এক মুখ দাঁড়ি, বিস্কুট রঙের মলিন খদ্দরের পাঞ্জাবী, কাঁধে ঝোলা, এক অচেনা ভদ্রলোক ৷ হাসছেন, বলছেন, "আমাকে চেনেন, আবার চেনেন না, আমাকে কিছু লিখে দিন ৷ আপনার চেনা অনেক কবি সাহিত্যিক আমাকে কিছু লিখে দিয়েছে , সব এই ঝোলার ভেতরে আছে।" ঝোলা থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে এগিয়ে দিলেন । আমার ভুরুতে ভাঁজ ," আপনি এখানে এলেন কীভাবে?"
"কেন, হেঁটে !"
" না মানে, করোনা ভাইরাস, লক ডাউন, রাস্তায় পুলিশ..."
" আমাকে বারণ করেনি কেউ , আর করোনা ....!"
ভদ্রলোক হাসলেন ৷ হাসি দেখে বুঝলাম , তিনি করোনাকে ভয় পান না, তোয়াক্কা করেন না। যাই হোক , ওনাকে এখন আমি কী লিখে দেব ! মাথা চুলকালাম ৷ পাগল-টাগল হয়ত হবে I লোকটাকে তাড়ানো দরকার , কিছু লিখে না দিলে যাবে না ৷ বললাম, " দাঁড়ান, একটা কলম নিয়ে আসি ।"
ঘর থেকে কলম নিয়ে এসে দেখলাম ভদ্রলোক উধাও I দরজায় ভাঁজ করা একটা কাগজ পড়ে আছে । সাদা কাগজটা ফেলে গেছেন লোকটা ! তুলে নিয়ে দেখি ছোট ছোট হস্তাক্ষরে অনেক কিছু লেখা I লেখকের নাম নেই ৷ পড়তে শুরু করলাম I
আহা কি সুন্দর বাসস্থান ! সামনে সারিবদ্ধ শৈল্যমালা, পেছনে ঢেউ ঢেউ সমুদ্র , পাশে বনাঞ্চল , তরতর নদী, মরু, মালভূমি , আরো কত কি I অরণ্য পেরিয়ে এলে নদী, নদী পার করলেই উর্বর ভূমি, চারিদিকে নরম সবুজ I এখানেই অপূর্ব সুন্দর বাসস্থানটি I তিনজন আত্মা স্থায়ী বাসীন্দা এই বাসস্থানের ৷ একটা সময় নির্দিষ্ট কোনও সীমানা ছিল না, এখন সীমানা হয়েছে । তবু পাখি, কাঠবিড়ালি, প্রজাপতি, ফড়িং, কীটপতঙ্গরা যাতায়াত করে I বাতাসে ফুলের গন্ধ ভেসে আসে ৷ পাখিদের কনসার্ট , নিষ্পাপ ভোর , বেহালার সুরের মতো অস্তরাগ , পূর্ণিমায় নেমে এসে গল্প করে চাঁদ , অমবস্যা রাতে জ্যোতিষ্কদের মেলা , দারুণ ৷ খুব সুখেই ছিল তিনজন আত্মা , ইদানিং সেই সুখ নিজ নিজ কারণে অসুখের গভীরে তলিয়ে যেতে বসেছে ৷ তিন জনের তিন রকম আচরণ ৷ করোর সাথে কারোর সুসম্পর্ক নেই । তিন জন তিন পথে হাঁটে I একজন বয়সে অনেক বড় এবং স্বনির্ভর , নিজের খাদ্য নিজেই তৈরী করে দেহে, কারো সাহায্য লাগে না ৷ বাকি দু'জন পরজীবী I পরজীবী-১ -এর বয়স পরজীবী-২-এর বয়সের চাইতে বেশি । যত দিন যাচ্ছে পরজীবী-১-এর দৌরাত্ম বাড়ছে I সে মনে করতে শুরু করেছে তার অধিকার অসীম, বাকি দু'জনের অধিকার সসীম ৷ পরজীবী-২ অত্যন্ত সরল মনের আত্মা , অতিরিক্ত কোনও চাহিদা নেই I বেশিরভাগ সময় খেয়াল খুশিতে ঘুরে বেড়ায় , স্বনির্ভর আত্মার প্রতি তার শ্রদ্ধা , আনুগত্য বেশি I তার কাছেই থাকে, ঘুমোয় ৷ মাঝে মাঝে পরজীবী-১-এর প্ররোচনায় স্বনির্ভর আত্মার প্রতি দুর্ব্যবহার করে বটে, তবে তার স্থায়ীত্ব ক্ষণকাল ৷ কিন্তু পরজীবী-১ ইচ্ছামত স্বনির্ভর আত্মা এবং পরজীবী-২ আত্মার সাথে ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত হয় । স্বনির্ভর আত্মার ঘাড়ে চাপে, শোষণ করে ৷ স্বনির্ভর আত্মা সহ্য করে , আর সহ্যক্ষমতা বাড়াতে থাকে ৷ সেদিন তুমুল ঝগড়া বাধলে বাসস্থান মধ্যস্থতা ক'রে ঝগড়া থামায়। বাসস্থান তিনজনকেই সমান ভালবাসে ৷ বিপদ আসন্ন দেখে তিনজনের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আবেদন করে ৷ নিরাশ্রয়ের মত দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে ব'লে সতর্ক করে I দু'জন সতর্ক হলেও পরজীবী-১ সতর্ক হয় না, উল্টে দাঁত বের করে হাসে, বলে , তিন আত্মার মধ্যে সে-ই একমাত্র মানুষ , স্বনির্ভর আত্মা হল চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছ, আর পরজীবী-২ হল লেজ লম্বা অকর্মন্য নিরীহ এক বাঁনর ৷ পরজীবী-১ মনে করে সে বিশ্বপ্রকৃতির শাসক ৷ তার কথাতেই বিশ্বপ্রকৃতি ভাঙে গড়ে। অপমান ! চরম অপমান ! মানতে পারে না বাকি দুই আত্মা । আঙুল তোলে স্বনির্ভর আত্মা ," মানুষের এত দম্ভ পাপের ইশারা , একদিন প্রকৃতির ক্রোধে মানুষ ধ্বংস হলে অবাক হব না ৷"
স্বনির্ভর আত্মার কথা খুব ভাল লাগে পরজীবী-২-এর I পরজীবী-২ দোল খেয়ে , ডিগবাজি খেয়ে, পরজীবী-১-এর দিকে তাকিয়ে মুচকে হেসে, দাঁত খিঁচিয়ে বলে," ঠিক বলেছে , তোর ধ্বংসের সময় আসছে I "
পরজীবী-১ ক্রোধ সামলাতে না পেরে ঘর থেকে একটা কাটারী নিয়ে আসে , হুম্ হুম্ শব্দ করে স্বনির্ভর আত্মার দেহে এলোপাথারি কোপ মারে ," এই দ্যাখ্ আমার প্রয়োজনে আমি গাছের ডাল কাটছি ৷ এই গাছের ফলও আমি একা খাব, তোকে খেতে দেব না , দেখি তুই কীভাবে খাস I "
পরজীবী-২ রাগে ফুঁসতে থাকে । জড়িয়ে ধরে স্বনির্ভর আত্মাকে I স্বনির্ভর আত্মা চুপ, শান্ত। ক্ষতস্থান থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু জীবন । পরজীবী-২ ছুটে এসে ঠাস্ করে চড় মারে পরজীবী-১-এর গালে I ১ তখন স্বনির্ভর আত্মার দেহের লম্বা একটা অংশ কেটে সামনে উচিঁয়ে ২-কে তাড়া করে I ২ দুই লাফে বগার পার ৷ বাসস্থান রুখে দাঁড়ায় , পরজীবী-১ কে বলে, " তুমি মানুষ ! না অমানুষ ? শোনো তবে মানুষের গল্প ৷ এক বাড়িতে তিনজন মানুষ থাকত I বাবা, মা, ও তাদের ছেলে I যত দিন ছেলেটি ছোট ছিল , তত দিন সংসার সুখের ছিল I সংসারে একমাত্র চাকরিজীবী ও সাবলম্বী হলেন বাবা, বাবা সকলের খাওয়া-পরার দ্বায়িত্ব নিতেন I মা রান্নাবান্না , ঘরের কাজ , ছেলের যত্ন নিতেন ৷ ছেলের আবদার মেটাত দুইজনই । দিন দিন ছেলের আবদার ও চাহিদা বাড়তে থাকল মাত্রা অতিরিক্ত ৷ বাবা তা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়লেন ৷ দুর্বল হতে থাকলেন ৷ সুঠাম দেহের ছেলে একদিন বাবার গায়ে হাত তুলল , বাবাকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিল ৷ মনের দুঃখে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন অন্যত্র I বাবার পিছু নিলেন মা I বাড়িতে পড়ে থাকল ছেলে একা I যা কিছু সঞ্চয় , সম্পত্তি , কিছুদিন ভোগ করল ছেলে ৷ একদিন তা ফুরিয়ে গেল ৷ বাবা অন্য জায়গায় বাসা বেঁধে থাকলেন মাকে নিয়ে ৷ চাকরিজীবী হওয়াই তাঁর কোনও সমস্যা হল না I ছেলে পথে পথে ঘুরল , কাজকর্ম কিছুই পেল না, কেউ সাহায্যও করল না ৷ না খেতে পেয়ে রোগা হতে থাকল , রোগা হতে হতে এক দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল ৷"
এই গল্প শোনার পর কিছুদিন থমকে থাকল পরজীবী১-এর অত্যাচার I বাসস্থান ভাবল , বোধহয় সমস্যা মিটল ৷ কিন্তু না, আবার শুরু হল I আবার একদিন তুমুল গন্ডগোল I কার ক্ষমতা কত বেশি শুরু হল প্রয়োগ I কে টিকে থাকবে , কে হারিয়ে যাবে !
আকাশে ভয়ানক কালো মেঘের হুংকার I বজ্রবিদ্যুৎ , ঝড়্ , মুসলধারে বৃষ্টি নামল । মাটি কেঁপে উঠল , ভূমিকম্প I অভিমান , রাগ, ক্ষোভে ভেঙে পড়ল বাসস্থান I গাছপালা ঘর-বাড়ি সব ধূলিসাৎ I পশু-পাখিরা পালিয়ে গেল অন্য জায়গায় , মানুষ মারা গেল ঘর চাপা পড়ে I হাহাকার ৷
একদিন ফের ধ্বংসাবশেষ থেকে গজিয়ে উঠল গাছ ৷ বড় হল I ফল ধরল I বানর ফিরে এল গাছে I গাছ বলল," প্রকৃতি আবার সেজে উঠেছে , তুইও ফিরে এলি, কিন্তু অহংকারী , দাম্ভিক মানুষটা তো আর ফিরল না ! খুব দুঃথ হচ্ছে ওর জন্য । অত্যাচারী ছিল বটে , তবুও প্রাণ ছিল , ছুটাছুটি করত , হাসত খেলত , গান গাইত... "
বানর বলল , " ওই দিকে তাকিয়ে দেখো , ওই যে , একটা শুঁয়োপোকা ৷ মানুষটা নেই বলে শুঁয়োপোকাটা নিশ্চিন্তে , মনের আনন্দে কি সুন্দর হেঁটে বেড়াচ্ছে , ও প্রজাপতি হবে ৷ ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াবে ৷"
এই পর্যন্ত লেখা I লেখার শেষে অন্য কারো লেখার ইঙ্গিত । কিন্তু কে লিখেছে এটা ! কেনই বা এই লেখা ! লোকটা কে ! কেনইবা চলে গেলেন ! এই লেখার সাথে নিশ্চিত যোগাযোগ আছে আজকের পরিস্থিতির । মাথায় ভিড় করে আছে কয়েকটা লাইন I কাগজটাতে লিখে দিলাম ,-- "পৃথিবী কিছুই মাখেনা গায়ে , সবই ফিরিয়ে দেয় সময় হলে I আকাশে শকুনের উড়াল দেখে বুঝে নিতে হয় পৃথিবীর স্নানের সময় হয়েছে কিনা ৷ মানুষের আবিষ্কার শেষ হলে শুরু হয় পৃথিবীর আবিষ্কার I মানুষের হাতেই একদিন জব্দ হল কোভিট-১৯ I মরা নদীতে জল ঢালল পৃথিবী , নদী ফের যৌবনা হল I পূর্ব জন্মের হাড়-গোর , মাংস পচে গর্ভবতী হল অনুর্বর উপকূল ৷ নতুন ধানের বীজ রোপন করতে পৃথিবী মানুষের নতুন মন দিল ৷
এতক্ষণ এই যা যা হল বললাম , তা তা হয় নি , হবে ৷ কীভাবে হবে অাপনি তা জানেন , পরেরটুকু আপনার মধ্যে তৈরি আছে , আপনিই লিখুন ৷ "
তা তো হল , কিন্তু লেখাটা দিই কার কাছে ? দরজায় রেখে দেব ? না কি অদৃশ্য একটি বক্সে ভরে শূন্যে ভাসিয়ে দেব ? আশেপাশে ভেসে বেড়াবে , কেউ না কেউ লুফে নেবে I অথবা দাড়িওয়ালা লোকটার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে ৷ তিনি আসবেন ।