পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা

  • 08 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 1135 view(s)
  • লিখেছেন : শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ
কুন্তী নারী হলেও যুদ্ধবিরোধী ছিলেন না। বরং বিদুলার আখ্যান বলে চেয়েছেন যুদ্ধকে, চেয়েছেন পাণ্ডবেরা নিশ্চিত করুক পাণ্ডুর উত্তরাধিকার, নিঃসপত্ন রাজ্যলাভ করে। দ্রৌপদী নিমেষের জন্যও ভোলেননি তাঁর লজ্জার মুহূর্তকে। ভোলেননি প্রতিশোধকে। অথচ এক অর্জুনে আসক্ত হয়েও পঞ্চ ভ্রাতার বধূ হবার দ্বিচারিতা তাঁকে কখনো অস্বস্তিতে ফেলেনি। যেন সেই-ই স্বাভাবিক। আসুন একটু মহাভারত পড়া যাক, আসুন একটু তলিয়ে ভাবা যাক।

মহাভারতের প্রচলিত পাঠে পাণ্ডব পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন কুন্তী। কর্ণের কাছে। এসে জানিয়েছিলেন কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত। প্রচলিত কাহিনী বলে তিনি বিফল হয়েছিলেন। তাঁর পঞ্চপুত্রই থাকবে, অর্জুন বা কর্ণ হত হলেও, কর্ণের এইমাত্র অঙ্গীকার নিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসু তাঁর নাট্যকাব্য 'প্রথম পার্থ'-তে এনেছিলেন তারপরেই দ্রৌপদীকে। কবির স্বাধীনতার সুযোগে। পাঞ্চালকন্যা কর্ণের বন্ধুতা চেয়েছিলেন। যুদ্ধে যদি পাণ্ডবপক্ষে না-ই আসেন অন্তত তিনি যেন নিরপেক্ষ থাকেন তাই-ই চেয়েছিলেন। তিনিও বিফল হয়েছিলেন। গোটা আখ্যানে এই দুই নারীর বিপরীতে কর্ণের স্বাভিমান, মর্যাদা প্রার্থনা ইত্যাদি দাঁড়িয়েছিলো। অর্থাৎ ব্যক্তি কর্ণের কথাটুকুই।

কিন্তু যুদ্ধ কি ব্যক্তিগত বিষয়? অজস্র অসংখ্য মৃত্যু, পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অর্থনীতি থেকে সামাজিক অবস্থার বিপুল রূপান্তর এসব কি তাতে জড়িয়ে নেই? কর্ণের বিবেচনার দিকে কেন থাকেনি সেই বিপুল জনধ্বংসের কথা, যাঁরা একটি পরিবারের দুই অংশের বিবাদে রক্তাক্ত হবে, উজাড় হয়ে যাবে? অথবা ভেবে দেখুন, কুন্তি স্বয়ং না-এসে বা আসার সময় তো যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েই আসতে পারতেন যে কর্ণ প্রথম পার্থ? জানালেন না কেন?

কারণ কুন্তী নারী হলেও যুদ্ধবিরোধী ছিলেন না। বরং বিদুলার আখ্যান বলে চেয়েছেন যুদ্ধকে, চেয়েছেন পাণ্ডবেরা নিশ্চিত করুক পাণ্ডুর উত্তরাধিকার, নিঃসপত্ন রাজ্যলাভ করে। দ্রৌপদী নিমেষের জন্যও ভোলেননি তাঁর লজ্জার মুহূর্তকে। ভোলেননি প্রতিশোধকে। অথচ এক অর্জুনে আসক্ত হয়েও পঞ্চ ভ্রাতার বধূ হবার দ্বিচারিতা তাঁকে কখনো অস্বস্তিতে ফেলেনি। যেন সেই-ই স্বাভাবিক।

এমন কেন হয়?

হয় কারণ পিতৃতন্ত্র মনে করে নারী ব্যক্তিগত সম্পত্তি। মনে করে সে নিকৃষ্ট। তাকে দাসত্বের অভ্যাসে অভ্যস্ত করা হয়। তার মগজের মধ্যে ভরে দেওয়া হয় সেই সব বিষ যা পিতৃ ও ক্ষমতাতন্ত্রে আছে। যুদ্ধে যে অজস্র পরিবার উচ্ছিন্ন হবে তাঁদের নারীরা এই দুই নারীর কাছে আর বিবেচ্য থাকে না। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ঘুঁটি সাজায়। বর্ণাশ্রমে ক্ষত্রিয়ানি করে গড়া হয়েছে কুন্তী আর দ্রৌপদীকে। মানুষের মৃত্যু, যুদ্ধের কারণে, চিন্তার নয়, গর্বের বিষয়। এমনকি নিজ নিজ সন্তানের মৃত্যুও, আপাত শোকের হলেও, গর্বের অবশ্যই। স্বর্গযাত্রা করবে যে তারা যুদ্ধে মৃত হলে!

অথচ স্বর্গ নরক কে দেখেছে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ কেউ চায় না। ব্রাহ্মণ্য পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ তো নিজেই বানিয়েছে কাঠামোটা। কিন্তু তার অধীন নারীও এ প্রশ্ন তোলে না। কে নিশ্চিত জেনেছে পরজন্ম আছে, সে জন্মে এ জন্মের কর্মফল প্রযুক্ত হয়, কেউ প্রশ্ন তোলে না। এই দুই নারীও এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত নন।

কেউ তোলে না বললাম, খানিকটা ভুল হল। যাঁরা তোলেন, তাঁরা নাস্তিক, পাষণ্ড, চার্বাকাদি লোকায়তগণ। তাঁদের পুড়িয়ে মারাই কাজ। সমাজের সব স্তর থেকে তাদের বর্জন করতে হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এটা। রাষ্ট্রবাদীদেরও। এমনকি ব্রাহ্মণ্য বিচারসভাতেও তাঁদের সাক্ষ্য দেবার অধিকার নেই।

কেউ একথাও বলার নেই, এদিকে পাঁচ আর ওদিকে একশো ভাই, চাইকি ধৃতরাষ্ট্র সমেত নিজেরাই মারামারি করে ঠিক করে নিক না কেন কার সম্পত্তি। বিরোধ তো ওদের। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী মরবে কেন? তারা কি মানুষ নয়? জীবনের যাবতীয় সৌন্দর্য থেকে স্নিগ্ধতার প্রতি তাদের অধিকার কম কীসে? কিম্বা রাজারা যারা সৈনিকদের এনেছে যুদ্ধে তারা সৈনিক বাদ দিয়ে নিজেরা লড়ুক গে! মরুক গে যদি অতই বাঞ্ছিত হয় সম্পদ, স্বর্গ ইত্যাদি।

কিন্তু অমনটা হয়নি মহাকাব্যে। কারণ সৈনিকেরাও সম্পদের ভাগীদার হবে, যতই সামান্যাংশ হোক না কেন, কিছু তো পাবে। বেতন হলেও পাবে। বলা হয়নি বা করা হয় না তার কারণ হল যুদ্ধ নিজেই একটা বিপুল অর্থনীতি। অনেক অনেক সম্পদের খেলা সেখানে। অস্ত্র থেকে হাতি, ঘোড়া, মানুষ, খাবার-দাবার কত্ত কিছু উপলক্ষে সম্পদের হাত বিনিময় হবে। তার নীচের দিকের ছিটিয়ে দেওয়া স্বল্পাংশ পাবে সৈন্যরা, মোটা মোটা অংশ পাবে রাজা-রাজরা আর তাদের নিকটজনেরা। ব্রাহ্মণাদিও পাবে বেশ ভাল সম্পদ। তবে আর মন্দ কী যুদ্ধ! এমন রোজগারের সুযোগ আর কোথায়! ব্যবসা-বাণিজ্য সবাই করে না। কৃষিতে পেটের খাবার জোগাড়, বেচলেও কৃষক আধপেটাই থাকবে। কারিগরের মাথায় মহাজন থাকলে তারই বা সম্পদ হবে কোথা থেকে! শূদ্র-চণ্ডাল তো পায়ের নীচের। দাস মাত্র। অস্পৃশ্য মাত্র। তার আবার সম্পদ! শুনলে ঘুড়ায় হাসবো কত্তা।

যেদিন সকালে উঠে শুনলাম ভারতীয় বাহিনী হানা দিয়েছে পাকিস্তানে সেদিনই একটা নাটক দেখছিলাম যা 'প্রথম পার্থ' আধারিত। দেখতে দেখতে এসব কথা মনে আসছিলো। এই যে যুদ্ধ যুদ্ধ হাওয়া, এতে আমরা কী কী ভুলে যাব? আমরা ভুলে যাব আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নিয়ে শান্তি এসে গেছে ভূস্বর্গে যারা বলেছিল, তারা মিথ্যে বলেছিল। ভুলে যাব স ন্ত্রা সী হানার গোয়েন্দা তথ্য সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেমন পুলওয়ামার বি স্ফো র ক বোঝাই ট্রাকটা নাকি বেশ কিছুদিন ঘুরেছিল উপত্যকায়, অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সেনানিবেশিত অঞ্চলে কেউ কিচ্ছু জানলো না।

কিন্তু এগুলোও ভুলে থাকার আসল চেহারা নয়! আসল চেহারা অন্য। ২০১৮-১৯ সালের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী দেশের কৃষকদের গড় আয় মাসে ১০,২১৮ টাকা বা তার চেয়েও কম। মানে দৈনিক ৩৪০ টাকার মতো। অন্যদিকে ২০২১ সালে শিল্পপতি গৌতম আদানির দৈনিক আয় ছিল ১৬১২ কোটি টাকা, অর্থাৎ মাসে ৪৮,৩৬০ কোটি টাকা। একদিকে ৩৪০ টাকা মাত্র আর অন্যদিকে ১৬১২,০০,০০,০০০ কোটি। অর্থাৎ একজন কৃষকের ৪৭,৪১১,৭৬৫ গুণ বেশী আয় করেন উনি। এবং দেশে কয়েকটি গোষ্ঠীই এভাবে বিপুল সম্পদ বা দেশের প্রায় সব সম্পদ হাতের মুঠোয় নিচ্ছে আর আমরা মরছি।

এবারে এটাকে ভোলাতে হলে কিছু কায়দা লাগে। যে রাষ্ট্রে সারাক্ষণ ঘৃণার চাষ চলছে, সেখানে হামলার পরে প্রধানদের মুখে শুনলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও দাঙ্গার জন্য এমন করেছে সন্ত্রাসীরা। সন্দেহ নেই। তা সত্যি। কিন্তু দিনে দিনে যে গো মাংস থেকে নানা অজুহাতে মুসলমান মারছে, অত্যাচার করছে ভক্তেরা তার বিরুদ্ধে এদ্দিন ব্যবস্থা নেননি কেন? প্রশ্নটা কিন্তু উঠলোই না। এখনও গুজরাটে কেন বাংলাভাষীদের বাংলাদেশী বলে হেনস্থা করা হচ্ছে? আটক করা হচ্ছে? জবাব নেই। এর নাম সাম্প্রদায়িক এবং জাতীয় সম্প্রীতি?

পরের কায়দা হল প্রেস কনফারেন্সে দুজন দুই ধর্মের নারীকে বসানো। এমনকী প্রগতিশীলেরাও বাহবা দিলেন। স্রেফ গুগল করার ফলাফল তুলে দিচ্ছি নারীধর্ষণ নিয়ে। নারীর বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধের কথা বাদই রাখছি।

ভারতে নারীধর্ষণ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) সংগ্রহ করে এবং প্রকাশ করে। এই ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। ২০২২ সালে, ভারতে ৩১ হাজার ৫১৬টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা নির্দেশ করে।
ভারতে নারীধর্ষণ সংক্রান্ত আরও বিস্তারিত তথ্য নিচে দেওয়া হলো:

নারীধর্ষণের হার:

এনসিআরবি (২০২২)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি লক্ষ মহিলা জনসংখ্যার জন্য ৪.৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

রাজ্য ভেদে পার্থক্য:

বিভিন্ন রাজ্যে নারীধর্ষণের হার ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে এই হার ২.৩, যেখানে রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই হার অনেক বেশি।

নারী নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র:

ভারতে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশব্যাপী নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৭.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে নারী নির্যাতন:

এনসিআরবি-র তথ্য অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির শিকারের সংখ্যা ২০১৮ সালে ৪০২ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৪২২ হয়েছে।

নারী নির্যাতনের কারণ:

বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারতে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দারিদ্র, শিক্ষার অভাব, সামাজিক কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, যৌতুক এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অন্যতম কারণ।

গুগলকে নারীধর্ষণের পরিসংখ্যান চাইলে এই উত্তর দিচ্ছে। এইখান থেকেই আরো ক'টা কথা মনে আসছে। এই যে দুই নারীর নেতৃত্বে প্রেস কনফারেন্স, তা কি এগুলোকে মুছে দিয়ে নতুন ভারত গঠন করে হোলো? না তো! বরং দেখলাম সামরিক অপারেশনের নাম হোলো সিঁদুর, যা পিতৃতন্ত্র আর ব্রাহ্মণ্যবাদের চিহ্ন সরাসরি। শুধু তাই-ই নয়, একেবারেই সরাসরি দেশের অন্যান্য ধর্মাদির মানুষদের বাদ দিয়ে, তথাকথিত হিন্দুত্বে র চিহ্ন।

সবটা দেখে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কথা মনে পড়ে গেলো। এবং চারপাশের প্রবল উল্লাসের মধ্যে মনে হোলো যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের কী স্বল্প ধারণা! অনেকে দেখলাম হুমকী দিচ্ছেন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না এখন। আরে সরকার এমনিই কথা বলে না কারো সঙ্গে। বিরোধী মত মানেই দেশদ্রোহী, অথবা পাকপ্রেমী। দেশপ্রেমের ঠ্যাকা যাঁরা একলা নিয়ে রেখেছেন তাঁদের বলি, দেশ আমারও। রাষ্ট্রকে কর দিই, যে সরকার এই দেশ চালাচ্ছে তাঁদের সমালোচনা করার, ভালোমন্দ বলার অধিকার আমারও। সবচেয়ে বড় কথা হোলো, যুদ্ধে যারা উচ্ছিন্ন হবেন, মরবেন, পঙ্গু হবেন আরো নানা কিছু হবেন তাঁরাও আমার দেশের মানুষ। আপনার যুদ্ধবিলাসের আহ্লাদে তাই আমাকে আপনার বিরোধিতা করতে হবে।

এবার আপনি আমাকে ত্যাগ করতে পারেন। বিরোধ করতে পারেন এর। কিন্তু যতক্ষণ বেঁচে আছি বলে যাবো, সমস্যার সমাধান মিলিটারির বুটের তলায় নেই, যুদ্ধে নেই, কাশ্মীরি সকলকে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে (কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা মাথায় রেখেই) ভালবেসে তাঁদের কথা জানার এবং তাঁদের চূড়ান্ত মতামত জানার মধ্যে আছে। নইলে যুদ্ধবিমান কেনায় যারা টাকা পায় তারা টাকা পেয়েই যাবে, আমরা আঙুল চুষবো।

 

0 Comments

Post Comment