পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ক্যালা

  • 01 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 411 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
জালাল তার গেরস্থ এনামুল বিশ্বাসের কাছে এভাবে জলিল হবে, জীবনে কোনওদিন ভাবেনি। সেই কোন ছোটবয়সে এনামুল বিশ্বাসের ‘বিশ্বাসমঞ্জিল’-এ রাখাল হয়ে ঢুকেছিল। তারপর মাহিন্দার থেকে এখন এনামুল বিশ্বাসের গেরস্থালির খাস লোক হয়েছে। সবাই জানে সে বিশ্বাস-মঞ্জিলের সবচেয়ে বিশ্বাসী লোক, তাও এই অপমান!

হয়েছে কী, এনামুল বিশ্বাস আজ তাকে বাজার পাঠিয়েছিল সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। তার মধ্যে ঘাস-মারা বিষ কেনার ব্যাপারটাও ছিল। শ্যালোমেসিন চালিয়ে মাঠে জমিতে জমিতে পাটের চাষ। কিন্তু ঘাসের খুব উপদ্রব। সেই ঘাস মুক্ত করতেই ঘাস-মারা বিষের কথা বলছিল। আজকাল জমির ফসলকে আগাছা মুক্ত করতে নিড়ানি লাগে না, বাজার থেকে কিনে আনা বিষ ছিটিয়ে দিলেই হয়। সকালে ছিটালে বিকালের মধ্যেই সব ঘাস ফিনিস। ফসলের কোনও ক্ষতি হয় না। অথচ সেটাই কিনে আনতে ভুলে গেছে সে। আর এতেই এনামুল বিশ্বাস তার ওপর বেজায় খাপ্পা। এমনই খাপ্পা যে রীতিমতো গালাগাল দিয়ে বলেছে, ‘শালা লেখাপঢ়হা না হয় শিখিসনি, সেবুল্যা কানেও তুই শুনিস ন্যা নাকি? আনতে বুলনু ক’টা জিনিস, তার মধ্যে একটা জিনিস আনতে ভুলে গেলি! শালা তুই ক্যালাচোদা না বোকাচোদা বে?’

এনামুল বিশ্বাসের এমন গালাগাল খেয়ে সে আর গেরস্থ-বাড়িতে দাঁড়ায়নি, শরীর খারাপের বাহানা করে সটান নিজের বাড়ি চলে এসেছে। প্রতিজ্ঞা করেছে যে সে আর এনামুল বিশ্বাসের গেরস্থালিতে কাজ করবে না। অন্য কোথাও অন্যকিছু করবে তাও ভাল। দরকার  পড়লে ভিনদ্যাশে রাজমিস্ত্রীর কামে যাবে। যেমন আর সবাই যায়, কিন্তু এনামুল বিশ্বাসের গেরস্থালিতে অপমান হতে আর কখনই নয়।

সেই সঙ্গে জালাল এটাও ভেবেছে যে তার একমাত্র ছেলে বেলালকে সে রাখাল হতে দেবে না। আজ সে যেমন অপমানিত হল হল তার ছেলে বেলাল যেন কারও কাছে সেরকম অপমানিত না হয়। এ-জন্য বেলালকে সে লেখাপড়া শেখাবে। মানুষের মতো মানুষ বানাবে। এনামুল বিশ্বাসের মতো কেউ যাতে তার বেলালকে ক্যালাচোদা-বোকাচোদা বলতে না পারে!

 

দুই

অসময়ে স্বামীকে বাড়ি ফিরতে দেখে বিবি লালবানু রীতিমতো অবাক হয়। হাতের কাজ ফেলে স্বামীর কাছে এসে জিগ্যেস করে, কী হইল? আইজ এই দুপ্পহরেই যে তুমি বাড়ি চইল্যা এল্যা!

শরীল খারাপ। জালাল বলল।

স্বামীর চেহারা দেখে লালবানুর তেমন কিছু মনে হয় না। দিব্যি তো খাসা লাগছে! তাহলে? এমন কৌতুহল থেকে সে আবার জিগ্যেস করল,  শরীল না মুন?

শরীল খারাপ কইরলে মুনও খারাপ হয়। বেশি বকিস ন্যা তো! জলদি এক গেলাস পানি দে।

লালবানু দুপুরের রান্নার তোড়জোড় করছিল। সেসব মাথায় উঠল তার। তাড়াতাড়ি কলসি গড়িয়ে গেলাসে করে পানি এনে দিল স্বামীর হাতে।

জালাল সেই পানি চোঁ চোঁ করে এক নিঃশ্বাসে পী মেরে খেল বটে, কিন্তু গেরস্থ এনামুল বিশ্বাসের কাছে নিজের অপমানটা গিলতে পারল না। ক্যাপসুল গিলতে গিয়ে মুখের কোথাঅ আটকে সেটা ফেটে গেলে মুখে যে বিস্বাদে ভরে ওঠে, জালালের মনের অবস্থাটাও আরও বিস্বাদে ভরে গেল। তা থেকে বাঁচতে তাই বুঝি সে বলে উঠল, বুঝলি লালি- বেটাটোকে হামি হামার মুতুন রাখাল-মাহিন্দার হইতে দিবো না। পঢ়হাবো। শিক্ষতি করবো।     

বিবি লালবানু আবার রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ওই অবস্থায় সে বলল, জেগে স্বপ্ন দেখছ তা ভালো। তা বেটাকে কুণ্ঠে পঢ়হাবা- ঠিক কইর‍্যাছো কিছু?

জালাল  বলল, ক্যানে- হাঁরঘের গাঁয়ের প্রাইমারি ইস্কুলে।

লালবানু বলল, গাঁয়ের প্রাইমারি ইস্কুল! ওখ্যানে অ্যাখুন কেহু পঢ়ে নাকি? 

তবে কুণ্ঠে পঢ়ে?

ক্যানে দেখতে পাও না, তুমার গেরস্থবাড়ির বালবাচ্চারাই তো টাউনের ইস্কুলে ইনজিরি শিখিতে যায়। বড় হুই জী সব লাটসাহেব হইবে।

জালালের মনে পড়ে, তার গেরস্থ এনামুল বিশ্বাসের বাড়ির বালবাচ্চারা, শুট-বুট পরে টাউন থেকে আসা স্কুলবাসে চড়ে পড়তে যায়। রোজই দেখে অথচ তা নিয়ে ভাবেনি কোনওদিন। বিবির কথায় এখন ভাবনা হল। কিন্তু টাউনের স্কুলে ছেলেকে পড়ানো মানে তো খরচা অনেক! কোথায় পাবে অত টাকা? গেরস্থের বাড়িতে কাজ করে যা পায়, কোনও মতে সংসার চলে। তাও ভাগ্য ভাল যে বাড়িতে কারও রোগ ভোগ নেই।

জালাল কে হঠাৎ চুপ করে যেতে দেখে লালবানু জিগ্যেস করল, কী হইল? চুপ কইর‍্যা গেল্যা যে!

জালাল  বলল, ভাবছি।

কী ভাবছো?

টাউনের ইস্কুলে বেটাকে পঢ়হাবো কী কইর‍্যা?

লালবানু উনুন থেকে তারকারির হাড়ি নামিয়ে বলল, অত ভাবতে হবে না। যাও হাত-মুখ ধুই এসো। চারটি মুড়ি মাখিয়ে দিছি, খেয়ে ল্যাও। তারপর ভাত হইলে ভাত খাবা।

বিবির কথা কানে যায় না জলিলের। তার চোখ ছেলে বেলালকে খুঁজছে তখন। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। অগত্যা বিবিকে জিগ্যেস করল, ছুঁড়াকে দেখছি না যে! কুণ্ঠে গেল?

কে জানে? বাহিরে কুণ্ঠে খেলে বেড়াইছে বোধায়!

একথা শুনে আরেক দুঃশ্চিন্তা ঘিরে ধরে জালালকে। বাহিরে খেলে বেড়াইছে! কী খেলে বেড়াইছে? এমন রোজই কি খেলে বেড়ায়? তাহলে তো বেটা আর বেটা থাকবে না, টুপিওয়ালার বেটা রেজ্জাকের মতো বাওডাণ্ডা হয়ে যাবে।

শুধু দুঃশ্চিন্তা হয় না, রীতিমতো জালালের মনে ভয় ধরে। টুপিওয়ালার বেটা রেজ্জাক কত কাণ্ডই না করে বেড়িয়েছে! চোখের সামনে দেখেছে সব। ভয়ে কখনও প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।

এমনিতেই আজকালকার ছেলেরা কেউ ভাল ছেলে নয়। তিনমাস ছ’মাস বাইরে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে যায়। ফিরে আসে জিন্সের প্যান্ট, রঙচঙে গেঞ্জি পরে। তার ওপর চোখে থাকে গগলস, হাতে থাকে বড় বড় মোবাইল।  দেখে সার্কাসের জোকার লাগে। অথচ ওদের না আছে লেহাজ, না আছে তমিজ। রাস্তাঘাটে সবার সামনেই বিড়ি ফুঁকে। আর মুখের ভাষা তো কানে তোলা যায় না। বেটা বেলাল ওদের খপ্পরে পড়ল না তো? 

জালাল  বিবি লালবানুকে কিছু বলে না, বাড়ি ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়ে ছেলে বেলালের খোঁজে। কিন্তু এই ভরদুপুরে বেলাল কোথায় থাকতে পারে অনুমান করতে পারে না। তাছাড়া তার অনুমান করার কথাও নয়, এই সময় সে ব্যস্ত থাকে গেরস্থের কাজকামে। মাঠঘাট, আগানবাগান ছাড়াও গেরস্থের ঘরগেরস্থালি দেখভাল করাই তো তার কাজ। অবশ্য এসব বাদেও আর একটা কাজ থাকে। তা হল, সুযোগ পেলেই গেরস্থ এনামুল বিশ্বাসের ছোটছেলে ওহাবের ঘরে বসে ক্ষাণিক ক্ষণ টিভি দেখা। যদিও আজ সেসব কিছুই করেনি সে। করবে কী করে, বাজার থেকে ফিরতে না ফিরতে গেরস্থের গালমন্দ! অগত্যা শরীর খারাপের বাহানা দেখিয়ে অভিমান করে সটান নিজের বাড়ি চলে আসা।

 

তিন

এবছরটা কেমন যেন! চৈত্র পড়তে না পড়তে যেন গ্রীষ্মকাল। সাংঘাতিক দাবদাহ। তার মধ্যেই এই ভরদুপুরে বেটা বেলালের খোঁজে জালাল গ্রামের ডহর ডহর ঘুরছে। যদিও গ্রামের রাস্তা এখন আর শুধুমাত্র ডহর হয়ে নেই। পঞ্চায়েতের কল্যাণে সব কংক্রিট ঢালাই পথ হয়েছে। কোথাও হোচট খেয়ে পড়ার ভয় নেই। তবে মাটি ফাটা গনগনে রোদে কংক্রিট ঢালাইয়ের রাস্তা বেশ উত্তপ্ত। হাঁটতে পা পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু গ্রাহ্যে আনছে না। বেলাল কোথায় আছে, কী করছে- সেই ভাবনায় সে অস্থির হয়ে উঠেছে।  

অন্যদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত করে যখন গেরস্থের বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে, এতসব অনুভব হয় না। সারাদিনের পরিশ্রমের ধকল থাকে শরীরে। আজকেও শরীরে ধকল আছে। তবে তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল আজ তার অন্তরে ‘অপমান’ নামে দগদগে একটা ঘা আছে। যার তীব্র যন্ত্রণা আছে। সেই যন্ত্রণার উপশম হিসেবে সে বেটা বেলালের খোঁজে পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে।

চরম উত্তপ্ত আবহাওয়ার কারণেই বোধহয় রাস্তা একেবারে শুনশান। সূর্যের প্রখর তাপ আর গরম হাওয়ার হলকা প্রচণ্ড আক্রোশে সবকিছুকে ঝলসে দিচ্ছে। কারও বাড়ি থেকেই কোনও আওয়াজ ভেসে আসছে না। কোথাও কোনও পাখির ডাক নেই। আন্টাকান্টায় একটাও মুরগি চরছে না পর্যন্ত।

তাহলে বেলাল কোথায় কী করছে? কার সঙ্গে খেলছে?

দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে জালালের। সেই সঙ্গে ভয় হচ্ছে। তার অবর্তমানে যদি ছোঁড়া রোজই এরকম বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়ায় তাহলেই হয়েছে! এটা যদি সত্যি হয় তাহলে টুপিওয়ালার বেটা রেজ্জাকের মতো হয়ে উঠবে তার বেটা। যা খুশি তাই করে বেড়াবে। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারবে না।

পেছন থেকে হঠাৎ জালাল কার ডাক শুনতে পায়, কী বে বালের বেটা কুণ্ঠে যেছিস?

জালাল চমকে ওঠে। ফিরে তাকায়। না, তাকে নয়। হজরতের বেটা সাইদুর নিজের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির কালুর বেটা মুসলেমকে কোথায় যেতে দেখে জিগ্যেস করছে।

হায়রে মানুষের মুখের ভাষা! তাকে লক্ষ্য না করে হলেও শুনে খুব লজ্জ্বা পায় জালাল। তাই সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সামনে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু সামনে তো আর কংক্রিট ঢালাইয়ের পথ নেই। যা আছে তা মেঠো রাস্তা। নাকি বনবীথি! পণ্ডিতসাহেবের আমবাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা মানুষের পায়ে পায়ে চলার রাস্তা। তাহলে ওই রাস্তায় সে যাচ্ছে কেন? জালালের মনে প্রশ্ন জাগে। অবশ্য বাগানের ওপারেই তাদের গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলটা।

বিবি লালবানু বলছিল, ওই ইস্কুলে নাকি এখন কেউ পড়ে না! সত্যি কি মিথ্যা, দেখে আসবে নাকি একবার? জালালের কৌতুহল হয়। পণ্ডিতসাহেবের বাগানের ভেতর দিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে ইস্কুলের দিকে।

পণ্ডিতসাহেবের আমবাগানটা বিশাল বড়। এই অঞ্চলে এককালে এই বাগানের খুব নাম ছিল। যখন পণ্ডিতসাহেব বেঁচে ছিলেন। আমের সময় টাউন থেকে কত বড় বড় মানুষ আসত এই বাগানে। ঝাঁকড়া আমগাছতলায় মাচানে বসিয়ে পণ্ডিতসাহেব তাঁদের নিজের হাতে আম কেটে খাওয়াতেন।

ফলের রাজা আম, এটা জানার আগে থেকেই আম ছিল জালালের পছন্দের ফল। তার গেরস্থ এনামুল বিশ্বাসের আমের বাগান নেই। অগত্যা সে তার পছন্দের আম কিনে খায়। এ তো গেল পাকা আমের কথা। অন্য বছর এই চৈত্রমাস থেকেই তার কাঁচা আম খাওয়া শুরু হয়ে যায়। কখনও মসুর ডালে, কখনও কাঠমাছের ঝোলে, কখনও আবার এমনি চাটনি করে কিংবা পুড়িয়ে সরবত করে। যখন মউল থেকে গুটি ধরে, সামান্য বাতাসে বোঁটা থেকে সেই গুটি ঝরে পড়ে কিংবা ঝড়ে, সেই তখন থেকে। কিন্তু এবছর আম নেই। মাঘ মাসে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর কুয়াশার কারণে কোনও গাছেই মউল আসেনি। এই তো সে এলাকার সবচেয়ে বড় বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছে এখন। তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমের গাছ। কিন্তু কোনও গাছেই একটাও আম নেই। বাতাসে আমের গন্ধ নেই পর্যন্ত। তাই বুঝি কোনও পাখপাখালিও নেই কোথাও।

জালালের মনে পড়ে, পণ্ডিতসাহেব সেই আমলে রকমারি আমের চাষ শুরু করেছিলেন। তার আগেও তাঁর আম বাগান ছিল। কিন্তু তা ছিল গুটি আমের বাগান। ছোটবেলায় দেখা পণ্ডিতসাহেবের সেই আমবাগানে সেরকম কিছু গুটি আমের গাছ দেখেছিল জালাল। যেমন একটা গাছের আমের ছিল গণ্ডারের মতো মোটা চোকা, তাই ওই গাছের নাম ছিল ‘চোকামোটা’। একটা গাছের নাম ছিল ‘জিলাপি’। জিলাপির মতো কড়া মিষ্টির স্বাদের আম, তাই ওই নাম। একটার নাম ছিল ‘দোআঁসলা’। দেখতে ল্যাংড়ার মতো। অথচ এত টক যে মুখে দেওয়া যেত না। পণ্ডিতসাহেব রকমারি আমের চাষ শুরু করলেও ইচ্ছে করে এরকম কিছু গুটি আমের গাছ রেখে দিয়েছিলেন এই বাগানে। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘ভালোর সঙ্গে মন্দ না থাকলে ভালোটা লোকে বুঝবে কী করে?’ শুধু তাই নয়, তাঁর বাগানে যাঁরা অতিথি আসতেন, পণ্ডিতসাহেব তাঁদের খাওয়ানো শুরু করতেন ওই সব গুটি আম দিয়ে। বাগানের সবচেয়ে ঝাঁকড়া গাছটার তলায় থাকত কুঁড়েঘর। যার বাইরে মাচা। অতিথিদের নিয়ে তিনি বসতেন বাইরের সেই মাচায়। চামচ-প্লেটের ব্যবহার থাকত না। শুধু তাঁর হাতে থাকত একটা ধারাল ছুরি। সঙ্গে ঝাবরাচাচা কিংবা নেষেরচাচা। তাঁদের হাতে থাকত আম পাড়ার আঁকশি। পণ্ডিতসাহেব হুকুম করতেন,  ‘যা তো নেষের একটা ’বিড়া আম পেড়ে লিয়ে আয়।’ আমের মধ্যে ওই আমটাই সবার আগে পাকে। সময়টা এরকম বৈশাখের মাঝামাঝি। পণ্ডিতসাহেবের বাড়ির রাখাল রব্বানভাই থাকত তাঁর ন্যাওটা হয়ে। নেষেরচাচা আম পেড়ে নিয়ে এলে রব্বানভাই বালতি ভর্তি জলে সেই আম ধুয়ে ধরিয়ে দিত তাঁর হাতে। আর তিনি তাঁর হাতে ধরা ছুরিটা দিয়ে বোঁটা থেকে শুরু করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী অদ্ভুত কৌশলে পুরো আমটাকে নিকিয়ে ফেলতেন। অতিথিরা তো বটেই সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে যারা বারবার দেখত সেই দৃশ্য তারাও অবাক না হয়ে পারত না। পণ্ডিতসাহেব ওভাবেই ল্যাংড়া, হিমসাগর, রাণী, ভবানী, সাদুল্লা, মোহনভোগ, গোপালভোগ, কাঞ্চনকষা, কোহিতুর, সবশেষে কেটে খাওয়াতেন তাঁর বাগানের সেরা চম্পা আম। অতিথিরা যখন বিদায় নিতেন, পণ্ডিতসাহেব তাঁদের হাতে একটা করে ছোট আম ভর্তি ঝুড়ি ধরিয়ে দিতেন। তাঁর নিজের বাঁশঝাড়ের বাঁশ কেটে ঝুড়ি তৈরি করতেন তাঁর বাড়ির সবসময়ের ঘরামি জয়নাল চাচা। ঝাবরা আর নেষের চাচা ভ্যাটপিটুলির পাতা সাজিয়ে আম ভর্তি করতেন সেই ঝুড়িতে।

বহুদিন এভাবে ছেলেবেলার কথা মনে পড়েনি জালালের। তবে হঠাৎ আজ মনে পড়ছে কেন?

জালাল একটু অবাক হয়। আর তার মনে পড়ে পণ্ডিতসাহেবের ঝাঁকড়া আমগাছতলার সেই মাচান আর কুঁড়েঘরটিকে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের কথা ভুলে যায় সে। পণ্ডিতসাহেব নেই। কিন্তু অযত্ন অবহেলায় তাঁর বাগানটা আজও আছে। পণ্ডিতসাহেবের পরিবার এখন শহরে বাস করে।

অনেকদিন এই বাগানে না ঢুকলেও ঝাঁকড়া আমগাছটি কোথায় আছে, স্মৃতি হাতড়ে সেই জায়গা খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না নিশ্চয়। এমন ভাবনা থেকে জালাল এগিয়ে চলে সেই কুঁড়েঘরের উদ্দেশে।

 

চার

ঝাঁকড়া আমগাছটি আরও ঝাঁকড়া হয়েছে। চারপাশে ঘন জঙ্গল। যদিও ভেতরে ঢোকার একটা রাস্তা আছে। জালাল সেই রাস্তায় ঢুকতেই শুনতে পেল কারা যেন কথা বলছে। কিন্তু এই বিরান বাগানে কারা কথা বলছে? জালাল থমকে দাঁড়ায়। আর স্পষ্ট শুনতে পায় একজন বলছে, ক ল-এ আকার! ক ল-এ আকার! ক ল-এ আকার!

আর একজন বলছে, একই জিনিস বারবার পঢ়ছিস। তারপর কী আছে সেইট্যা পঢ়বি তো!

প্রথম জন বলছে, তারপর কী পড়ব সেইট্যাই তো পঢ়তে পারছি ন্যা। তাই তো আইজ ইস্কুলে যাইনি।

জালালের কৌতুহল বাড়ে। খুব সাবধানে আর একটু এগিয়ে যায়। আর দেখতে পায় তার ছেলে বেলাল আর তাদের গ্রামের ফুতকি পাড়ার মর্জেমের বেটা উজিরকে। ওরা পণ্ডিতসাহেবের বাগানের ঝাঁকড়া আমগাছের নীচে ভাঙা মাচানে একটা বই নিয়ে বসে আছে। শুধু বসে নেই, কথা বলছে। এই তো তার ছেলে বেলাল বলছে, ইস্কুল যাইসনি মাস্টারের মারের ভয়ে? কই দেখি! বলে উজিরের বইটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে বেলাল জিগ্যেস করল, কুনটা?

উজির যেটা পড়ছিল সেটা দেখাল। কিন্তু বেলালও তো নিরক্ষর! কী বলবে সে?

তবু বেলালকে বলতে শুনল জালাল। বেলাল বলল, ক ল-এ আকারের পর ক্যালা পঢ়তে হবে। দেখতে পেছিস না, পাশেই তো একটা ক্যালার ছবি আঁকা আছে।

আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব শুনলেও জালাল কিন্তু দেখতে পাচ্ছে, কোথাও আম না থাকলেও পণ্ডিতসাহেবের ঝাঁকড়া আমগাছটির শাখাপ্রশাখায় অসংখ্য গুটি আম হালকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।  

পরি'চয়’, শারদ সংখ্যা ২০১৮  তে প্রকাশিত

 

0 Comments

Post Comment