১৪-ই ফেব্রুয়ারি দিল্লির পথে পঞ্জাব-হরিয়ানার শম্ভু সীমান্তের আকাশে দেখা গেল ঘুড়ির ঝাঁক। কড়া চিনা মাঞ্জার ইস্পাতের তারের মত ধারালো সুতোর টানে উড়ছে ঘুড়ি। ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন শম্ভু সীমান্তে অবরোধকারী অসংখ্য কৃষক জনতা, হরিয়ানা পুলিশ বাহিনীর উড়িয়ে দেওয়া ড্রোণগুলোর আক্রমনের জবাবে। এমনিতে ড্রোণের কাজ, ওপর থেকে নজরদারি চালানো। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন এই ড্রোণকে তিনি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে চান। এইরকম ভাবে ব্যবহিত হবে, তা অনেকেই হয়তো বুঝতে পারেননি সেদিন। একদিন আগেই ওই ড্রোণগুলো পেট ভর্তি টিয়ার গ্যাস শেল নিয়ে তা উগড়ে দিচ্ছিল অবরোধকারী কৃষক জনতার ওপর। কিন্তু কৃষকদের ঘুড়ির সুতোর টানে আজ সেগুলো নিষ্ক্রিয় ।
'চলো দিল্লি '- ডাক দিয়েছেন সম্মিলিত কৃষক মোর্চা। দিল্লি যাওয়ার সব সড়ক পথে নজির বিহীন অবরোধ গড়ে তুলে দেশের রাজধানীকেই অবরুদ্ধ করে তুলেছেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। সমবেত কৃষক জনতার দাবি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারকে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের ঘোষনা করতে হবে আর আড়াই বছর আগে সংগ্রামী কৃষকদের ওপর লাগু হওয়া মামলাগুলো নিঃশর্তে প্রত্যাহার করতে হবে। এবারের লড়াইটা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী সরকারকে সবক শেখানোর লড়াই। পঞ্জাব হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের একাংশের প্রায় দু'শো কৃষক সংগঠনের দু'লক্ষ সদস্য জমায়েত হয়েছেন শম্ভু সীমান্তে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে সরকারের চাপানো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষেরা, ঢল নামছে মানুষের।
জাঠ নেতা শ্রী রাকেশ টিকায়েত সম্প্রতি কর্ণাটকে ঘোষনা করেছেন যে এবার দাবিদাওয়া আদায় করতে অন্যান্য কৃষক সংগঠনের আরও দু' লক্ষ কৃষক দিল্লি অবরোধে অংশ নেবেন। সেক্ষেত্রে দিল্লি যাওয়ার সড়ক পথের অন্যান্য সীমান্ত যেমন সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিয়াবাদ ইত্যাদি, অবরুদ্ধ হবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই কিষান জাগরণকে মোকাবিলা করতে দ্বিমুখী কৌশল নিচ্ছেন। একদিকে দিল্লিকে দূর্গে পরিণত করে অবরোধকারী কৃষকদের ওপর বেলাগাম সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছেন। অন্যদিকে চরণসিং ও স্বামীনাথনকে ভারতরত্নে ভূষিত করে নিজেদের 'কৃষক দরদী' হিসেবে দেখাতে চাইছেন। এদিকে কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন সুপারিশ ছিল ওই স্বামীনাথন কমিশনের সেটা আজকের সরকার কিন্তু ভুলিয়ে দিতে চাইছে।
শম্ভু সীমান্তে পুলিশ/আধা সামরিক বাহিনীর সন্ত্রাসে গতকাল পর্যন্ত আহত হয়েছেন প্রায় একশো আন্দোলনকারী। ২০২০-২১ এর দিল্লি অভিযানে কৃষক জনতার নাছোড় লড়াইয়ের মুখে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ৭০০ অবরোধে অংশগ্রহণকারী কৃষক, কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয়েছিলেন জনবিরোধী তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহার করতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্বেও কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি আজও অধরা। উত্তরোত্তর কৃষি উৎপাদন সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে এই দাবি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক কারণ ৬৬ শতাংশ মানুষ এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল আর সেখানে মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। পঞ্জাব-হরিয়ানা তথা গোটা দেশের কৃষকদের ক্ষোভ সঙ্গত কারনেই। গতবারের লড়াই থেকে দেশের মানুষ এটা অন্তত বুঝেছেন যে কৃষকদের লড়াইটা ছিল সরকারের স্যাঙাৎ কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর লড়াই। একদিকে সরকার কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিতে প্রস্তুত নন অন্যদিকে কর্পোরেট স্যাঙাৎদের ১৬ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণে ছাড় দিতে প্রস্তুত।
ওই দেশ কাঁপানো আন্দোলনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া এই প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয় নয়। এর আগে বহু প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গত তিন দিনের ঘটনা প্রবাহ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কৃষকরা রাষ্ট্রের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে যেতে দ্বিধা করছেন না। লাঠি, জলকামান, রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস শেলের সন্ত্রাস অতিক্রম করে তাঁরা একে একে ভেঙে ফেলছেন শম্ভু সীমান্তের কংক্রিটের ও তারকাঁটার ব্যারিকেড। হরিয়ানা পুলিশের ড্রোণগুলো তাঁরা নিষ্ক্রিয় করলেন অভাবনীয় উপায়ে, ড্রোণের মুখে ঘুড়ির ব্যারিকেড গড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লণ্ডনের নাগরিকরা জার্মান বোমারু বিমানের লাগাতার হামলার বিরুদ্ধে আকাশে উড়িয়ে দিতেন শয়ে শয়ে বেলুন। ওই বেলুনের শক্ত সুতো বোমারু বিমানের প্রপেলারে জড়িয়ে গিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করতো। এর কোন উত্তর জার্মান যুদ্ধবাজদের জানা ছিলনা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সৃজনশীল জনতা বাঁচার অস্ত্র তৈরি করেন।
১৫ই ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা পঞ্জাবের অবরোধকারীরা নামিয়ে দিলেন ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে। শম্ভু সীমান্তে ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার কাজে। ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে লাঠি হাতে ঘোড়সওয়াররা পুলিশ বাহিনীকে তাড়িয়ে এলাকা মুক্ত করছেন পঞ্জাবের কৃষকরা। আমরা মাউন্টেড পুলিশের কথা জানি, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে যাদের কাজে লাগায় সরকার। শম্ভু সীমান্ত আজ এক নতুন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। বেশিরভাগ মিডিয়া কৃষকদের এই বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে বিন্দু মাত্র পাত্তা দিতে রাজি নন।
আর এক দফা আলোচনার ডাক দেওয়া হয়েছে সরকার পক্ষ থেকে। কৃষক নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন উল্লিখিত দু'টো দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে। কৃষকদের এই অনড় মনোভাবের ফলে রামমন্দির উত্তর পর্বে দেশকে সাম্প্রদায়িক লাইনে আর এক দফা বিভাজিত করার রাজনীতি জোর ধাক্কা খাবে সন্দেহ নেই। কারণ পেট ভরাতে রাম নয়, ভাত চাই। সময়টা এখন একতরফা মার খাওয়া নয়, পাল্টা মারের।