আমরা সবাই জানি চিকিৎসা শুধু একটা পেশা নয় বরং তা আসলে সামাজিক দায়বদ্ধতার অপর নাম। হিপোক্রেটিসের শপথ তাই একজন চিকিৎসকের পেশাগত ব্যবস্থাপত্র নয়, সেই শপথ এক চিকিৎসককে স্মরণ করিয়ে দেয় এক ভালো মানুষ হয়ে উঠতে। আজ এই কর্পোরেট শাসিত চিকিৎসা ব্যবস্থায় মুনাফা যখন সমস্ত আলোচনার ভরকেন্দ্রে তখন নর্মান বেথুন, দ্বারকানাথ কোটনিশের পথ ধরে আজও কিছু চিকিৎসক জেগে থাকেন মানবতার উজ্জ্বল প্রহরী হয়ে। আমাদের মনে পড়ে ছত্তিসগড়ের বিনায়ক সেনের কথা যার নেতৃত্বে কমিউনিটি মেডিসিনের যথার্থ প্রয়োগ সেরাজ্যের শিশুদের স্বাস্থ্যের হাল অনেকটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। আদিবাসী মানুষদের অধিকার রক্ষার সওয়ালের জন্য তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে পোরা হয়। সংখ্যায় সামান্য হলেও এই চিকিৎসকরা আজও আমাদের ভরসা। এইরকমই এক চিকিৎসকের নাম কাফিল খান। সরকারের যাবতীয় দমন-পীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এই মানুষটি তার বিশ্বাসে স্থির।একের পর এক ভুয়ো মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে,জেলে আটকে রাখা হয়েছে,আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছে সরকারি চাকরি তবুও এই মানুষটি তার লড়াই জারি রেখেছেন। আমাদের সৌভাগ্য কাফিল খান এই সংকটকালের ইতিবৃত্ত লিখেছেন ( দি গোরক্ষপুর হসপিটাল ট্র্যাজেডি/ কাফিল খান/ প্যান ম্যাকমিলান ইন্ডিয়া) সহজবোধ্য ভাষায় যা পড়তে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর অনুভূতি হল।
উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলায় জন্ম কাফিল খানের। শিশু চিকিৎসায় কর্নাটকের মনিপাল থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করার পর তিনি গ্যাংটকের সিকিম মনিপাল ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সে তার কলেজ জীবন শুরু করেন।তারপর সরকারি চাকরিতে যোগ দেন নিজের শহরে বাবা রাঘবদাস মেডিক্যাল কলেজে একজন শিক্ষক হিসাবে। কাফিল খানের নামটা এদেশের বহু মানুষের জানা হয়ে গিয়েছিল ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট রাঘব দাস মেডিক্যাল কলেজে লিকুইড অক্সিজেনের ঘাটতি ও তজ্জনিত কারণে আশিজন রোগীর মৃত্যু। এদের মধ্যে ছিল ৬৩ জন শিশু ও ১৮ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। ঐ সংকটকালে কলেজের সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক কাফিলের হার না মানা লড়াই, অক্সিজেন জোগাড়ের জন্য নিরলস চেষ্টা তাকে কিছু সময়ের জন্য মিডিয়ার নায়ক করে তোলে। একই সঙ্গে একাধিক মৃত্যু, পরিজনদের বিক্ষোভ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এক কঙ্কালসার চিকিৎসা ব্যবস্থার যার নিজেরই দ্রুত মেরামতি জরুরি। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ছবিটা পাল্টে থাকে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে এখানে কিছু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, কাজকর্মে অবহেলা ও চক্রান্তের অভিযোগ তোলেন। কাফিল খাকে কর্পোরেট মিডিয়া রাতারাতি খলনায়ক প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
এই কথকতার শুরুতে রয়েছে কাফিলের ছোটবেলার কথা। গোরক্ষপুরে সেই সময়েও এক বহুত্ববাদী ভারত বেঁচে ছিল। রাম-রহিমের উৎসবে মানুষ একসাথে আনন্দ করত। বিরিয়ানি,শেমুই আর মালপোয়া ঘেরা সেই সময়ে কাফিলের বেড়ে ওঠা। হিংসা, ঘৃণা আর ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির এত বিস্তার হয় নি। কাফিলের বাবা ছিলেন রাজ্য সেচ দপ্তরের এক আধিকারিক। কাফিল সেই ছোট বেলার স্মৃতিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা ও তৎপরবর্তীকালে সারা দেশ জুড়ে শিখ নিধন কান্ডের উল্লেখ করেছেন। ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট বিআরডি মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। বই এর এই সূচনাপর্বটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা পরবর্তী সংকটের রূপটিকে বুঝতে সাহায্য করে।
মেডিক্যাল অক্সিজেন এক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। ন্যাশানাল লিস্ট অব এসেনসিয়াল মেডিসিন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি ওষুধের মডেল তালিকায় তার নাম রয়েছে।চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন জানেন যে হাসপাতালে বিদ্যুৎ বা জলের সরবরাহ এক আধবার বিঘ্ন ঘটলেও অক্সিজেনের ঘাটতি মুহূর্তের জন্য সম্ভব নয়। অথচ গোরক্ষপুর মেডিক্যাল কলেজে সেই ঘটনাই ঘটেছিল। বিআরডি মেডিক্যাল কলেজের শিশু চিকিৎসা বিভাগে সবমিলিয়ে ২১৬ টি সজ্জা এবং অক্সিজেন ছাড়া চিকিৎসা সম্ভবই ছিল না। ২০১৭ সালের ১০ আগস্টের সেই ভয়ংকর রাতে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় বলে কাফিল ও তার সহকর্মীরা জানায়, সেই সময়ের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও সেই খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরের দিন থেকে নিজেদের অপদার্থতা ও অযোগ্যতা ঢাকতে শুরু হয় অন্য খেলা,যার প্রথম নমুনা কোনরকম তদন্ত ছাড়াই সরকার ঘোষণা করে যে অক্সিজেনের অভাবে একটি শিশুরও মৃত্যু হয় নি।
অক্সিজেন সংকটের সময় কাফিল খানের ভূমিকার মূল্যায়ণ কিভাবে পরিবর্তিত হল, কিভাবে কাফিল খানকে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত করা হল তার একটা ছবি এখান থেকে পাওয়া যায়।ঘটনার অব্যবহিত পরে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়: "Crises brings out the best in some people. At a time when all hell broke loose in Baba Raghav Das Medical College following alleged disruption of oxygen supply,one man-- Dr Kafil Ahmed-- answered the call of duty... For several hours,Dr Kafil became a one-man army for the junior doctors and hospital staff..."। ছবিটা পাল্টে গেল মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রবেশের পর। কোন অবস্থাতেই সরকার জনগণের কাছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের গাফিলতি স্বীকার করতে রাজি ছিল না। কাফিল খানের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারে তিনি কাফিল খানকে তুই বলে সম্বোধন করেন।চিৎকার করে বলেন : ' তো তু সোচতা হ্যায় সিলিন্ডারস লা কে তু হিরো বন যায়েগা... দেখতা হু তুঝে"। বাকি মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এরপর থেকে সরকারি চিত্রনাট্য মোতাবেক খেলা শুরু হল। কাফিল খান ও আরো আটজনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪০৯, ৩০৮, ১২০খ, ৪২০ সহ নানান ধারায় এফ আই আর দায়ের হল। ২ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের কুখ্যাত স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের দ্বারা কাফিল খানের গ্রেপ্তার, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসকদের পক্ষে বিবৃতি, আট মাস পরে জামিনে মুক্তি, কাফিল খানের ভাইকে অজ্ঞাত পরিচয় আততায়ীর গুলিতেও সবটা শেষ হল না। ২০১৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আবার রাজ্য পুলিশ গ্রেপ্তার করে,এবার অভিযোগ বাহারাইচ জেলা হাসপাতালে জোর করে রোগীদের চিকিৎসার চেষ্টা ও সরকারি পলিসি র সমালোচনা। এবার কারামুক্তি হয় চল্লিশ দিন পরে।পাশাপাশি কাফিলের লড়াইও জারি থাকে। একাধিক বার তাকে তদন্তকারী দলের প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়,আদালত নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলে।ইতিমধ্যে মোদি সরকার নামিয়ে এনেছে চরম অগণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি কারী নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। দেশ জুড়ে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। নানান ধরণের প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে কাফিল পৌঁছে গেছেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে, বক্তব্য রেখেছেন সিএএ আইনের বিরুদ্ধে। উত্তরপ্রদেশ সরকার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গের অজুহাতে মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে চালান করেছে মথুরা জেলে। এই খেলা শেষ হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে যখন উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার বিআরডি মেডিক্যাল কলেজ থেকে কাফিল খানকে বরখাস্ত করল।
তবে রাষ্ট্রের এই সন্ত্রাস, কর্পোরেট মিডিয়ার সরকারি ঘোষক হয়ে ওঠা বা আইটি সেলের ঘৃণা বর্ষী ট্রোল গুলো শেষ কথা বলে নি। সংখ্যায় কম হলেও দেশ- বিদেশের বহু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।কাফিল খান নিজে তার এই ইতিবৃত্তে সেকথা বার বার উল্লেখ করেছেন,যেমন করেছেন তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হৃদয়হীন কর্তাভজা আচরণের কথা।কিন্তু কাফিলের একটা কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাফিল বলেছেন :" When the entire state machinery singled me out,two things happened.one,the majoritarian media,eager for the approval of the government,began to make much of my being a Muslim,and how this meant that I was a potential terrorist and a wrong doer.Second, people with secular values began expressing outrage at how I was being victimized only because i was a muslim"।ধর্মীয় মেরুকরণের এই গল্পের ক্ষেত্রে শাসকের একমাত্র লক্ষ্য ছিল যাদের কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, তাদের আড়াল করা।কাফিল খান কিন্তু চিকিৎসার ক্ষেত্রে একই রকম সক্রিয়। কোভিড কালে যখন সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতা স্পষ্ট তখন বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী বিকল্প চিকিৎসা উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। ২০২১ সালে এরকমই এক উদ্যোগ ' ডক্টরস অন রোড' গ্রাম ভারতে চিকিৎসার কাজ শুরু করেন যা এখন বহুব্যাপ্ত।
কাফিল খানের এই আখ্যান অমৃতকালের ভারতবর্ষে কোন ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি মুন্ডাকা উপনিষদের সত্যমেব জয়তে উচ্চারণ করে যে ভারত যাত্রা শুরু করেছিল,তা আজ অতীত।সে ভারতে অনেক অসম্পূর্ণতা ছিল কিন্তু সে ভারত বহুত্বের কথা বলত,বলত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা।আজ এই একত্ববাদী দেশের ঘোষিত লক্ষ্য হল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আজ এখানে সংখ্যালঘুদের, দলিতদের নিকেশ করার হুমকি দেওয়া যায়,ঘোষনা করা যায় নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে সংবিধানকে বদলে ফেলার নীল নকশা। এই দেশে শাসকের কথাকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেওয়াই দস্তুর, ভিন্ন মত হলেই জোটে দেশদ্রোহীর তকমা। এই শ্বাসরূদ্ধ অবস্থায় যে মানুষেরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যারা নির্বাক কণ্ঠস্বরকে ভরসা জোগান তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে গরাদের কালো অন্ধকার। ফাদার স্ট্যান স্বামী, সুধা ভরদ্বাজ, শার্জিল ইমান,সাংবাদিক কাপ্পান, উমর খালিদ, অধ্যাপক সাইবাবা, কাফিল খানেরা তবুও বিরুদ্ধতার ভৈরবী বাজান। এই কুয়াশাঘেরা সময়ে আমরাও খানিক আলোর দেখা পাই।