পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ন্যায়বিচারের দাবি: অন্যায়কে সমগ্রভাবে দেখতে হবে

  • 30 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 783 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
এই আন্দোলন একমুখী হয়ে ক্রমশ এক কানাগলির ভেতরে সেধিয়ে চলেছে। আরজি করের ন্যায়বিচার চাইতে চাইতে আমরা আরও চার দিকের যে সব ঘটনায় ন্যায় বিচারের দাবি তুলতে হবে, ভুলে যাচ্ছি। হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের বীভৎসায় আমরা মুখ বন্ধ রাখতে পেরেছি। হঠাৎ আমরা যেন “আমরা-বাঙালি” হয়ে উঠেছি। আমরা রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করে আন্দোলনের মহড়া দিচ্ছি ভেবে শরীর গরম করছি, আর আসলে রাষ্ট্রের এক ছোট হাতলের বিরুদ্ধে লড়াই করে বড় কুর্সিটাকে যেন ছাড় দিতে বদ্ধপরিকর।

 

আমার খুব আশ্চর্য লাগছে। আরজি করের পৈশাচিক ঘটনায় আমাদের প্রতিক্রিয়ার বিপুলতার মধ্যে এত দিন খুব প্রেরণাদায়ক মশাল দেখেছি। অনেক দিন পরে অনেক দিন ধরে রাজ্য জুড়ে জায়গায় জায়গায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে নিজের অক্ষম ভাঙাচোরা শরীরেও শিহরণ অনুভব করেছি। কিছু কিছু জায়গায় অপারগ অবস্থাতেও মিছিলের শুরুতে বা শেষে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, চার দিকের সেই দ্রোহমনে ওম বুকে পিঠে স্পর্শ করে নিতে!

তারপর ---

এই চলতে চলতেই আবিষ্কার করলাম, এই আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো কেমন একটেরে হয়ে উঠছে। আন্দোলনকারীরা কেন জানি না দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাঁরা আর কোনো দিকে তাকাবেন না। হরিয়ানায় গোরক্ষকরা একজন বাঙালি ঘরছুট শ্রমিককে গোমাংস ভোজনের বাহান্য পিটিয়ে মেরে ফেলল। আমরা প্রায় চুপচাপ। রাজস্থানে আরও একজনকে। আমরা তখনও পাখির চোখের দিকেই তাকিয়ে আছি। হরিয়ানায় আবার একজন হিন্দুকেও ওরা গাড়ি নিয়ে তাড়া করে ধরে ফেলে পিটিয়ে মেরে ফেলল। আমাদের দ্রোহধ্যান তাতে ভাঙল না। মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনীর রাস্তায় ভর দুপুরে একজন নারীকে দুষ্কৃতিরা ধর্ষণ করতে সক্ষম হল আর চার দিকে অনেক লোক দাঁড়িয়ে তা দেখতে এবং ভিডিও করতে লাগল। তাদের কারও মনে হল না, ঘটনায় বাধা দেয়, এবং/অথবা পুলিশে খবর দেয়। আমাদের আন্দোলনে তারও কোনো ছাপ পড়ল না। অন্তত প্রধানত। অধিকাংশত। কোথাও কেউ না কেউ হয়ত, বা, নিশ্চয়ই এই মুদ্দাগুলির দিকে নজর দিয়েছেন, ফ্লেক্সে লিখেছেন, এ নিয়ে অবস্থানে বসেছেন। কিন্তু সেসব সংখ্যায় এত কম যে ধরতিতে আসে না।

কেন না, আমরা শুধু আরজি করের ঘটনায় ন্যায়বিচার চেয়ে চলেছি।

রবীন্দ্রনাথের একটা বিখ্যাত নৃত্যনাট্য আছে। “শ্যামা”। তার প্রথম গানের সংলাপ স্মরণ করুন:

চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে।

চোর চাই।

যে করেই হোক চোর চাই।

আমাদের আকাঙ্ক্ষাটা অনেকটা যেন এরকম হয়ে গেছে। আরও কোথায় কী চুরি দুর্নীতি খুন ধর্ষণ হয়েছে বা হয়ে চলেছে তা নিয়ে আমাদের কোনো রকম মাথা ব্যথা নেই – আমি আগেকার কথা তুলছি না, কাঠুয়া, উন্নাও হাথরাস, মনিপুরের কথা বলছি না – বলছি উপরের কয়েকটা একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনার কথা।

বিচার চাই। ন্যায় বিচার চাই। খুবই স্বাভাবিক ন্যায্য দাবি।

আরজি করের পৈশাচিক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও বিচার এবং দোষীদের কঠোর সাজা চাই। খুবই স্বাভাবিক ও ন্যায্য দাবি।

কিন্তু --- এক মাসের মধ্যে বিচার চাই, কোনো যুক্তিসঙ্গত দাবি নয়।

 

এনকাউন্টারের রাস্তায় না গেলে, “যে করেই হোক চোর চাই” রাস্তায় না গেলে, অপরাধীকে ধরতে এবং বিচার দিতে সময় লাগবে। তাতে এক মাস যথেষ্ট সময় হতে নাও পারে। দু বছরও লাগতে পারে।

পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে জনস্রোতের আবেগকে আঁচলে পুরতে এবং সম্ভাব্য অভিযোগ তির অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে বিধান সভায় দুম করে একটা “অপরাজিতা বিল” এনে এক মাসের মধ্যে বিচার এবং অবশেষে ফাঁসির ব্যবস্থার নিদান দিয়ে ফেলেছেন। আইনের ধারা দিয়ে যে ক্রিমিন্যালকে ধরা যায় না, ধরার পরে কাজে লাগে, পুলিশের কাজের সেই সময়টা যে বিধায়কদের আবেগ বা মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় না—এই সহজ সত্যটা তাঁদের মাথার উপর দিয়ে বোধ হয় উড়ে গেছে!

আমাদের জরুরিত্ববোধের আবেগ সবেগে ধাবিত হোক, ধর্ষণ নামক এই পাপাচার থেকে ভারতীয় তথা বঙ্গ সমাজের উদ্ধার আর কবে হবে, সেই দিকে। আমরা কবে বলতে পারব, বসন্ত রোগের মতো ধর্ষণও সম্পূর্ণ অপনোদন হয়ে গেছে? আন্দোলনকারীদের আবেগকে আমি উপেক্ষা করছি না। যারা সেই আবেগে ভেসে যাচ্ছেন তাদেরও আমি সমালোচনা করতে চাই না। কিন্তু আমাদের আবেগকেও তো বুদ্ধিদীপ্ত হতে হবে। এমনকি দুঃখ আঘাত শোকের মুহূর্তেও।

এই যুক্তিহীন আবেগ এক গণ হিস্টিরিয়ার আকার নিয়ে হেতাল পারেখের ধর্ষণ ও হত্যার জন্য লিফট চালক ধনঞ্জয়ের ফাঁসি সম্ভব করেছিল। আজ সকলেই জানেন—এমনকি মীরা দেবীও—ধনঞ্জয় অপরাধী ছিল না। আসল অপরাধীরা—খুব সম্ভবত মেয়েটিরই খুব কাছের স্বজন—আজও অধরা রয়ে গেছে। গণ হিস্টিরিয়ার প্রভাব পরোক্ষভাবে আদালতের উপরও পড়ে, বিচারকরা এই সমাজের বাইরের কেউ নন, অতিমানব নন।

তিলোত্তমার ঘটনায় আদৌ কি বিচার হবে? অপরাধীরা শাস্তি পাবে? ধর্ষক খুনিরা কি ধরা পড়বে? পুঁটির সঙ্গে বোয়ালরাও?

সম্ভাবনা কম। দুটো কারণে আমার এই ধারণা।

প্রথমত কার্ল মার্ক্সের এক বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণ ও অনুকরণ করা যাক। উনি বলেছিলেন, The ideas of the ruling class in every epoch are the ruling ideas. আমি বলতে চাইছি, The elements of the ruling party are the ruling elements in every regime. এ হচ্ছে প্রথম বাধা। শুধু আরজি কর নয়, কোনো মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে, স্বাস্থ্য দপ্তরে কোনো অপরাধ চক্র বাসা বাঁধতে পারে না, যদি তা শাসক দলের আশ্রয় ও প্রশ্রয় না পায়। এই আশ্রয় আর প্রশ্রয়ের আমরা সরল লোকেরা যে সরলতর রূপ কল্পনা করে থাকি—শুধু শাসক দলের লোক টাকা তোলে আর উপরে হিস্যা পাঠায়, পছন্দের লোককে সাহায্য করে আর যাদের অপছন্দ করে তাদের ডুবিয়ে দেয়, ইত্যাদি—অপরাধের ধরন, ব্যাপ্তি ও কু-ধন বন্টনের তরিকা, এক কথায় সেই সবই বদলে গেছে। আজ নয়, অনেক দিন আগে থেকেই। এই জালচক্রে শাসক দল আছে, বিরোধী দল আছে, প্রশাসনের চাঁই আছে, খ্যাতিমান বিত্তবান লোক আছে, অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক আছে, আবার এমনকি আমার আপনার মতো সিধেসাদা লোকজনও আছে। কাজ এবং দায়িত্বের ভাগাভাগি আছে। সেই অনুযায়ী তথ্যজ্ঞান এবং পরিচিতিরও। কে কতটা জানবে এবং কে কাকে চিনবে।

এর মধ্যে শাসক দলের মুখটাই আমরা খানিক দেখতে পাই। বাস্তব কারণেই। আর শাসক দলের বুদ্ধির মাত্রানুসারে তার ব্যস্তানুপাতে দেখা যায়। ১৯৮২ সালে কুচবিহারের মহারাজা দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ হাসপাতালের নার্স বর্ণালী দত্ত যখন নিজের কোয়ার্টারে দিনে দুপুরে আক্রান্ত হয়ে খুন হন, সেদিনও যারা অপরাধী তারা তদানীন্তন (বড়) শাসক দলের প্রশ্রয়েই কাজটা নির্ঝঞ্ঝাটে সারতে পেরেছিল। নব ব্যারাকপুরের যে নেতাকে তার আগে দল পাঠিয়েছিল সেই জেলার স্বাস্থ্য দপ্তরের পার্টি সেলের কাজ দেখাশোনা করতে, তাকে রাতারাতি তুলে ফেরত নিয়ে আসে তার বাসভিটায়। সেবারেও অপরাধী ধরা পড়েনি। বর্তমান প্রজন্মের কারও হয়ত সেই বর্ণালী দত্তের নাম আজ আর মনে পড়বে না। নামটি উচ্চারণ করায় বেয়াল্লিশ বছর বাদে পুলিশও সম্ভবত আমাকে বা এই পোর্টালকে আর নোটিশ ধরাবে না।

বর্তমান রাজ্য শাসক দলের এতটা বুদ্ধি এবং তৎপরতা নেই বলে তাদের মুখগুলো সহজেই ধরা পড়ে যায় এবং সামনে চলে আসে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বলে ওরা আছে, এমন নয়। দেখতে না পেলেও ওরা থাকে। 

এবারেও একই কারণে (ruling elements in every regimeare the elements of the ruling party থিসিস মোতাবেক) জাল কেটে খুনি ও ধর্ষকদের ধরার সম্ভাবনা খুবই কম। আর ধরলেই তো হবে না। তারাই যে খুনি ও ধর্ষক, তার ঠাসা বস্তুময় সাক্ষ্য প্রমাণ (solid material evidence) সংগ্রহ করতে হবে, যা আদালতকে খুশি করতে পারবে। তার সম্ভাবনা বেশ কম।

দ্বিতীয়ত, এবারের আরজি করের ঘটনায় অপরাধের জায়গাটা এমন যে প্রায় সাক্ষ্য প্রমাণ না রেখেই খুন ও ধর্ষণের কাজটা অপরাধীরা সেরে ফেলতে পেরেছে। একজন ছাড়া আর কাউকে ধরার মতো এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। প্রমাণ লোপাটের কথা শোনা যাচ্ছে বটে। সে সম্ভাবনাও প্রচুর পরিমাণে আছে। এমনকি যেখানে লাশ পাওয়া গেছে, সেখানেই যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, এমনটা নাও হয়ে থাকতে পারে। ঘর ভাঙার গল্পটা সেই ঘরের দিকেই নজর আটকে রাখার জন্যও হয়ে থাকতে পারে, যাতে অন্যত্র “প্রকৃত ঘটনাস্থল” খুঁজতে তদন্তকারী দল আগ্রহী না হয়। তাই আমার ধারণা, “প্রমাণ” লোপাটের চেষ্টা না হলেও খুব বেশি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এই কেসে পাওয়ার অবস্থা প্রথম থেকেই ছিল না বা নেই। একমাত্র যদি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ গোপন তদন্তে নামে এবং সমস্ত প্রভাব বৃত্তকে উপেক্ষা করে আড়ালে স্বাধীন ভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তবে ছমাস বা এক বছরের মাথায় হয়ত কিছু কিনারা হলে হতেও পারে।  

না হলে, একবার ভেবে দেখুন, যে বিশাল দীর্ঘকালীন র‍্যাকেটের সন্ধান আভাসে ইঙ্গিতে উঠে আসছে, সেগুলো সম্পর্কে আজকে যাঁরা মুখ খুলছেন, তাঁদের সংগঠনগুলো এত দিন চুপ করে বসেছিল কেন? চিকিৎসকদের একাধিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, ইত্যাদি? একজন একক ব্যক্তির পক্ষে একটা অবতল দুষ্কৃতি-গ্যাঙের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় ঝামেলা আছে, বিপদ আছে। কিন্তু সংগঠন? তারা কেন চুপ করে থাকবে? কেন ছিল?

একটাই কারণ। উচ্চতর প্রভাব বৃত্তের পরিধি ভেঙে ঢুকতে কেউই সহসা চায় না। সোজা কথায় ঘাঁটাতে চায় না। সংগঠনও নয়। বিরোধী সংগঠনও নয়। এ হল আমাদের বাস্তব সমাজের কঠোর বাস্তব ছবি। জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিলে যে মেরুদণ্ড মেমেন্টো এখন খুব জনপ্রিয়, তাকে পছন্দ করেও মনের গহনে অনেকেই স্বীকার করবেন, শুধু শাসক দলের ধামাধরারা নয়, শুধু গতকালের বা আজকের শাসকদের তাঁবেদাররা নয়, সমাজের এক বিরাট অংশের মধ্যেই মেরুদণ্ড এখন প্লাস্টিক নির্মিত। অসুখবিসুখে এক্স-রে না করলে সে যে আছে তা বোঝাই যায় না!  

না হলে ভাবুন না, গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ দিনের বেলায় উন্মুক্ত রাজপথের উপরে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে যখন ধর্ষণের ঘটনাটা ঘটছে, তখন চার পাশে অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে। এবং তারা চুপচাপ দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ভিডিও তুলছে মোবাইলের ক্যামেরায়। কেউ বাধা দিতে বা মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে না! এটা কী করে সম্ভব হয়? কখন সম্ভব হয়? রাজ্য সরকার না হয় বিজেপি-র হতে পারে। কিন্তু সেই রাস্তার লোকগুলোও সবাই কি বিজেপি ছিল? ধর্ষক পূজারী গেরুয়া সেনা ছিল? না, তা নয়, স্রেফ মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ। হোমো টরপিডেন্স। শুধু ওরা নয়, ওখানেই নয়; আমরাও, এখানেও। দুচার জন নয়, অনেক, অসংখ্য।  

তাহলে এই যে এত আন্দোলন আমরা করলাম, রাত জাগলাম, রাত এবং রাস্তার দখল নিলাম কত বার, “এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা”?

না। একেবারেই নয়। ইতিমধ্যেই অনেকগুলি সাফল্য অর্জন করেছি আমরা। সেগুলি দেখতে হবে। চিনতে হবে। মনে রাখতে হবে।

মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলিকে কেন্দ্র করে যে সিন্ডিকেট রাজ ও ধমক-ধামাকা উন্মোচিত হয়ে চলেছে, এটা এই আন্দোলনেরই ফসল। দশ বিশটা লোকও যদি ধরা পড়ে, চক্রটা ভেঙে যাবে এবং সামনে অনেক দিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কোনো নেতাও অচিরে আর একজনকে “বিরূপাক্ষ দাস” বানাতে সাহস পাবে না। একজন তিলোত্তমাকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর খুনি-ধর্ষকরাও সকলে যদি ধরা না পড়ে, অন্তত অনেক দিন আর কোনো তিলোত্তমাকে প্রাণ দিতে হবে না! এরকম একটা ভরসার আবহ তৈরি হয়েছে বর্তমান আন্দোলনের জোরে।

অনেক কাল পরে এবার মনে হচ্ছে সিবিআই খানিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করছে। তাড়াহুড়ো করছে না। ঢাকঢোল পেটাচ্ছে না। সঙ্গে চ্যানেল গুচ্ছের ওবি ভ্যান নিয়ে ঘুরছে না। প্রতি দিন প্রকাশ্যে মিডিয়ার কাছে ক্রাইমের বিরুদ্ধে ফাইট করার গরম গরম বাইট দিচ্ছে না। অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার না করে ষোল দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। চার দিকে সবাই অধৈর্য—এখনও তুলছে না কেন? সেটিং তত্ত্বের পশরা বার বার ঘুরপাক খেলেও তারা নিঃশব্দে কাজ করছে।

অথচ, ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই বিচারপ্রার্থীরা বুঝতে পারতেন, গ্রেপ্তার করলেই ঘোষ মুখ বন্ধ করে ফেলত। বলত, আমাকে আদালতে তুলুন, সেখানেই আমার সমস্ত বক্তব্য আমার উকিল বলবে। গ্রেপ্তার না করায়, জিজ্ঞাসাবাদে তাকে সাড়া দিতে হয়েছে। এই প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম অসমঞ্জস কথা সিবিআই টুকে নিয়েছে। সেগুলো বাইরে পোস্টার করেনি। নানা রকম ছবিটবি দেখে ঘোষের সাগরেদদের চিহ্নিত করেছে। রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যেই তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করেছে।

সন্দীপ ঘোষকে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর আরজি কর থেকে পদত্যাগ করার পরে এদিক ওদিকে পোস্টিং দেওয়াতেও অনেকেই প্রচুর অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। এটাও যে (আমার বিশ্বাস, রাজ্য পুলিশ ও সিবিআইয়ের মধ্যে কথা চালাচালির ভিত্তিতে) একটা দারুণ প্রশাসনিক চাল তারা ধরতে পারেননি। সে বিভিন্ন ভালো পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তার সঙ্গীসাথীরা খুবই নিশ্চিন্ত ছিল—আমাদের গায়ে হাত পড়ছে না। স্যর আছে, ঠিক দেখে রাখবে। ফলে তারা যে যার বাড়িতে ভালোই ঘুমচ্ছিল। অপরাধের সাক্ষী কাগজপত্রও তাদের বাড়িতেই সু(?)রক্ষিতভাবে লুকনো ছিল। তাই গত ৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সকালে যখন ইডি-র একাধিক টিম সাঁতরাগাছি, বৈদ্যবাটি, ক্যানিং, সুভাষগ্রাম, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেল, তারা স্বভাবতই হতবাক। আমরাও অবাক আমাদের বুদ্ধির হ্রস্বতা দেখে।

আমার মনে হচ্ছে, এই যে নিয়মানুগ প্রচারবিমুখ আইনি কার্যকর তৎপরতা, এটাও গত এক মাসের গণ আন্দোলনের একটা সুফল। এই সাফল্যকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।

এই আন্দোলনের আরও একটা বিরাট সাফল্য এসেছে। গেরুয়া পার্টি অনেক চেষ্টা করেও এর মঞ্চ দখল নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, একাধিক মঞ্চ থেকে তাড়া খেয়ে তাদের পালাতে হয়েছে। গেরুয়া প্রসাদপুষ্ট এম-পি অভিজিত গাঙ্গুলীকেও “গো-ব্যাক” ধ্বনি শুনে মুখ গোমড়া করে চলে আসতে হয়েছে। যে দলটা মনিপুরকে এক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে ফাঁসিয়ে রেখেছে, হাজার খানেক মানুষ নিহত, শত শত ধর্ষণের শিকার মনিপুরের নারীরা, যে রাজ্যে প্রধান মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গত দেড় বছরে গিয়ে উঠতে পারেননি, যে রাজ্যের সমস্যার কথা সংসদে ওঠার দিনে প্রধান মন্ত্রী হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন, যে দলের খাতায় কাঠুয়া, উন্নাও, হাথ্রাশের মতো অসংখ্য নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা লেখা রয়েছে, যারা সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের জেল থেকে ছুটি দিয়ে দেয়, গ্রেপ্তার হওয়া ধর্ষকদের জামিনের ব্যবস্থা করে, এরকম আরও অসংখ্য ক্রিমিন্যাল রেকর্ড যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের যে আরজি করের ঘটনায় এসে কুমির কান্না প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়নি হাজার হাজার প্রতিবাদ মঞ্চের একটিতেও—এটা অবশ্যই এই গণ আন্দোলনের একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই ধারাকেও আগামী দিনে রাতে বজায় রাখতে হবে এবং একই রকম সাবধান থাকতে হবে।

কিন্তু এক জায়গায় এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়েছে।

এই আন্দোলন একমুখী হয়ে ক্রমশ এক কানাগলির ভেতরে সেধিয়ে চলেছে। আরজি করের ন্যায়বিচার চাইতে চাইতে আমরা আরও চার দিকের যে সব ঘটনায় ন্যায় বিচারের দাবি তুলতে হবে, ভুলে যাচ্ছি। হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের বীভৎসায় আমরা মুখ বন্ধ রাখতে পেরেছি। হঠাৎ আমরা যেন “আমরা-বাঙালি” হয়ে উঠেছি। আমরা রাষ্ট্রকে চিহ্নিত করে আন্দোলনের মহড়া দিচ্ছি ভেবে শরীর গরম করছি, আর আসলে রাষ্ট্রের এক ছোট হাতলের বিরুদ্ধে লড়াই করে বড় কুর্সিটাকে যেন ছাড় দিতে বদ্ধপরিকর।

এই লক্ষ্যের কথা বিশিষ্ট গণ উকিল বিকাশ ভট্টাচার্য সর্বোচ্চ আদালতে দিল মুখ একাকার করে বলে ফেলেছিলেন। রাজ্য সরকারের পদত্যাগ চাই। আদালত তাঁকে ধমকে বসিয়ে দিয়েছে। সেটিং, সেটিং ছাড়া আর কি!

বর্তমান রাজ্য সরকারের অনেক গাফিলতি সত্ত্বেও মানতেই হবে, মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালীন জ্যোতি বসু বামপন্থী নেতা হয়ে ১৯৮০-র দশকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের সঙ্গে যে আচরণ করেছিলেন, মমতার আচরণ তার তুলনায় অনেক ভব্য, অনেক নিয়ন্ত্রিত। বসু একাধিক মেডিক্যাল কলেজে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডার দিয়ে মারদাঙ্গা করে আন্দোলন ভাঙতে চেষ্টা করেছিলেন। না পেরে অবশেষে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছিলেন। আলোচনার টেবিলে দশ জনের বেশি প্রতিনিধিকে তাঁর পুলিশ ঢুকতে দেয়নি।

আর সম্ভাষণ?

আলোচনার শুরুতেই বসু জুনিয়র ডাক্তারদের বলেছিলেন, “আপনারা ক্রিমিন্যাল।”

মমতা ব্যানার্জীর এই লব্জ শিখতে এখনও ঢের দেরি।

এর কারণটাও বুঝে নিতে হবে।

জ্যোতিবাবুর ডিগ্রিগুলো জাল না হওয়ায় তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে সুশিক্ষিত ছিলেন। তিনি যে রাষ্ট্রের একটা ছোট চেয়ারে বসে আছেন জানতেন। মমতার ডিগ্রিগুলি জাল হওয়ার ফলে এই প্রশিক্ষণ তাঁর হয়নি।

আর তাই তাঁর মুখ থেকে সহজেই বেফাঁস কথা বেরিয়ে আসে। “আন্দোলন অনেক হল। এবার উৎসবে ফিরুন।” সেই চেয়ার থেকে একথা বলতেই হবে। সামনে পুজো মানে প্রায় আশি হাজার কোটি টাকার বাজার। যে দিকে তাকিয়ে মোদী সরকার ইতি মধ্যেই সমস্ত ভোজ্য তেলের উপর ২০ শতাংশ জিজিয়া কর বসিয়েছে। সেই বাজারের সাদা কালো বাজারিরা সব সরকারকেই বাগে আনতে চায়। পুজো না জমলে, কেনাকাটা না হলে, তাদের বেজায় ক্ষতি।

তবে, আমাদের সাফ কথা, আন্দোলন থেকে “উৎসবে ফিরবার” আলাদা কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা উৎসবেই আছি। আমাদের মঞ্চে মঞ্চে গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে, কবিতা পাঠ আছে, আলোক সজ্জা আছে, অনেক, হরেক রকম। আমাদের শোক আছে, দুঃখ আছে, ব্যথা আছে, আনন্দ আছে, প্রতিজ্ঞা আছে, আগামী কাল আছে। সেই সব নিয়ে আন্দোলনটাই আমাদের উৎসব। বড় পার্বণ। এই উৎসবে আমরা মেতেই আছি, থাকবও। প্রায় একশ বছর আগে বাঙালির চিরপ্রোজ্জ্বল দ্রোহস্বর কাজী নজরুল ইসলাম দিন বেঁধে দিয়ে গেছেন, আমরা বিদ্রোহীরা কবে শান্ত হয়ে ঘরে ফিরব।

তার ব্যত্যয় করি কী করে?   

মেরুদণ্ড যখন খুঁজে পেয়েছি, তখন তার বত্রিশটি কশেরুকাকেই কাজে লাগাতে হবে। মস্তককেও হোমো স্যাপিয়েন্স-এর মতো করে খাড়া অবস্থায় সামনে-তাকানো মুদ্রায় ব্যবহার করতে হবে। রাষ্ট্রকে রাজ্য বলে নয়, রাষ্ট্র বলেই চিনতে ও চেনাতে হবে। রাজ্যের অন্যায়ের পাশাপাশি দেশের বুকে ঘটে চলা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হবে।

ন্যায়বিচারের দাবি যখন বাছাবাছি করে ন্যায় খোঁজে, তাতে ন্যায় থাকে না।

সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধেই ন্যায়বিচারের দাবি পেশ করতে হবে।

 

0 Comments

Post Comment