যা খুশি করুক। আমি উঠি। চা করি। সকাল থেকে একের পর এক চলছে। চা না খেলে আমার মাথাটা এবার ফেটে যাবে। উঠে জল চাপালাম কেটলিতে।
আজ রবিবার। ও ব্যাডমিন্টন খেলে ফিরল সকাল দশটা। বাড়ি ফিরে আমার মুখের চাউনি, আমার মুড – কিছুই চোখে পড়ে না ওর। মন বিক্ষিপ্ত না খুশি, বোঝেও না। সবই বলতে হবে মুখ ফুটে। ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন? ওর ক্ষেত্রে তো তা নয়।
ল্যাপটপে কাজ করতে করতেও ঠিক টের পাই। পাশের ঘরে ও কী করছে। বুঝি, কখন রেগে আছে। কখন খুশি। কখন ভয় পাচ্ছে। তা হলে আমার ক্ষেত্রে মনের ভিতরের কথা মুখ ফুটে বলে দিতে হবে কেন?
ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ। লিভিং রুম থেকে ভেসে আসছে ঋভুর কান্না। অর্থহীন। ক্লাস সেভেন। একটা অ্যালজেব্রিক এক্সপ্রেশনে যোগ বিয়োগ চিহ্ন লিখতে ভুল করবে কেন? অঙ্কের উত্তরটা ভুল হয়ে গেল না?এইটুকু বুদ্ধি নেই যে, একটা সাইন ভুল লিখলে গোটা অঙ্কটা ভুল হয়ে যাবে?
ছেলের অযৌক্তিক কান্নাকে দিক পাত্তা ও। আমার সময় নেই। ইচ্ছেও নেই।
আদা থেঁতো করলাম। তেজপাতা, ফার্স্ট ফ্লাশ, গুঁড়ো চা, এলাচ, আদা ভিজয়ে রাখলাম। কড়া এক কাপ চা না খেলে হবে না। ও পিছন থেকে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। বলল, '' কী হয়েছে? একটা ছোট্ট ভুলের জন্য এত বকলে কেন ঋভুকে? অন্য কিছু হয়েছে?''
'' ঋভু কোথায়? '' ভুরু কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে জানতে চাইলাম।
'' বাইরে খেলতে পাঠিয়েছি।''
'' মানে? কাল ওর ম্যাথ টেস্ট। দেখছ, সিলি মিসটেক করছে। খেলতে পাঠিয়ে দিলে? আশ্চর্য! '' আমি কোমর থেকে ওর হাত সরিয়ে দিলাম। গজগজ করতে করতে কাঁপে চা ঢালছি।
শান্ত গলায় ও আবার জানতে চাইল, “ কী হয়েছে?…হয়েছেটা কী? হুঁ?” ছেলে একটা মাইনাস সাইন লেখেনি বলে চেঁচিয়ে ওঠার মেয়ে আমি নই। ও জানে। বোঝে। আমার সূক্ষ্ম মুড চেঞ্জ খেয়াল না করলেও এটুকু ওর চোখে পড়ে এই সংসারে।
'' আমি রাইমাকে নিতে পারছি না! গত দেড় মাস ধরে ও আমাকে এত মানসিক কষ্ট দিচ্ছে, কী বলব! আজ সকালে উঠে দেখি রিয়ানার ট্র্যাক তৈরি করে শঙ্খিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কে, কে?'' আর - একটু গলা চড়িয়ে বললাম, ''কে অথরিটি দিয়েছে ওকে? এটা কি ওর প্রোডাকশন? আশ্চর্য!”
ও বড় নিঃশ্বাস ফেলল।আমার শরীর থেকে হাত সরিয়ে চায়ের কাপ তুলে নিল হাতে।
'' একটা সামান্য পাড়া ক্লাব। সেখানে তোমাদের এত রাজনীতি চলে! এইজন্যে আমি ' শান্তি ' ক্লাবের সাথে পাশে নেই। ''
এ সব ওর গা-বাঁচানো কথা। কয়েক মাস আগে ' শান্তি ' ক্লাবের ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট হয়েছিল। ও ছিল একটা টিমের ক্যাপ্টেন। রাইমার বর, পীযূষ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। কম মাইক্রো ম্যানাজ করেছিল? দিন রাত ফোন। ও প্রচণ্ড পলিটিক্যালি হ্যান্ডেল করেছিল সে সব।
কয়েক বছর আগে এই সমস্যাটা ছিল না। পীযূষ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই যত অশান্তি! শুধু স্বজনপোষণ। কে সহ্য করবে? প্রতিটা বিষয়ে পীযূষ আর রাইমার নাক গলানো চাই।
যে বা যারা ওর ' মদের গ্লাস-পার্টনার ' তারাই চান্স পাবে সর্বত্র।আমি আর ও কীভাবে যে চান্স পাই, কে জানে!
একেতেই মাথা গরম তার মধ্যে ওর ন্যাকা ন্যাকা কথা। চেঁচিয়ে বললাম,'' তোমার ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে তোমাকে কিছু সামলাতে হয়নি বলছ? ''
'' আমার ওপর বা ঋভুর ওপর মাথা গরম করে কিছু হবে না। ভাবো, কীভাবে ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডেল করতে পারবে পরিস্থিতি। ''
'' আমি রঞ্জিতাদিকে জানিয়ে দেব। লিখিত। আমি শান্তি ক্লাবে আর কোনওদিন কোনও অনুষ্ঠান করতে পারব না। উনি ক্লাবের কালচারাল সেক্রেটারি। বাকিটা রঞ্জিতাদি বুঝে নেবে।
ইয়ার্কি! রাত জেগে স্ক্রিপ্ট, কনসেপ্ট তৈরি করব। আমার বান্ধবী কলকাতা থেকে ফ্ল-লেস কস্টিউম পাঠাবে। আলো ঠিক করব। ট্র্যাক তৈরি করব রাতের পর রাত জেগে। আর, প্রতিদিন রিহার্সালে এসে এটা হচ্ছে না। ওটা হচ্ছে না বলবে রাইমা? কে রে তুই? তোর প্রোফাইল কী? ওই তো এক ধাঁচে কবিতা পাঠ করে। গলায় কোনও ভ্যারিয়েশন নেই। আর কী গুণ আছে তোর?
পাবলিকও হয়েছে। দিনের পর দিন একই জিনিস শুনবে। বুকটা দশ ইঞ্চি উঁচিয়ে মঞ্চে ও হাঁটবে। দর্শক হাঁ করে তাই দেখবে। রিডিকিউলাস! '' বলতে বলতে আমি হাতের কলমটা টেবিলের ওপর ঘুড়িয়ে যাচ্ছি। একবার ক্লকওয়াইজ। একবার অ্যান্টিক্লকওয়াইজ। ও লক্ষ করছে। সেটা দেখলাম।
'' রঞ্জিতাদিকে লিখে কোনও লাভ নেই। উনি তোমাকে হাতছাড়া করবে না। তোমার সমস্যা হল, তুমি চটজলদি একটা প্রতিক্রিয়া দিয়ে দাও। এভাবে আজকালকার দুনিয়াটা চলে না। কিপ কুল। রাইমা যা যা বলবে, তোমার শোনার দরকার নেই। ওকে কিছু বলারই দরকার নেই। অনুষ্ঠানের পরিচালক তুমি। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই করবে। কে কী বলল, ফরগেট ইট। ঋভুকে বকছ? তুমি নিজেই জানো না। জীবনের কোথায় প্লাস সাইন আর কোথায় মাইনাস সাইন বসাতে হয়।“
কথাটা মন্দ বলেনি ও। ঝগড়াঝাটি করে লাভ নেই। রাইমার সঙ্গে এভাবেই খেলতে হবে। কিন্তু আমার মনে একটাই প্রশ্ন।রাইমার আমাকে নিয়ে সমস্যা কোথায়? কেন ও আমার কাজে নাক গলাবে? নিজেকে বড় দেখানোর চেষ্টা করবে? প্রতিযোগিতাটা কোথায়?
ও লম্বা। আমার মাঝারি গড়ন। ও শ্যামবর্ণ। আমি ফর্সা। ও বাচিকশিল্পি। আমি কর্পোরেট কাজ করি। শিল্প জগতে আমি কেউ নই। মাঝেমধ্যে পাড়ার দিদিরা বললে একাঙ্ক নাটক পরিচালনা করি। এই যা।
ওর হাজবেন্ড শান্তি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। আমার হাজবেন্ড ক্লাবের সামান্য মেম্বার।
ওর অজস্র প্রেম। আমার জীবনে প্রেম হাতে গোনা। ও তিনবার বিয়ে করেছে। আমার একটাই বিয়ে।
শান্তি ক্লাবে বিখ্যাত হওয়ার কোনও আশাও নেই আমাদের।কেননা, রাইমাদের মতো, আমাদের বৃত্তটা ক্লাব ঘিরে নয়।আমরা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি কাজের সূত্রে। সেই সব জায়গাগুলো চিনেছি, জেনেছি।সে সব নিয়ে ও কলকাতার নানা পত্রিকায় কত ভ্রমণ কাহিনি লেখালেখি করেছিল কয়েক বছর।
আমার ইউনিভার্সিটি জীবনে আমেরিকান প্রেমিক ছিল একটি। ওকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলাম। শিকাগোর শৈলে তুমি। শান্তিনিকেতনের একটা পাবলিশিং হাউজ ছেপেছিল নভেলটা। ভাল বিক্রি হয়েছিল বইমেলায়। তার পর.. ওই আর কী! যা হয়। সংসার। অফিস।
লেখা, প্রেম সবই গেল চুকেবুকে।
আমাদের দাম্পত্য জীবনটা রাইমা আর পীযূষের মতো বিদেশের সামান্য একটা বাঙালি ক্লাবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি।
তা হলে? তা হলে রাইমার সমস্যা কোথায়? নাহ। ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। পিছনের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। ঋভু একা একা ক্রিকেট খেলছে বাগানে। বাড়ির দেওয়ালে বল ছুঁড়ছে। বল ওর কাছে এলে ব্যাট করছে। চোখ মুখ থমথমে।
আমি বলটা ক্যাচ করে বললাম, '' আউট?''
'' নো।'' চেঁচিয়ে উত্তর দিল ও। তারপর ব্যাট মাটিতে রেখে, এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। এই দাঁড়ানোটার মানে হল, নাও। রাগ কমেছে। এবার আমাকে আদর করো।
আদর হল কিছুক্ষণ। এখন আর ঋভুর রাগ নেই মনে হয়। আমি আদুরে গলায় ওকে বললাম, '' আমরা দু'জনেই শিখব। একসঙ্গে।''
'' কী? ''
'' ইকুয়েশনের উত্তরে কোথায় আর কেন, মাইনাস সাইন বসাতে হবে।''
ঋভু মাথা নাড়ল। কী বুঝল কে জানে! আমিই-বা কতটুকু বুঝি? তাই না, বলুন?
তার পর ও ডাকল, '' তোমার ফোন। ধরবে?''
বাগান থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ''কে?''
'' রাইমা। '' ও বলল।
'' না। টেক্সট করুক। পরে পড়ে নেব। এখন একটু খেলি। ''
২
সেই রবিবার সকালে ফোনটা ধরলে ভাল হত।
রাইমা একটা দীর্ঘ টেক্সট করেছিল।
'' তুই সকাল সকাল এত রেগে গেলি কেন আমার ওপর? গ্রুপে বললি, তুই জানিস কতটা ট্র্যাক কাটতে হবে। কী করতে হবে, ইত্যাদি। আমার সে সব করার প্রয়োজন ছিল না। আমি ভাবলাম ট্র্যাক করে পাঠালে তোরই সুবিধে হবে। এত জটিল ভাবে ভাবতে পারি না। ক্লাবের অনুষ্ঠান ভাল হোক। সবাই চাই। আর, আমি পীযূষের ওয়াইফ হয়ে সেটা চাইব না? ও এখন প্রেসিডেন্ট। পান থেকে চুন খসলে সবাই ছি ছি করবে। তখন আমরা কোথায় দাঁড়াব? যাক গে। কিছু কস্টিউম আমার বাড়িতে এসেছে। তুই নিয়ে যাবি? অন্য অনুষ্ঠানের কিছু কস্টিউমও রয়েছে। মিশে গেলে মুশকিল। পীযূষ রাগারগি করবে। কখন আসতে পারবি জানাস।''
ন্যাকা। সারাক্ষণ শুধু পীযূষ আর পীযূষ! যেন স্বামী অন্তপ্রাণ! প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ফিরেও তাকাসনি এই হাজবেন্ড এর দিকে।সবাই জানে।সবাই বলাবলি করত।
ক্ষমতা ক্ষমতা! গোটা পৃথিবী এখন ক্ষমতার পূজারী।স্বামী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দরদ একেবারে উতলে পড়ছে।
‘ জটিল ভাবে ভাবতে পারি না।’ গা জ্বলে যায় রাইমার কথায়! সবাই জানে রাইমা কী ভাবে। কীভাবে ভাবে। প্রত্যেকদিন রিহার্সালে এসে '' এটা ঠিক কর। ওটা ঠিক কর। '' তুই কে রে বলার? তুই কে? ক্লাব আমাকে ভরসা করে অনুষ্ঠান করতে দিয়েছে। ভাল, মন্দ ক্লাব বুঝবে। তোর মাতব্বরি সহ্য করব কেন? কে তুই?
যাক গে। কস্টিউমগুলো তুলতে হবে। তখনই বলেছিলাম, '' রাইমা, আমার ঠিকানা দিই।'' অমনি। অমনি...'' না না। আমার মেয়ের কস্টিউমটা দেখব না কেমন পাঠাল? আমার বাড়ির ঠিকানা দে।'' কেন? বাকিরা আমার কাছ থেকে কস্টিউম সংগ্রহ করবে। তোর মেয়ে আকাশের কোন পরী যে, আলাদা করে দেখাতে হবে তোকে? ভাল হলেও পরবে। মন্দ হলেও পরবে। বাকিরা পরছে না? তুই দেখে ঠিক নেই বললে, আমি আবার বদলাব কস্টিউম? আশ্চর্য! ও যে কী চায়!...তাও কিছু বলিনি এত দিন।মেনে নিয়েছি।
সামলাতে না-পেরে আমাকে টেক্সট করেছে। এসে নিয়ে যাবি? অন্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিশে যাবে! কেন মিশবে? তোর দায়িত্ব নেই?
একবার লিখল না কস্টিউমগুলো কী দারুণ দেখতে! তা কেন বলবে? আমার বান্ধবীর বুটিক থেকে কস্টিউম অর্ডার করা হয়েছিল। ভাল বললে যদি জিভ খসে যায়? অন্যদিকে দীপাকে বলে রেখেছে, বুটিকের নম্বরটা শেয়ার করতে।হারামির হাতবাক্স একখানা। যেখানেই যাবে, ধান্দা।
আজ ঝকঝকে শরতের আকাশ।পেঁজা পেঁজা মেঘ।এখানেও জমে। জমবে না কেন! আকাশের কী দেশ হয়? হয় না। তবে, এখানের আকাশটা দূরের মনে হয়। কেন বলুন তো? অনেকটা আকাশপথ পেরিয়ে এই দেশটায় এসেছি বলে?
অফিস ফেরতা ঋভুর জন্য পাড়ার একটা চাইনিজ দোকান থেকে চিলি ফিশ আর মোমো তুলে নিলাম। আজ সন্ধেবেলা ডিনার তৈরি করার সময় নেই।সোজা চলে যাব ক্লাবে। কয়েকটা কাজ সেরেই চলে যেতে হবে রাইমার বাড়ি। তিনদিন হয়ে গেল। কস্টিউমগুলো আনতে যেতে পারিনি।
কখন যাব? পুজোর আগে দম ফেলার সময় নেই। অফিস, সংসার, প্রডাকশনের কাজ। তার মধ্যে ঋভু পড়াশুনোয় ফাঁকি মারবে। ও একটা ঘণ্টার জন্যেও ছেলের লেখাপড়া নিয়ে বসবে না।বললেই ও বলবে, '' এই বয়সে কেউ লেখাপড়া করে না কি? এখন খেলবে, বেড়াবে। টিভি দেখবে। ভিডিও গেম খেলবে। ছাড়ো তো!'' এত ক্যাজুয়াল! কী বলব!
ক্লাব হাউসে আজ প্রচুর ভিড়। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করাবার জায়গা নেই। কোনও মতে একটা স্পট পেলাম পনেরো মিনিট চক্কর মেরে। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি মদ, আড্ডা চলছে। আর বেশ কয়েকজন রিস্ট ব্যান্ড তৈরি করছে। যেটা পরে ক্লাবের পুজোয় ঢুকতে হবে। আমিও কিছুক্ষণ ব্যান্ড তৈরি করতে হেল্প করলাম।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দিকে সাড়ে ন'টা বেজে গিয়েছি। উঠে পড়লাম। রঞ্জিতাদিকে বললাম,” দি। আজ উঠি। রাইমার বাড়ি যেতে হবে।'' রঞ্জিতাদি ঘাড় নাড়ল।বলল, '' জানিস, পীযূষের মা হাসপাতালে ভর্তি।'' সেকি! আমি জানতাম না তো! বললাম, '' তাই নাকি? কবে ভর্তি হল?''
'' এই তো। আজ বিকেলে। শ্বাস কষ্ট। ''
'' ও। দেখি। আমি এখন গিয়ে কথা বলি। যদি কিছু লাগে। '' বলে তাড়াহুড়োয় পার্সটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
ক্লাব হাউস থেকে রাইমার বাড়ি অনেকটা দূর। প্রায় কুড়ি মিনিট। আজ অকারণ একটা ট্র্যাফিক জ্যাম। এত রাতে এই রুটে অর্ধেক গাড়ি থাকে না।
রাইমার বাড়ি পৌঁছতে রাত দশটা বেজে গেল। ডোর বেল টিপলাম। কেউ এল না। নক করলাম। তাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। সদর দরজায় বেশ কয়েবার ঠেলা দিলাম। দেখি, দরজা খোলা।
অনেক সময় এই পুজো, রিহার্সালের মরসুমে আমাদের সদর দরজা খুলেই রাখা হয়। কে কখন আসবে। ঢুকবে। কতবার দরজা খুলব? রাইমাও হয়তো সেই কারণেই দরজা ভেজিয়ে রেখেছে।
ঘরে ঢুকে কয়েকবার ডাকলাম,'' রাইমা। রাইমা।'' উত্তর নেই। লিভিং রুমের ডানদিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই বেসমেন্টের সিঁড়ি নেমে গিয়েছে।
বেসমেন্টে চলে যাব? রাইমা যদি সেখানে থাকে? সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেব, এমন সময় পীযূষের গলা, '' আমার জীবনটাকে হেল করে দিয়েছ তুমি! ''
'' আমি? আমি? তাই...না?'' রাইমার গলা কাঁপছে।
'' হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি। তোমার কী মনে হয়। তোমার হাজারটা প্রেম কাহিনি আমার কানে আসে না? আমার মায়ের সাপোর্ট সিস্টেম না থাকলে তুমি ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াতে পারতে সারাক্ষণ? আজ মা অসুস্থ। একা সব সামলাচ্ছি। তুমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়িতে নেই।''
'' একা সামলাও? তাই? তোমার আর পিয়ালীর সঙ্গে সম্পর্ক আমার কানে আসে না? মাসে মাসে ক্যালিফোর্নিয়া ট্যুর। কেন? এগুলো বুঝি না আমি ? তখন তোমার মায়ের দেখাশোনা কে করে শুনি? ''
'' এত কিছু জেনেবুঝে এক সঙ্গে আছ কেন? ভেঙে ফেলো বিয়েটা। ভেঙে ফেলো। কে বারণ করেছে?'' পীযূষের গলা আরও এক ধাপ উঁচু।
'' সেই। বিয়েটা ভাঙলে তো সুবিধেই হয় তোমার। বুঝি না আমি ভেবেছ? … চেনো না আমাকে তুমি পীযূষ। লোকের সামনে সাধু পুরুষ সেজে থাকবে। তলে তলে শয়তানি বুদ্ধি। আমি বেরিয়ে গেলেই পিয়ালীকে ঘরে ঢোকাবে। তাই না? আর ক'টা বিয়ে করবে? প্রথমটাকে তো সামলাতে পারলে না। নিজের ব্যর্থতা চোখে পড়ে?''
পীযূষ হাসছে। অট্টহাসি। বলল,” আমি ব্যর্থ? বটে বটে। নিজে কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছিলে। বর মারত। মনে পড়ে দিনগুলো? আমাকে বলছ ব্যর্থ আমি? লজ্জা করে না? তখন আমাকে প্রেমে ফেলে এই দেশে রয়ে গেলে। কলকাতায় তখন থাকলে কোথায় ঠাই পেতে? এখন আমার দেওয়া লাইফস্টাইল ছেড়ে যাবে-টা কোথায়? কোনও জায়গা আছে যাওয়ার? না আছে বাপের বাড়ি। না কলকাতা শহর। না বন্ধুবান্ধব।পাড়ায় কেউ যে তোমাকে সহ্য করতে পারে না, বোঝো নিশ্চয়ই। নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়ে। আমাকে ব্যর্থ বলছে!''
রাইমার মেয়েটা কাঁদছে। “ জাস্ট শাট আপ! '' রাইমা চিৎকার করে পীযূষকে থামাতে চাইল,” বাচ্চা মেয়েটার সামনে...''
'' এখন বাচ্চা মেয়ে। নিজে যখন আমাকে অপমান করছিলে? মনে ছিল না, মেয়েটা এখানে বসে খেলছে?'' রাইমার মেয়ে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল।
আমি সহ্য করতে না-পেরে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। যদি আমাকে দেখে চুপ করে ওরা। বাচ্চাটার কান্নায় আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি।
'' তোরা পাগল হয়ে গেছিস? '' বেসমেন্টে পৌঁছে চেঁচিয়ে বললাম রাইমার দিকে তাকিয়ে। রাইমার মেয়েটা আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। ফোঁপাচ্ছে মেয়েটা। পীযূষ কী একটা বলতে শুরু করেছিল।
''একদম চুপ। একটা কথাও বলবে না। ইউ লস্ট ইওর ডিগনিটি। কাকিমা সুস্থ হয়ে উঠুক।কিছু লাগলে জানাবে। ওপরে যাও তুমি।'' আমি পীযূষের দিকে আঙুল তুলে বললাম।
পীযূষ বলল,“ তুমি সব জানো না। আমার কথাটা শোনো। শি ইজ...'' পীযূষকে আরও জোরে ধমক দিলাম,'' আর একটা কথাও বলবে না তুমি। প্লিজ গো।''
কয়েক মাস আগের ঘটনা। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পীযূষ আমাকে টেক্সট করেছিল। ওর জন্মদিন ছিল সেইদিন। নানা কথায় বোঝাতে চেয়েছিল ও আমাকে চায়।
কীভাবে চায়? এখন তো চাওয়ার অনেক রকমফের থাকে। মন চায়, না কি শরীর? বলেনি। চটজলদি বলার ছেলের পীযূষ নয়। রয়েসয়ে আগুনে হাত সেঁকতে হয়।ও জানে।চোখের চাউনি দেখলেই বোঝা যায়।
পীযূষের সাদামাটা গড়নে বুদ্ধিদীপ্ত চোখটাই আকর্ষণীয়।
আমি বার বার লিখছিলাম। আসি এখন। আসি এখন। যতবার লিখেছি। ততবার পীযূষ আমাকে আটকে দিয়েছিল। তারপর শেষে বলেছিল,” ডোন্ট গো। আমার হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে যাক। তার পর চলে যেও।''
সেই রাতে পীযূষের সিগারেট কখন শেষ হয়েছিল আমি জানি না। কেননা, আমি আর একবারও লিখিনি, আসি এখন। পীযূষও জানতে চায়নি আমি স্ক্রিনের এপারে জেগে আছি, না ঘুমিয়ে পড়েছি।
মাঝে অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে। পার্টি, ক্লাব - কোথাও পীযূষের সঙ্গে দেখা হলে আমরা একে অপরকে এড়িয়ে গিয়েছি। চোখে চোখ আটকে যাওয়ার আগেই খুব স্ট্রাটিজিক্যালি সরে গিয়েছি।
আজ এত দিন পর '' প্লিজ গো '' বলতে পীযূষ আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল। চশমা খুলে চোখ মুছল। তার পর বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
রাইমা এসে আমার বা-কাঁধে মাথা রাখল।কাঁদছে।সেই থেকে কেঁদে চলেছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
আমার কোমর জড়িয়ে রয়েছে রাইমার সন্তান। আমার কাঁধে রাইমার কান্না। বড় বড় নিঃশ্বাস।
আমি কাকে সান্তনা দেব? কী বলব? আমি না রাইমার ওপর রেগে থাকতাম? কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও আমার না অসহ্য লাগত ওকে? আর এখন? এখন কেমন লাগছে?
কী করব আমি? কী করা উচিত আমার? কোন চিহ্ন বসাব এখানে? যোগ না বিয়োগ? ঋভুর মতোই বুঝতে পারছি না।কনফিউজড।
কাকে জুড়ব জীবনের সঙ্গে? কাকে ছেঁটে ফেলে দেব? কোন সমীকরণ কষলে জীবনে এই অঙ্কের দু'দিক সমান হবে?
সোফায় একটুক্ষণ বসি ওদের নিয়ে। দু'জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই? পা বাড়িয়েছি সোফাটার দিকে। এমন সময় রাইমার মেয়ে খামচে ধরল আমাকে।পীযূষের টোনে ধরা গলায় বলল,”ডোন্ট গো।''