ভারতজোড়ো যাত্রায় আমি যোগ দিয়েছি পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে এবং আমি শেষ যাত্রী হিসাবে শ্রীনগরে গিয়ে লালচকে পৌঁছেছি আর আমার দেশের জাতীয় পতাকা জড়িয়ে রেখেছি সেদিনে এবং এদিনেও।
এই যে যাত্রা কালের একটি অভিজ্ঞতা আমার মনের ভিতরকে তোলপাড় করে তুলেছে তাই লেখা। লেখার শেষে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে আসা যাবে এটাও আমি মনে করি। সাত সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারীতে যে ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু হয় সেই যাত্রায় প্রথম থেকেই অংশ নিতে পারলে হয়তো খুব ভালো হতো আমার জন্য। সব কিছুর গুরুত্ব সবার আগে বুঝে নিতে পারলেও ব্যক্ত করার জন্য কিছুটা সময় কিছু মানুষের তো দরকার হয়ই। রাহুল গান্ধি ২০১৯ সালে বা তার পরে বা আগে পশ্চিমবঙ্গে একাধিকবার এলেও আমার তাকে দেখতে যাবার বা তার কথাশোনার জন্য আগ্রহ কনোদিনই হয় নি। তেমন আগ্রহ তৈরিই হয়নি। আমাদের রাজ্যে জুড়ে নানা ধারায় রক্ত বয়ে যায় তা দাঙ্গার জন্য না হলেও একধরনের দাঙ্গা তো বটেই। কাঁধে যারা নানা রাজনৈতিক পার্টির জোঁয়াল নিয়ে দৌড়ায় তারা যে কি মহোগ্রস্ত! কি জানি তাদের কানে কানে কি যে বলে দেয় মহামন্ত্রী মহাশয়েরা এবং সেই মন্ত্র যে নিততান্ত মিথ্যে তা জানার পরেও বুক চিতিয়ে দাদার হয়ে দিদির পক্ষে গুলিকে ডেকে নেয় গুলিবিদ্ধ হয় বাঁশের বাড়িতে রডের বাড়িতে মাথার ঘিলুকে মাটিতে মাখিয়ে দিয়ে রক্তের বিছানায় চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে কেনো জানি না! কিসের আশায় কোন স্বাধীনতার জন্য? নাকি পেটের ভাতকে এই রক্তের কাছে বন্ধকি দিতে হয় তাদের! এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি।
আহা আমাদের দেশের মানুষ, আমার পাশের মানুষ! এই ব্যাথা নিয়েই বসে বসে দিন গুনি— একদিন আসবেই সেই রোদমাখা দিন, যেদিন সবার পাতে গরম ভাত আর থাকবে হাতে হাত। কিন্তু কি মুস্কিল এটা বুঝিনি যে তার জন্য পথে নামতে হয়। পথে যে নামিনি তা নয়। নেমেছি বলেই না জগদ্দল পাথরগুলো সরিয়েছি। কিন্তু এই পাথরগুলো যে লাইন দিয়ে আছে সেটা বুঝিনি এবং তারা যে ভাব ভালোবাসায় একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটা বুঝিনি। ভেবেছিলাম একটা সরালে আর পাথর নেই অন্তত পক্ষে। আমরা পরবর্তী সময়টাকে সাজাতে পারিনি এই জন্য যে আমাদেরই পরার্থপরতার অভাবে। সেদিন যদি আন্দোলনের পরেই পরিবর্তন এবং তার পরে থেমে না থেকে আবার আন্দোলন করতাম তাহলে হয়তো আমাদের এই ভাবে ভাতের কাছে রক্তকে বন্ধক রাখতে হতো না। যারা পারে কুভাবনাগুলোকে সুভাবনায় বদলে দিতে তাদের নিরন্তরতার অভাব। আমাদের এতোবড়ো দেশে প্রতিটি ঢেউয়েই আছে কুটো আর সেটাকে গুঁড়িয়ে জলে মিশিয়ে না দিলে জল যে তাকে হজম করতে পারবে না সেই দিকে সুনাগরিক নজর দিতেই চায় নি। তাই বার বার আমাদের পদস্খলন। আমাদের চলার পথে বার বার পা মোচকে গেছে আর তার পরিণতি সিদ্ধান্তে পৌচ্ছানোর রাস্তা আমাদের সামনে পড়ে থাকলেও চলার ক্ষমতা হারিয়েছি।
রাস্তাই যদি সমাধানের রাস্তা হয় আর সেই রাস্তায় যদি কেউ চলতে চায় তাহলে বাড়িতে বসে থাকা কেন? এই কথাটা আমার মনের ভিতরে বারবার ঘুরপাক হতে থাকে আর আমার সিদ্ধান্তের বিলম্বিত হতে থাকে। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম যে পথের ডাকে বেরোতেই হবে, তাই বেরিয়ে আসা।
১৬ই জানুয়ারি থেকে ভারতজোড়ো যাত্রায় অংশ নিয়েছি। কলকাতা থেকে দিল্লি, সেখান থেকে পাঞ্জাবের অমৃতসরে নেমে নাম না জানা নানা গ্রামের ভিতর দিয়ে পৌঁছলাম জলন্ধর। আমি সকালের যাত্রায় অংশ নিতে পারিনি তাই রাস্তায় অপেক্ষা করছি বিকেল তিনটে থেকে— যে যাত্রা শুরু হবে সেই য়াত্রায় গিয়ে পা-মেলাবো। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শীত যাবো যাবো তবুও সেই বাঙালির অতিথি বিদায়ের মতো, বিদায় বলেই আবার কিছুটা এগিয়ে যাওয়া ছাড়তে আর চায় না। জলন্ধর হাইওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি চারিদিকে অনন্ত ফাঁকা মাঠ হাওয়া চলছে তীব্রগতিতে, তীক্ষ্ণশীত মাখানো সে হাওয়া। পাঞ্জাবের সবুজ বিল্পব নিয়ে কতোই না পড়তে হয়েছিলো সেই পাঞ্জাবে এসে গেছি। চারিদিকে সবুজ মাঠে লাগানো হয়েছে গম যব আর আছে আখ। মাঠ সবুজ থেকে সবুজতর, চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে দূরে আখের মাঠেরা মাথায় গভীর সবুজ পাতা নিয়ে হাওয়াতে দোল খাচ্ছে। আমি তো গ্রামের মেয়ে, মাঠ থেকে আখ ভেঙে খাওয়ায় পটু ছিলাম। আখ খেতে খেতে কয়েস ছিঁড়ে যেত। কিন্তু এক খড়কি আখ যে অমূল্য সম্পদ সে যারা এমন হাড্ডাহাড্ডি লড়ায় করে আখ খেয়েছে সেই জানে। কে কাকে চেনে, আমি তো একেবারেই অপরিচিত এই মাঠের কাছে, মানুষদের কাছে। আমার কাছে কোনো প্রতীক নেই যা দেখে বুঝবে আমি আমি কে। পা বাড়ালাম মাঠের দিকে আখ ভেঙে খাবো। তবে আর যাই হোক বাঙালি যেভাবে আমাদের তাড়া করতো নিশ্চয় সেভাবে কেউ তাড়া করবে বলে মনে হল না। আমায় মাঠের দিকে এগোতে দেখে রাস্তার ওপাশ থেকে একজন এগিয়ে এসে বললেন, এই আখ ভেঙে বের করা এতোটা সহজ হবে না। আপনি কি যাত্রী? আমি বললাম হ্যাঁ যাত্রী। সেই ব্যক্তি বললেন, হারা লোক হ্যাঁয় থোড়া রুখিয়ে হাম গেন্না দেতিহু। হামারা রাহুলজি- গেন্না তোড়কে খায়া।
সেই সব ছবি রাস্তার দুপাশে ব্যানারে দেওয়া আছে। আমাকে আখ এনে দিলে আমি সেই তেমনি করেই ছিলতে থাকলাম এবং খড়কি বানিয়ে খেতে থাকলাম। দেখি হলুদ জাকেট পরা যাত্রীর দল এগিয়ে আসছে। তাদের ব্যানারে লেখা আছে সিভিল সোসাইটি। দেশ বাচানোর জন্য বেরিয়েছে, সংবিবিধান বাঁচানোর জন্য যাত্রায় বেরিয়েছে। আমি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গেছিলাম তাদের একজন এসে আমাকে যাত্রার ভিতরে নিয়ে গেলে আমি তাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে থাকলাম। তখন আমার হাতের আখ আর একজন যাত্রী কখন যে নিয়ে নিয়েছে টের পায়নি। আমাকে ব্যানারের পাশে থাকতে নির্দেশ দিলে তাই করলাম। এই পা মেলানো একটু অসুবিধাজনক হয়েছিলো প্রথম প্রথম। খুব বেশি সেদিন হাঁটতে হলো না। কারণ সকাল ছ’টার যাত্রায় তারা ঊনিশ কিলোমিটার হেঁটে নিয়েছেন, তাহলে মাত্র পড়ে আছে ছয় কিমি। হনহন করে হেঁটে চলেছে সকলে। আমি সেই তালে পা মিলিয়েছি। সিভিল সোসাইটি সবার আগে, তারপরে আছেন জননেতা জয়রাম রমেশ, সেবাদল তারপরে আছে বাজনার দল তারপরে আছে কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী, তারপরে আছে পুলিশ-মিলিটারি-প্যারা মিলিটারি নিরাপত্তাকর্মীর মিছিল। মিডিয়া আর ওই ঘেরার ভিতরে আছে রাহুল গান্ধি এবং আরো অনেকেই। হাঁটা নাকি দৌড়ানো? দুটোই দেখতে পাচ্ছি। মানুষের ভীড় দেখতে পাচ্ছি রাস্তার দুপাশে। পুলিশ নিরাপত্তার জন্য মানুষের ভীড়কে লাঠি দিয়ে তাড়া করে ছত্রভঙ্গ করছে। কাউকে চিনি না, আমার সঙ্গে কোনো বাঙালি নেই পরিচিত নেই। কেবল ভারত জোড়ো যাত্রী হিসাবে আছি কিন্তু কোনো আইকার্ড নেই। পুলিশ আমার কাছ পর্যন্ত আসার আগেই হাঁটা শেষ হয়ে গেল।
সিভিল সোসাইটির মানুষেরা চা-পান করার জন্য একটি চায়ের দোকানে জমায়েত হলে আমিও সেই দলে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রথম দিনে যাত্রা শুরু হতেই শেষ হয়ে গেল। যাত্রীরা ঝুলঝুল করে দৌড়াচ্ছে তাদের টেন্টের দিকে। না কাছেপিঠে কোথাও নেই, আছে তিন কিলোমিটার ভিতরে। বাস দাঁড়িয়ে আছে এম্বুলেন্স ট্রাক যে যাতে পারল উঠে পড়লো। আমি বুঝছি না কি করবো কোথায় যাবো। একটা কার এনে রামনভাই বললেন, আসুন এটাতেই যেতে হবে। বলা হয়নি, অমৃতসর থেকে এই রামনভাই আমাকে তার গাড়িতে লিফট দিয়েছেন। তিনি এই যাত্রার যাত্রী। আসলে রাস্তায় আসার পথে অনেক কিছু দেখেছি, পাঞ্জাবের লোক সংস্কৃতির আকিবুকি, চৌকিধানি পথের ধারে কত রংবেরঙ্গের সিফন শাড়ি দিয়ে সাজানো বিয়ের প্যান্ডেল টায়ার ঝোলানো গাছে পাখিরাও কিছুটা হলেও বড়ো। হ্যাঁ যা বলছিলাম, সূরযের ডুবে যাওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম আজকে অনেকদিন পরে। রামন আমাকে গাড়িতে উঠতে বলামাত্র উঠে পড়লাম তার কারে। যেখানে ক্যাম্প করা হয়েছে সেখানে গিয়ে পৌছাতেই পুলিশের দল এসে হাজির। গেটের পর গেট বসানো সব্বাইকে তার ভিতর দিয়ে যেতে হবে। আমি যাচ্ছি আমার কাছে তো পাশ নেই কি হবে? আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ক্যাম্পে প্রবেশের পাশ কোথায়? কোন আইডেন্টিফাই করেগা হামকো? হ্যাঁ সেকথা ঠিক। অপেক্ষায় আছি গাড়ির ভিতরে থাকার জন্য তেমন করে আর ঠান্ডা লাগছে না কিন্তু বাইরে বেরলেই কাঁপুনি দিয়ে ঠান্ডা লাগবে। কিচ্ছুক্ষণ পরেই উয়াই উয়াই মহাশয় নিজেই এলেন এবং আমাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। দুই দিকে ক্যাম্প করা আছে। একদিকে সিভিল সোসাইটি আর ঠিক তার পাশে নিজের আগ্রহে যারা এই যাত্রায় যোগ দিয়েছেন তাঁরা থাকবেন। আর আধা কিমি দূরে আর একটি ক্যাম্প হয়েছে যেখানে রাহুল গান্ধি এবং কংগ্রেসের সেবাদলের ছেলে মেয়েরা থাকবেন এবং তাঁরা কন্টেনারে থাকবেন। আমার জায়গা হলো একটি আখের মাঠের চাতালে। বিশাল ক্যাম্প। এক সঙ্গে দুইশো লোকের ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আলোর অভাব রাখেনি। ক্যাম্পের ভিতরে প্রবেশ করতেই অনেকদূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়। লোহার পাত দিয়ে ব্যারিকেট করা আছে, তার উপর দিয়ে পাতলা রঙিন কাপড়ের বিভাজন। বলা যেতে পারে একই রঙের তোশাক থাকলেও একই রঙের লেপ ছিলো না।
মেয়েরা আছে দেখলাম গুনে গুনে কুড়ি বাইশটা হবে। আমি তাদের কাছে গিয়ে বসলাম। পাঞ্জাবি মেয়ে থেকে কেরালা, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, রাজস্থান, হরিয়ানা দিল্লির মেয়েরা আছে। কে কতটা হেঁটে এসেছে এই নিয়ে কথা চালাচালি হাসাহাসি চলছে। এদিকে এরই ফাঁকে কে কোথায় কিভাবে ঘুমাবে তার একটা হিসাব চলছে। আমি এখুনি নিজের কোনো কিছুই গুছিয়ে নিতে পারছি না, ব্যাগ পোটলা গাড়িতে রাখার কথা, গাড়ী মানে বাস, সেই বাসে নিজেদের সামান রেখে আসতে হবে আর শুধু কয়েটি জিনিস নিয়ে থাকতে হবে যেমন টুথব্রাস, পেস্ট, গামছা সাবানি— নিজের নিজের মেডিসিন ইত্যাদি। আমি তো সব লাগেজ নিয়েই এসেছি তাহলে আর সেগুলোকে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার নেই তাই পায়ের কাছেই রাখলাম। বন্ধুদের দু-একজন বলে দিয়েছে “দুজোড়া জুতো নিয়ে যাস। রেনকোর্ট নিতে ভুলিস, না-বেশি লাগেজ করিস না, পেটখারাপ, ঠান্ডা সর্দিজ্বর মাথাব্যাথার অসুধ নিতে ভুলিস না। হাত কাঁধ যত খালি থাকবে বিদেশ বিভুয়ে তত ভালো।” আমি সেসব কথা মেনেই কম লাগেজ নিলেও কি করে যে দুটো ব্যাগ হয়ে গেছে। হাল্কাতো নয়ই বেশ ভারি। ভাবছি এই দুটো লটবহর নিয়ে চলতে হবে। কিন্তু অনেকেই নিশ্চিন্ত করেছেন সব মালামাল বাসে রেখে তবে হাঁটা। ভালোই হল। অনেকক্ষণ এসেছি চা পান করার বাসনা ছিলো না কিন্তু হঠাৎ করে এ বাসনা বেড়ে গেল। এদিকে যে তীব্র ঠান্ডা আর সেই সাথে বাতাস। হায়রে কি করি এবারে! এ ঠান্ডার মুখোমুখি যে কোনো দিন এর আগে হইনি। মেয়েরা কেউ আর হাতমুখ ধোবার ইচ্ছা প্রকাশ করে না। ক্যাম্পের বাইরে বেরিয়ে এসেছি দেখি কিছু দূরে মোবাইল টয়লেট সারিসারি স্থাপন করা আছে। ভিতরে ঢুকি তার সাধ্য নেই। যদিও নিজের গোদা শরীরকে আগের চেয়ে অনেকখানি শুকিয়ে নিয়েছি তারপরেও সেই টয়লেটে সরানড়ার জায়গা যেমন নেই তেমনিই অপরিচ্ছন্ন। তাহলে কি গাড়ু হাতে মাঠ সারতে যেতে হবে! সাপের ভয় আছে। পাঞ্জাব আবার নাম জলন্ধর কি জানি কি জলনে পড়বো! মনে মনে হাসি আর ভাবি তাহলে উপায়! কিছু করার নেই। মাথাকে বোঝালাম একটু তুমি নারভকে বলো ধরে রাখতে। তাহলে আমাকেও কিছু করতে হয়। আমি চা পানের বাসনা ত্যাগ করলাম এবং দূরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম একদল পুরুষ গান ধরেছে। এখনো কারোর সঙ্গে আলাপ হয়নি। দু-একজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাঁসি বা বোকার মতো তাকিয়ে থাকি। এটা আমার স্বভাব। গান হচ্ছে, তাহলে সেদিকেই যাই। সেদিকে এগোতেই দেখলাম এখানে যে চা পাওয়া যাচ্ছে। আর কারো কথা শুনলো হাত-সে হাত বাড়িয়েই দিলো চায়ের কাগজের কাপের দিকে। এন্তার ভুলে গেলো সেই সব মোবাইল টয়লেটের কথা।
দেখি হরিয়ানার মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে। তখনো তাদের নাম জানা হয়নি। এদিকে যে বদ অভ্যাস আছে যখন কেউ নাম বলে তার তখন আমার মন হাঁ করে অন্য কোথাও অন্য দিকে চলে যায়। সুতরাং এক নাম বেশ কয়েক বার বলা এবং ব্যবহার না করলে কার নাম কার দিকে লিখিয়ে চলে আসি। এনআরসি আন্দোলন করতে গিয়ে বুঝেছি ওই সব বিসিএস দেরও অ আ ক খ করে অন্তত বার চল্লিশেক লিখে দিলে অবে তিন অক্ষরের বাংলা নামের বানান ঠিক হয়। সেই সঙ্গে চলে গালাগাল ঝগড়া বাবা তুলে বর্ণপরিচয় শেখানো আর বীরভূম মানে তো জানেনই কিছু দোষ না পেলে সেই সব আফিসারেরা গাঁজার কেশ ঠুকে দেন! কি যে মুসিবতে পড়েছি ভাই কি বলব। সেই হরিয়ানার মেয়েগুলোর হাতে গাড়ু দেখতে পেলাম, তবে গাড়ুগুলো এখানে দেখতে একটু অন্যরকম। লম্বাটে জলের বতোল। হ্যাঁ এতেই কাজ হবে, তাঁরা যাচ্ছেন মাঠ সারতে। আমিও পিছু নিলাম।
ফিরে এসে দেখি পা’দুটো যে কার কে জানে, নড়েও না সড়েও না। সান অবসান অসান সব হয়ে পড়ে আছে। কার আবার আমারই সে চরণদুখানিকে। অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে তুলে বললাম— বাচ্ছা হাঁটতে এসেছো এই সবে ছয় কিলোমিটার হেঁটে এসেই তুমি যদি ডাইনে বলদের মতো গোত্তা মেয়ে পড়ো তাহলে তো চলবে না, কথা শোনো ওঠো চলো ওই দিকে রাতের খাবারের ব্যবস্থা আছে। হরিয়ানার মেয়েরা আমাকে আর ছাড়ে না। চালিয়ে ব্যাহেনজি খানা উধারই হ্যাঁয়। বার বার পায়ে হোঁচট লাগছে কারণ নিচে তো গেন্নার মুড়ো আছে তার উপরে শতরঞ্জি পেতে দিয়েছে সুতরাং হোঁচট লাগা আর ঠান্ডায় পা-অসাড় হয়ে যাবার কারণেই এই অবস্থা। খাবারে ঘর অনেক অনেক বড়ো। ঘর মানে ওই ক্যাম্প। টেবিল চেয়ার পাতা আছে। নিজে নিজে খাবার নিতে হচ্ছে। ভাত আছে রাজমার ডাল পনির ক্যোড়ি রাইতা গোলাপ জামুন। ওদিকে পিচের ড্রামগুলোতে উনুন বাবানো আছে সেসব নান তন্দুরি বানানোর জন্য। চারটে চুলো হা হা করে আগুন ছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই দেখি আগুন নিভে গিয়ে আঙ্গার হলো এবং ক্রমশ কিছুটা নিভুনিভু হয়ে গেলে। দেখি চুলোর ভিতরের দেওয়ালে যে পুরু অংশ আছে সেগুলো আগুন রঙ্গা হয়ে উঠেছে। চার জন ছেলে হাতে মোটা কাপড় নিয়ে সেই আটার লেয় হাতে থাপড়ে সই চুলার ভিতর গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই লম্বা শিক নিয়ে খুঁচিয়ে তুলে আনছে। মড়মড়ে রুটি আর ভাপ ওঠা পণীর বড়ই তৃপ্তি করে খেলাম। এমন ঠান্ডায় কোন এক আইস্ক্রিম মালিক যাত্রীদের জন্য আইস্ক্রিম পাঠিয়েছেন। মানুষ কাঁপতে কাঁপতে হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে আইস্ক্রিম।
এখনো পনেরো দিন সামনে পড়ে আছে ৪০০ কিমি রাস্তা। বাঙালি আর একজনও নেই এই ক্যাম্পে। একটি আইস্ক্রিমের জন্য কিনা করতে হলো আমাকে যাই হোক আমার জীত হল, হাত আর বাড়াতেই পারলো না। সোজা ঘুমানোর ক্যাম্পে এলাম। দেখি অন্য দৃশ্য। মনে হচ্ছে দেশ ভাগ হয়ে গেছে। আগুনতি মানুষ রাতের আঁধারে পালিয়ে এসে গাঢাকা দিয়েছে এই মাটির ভিতরে। একজন পুরুষ বসে আছে, সে জানালো মেয়েরা একেবারে ভিতরে চলে যাও এতোগুলো লেপ তোশাক পেরিয়ে যেতে হচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে কারোনা কারো গায়ে পা পড়ে যাচ্ছে। আও মাও করে চিৎকার করলে বুঝতে পারি রাস্তা কোনটা। নিজের বিছানার কাছে পৌঁছালে দেখি সেই মেয়েরা সারি দিয়ে শুয়ে পরেছে। আহা আমিও একটু ঘুমাতে চাই। তাদের পাশ গিয়ে একটি তোশকের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। মনে হলো আমি শীতে রোদ না-পাওয়া কোনো পুকুরের জলে নামলাম। বাবা গো বলে চিৎকার করলে পাশের সেই হরিয়ানার মেয়েরা হোহো করে হেসে উঠোলো। বললো, চিল্লাও মাত কিউ কি থোড়াদের বাদ আইস্তে আইস্তে গরম হো জায়েগা। কি করি সয্য করতেই হলো। অনুভব করলাম আস্তে আস্তে একটু ঠান্ডা কমে এলো। তবে একটা কথা বলা দরকার বাংলার মানুষের ঘরে যে রেজায় লেপ আছে তা এখানে নেহি চ্যালেগা। এযে এক এক টা দেওয়ালের সমান ভারি। পাশ ফিরে শুতে নড়ে ওঠা বেশ কঠিন। কিচ্ছুক্ষণ পরে একদল যুবক চিৎকার করে ওঠে “জোড়ো জোড়ো ভারত জোড়ো”। ভাবলাম এই সবে চোখ লাগছে কি জানি এই চিৎকার কতক্ষণ চলে। যেই চোখ লাগে আবার শুনতে পায় সেই চিৎকার করা যুবকেরা লোহার পাতের ওপাশে যে রঙিন কাপড়ের পর্দার দেওয়াল দিয়ে বিভাজন করা আছে আমাদের ক্যাম্পের সঙ্গে, তার ঠিক ওপাশে এসে তাদের ক্যাম্পে শুয়ে পড়লো। ওরা যে গল্প করছে আমরা তা সব শুনতে পাচ্ছি। হরিয়ানার মেয়েরা হি হি করে হেসে উঠোলো। কারণ ওরা নাকি পাঞ্জাবিতে কথা বলছিল যার মানে আমি বুঝি না। মেয়ে দুটো ওদের ধমক দিলে ওরা তাদের চিৎকার থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।