পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

যাত্রা কথা: তিন

  • 21 February, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 894 view(s)
  • লিখেছেন : আয়েশা খাতুন
‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র অন্তিম পর্বে যোগ দিয়ে তিনি হেঁটেছেন পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত। জলন্ধরে হাঁটা শুরু করে শ্রীনগরের লালচকে যাত্রাশেষে রাহুল গান্ধির জাতীয় পতাকা উত্তোলন পর্যন্ত অনন্য অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন তিনি। চার পর্বের এই যাত্রাকথনের এটি তৃতীয় পর্ব।  

হিমাচল পেরিয়ে গেছি। হিমাচল আর জম্মুর মাঝে সে এক রবি নদীর সেতু, সেখানে মশাল হাতে দুপক্ষই আছে দাঁড়িয়ে। এদিক থেকে হিমাচলের মানুষ মশাল জ্বেলে সীমানা পার করে দিচ্ছে আর ওদিক থেকে জম্মুর মানুষ মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে সেই ব্রীজের মাঝে রাহুল গান্ধিকে আর ভারত জোড়ো যাত্রার যাত্রীদের বরণ করে নেবার জন্য। ভালোবাসার খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নতুন আঠোরো বছর বয়স। এই যে মানুষের মধ্যে চেতনা জেগেছে সেই চেতনার প্রদীপের সলতের মুখে কিন্তু এই যাত্রীরা একটু আগুন দিয়ে দিয়েছেন। এই ভালোবাসার প্রদীপ এই ভালোবাসার আগুন যেন হিংসামুক্ত ভারত গঠনের উজ্বলতম উদাহরণ।

হিমাচল প্রদেশের সীমান্ত পার হলাম রবি নদীর ব্রীজ দিয়ে আগেই বলেছি। কিন্তু আমার যে নানা দোষ! আমি যে কি ভালো লাগায় কাকেদের ওড়াকেও হাঁ করে দেখি— ওপরে জম্মুর দুর পাহাড় ঘেঁষে মেঘের সারি আর ঠিক তার উল্টোদিকে সূর্যাস্ত পাখিদের বাসায় ফেরা সব যেন আমাদের বাংলার মতোই। একটি নতুন দৃশ্য দেখলাম-রবি নদী উত্তর পাড় থেকে একদল ঘোড়া চরতে চরতে নদীর মাঝে বয়ে যাওয়া জলে লাফ মেরে পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো আর এক মেয়ে এক ঘোড়ার পিঠে চড়ে লাফিয়ে নদী পেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমি কোনো দিন দেখিনি। দেখেছি গরু ছাগল নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি দলছুট হয়েছি। ভাবতে শুরু করেছি এই মেয়ে কি সেই ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাই! হতেও পারে ভারত জোড়ো যাত্রার খবর পেয়ে হয়তো এই রবি নদীর ধারে নিজের ঘোড়াদের ট্রেনিং দিচ্ছিলো এবং ট্রেনিং নিচ্ছিলো! না হলে হতে পারে সেই ছোট্ট মেয়ে আসিফা যে ঘোড়া চরানোর ছলে আবার দেখতে চেয়েছে বিচারের বাণীর মালা।

 দলছুট যাত্রী বিভ্রান্ত হয়। তবুও আজকের দিনে পথ হারিয়ে হারিয়ে যাবো এটা একটু হলেও সম্ভাবনা কম। বুঝে উঠতে পারছি না আমাদের সিভিল সোসাইটি গ্রুপ কোথায়? চারিদিকে পুলিশ মিলিটারি। হয়ত আর আর কোনো আইবি, সিআইডি ইত্যাদি আছে। দলে দলে যুবক দূর দূর থেকে আসছে। হাতে মশাল। ভাবছি কি করবো। সামনে এসে হাজির এক সাংবাদিক। প্রশ্ন করলো, আপনারা তো ভারত তোড়তে তোড়তে আসছেন জুড়ছেন কোথায়? আমি নিজেই তোড়ে পড়ে আছি! বললাম, কন্যাকুমারী আমাকে অঞ্জলী ভরে জল দিয়ে বলল, আমার জল ভারতের মাটিতে ফোঁটা-ফোঁটা ফেলো— যেখানে ইন্দিরা গান্ধী, গান্ধীজীর রক্ত ছড়িয়ে আছে। এই জল রক্ত মিশে জুড়ে যাবে দূর্বা ঘাসে।

আমরা অন্তরে অন্তরে জুড়ে চলেছি ভারতের মানুষকে— আপনি কি করে দেখতে পাবেন এই জোড়া!
এখানেই শেষ করলে হবে না, অনেক কথা আছে বলার। বারবার বলে যাচ্ছি হিংসা বিদ্বেষ মুছে দেবার যাত্রা, সংবিধান বাঁচানোর যাত্রা, দাঙ্গা বন্ধ করার যাত্রা, রোজগার আনার যাত্রা, বেরোজগারি হঠানোর যাত্রা, তেরঙা ঝান্ডাকে দোরঙা করতে চায় দাঙ্গাবাজরা— এখানে পতাকা বাঁচানোর যাত্রা— রাষ্ট্রকে ধর্মের রাষ্ট্র করে দিতে চায়— এই রাষ্ট্রকে মানুষের রাষ্ট্রর জন্য যাত্রা।

জম্মুতে যাত্রা বন্ধ করে দেবার নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রিয় সরকার। হঠাৎ শোনা গেলো জম্মু শহরের কাছাকাছি পাঁচটা বোম্ব ব্লাস্ট করেছে। এখানে আতংকবাজ আছে, তাই কোনো যাত্রীর নিরাপত্তা দিতে পারবে না নিরাপত্তা বাহিনী। সুতরাং যাত্রা এখানেই সমাপ্তি ঘোষনা করতে হবে। কিন্তু সে কথা রাহুল গান্ধি যেমন শোনেন নি— অন্য যাত্রীরাও মানেননি। কাঠুয়া থেকে পাঠানকোট ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো যাত্রা। আশ্চর্য ভাবে মুষলধারায় বৃষ্টি নামলো। যাত্রীরা ভাবতে থাকলো কি করা যাবে? একদিকে ঠান্ডা আর একদিকে পুলিশি ভয়। উপর থেকে নামলো বৃষ্টি। কিন্তু কোনো বাধাই থামাতে পারলো না। সব কিছুকে ভেঙে দিয়ে এগিয়ে গেলো যাত্রা। তিনদিন যাত্রার পরে পৌঁছালো জম্মু শহরে। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে। উধমপুর যেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। উধোমপুর থেকে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে রাস্তা। হাঁটা খুব কঠিন ওদিকে। বৃষ্টি ছাড়েনি, সেও চালিয়ে যাচ্ছে। রাম্বান পৌঁচ্ছে আমাদের ক্যাম্প খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগেছে। রাত ১২টা জলের পাতলা পাতলা ঢেউ রাস্তায় বয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে। এক কোণে একটি জাগায় দেখা গেলো সেই ক্যাম্প। আমরা সেই ক্যাম্পে পৌঁচ্ছালাম। দেখলাম কোনো খাবার নেই, সব শেষ। যারা খাবারের ব্যবস্থা করেন সেই ছেলেরা এখন একটু ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা আবার রাত একটায় উঠবে সকলের জন্য নাস্তা তৈরি করে ভোর সাড়ে চারটেই দিতে হবে। বৃষ্টিও থামে না ক্যাম্পের চাঁদোয়া ফুকে বৃষ্টি ঝরছে। আমরা ভিজেছি। ভাবছি কি করবো সত্তরজন যাত্রী আছি। দেখলাম কয়েজন স্থানীয় মানুষ আমাদের জন্য রুটি সব্জি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই রুটি বেশ শক্ত, দাঁতে কাটতে বেগ পেতে হচ্ছে। কিন্তু চিবোতে চিবোতে একটা মজা পাওয়া যাচ্ছে। সকলেই সেই মজার রুটি তুলে নিয়ে নিভু নিভু আগুনে স্যাঁকতে থাকলো। সেই খাবারে  ছিলো বড়ো শান্তি। স্থানীয় মানুষ একটি ঘরের ব্যবস্থা করেদিয়েছেন থাকার জন্য। এই যে এই ব্যবস্থা স্থানীয় মানুষ করছে, এরা কি হিন্দু নাকি শিখ নাকি পন্ডিত নাকি এদের উপরে কোনো হিংসা হয়ে গেছে এই খবর জানি না। আবার তারাও জানেন না এদের মধ্যে কে সাঁওতাল আছে মুসলমান আছে দলিত আছে নাকি ব্রাহ্মণ আছে। এত রাতে এই স্থানীয় মানুষ যাত্রীদের কথা ভেবেছেন, তাঁরা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়েছেন, তাঁরা যাত্রায় বেরোতে পারেননি অংশ নিতে পারেননি কিন্তু তাঁরা চান দেশ থেকে হিংসার রাজনীতি বন্ধ হোক। আমদের তো থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কিন্তু যারা কন্টেনারে আছে তাদের নিশ্চয়ই খুব ঠান্ডা লেগেছে, রাহুল গান্ধির কন্টেনার বৃষ্টিতে স্নান করে যাচ্ছে। পরেরদিন ছিলো ছাব্বিশে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস। পতাকা তোলা নয় মেলা হলো খোলা হোলো ফুল ঝরে পড়লো। অনেকেই ভারত মাতা কি জয় ধ্বনি দিলে ভয় হচ্ছিলো মাঝে মাঝে কিজানি এখানেই কি আরএসএস ঢুকে আছে নাকি! পরে বুঝলাম, আসলে সব ধ্বনিকে হাইজেক করেছে বিজেপি। সেই সব বন্দি ধ্বনিগুলোকে মানুষের মাঝে মানুষের জন্য করে তুলছে।                   

 রম্ভান থেকে বাণিহাল এলাকায় এসেছি গতকাল রাতে। সন্ধ্যায় ছিলো এক ডিগ্রি তাপমাত্রা। রাত যত বেড়েছে তাপমাত্রা তত নেমেছে মাইনাস ৪ ডিগ্রিতে। বানিহাল পাহাড়ের উপরে সবুজ গাছগুলো বরফে ঢেকে গেছে। কোনো কোনো গাছ এখনও মুখ বের করে রেখেছে। স্তরে স্তরে পাথর সাজানো। কোনো কোনো পাহাড় সিলেটের মত সাজানো। সে পাহাড়ে কোনো গাছ নেই আছে ঘাস। আর তারা হলুদ হয়ে আছে। কি জানি কি হয়েছে বরফের সঙ্গে পাহাড়ের। কিছু পাহাড় কিছুতেই বরফের একটা টুকরোও নেয়নি নিজের উপরে। ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে। পাশাপাশি সমান উচু পাহাড় কেউ বরফ ঢাকা কেউ উদ্যম। কয়েকটি পাহাড় আকাশ থেকে যেনো মেঘের লেপ টেনে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। হুহু ঠান্ডা নাকি নীরব ঠাণ্ডা বুঝে উঠতে পারছি না। আসলে নীরব ঠান্ডার কথায় বলছে সকলে। যেই শুনলাম মাইনাসে যাবে তাপমাত্রা অমনি চুপ। শুনলাম কাল সকালের যাত্রা শেষ হবে কাশ্মীর গেটের কাছে এবং টানেল পার করেই আবার যাত্রা শুরু হবে। উঠতে হবে ভোর ৪ টে। অনন্ত বৃষ্টি পড়ছে। আমরা বার হলাম বরফে চলার জুতো কিনতে। ৭০জন যাত্রীর মধ্যে ৩০ জন কিনতে চলল। পেলাম একটা দোকানে আমাদের অনেকেই বর্গেনিং করতে চাইলে বানিহালের দোকানদার হেঁসে বললেন পারব না। যাই হোক মুখ চুনুমুনু করে ৫০০/ টাকা দিয়ে সেই জুতো কিনে নিলাম। সকলেই প্রাকটিস করে নিলাম জুতো পরে। জুতোর গঠন মিলিটারির জুতোর মত। সুতরাং চলাও যেন তাই। এক বীর চলে যাচ্ছি যেনো সে জুতো পায়ে। জুতো কিনে নিয়ে সন্ধ্যা হতেই খেয়ে শুয়ে পড়েছি। স্থানীয় মনুষের আসা যাওয়া। রাতের অন্ধকারে মেয়েরা স্নানের জন্য উৎসাহ দিতে এগিয়ে গেলো। গরম জলে স্নান সেরে নিয়ে রেডি। শুনতে পাচ্ছি ঝরঝর জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। ভাবলাম সারারাত বৃষ্টি হচ্ছে। আসলে তা না— পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে, তার শব্দ। মনের মধ্যে খুশি এলো, যাক আজ আর বৃষ্টি হবে না। হলো না। ফজরের আজান শোনা গেলো। একটা শেষ হতেই হতেই আর একটা শুরু। হোটেল তো নয় এটা হোমস্টে। ঘরের মালিক এসে চা দিয়ে গেলো আর সাথে একপিস করে পাউরুটি। সেটা খেয়েই আমরা পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিলাম। কারণ আগের দিনে নেতা বলে দিয়েছেন, আগামি কালকের যাত্রা দীর্ঘ, একটানা ২০ কিমি রাস্তা— এই পথে  কোনো খবর পাওয়া যাবে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি  যাবে তত তাড়াতাড়ি ওরা রুটি বানিয়ে দেবে এবং এই ভোরে রুটি খেয়েই সারা দিন থাকতে হবে। এলাকার সকলেই রাহুল গান্ধীর সঙ্গে হাঁটবে। ভোরে বেরিয়ে পড়লাম রুটি খেতে। রুটি খেয়ে হাঁটার জন্য উপস্থিত হতেই দেখি রোদ উঠেছে ঝিলিমিলিয়ে গাছের ডালে ডালে। সত্যিই অভূত অপূর্ব সুন্দর। নীল আকাশ নাকি নালী নীল পাহাড়! চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এই বানিহাল। বরফ ঢাকা তার উপরে শুরু হলো প্রবল হওয়া। বরফের হাওয়ার বর্ণনা যত কম করা যায় ততই ভালো। ডিপফ্রিজের ভিতরে মাথা ভরে দশ মিনিট রাখলে যে ঠান্ডা পাওয়া যাবে ঠিক তাই।

রাহুল গান্ধি আসতেই হাঁটার মাত্রা পাল্টে গেলো। আগেই বলেছি আমি সিভিল সোসাইটির মধ্যে হাঁটছি। চারিদিকে নানা স্লোগান মুখর। হাঁটা চলছে— ৩ কিমি পাহাড়ি রাস্তা কেবল উপরের দিকে ওঠা। হাঁপ ধরে যাচ্ছিল আমার কিন্তু ছাড়া হবে না। করেঙ্গে ই মরেঙ্গে এই শপথ নিয়ে বেরিয়েছি। কাশ্মীরের গেটে হাওয়া আরো তিনগুণ বৃদ্ধি পেলো। পায়ে হেঁটে টানেল পার হবার নিয়ম নেই। তাই বাসে বসেই টানেল পার হব। নতুন টানেলের দূরত্ব ১২ কিমি। টানেল পেরিয়েই দেখি অন্য জগৎ। এ কি দেখছি!  এ কি দেখছি! এ কোথায় এলাম! মুখে কথা নেই। আমি কি আকাশ থেকে আকাশে পড়লাম। মানুষের জমাট সারি দাঁড়িয়ে আছে আর সাদা বরফ আর বরফ আর বরফ আর কেবলই বরফ। এখানে পাহাড় কোথায়! এ যে হাজার আকাশের সাদা মেঘে মোড়া সমতলভূমি। শুকনো গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে যেন প্যাঁজা তুলোর বোঝা কাঁধে নিয়ে। ঝুর ঝার করে ঝরে পড়ছে। ঠিক সেই সময়েই মনে হচ্ছে বুঝি রানির খোঁপা থেকে মুক্তোর গোছা বাগানে ঝুপ করে খোসে পড়লো! একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বিবরণ আমি কার সঙ্গে কাকে দেবো! আমি কি দেখছি!

এই ভারত জোড়ো যাত্রার অন্যান্য পর্বগুলোর সূত্র।

https://sahomon.com/welcome/singlepost/jatra-katha:-one

https://sahomon.com/welcome/singlepost/jatra-katha:-2

https://sahomon.com/welcome/singlepost/yatra-katha-4

 

0 Comments

Post Comment