অনেকদিন পরে এমন একটা সকাল পেলাম। সুবিস্তৃত বিছানায় ঘুমিয়েছি আবার জেগেছি বেশ ভোরে। যাত্রীরা স্নান সেরে নিল। এত কঠিন হাওয়া এবং জল ছিল খুবই ঠান্ডা। বলা যেতে পারে বরফের আগের মুহূর্তটা। বালতি নেই-বাথরুম সীমিত। ভারতের সকল প্রদেশের মানুষ আছে। আজ রাতে বরফ পড়ার মতো অবস্থা। এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ছিল। টেন্টের ছাদ চুইয়ে জল পড়ছিল। কিন্তু বৃষ্টি ছিল না ছিল শিশির। এত শিশির পড়েছে এবং তা এত ঘন ছিলো তা আসলে কুয়াসা ছিলো। টেন্টের কাপড় ফুঁকে টিপিটিপি জল ঝরেছিল যার ফলে ভিজে গেছিল আমার লেপ, শুকনো জামা কাপড়ের ব্যাগ। আগেই বলেছি রেজায় এতো মোটা আর ভারি ছিলো সে এই ভিজে যাওয়া আমদের কাউকে টের পেতে দেয়নি। শুধু আমার না, এই টেন্টে যত জন ছিলাম সকলেরই। খুব অসুবিধা হয়েছিল মানুষের। এই যে ক্যাম্পের মধ্যে মেয়েদের জন্য আলাদা ক্যাম্প করা হয়নি একই ক্যাম্পে ঘুমিয়েছে— তাই বলে এখানে কোন অসুবিধা সৃষ্টি হয়নি। এই বিষয়টা আলাদা করে ভাবাচ্ছে। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন গল্পে আলোচনায় বলে এসেছি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেলে বলাৎকার শব্দের অবসান হয়। এই প্রসঙ্গে অন্য জনের কথা একটু বলি— জাপানের টোকিও শহরে ২০১৫ সালে আছি। বুলবুলের বাড়িতে। বুলবুলের স্ত্রী আমাকে একটা থ্রি বেডরুমের ফ্ল্যাট দিয়ে বললেন এখানে থাকো। সেমিনার শেষ হলে এই বাড়িতে এসে থাকি। কয়েকদিন পরে বুলবুলের স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি নাকি সারাদিন বাড়িতে বসে থাকো? বাইরে যাও না কেন? বলেছিলাম, বাইরের পরিস্থিতি মেয়েদের জন্য ভালো কিনা জানি না। তাই যাই না। অনেকক্ষণ ভাবলো। তারপরে বলল, না এই শব্দ অনেক দিন হল মুছে গেছে। একটা বিড়ালও তোমার পথ আগলাবে না। সত্যি তাই, তারপরে আমি একাই হিরোশিমা নাগাসাকি এমনকি জাপানের গ্রাম গুলোতেও গেছি নির্ভাবনায়। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো খুব জরুরি। এই ক্যাম্প তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহারণ।
এতো কষ্টের পরেও প্রত্যেকটি যাত্রী অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লাম। আবার হাঁটবার জন্য। সকাল ছয়টা থেকে যাত্রা শুরু করেন রাহুল গান্ধি। আমরা সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে গিয়ে বাসে বসেছি। বাস নিয়ে গেছে আমাদের সেই নির্ধারিত পয়েন্টে যেখান থেকে হাঁটা শুরু হবে। রাস্তায় উঠেই দেখি মানুষের সমাগম। সাড়ে চারটে থেকে কয়েম মিনিট পেরিয়েছে অমনি চারিদক অন্ধকার। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল অস্বচ্ছ কাচের ওপাশের ছবি দেখার মতো মানুষদের দেখা যায়। আমাদের নামতে হবে বাস থেকে। মেনেই দৌড়ালাম সামনের দিকে ব্যানার ধরতে হবে। এতো পুলিশ কেন? শোনা গেল রাহুল গান্ধির মায়ের শরীর খারাপ তাই তিনি গতকাল যাত্রা শেষ করে দিল্লি গেছেন আর মায়ের সঙ্গে দেখা করে রাতেই ফ্লাইট ধরে ফিরেছেন। বিমানবন্দর থেকে তিনি এই পয়েন্টে আসবেন। যাক আমাদের কাজ এগিয়ে যায়। সকলে পা মিলিয়েছি। রাস্তার দুপাশে মানুষ দেখলাম, এতো ভীড় যে মনে হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসছে। কোথাও জাতীয় পতাকা কোথায় কংগ্রেসে পতাকা, পতাকার আকাশ করে ফেলেছে। চারিদিকে একটাই শ্লোগান “ভারত জোড়ো ভারত জোড়ো”। আমাদের ডাকছে তাদের বাড়িতে, উপায় নেই পথে চলে যেতে হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে। কত স্লোগান— আমরা সবাই চাই ভারত জুড়তে, ‘ভারত জোড়ো’ একটাই স্লোগান। তোমরা ভাঙবে আমরা জুড়বো— ‘উও ডান্ডাসে তোড়েঙ্গে হাম ঝান্ডাসে জোড়েঙ্গে”— এমনি অনেক স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে এখনও রাহুল গান্ধির দেখা হয়নি। হয়তো হবে এক দু’দিনের মধ্যে। তবে যোগেন্দ্র যাদব মহাশয় সব সময়ে সঙ্গ দিয়েছেন। স্বরাজ আরেকটা বিপ্লবের নাম হবে আগামী দিনে, এটা এখানে এসে বোঝা যাচ্ছে।
যাত্রার পথ একদিন আগেই ম্যাপ করা হয় নিরাপত্তার কারণে। আগে থেকে কোনো ম্যাপ বলা হয় না, আগামীকাল কোন পথ দিয়ে যাবে। এটা ঠিক করে দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তবে প্রতিদিন যাত্রায় সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কত কিলোমিটার হাঁটা হবে এবং কতটা বিকেলে হাঁটা হবে এটা ঠিক করা থাকে। সকাল থেকে ঠিক থাকে যে, দশ কিলোমিটার হাঁটার পরে কোথাও একটু টি ব্রেক নিয়ে আবার ছয় কিলোমিটার হাঁটার পরে যাত্রা শেষ। দুপুরে টেন্টে বিশ্রাম ঘন্টা দুয়েক দুপুরের খাবার খাওয়া এবং তিনটে থেকে আবার যাত্রা শুরু। প্রতিদিন গড়ে ত্রিশ কিমি করে পথ চলতেই হবে। আজকেও তাই। কিন্তু আমার আজ দ্বিতিয় দিন হলেও প্রথম দিন। মনের ভিতরে একটু ভয় তো পাচ্ছি। কি করা যায় কি করা যায়। বাঙালি মন ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। আমাদের মাটিতে ৭৫ বছর অনেক গোবরের ছড়া পড়েছে। তাই সেই নেতাজি, প্রফুল্ল চাকি, নজরুল, চিত্তরঞ্জন দাস, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা, বিনয়-বাদল-দিনেশ, মাতঙ্গিনী হাজরার হাওয়া বাতাস একটুও পাইনি রে তাই আমার এমন দশা। যাই হোক আমি তো আবার যুধিষ্টির। মিথ্যে কইতে পারিনে তাই লিখলাম। দেখি আমার চেয়ে অনেক বয়স্ক মানুষ আছে যারা হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। জয় মা বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সবার আগে ব্যানার ধরে নিলাম। জোড়ো জোড়ো ভারত জোড়ো। সে ঝাঝালো শ্লোগানে মুখর বাতাস। কনকনে বাতাসে হাতের আঙুল শিকুড়ে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে ‘ছোটা কদম দৌড়কে চল’ সেই এনসিসি-র ক্যাম্পের কথা মনে পড়লো। ওই ভাবে কিছুটা যেতে গিয়ে বুঝলাম রাহুল গান্ধী ঠিকই করেছেন— টি শার্ট পরে হাঁটছেন। ধীরে ধীরে গরম লাগতে শুরু করেছে। প্রথমেই হাতের মোজা খুলে জাকেটের পকেটে ভরলাম কিছুদূর যেতেই মাথার টুপি খুলে পকেটে ভরলাম। একঘন্টা হাঁটা হয়ে গেছে— ছয় কিলোমিটার পেরিয়েছি। এবার জ্যাকেট খুললাম। রাখতে হবে কিন্তু উপায় কোথায়! সবাই হাঁটছে, দেখি সকলেরই একই অবস্থা। জ্যাকেট কোমোরে বেঁধে হাঁটছি। এক ঘন্টা হয়ে গেছে, বারো কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি। এবার চা খেতে হবে। রাস্তার দুপাশে চায়ের দোকান। আলাদা আলাদা গ্রুপের আলাদা আলাদা টি ব্রেকের স্থান। তা নাহলে রাস্তায় ভীড় জমে যাবে, যা নাকি নিরাপত্তারক্ষীরা সামলাতে পারবে না। মানুষ নাকি খেপে আছে বর্তমান শাসকের প্রতি। তাই এই অভিযান নাকি গান্ধিজির অভিযানের সমান।
এই সময় দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে একটা ছোটো লরি যাচ্ছে, বলা যেতে পারে ছোটো হাতির চেয়ে একটু বড়ো। সকলেই দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে জাকেট সোয়েটার তার মধ্যে ফেলে রাখছে। টি ব্রেকের মাঝে বেশ মজা হয়েছে। রাস্তার দুপাশে যার যত চেয়ার আছে পেতে দিয়েছে যাত্রীরা বসবে। সামনে চা চলে আসে বিস্কুট পাওরুটি টোস্ট। যার যা ইচ্ছা খেয়ে নিয়ে একটু জিরিয়ে নেয়। ফটো তোলে ভিডিও করে বাড়ির সঙ্গে কথা বলে। লিডার এসে হাঁক দেয়, ভারি নরম কন্ঠস্বর, ‘চলিয়ে ভাই বহেন সব চালিয়ে আউর ভি দশ কিলোমিটার বাকি হ্যায়।’ হুইসেল বাজিয়ে দিল বিনোদবাবু তিনি রাজস্থান থেকে চলেছেন। দূরে ড্রামের তালে তালে সারে জাহা সে আচ্ছে হিন্দুস্তা হামারা হামারা। দৌড়ে গিয়ে ব্যানার ধরে আবার চলছি। ফিরফির হাওয়া— সেই ঠান্ডা হাওয়া সোয়েটার খুলিনি। যদিও গরম লাগছে কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষেরা মানা করছেন, খোলা যাবে না ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। যাই হোক দৌড়ে গিয়ে ব্যানার ধরতেই জোড়ো জোড়ো ভারত জোড়ো। বাকি শ্লোগান মুখস্ত করতে আরো দিন তিনেক লাগলো। বাঙালি মানুষের জিহ্বা অত সহজে ঘোরে নারে তাই এক বলতে আর এক বলে ফেলছি। ওরা বলছে জোড়ো জোড়ো আমি বলছি ছোড়ো ছোড়ো। আমার ভারত ছাড়ো মুভমেন্টের কথায় মাথায় আসছে।
ওদিকে সাংবাদিকেরা ধেয়ে আসছে ইন্টারভিউ নেবার জন্য, উয়াই উয়াই এই ইনন্টারভিউ দিচ্ছেন, কখনো বুম এগিয়ে দিচ্ছে অন্যযাত্রিদের জন্য। সকলেই ভারতের হিংসা বিদ্বেষ তাড়াতে চায় মুছে দিতে চায়। দশের শত্রুর নিপাত চাই। খুব ভালো আমিও চাই। ততক্ষনে আবার ছয়কিমি হাঁটা হয়ে গেছে। এবার নাকি কিছুটা গেলেই আকাশে বেলুন দেখা যাবে। তাহলে সেই বেলুনের কাছে যাত্রা শেষ হবে এবেলার মতো। সত্যিই কিছুটা যেতেই বিশাল বেলুন আকাশে উড়ছে যে বেলুনে জাতীয় পতাকা, কংগ্রেসের পতাকা মহত্মা গান্ধি ইন্দিরা গান্ধির ছবি দেওয়া আছে। বিশাল ভারতের মানচিত্রের ভিতরে ভারত জোড়ো যাত্রার প্রতীক। শেষ হোলো শেষ দশ কিমি চলা, প্রথম দিনেই হাঁটতে হল আঠারো কিমি। এবার খুঁজে নিতে হবে হাই রোড় থেকে দূরে কোথায় সেই ক্যাম্প। দুপুরে সেখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা এবং একিছুটা রেস্ট। পেয়ে গেলাম। কেউ বাসে উঠল কেউ দৌড়াল। এই ক্যাম্পে অনেক প্রদেশের মানুষের সঙ্গে কথা হতে থাকল, আলাপ হল, অনেকেই অনেকের জন্য চা হালুয়া এনে দিচ্ছে, কেউ জল এনে দিচ্ছে। এই চা কফি হালুয়া খেতে খেতেই দেখি খাবারের টেবিল সেজে উঠেছে লম্বা লাইন। আমিও দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতেই হাতা এলো ভাত রুটি ডাল পনির মাছ দই রসোগোল্লা ইত্যাদি। খাও খাও যত পারো খাও অসুবিধা নেই। নিরাপত্তা রক্ষীরা হুড়মুড় করে এগিয়ে গিয়ে লাইন ভেঙে খাবার আগে নিয়েই বেশি করে খচ্ছিলো দেখাগেলো।
ক্যাম্পে গিয়ে দেখি সেই লেপ সেই তোষকেরা সঙ্গেই আসছে। ভালোই হল, “যা দেবে তাই পাবে” নিশ্চয়ি সেই ফকিরের কথা ফলে যাচ্ছে পদেপদে। তোষক যেমন রেখেছো তেমনি পাবে। নোংরা করলে নোংরা পরিস্কার রাখলে পরিস্কার পাবে। যেকোনো একটা নিতে গিয়ে দেখি সব দখলে, একটা এক কোণে পড়ে আছে। সেটাকেই টেনে এনে গুছিয়ে বিছিয়ে ঘন্টা ঘানেক বিশ্রাম। ওদিকে খাবারের ঘর বন্ধ হয়নি। বাঁশি বাজতেই গিয়ে চা কফির লাইনে দাঁড়িয়ে এক মগ নিয়ে পাশে চোচো করে পিয়ে ফেলা। আবার দৌড়। কারণ এখনো আট কিমি বাকি। লাইনে দাঁড়িয়েই ব্যানার নিলাম। জোড়ো জোড়ো ভারত জোড়ো। দু ঘন্টা হাঁটার পরেই নেমে আসছে সন্ধ্যা। পাখিদের দলে দলে উড়ে যেতে দেখছি। কুয়াশাদের কি আনন্দ ঝেঁপে ঝেঁপে নেমে আসছে। ঠান্ডা হাওয়া চলছিল, তার গতি বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। এবারে হাঁটাতে আর জোর নেই। একটু ধীরে একটু হেলেদুলে এসে পৌঁছলাম বাসে। বাস নিয়ে গেল আজকে রাতে থাকার ক্যাম্পে।
যাত্রার অভিজ্ঞতা এই ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বলার ইচ্ছে। আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বললাম।
এই যে ভারত জোড়ো যাত্রা এবং তার মূল উদ্দ্যেশ্য ও লক্ষ্যের ইম্প্যাক্ট এবং এর ইন্ডিকেটার নিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই এই যাত্রার অনেকগুলো ইতিবাচক লক্ষণ দেখা গেছে। যাত্রার লক্ষ্যই হলো জুলুমবাজ সরকারের পতন ঘটানো। এই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে যদি এগিয়ে যেতে হয় তাহলে তার রণনীতি কি হবে? তাঁরা ছকে রেখেছেন ২০২৪ সালের লোকসভার ভোট। এই ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতবাসির কাছে। ১৯২৪ সালে আরএসএস-এর জন্ম এবং তার বয়স ১০০ বছর হবে ২০২৪ সালে। তাই এই জুলুমবাজ শাসকের সামনে আছে চরম উত্তেজনা। কারণ তারা তাদের লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্য নিয়ে কেঁচোর মতো হেঁটে চলেছে। এখন গতি হচ্ছে রকেটের মতো। মানুষকে ধর্মের হিংসা খাইয়ে পুশটোলো করে রেখেছে। সেই বদ রক্তের প্রখালন করতেই নামা। নফরতের বাজারে ভালোবাসার দোকান খোলা হয়েছে। যারা ভালোবাসতে জানে তাদের ভয়ভীতি দূর করানোর জন্য জান বাজি রেখে পথে নেমেছেন রাহুল গান্ধি। এটা সহজ ভাবনা নয়! কাজটাও সহজ নয়। ৭ সেপ্টম্বর যাত্রার শুরুর দিনে রাহুল গান্ধি তাঁর পিতার স্মৃতিসৌধতে ফুলমালা দিয়ে বলেই এসেছেন “বাবা এই ফুল এই মালা তোমার প্রাণ কেড়েছে আমি আমার প্রাণের সেই ফুলমালা তোমাকে দিয়ে গেলাম।” বলা যেতে পারে রাহুল গান্ধি নিজের জানাজা নিজেই পড়ে রাস্তায় নেমেছেন। আমি রাহুল গান্ধির এই যাত্রার শেষের দিকে এসে জুড়েছি পাঞ্জাব থেকে কাশ্মীর। এই সময়কালকে ধরেই যা দেখেছি তার উপরেই কিছু কথা লেখা।
প্রথমেই বলতে হয় যে খরিদদারদের জন্য ভালোবাসার দোকান খোলা হয়েছে সেই খরিদদারদের সমাগম কেমন? এই যে লম্বা রাস্তা সেই রাস্তার দুই একটি জায়গা বাদ দিলে প্রতিটি রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ভোর পাঁচটা থেকে বিকেল পাঁচটা এই যে যাত্রাকাল এই সময় রাজ্যের মানুষ এসেছেন একজন দু-জন নয়— হাজারে হাজারে মানুষের ঢল নেমেছে। টিভি চ্যানেল তেমন খবর করেনি। তারা নফরতের দোকানে নফরত কিনতে মসগুল। কিন্তু মানুষের হাতে যে ভালোবাসার খবেরর বাকসো বোঝাই। মোবাইলের উপরে আঙ্গুল চালিয়ে দিলেই হবে— সোসাল মিডিয়ার বিভিন্ন চ্যানেল এগিয়ে নিয়ে চলেছে রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো যাত্রাকে। বিতরণ করছে খবর। আমি মানুষের কথা বলছি। মানুষজন অপেক্ষা করছে রাহুল গান্ধির জন্য মানুষ ভালবেসেছে সমস্ত যাত্রীদের। এটা কোনো ধর্মের মিছিল ছিল না। হিংসার মিছিল ছিল না। কোনো মহান ব্যক্তি মহত্মা গান্ধি, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মিছিল ছিল না। মিছিল ছিল একটি সর্বহারা স্নেহ মমতা বালক বেলার, বয়ঃসন্ধীক্ষণের যত ভালোলাগা ছিল সব থেকে বঞ্চিত একটি রাজনৈতিক নেতা যাকে হিংসার রাজনীতি করার মানুষেরা পাপ্পু বলে প্রোপাগাণ্ডা করে সারা দেশে অকারণে এই দূর্নাম দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। সেই ছেলেটা বেরিয়েছে অনেক সাহস করে ভালোবাসার দোকান খুলেছে। কোথায়? না সেই নফরতের বাজারে। মানুষ বুঝেছে তাঁরা ভুল পথে চলছে। রাস্তার দুপাশে যে মানুষেরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অনেকেই আমাদের মেয়েদেরকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। মেয়েরা পথে নেমেছে তাদের হাজার একটা শারীরিক সামাজিক পারিবারিক বাধা তারপরেও। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ সেই মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের বাসায়, স্নান করার গরম জল পেচ্ছাপ পায়খানা করার বাথরুম, গামছা তোয়ালে এগিয়ে দিচ্ছেন। আমরা ঝপাঝপ স্নান সেরে নিচ্ছি ঠান্ডায় কাঁপছি তাঁরা গরম পায়েস চা দুধ এনে সামনে ধরছেন। মানুষ বলেছে কি ভাবে তাঁরা অত্যাচারিত কিভাবে তাদেরকে বঞ্চিত করেছে তাদের মাঠের ফসলকে কিভাবে অল্পমূল্যে একপ্রকার কেড়ে নিচ্ছে। চাষিদের কি ভাবে ঠকাচ্ছে। বেরোজগারিতে দেশ ভরে গেছে। রোজগারের জন্য ঘরের সন্তান বিদেশ বিভুঁয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু যাবার উপায় নেই। গরিব মানুষ পাশপোর্ট ভিসা কিভাবে করবে তাতে যে অনেক টাকা লাগে। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছে।
এই যে দেখা এই যে মানুষের হৃদয় দুঃখে কোকিয়ে উঠছে এটা দেখেছি— পাঞ্জাব থেকে শ্রীনগরের লালচক পর্যন্ত। পাঞ্জাব পেরিয়ে হিমাচলপ্রদেশে প্রবেশ এবং ইন্দোরাতে গিয়ে আর এক আহবান পেয়েছি। মেয়েরা এসে নিয়ে গেছে তাদের বাড়িতে। এই খানে আছে কমলালেবুর বাগান। আছে কিনুর বাগান। আঁচল আঁচল কিনু পেড়ে দিয়েছে। ‘হামারা রাহুলের যাত্রী, হামারা দেশসে হিংসা জখমি হটানেবালার যাত্রী। হাম বহত দুখমে হ্যাঁয়। হামে জুলুম নেহি চাহিয়ে হামে পিয়ার চাহিয়ে।’
জিজ্ঞাসা করেছি আপনারা কি কংগ্রেস করেন? উত্তর দিয়েছেন, “নেহি হাম সব এহি জুলুমবাজকো ভোট ডালা লেকিন সত্যনাশ করদিয়া মাহারা রিস্তেকা। হাম বদল চাহিয়ে।”
কেউ কেউ বলেছেন “হাঁ তো কাংগ্রেস করাতা থা লেকিন বিচমে এহি আদমিকা পাশ ফাঁসগ্যাগি। হামে ইয়ে দাঙ্গা নেহি চাহিয়ে।”
আর যাই হোক আজকে হিমাচল প্রদেশে নতুন দুটো জিনিস দেখলাম— এক সুসজ্জিত মহিলা সাজানো গোছানো পোষাকে টুপি সমেত। আরেক জনকে দেখলাম ট্রাডিশনাল পোশাক গহনা পরে এসেছে। আমাকে পরিয়ে ছিল কেউ তাদের টুপি তাদের চাদর আসলে এগুলোই ছিল ভারতবর্ষের মূলকথা— সংবিধান বদলানো যাবে না। তেরঙা পতাকা দু’রঙা করা যাবে না। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের সেই সূর্যটাই উঠবে যেটা গান্ধিজী চেয়েছিলেন।