নিম্নবর্ণ ও সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের নিঃশ্বাসে বেঁচে আছে হুগলী চাঁপদানি। এখানে রয়েছে তিনটি চটকল, আরও কয়েকটি ছোট কারখানা। কারখানার সাইরেনের আওয়াজ ও ধোঁয়ায় মিশে সকাল-সন্ধ্যা হয় রাস্তার দু-পাশের ফুট লাগোয়া হকারদের। ৯ই এপ্রিল ২০২৫, রাম নবমীর আঁখাড়া, রামের ভাসানে অস্ত্রের যাত্রা। এ দিন 'বড় ঝামেলা হতে পারে', আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, আরএসএসের 'ঘাঁটি' অঞ্চলের নিম্নবর্ণের শ্রমজীবী মানুষেরা। বিকেল ৫টা, চাঁপদানি জিটি রোডের মঞ্জুশ্রী(দমকল কেন্দ্র) থেকে ডালহৌসি চটকল অবধি 'নো এন্ট্রি', প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তা। মঞ্জুশ্রী থেকে ডালহৌসি চটকলের দিকে যতই এগানো যায় ততোই দপদপ বিটের আওয়াজ কানের মধ্যে কিলবিলিয়ে বাড়ছে। সব ক'টি আওয়াজেই(মিউজিক) রাম ও হনুমানের নামে ডিজে মেশিনে বিট পড়ছে। স্বাভাবিকভাবে এসব আওয়াজ(মিউজিক) বেশিরভাগ কম বয়সী ছেলেদের মস্তিষ্কে উত্তেজনা বাড়াতে বিলক্ষণ সাহায্য করে। শরীর তখন নিজের থেকে দোলে, ভেতর থেকে নিজেকে বা নিজের ধর্মকে 'হিংস্র', 'সর্বশ্রেষ্ঠ' ইত্যাদি মনে হতে বাধ্য, বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘদিনের আর্থ-সামাজিক সংকটের মধ্য থেকে 'সংকটমোচনে'র ধর্মীয় অনুশাসনে বড় হয়েছেন।
এইটুকু রাস্তার মাঝে হয়েছে মোট ৫-৬ টি রামের পূজো। রয়েছে এতগুলোই মন্দির, পুরোটাই হিংস্র গেরুয়ার রাগ-আক্রোশের চিত্রে বন্দি। মন্দির ও পূজোগুলোর বিপরীত দিকে রয়েছে একটি মাজার ও একটি মসজিদ। সন্ধ্যা ৬টা, সূর্যের বিদায় বেলা। গাছের সবুজ পাতার সাথে নানা রকমারি আলো মিশে যাচ্ছে, ক্রমশ মানুষের ভিড় উঁপচে উঠছে। তখন মোটামুটি ১০০-১৫০ জন গেরুয়াধারী উপস্থিত। কেউ মন্দিরের ভেতরে আবার কেউ মন্দিরের বাইরে ধারালো অস্ত্র(সোর্ড, তরোয়াল, চাপাটি ও আরও নানা রকমারি অস্ত্র ইত্যাদি) হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত। হনুমানের বুক চিঁড়ে বা কোল আলো করে রাম লালা বেড়িয়েছেন, ১০-১২ ফুটের সেই সব মূর্তি রাস্তায় রাখা। মূর্তির মুখগুলো ক্ষুধার্ত, নরখাদকের চরিত্রে আঁকা। উপস্থিত হলেন, চাঁপদানি বিধায়ক কল্যাণ ব্যানার্জি, সদলবলে। প্রত্যেকেরই মাথা থেকে পা অবধি গেরুয়া কাপড়ে ঢাকা। আকাশে তখন উড়ছে সারি সারি হিংস্র হনুমান ও রামের গেরুয়া পতাকা।
সন্ধ্যা ৭টা, অঞ্চলের বেশ কিছু সংখ্যালঘু শ্রমিকেরা জানান, রামের ভাসান, আঁখাড়া আসলে অস্ত্র প্রদর্শনের যাত্রা। তাঁরা আজকের দিনটিতে পরিবার ছেড়ে ঘর থেকে বেড়ান না। সারারাত পাহারা দেন, সকাল হলে ঘুমাতে যান। ততক্ষণে মুসলমানদের দোকানপাট বন্ধ, মসজিদ ও মাজারে তালা ঝোলানো, যে যাঁর বাড়ির সামনে বা ভেতরে। বাইরে পুলিশ ও 'র্যাপিড একশন ফোর্সে'র পিকেটিং। ডালহৌসি চটকল মহল্লা লাগোয়া ইফটু, আইএনটিউসি প্রভৃতি ট্রেড ইউনিয়নের অফিসগুলো বন্ধ হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসায়ীর দোকানপাট খোলা, যাঁরা নিম্নবর্ণের তবে আরএসএসের এ সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। ধীরে ধীরে ভিড় বেড়ে আরও কয়েকগুণ, প্রায় ১০০০ জনের বেশি। প্রতিটি মন্দিরের সামনে এক সাথে ৫-৬ জোড়া বড় জেবিএল বক্স গমগম করছে, কয়েকটার চারিপাশে আবার বড় চোঙ লাগানো। পাশের দেওয়ালগুলো যেন রীতিমত কাঁপছে। তারই মাঝে অস্ত্রেরা সব রাস্তা জুড়ে খেলছে, ডিজে মেশিনের রকমারি আলোর ঝলকানি সেই অস্ত্রের গায়ে পড়ে হুট করে মানুষের চোখে মুখে ছিটে যাচ্ছে। নেতা, মন্ত্রীদের জন্য সিংহাসন রেডি, তাঁরা সেখান থেকে অস্ত্রের সমাগমের দিকে হাত নাড়ছেন। সিংহাসন থেকে বিধায়ক মাননীয় কল্যাণ ব্যানার্জি 'বজরং দলে'র হিংস্র হনুমানের গেরুয়া পতাকা উড়াচ্ছেন। মানুষগুলো এখানে ৮০ শতাংশই, বালক, যুবক থেকে মাঝবয়সী। ৪৫ ঊর্ধ্ব মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন, প্রায় নেই।
রাত ৮টা, এবার মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। গানের ভাষা(লিরিক্স) হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছে। গানের মাঝে যোগী আদিত্যনাথের মুসলমান বিদ্বেষী বক্তব্য র্যাপ আকারে বেরিয়ে আসছে, তার ফাঁকে ফাঁকে চলছে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের জয়ধ্বনি ও 'কাশ্মীর মাঙ্গো গে তো চিঁড় দেঙ্গে'র মত 'ঢাই কিলো'র ডায়লগ। এসব আওয়াজ(মিউজিক) অনেকটাই মস্তিষ্কে উগ্রতা বাড়ায়, মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। এবারে বালক, যুবক, মাঝবয়সী পুরুষের পাশাপাশি কমবয়সী বালিকা ও মাঝবয়সী মেয়েরাও যোগ দিয়েছেন, অনেকের পরনে সাদা শাড়ি মাথায় গেরুয়া পাগড়ী, আবার অনেকের সাধারণ পোশাক। পুরুষেরও একই। যাঁরা শরীরের উপরে অংশে সাদা পোশাক পরেছেন, মাথায় গেরুয়া পাগড়ী চড়িয়েছেন, গলায় গেরুয়া ওড়না, তাঁরা সকলেই আরএসএসের এই অঞ্চলের নানা শাখার সক্রিয় সদস্য। যাঁরা এই অস্ত্র যাত্রায় রামের ভাসান পরিচালনা করছেন। এঁদের প্রত্যেকের হাতেই নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র যা দিয়ে সংখ্যায় কম নিরস্ত্র মানুষকে নিশ্চিন্তে ভয় দেখানো যায় বা হত্যাও করা যায় এক নিমেষে। সেই সব অস্ত্রেরা একে অপরের উপর থেকে রাস্তায় ঘষাঘষি করে আগুনের ফুলকি উড়াচ্ছে, সদস্যেরা সব রাম নামের উগ্র গানে নানা অঙ্গভঙ্গি করে শরীর দোলাচ্ছেন, অস্ত্র প্রশিক্ষণের নানা কৌশল দেখাচ্ছেন। কেউ আবার মুখে পেট্রোল দিয়ে রাস্তা জুড়ে আগুন জ্বালাচ্ছেন, কেউ আবার কায়দা করে ১২ ফুটের বাঁশে হিংস্র রাম ও হনুমানের গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে মাথার উপর দিয়ে ঘোরাচ্ছেন। অস্ত্র ও বাঁশগুলো আশপাশের মানুষের গা ঘেষে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেই দেখে মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট হয়েছে, 'আনন্দ করতে গিয়ে কারোর আঘাত যেন না লাগে, সবাই যেন এদিনটা উপভোগ করতে পারে'। তবে আনন্দ যখন অস্ত্রেরা করে তখন মানুষের আঘাত অল্প বিস্তর লাগলেই বা দোষ কোথায়? দোষ যে নেই, তারই ইঙ্গিত মিলেছে। হিংস্র পতাকার বাঁশ ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার ধারে এক ছোলা ওয়ালার ছাউনী ফাটিয়ে দিয়েছে, কিছুজনের শরীরে কম-বেশি আঘাতও দিয়েছে।
রাত ৯টা, এক কিলোমিটার রাস্তার ভেতরে মোটামুটি ১৫০০-১৮০০ মানুষ, নানা ধরনের ধারালো অস্ত্র প্রায় হাজার খানেক। তুমুল নাচ, কেউ মন্দিরের উপরে, কেউ ডিজে বক্সের উপরে দাঁড়িয়ে, আরএসএসের শাখার সঙ্গে যুক্ত যুবক ও মাঝবয়সী পুরুষেরা। যুবতীরা তখন অস্ত্র উঁচিয়ে নাচছেন, একত্রিত হয়ে নিজেদের ছবি তুলছেন। অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায় - এসব অস্ত্র তৈরি হয় আশপাশেই, চাইলে দু-আড়াই হাজারের ভেতরে পাওয়া যেতে পারে। অনেকে আবার এবারের মহাকুম্ভ থেকে অস্ত্র আনিয়েছেন। পুলিশ-প্রশাসন, নেতা-মন্ত্রী সকলের সামনেই সবটা চলছে, সকলেই এসব উপভোগ করছেন। পারমিশন না নিলেও ক্ষতি নেই, অস্ত্রের আঁখাড়া চলবে মাঝরাত অবধি। মূর্তিগুলোর ভাসান যাবে চাঁপদানির ফলতা ঘাটের গঙ্গায়। আরএসএসের নেতারা জানান, হিন্দুধর্মের দেবদেবীর হাতে অস্ত্র ছিল, রাম রাবণকে অস্ত্র দিয়ে বধ করে সকলকে বাঁচিয়েছেন। তাই হিন্দুদের হাতে অস্ত্র থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, শত্রু যেখানে অনেক। তবে মডার্ন ওয়ারফেয়ারের যুগে এই ধরনের অস্ত্র অচল। শোকেসে সাজানো বাঘ যেমন শিশুদের ভয় দেখাতে কাজে আসে, তেমনি নিরস্ত্র মানুষকে ভয় দেখাতে বা হত্যা করতে কেবল এই ধরনের অস্ত্রগুলো কাজে আসতে পারে।
হুগলী চাঁপদানিতে আখাড়ার অস্ত্র যাত্রা সূচনা হয়, ২০১০ সাল থেকে। তখন লাঠি, বাঁশ হাতে মিছিল করতেন কিছুজন গেরুয়াধারী। প্রধানত, ২০১৬-২০১৭ পর থেকে রামের ভাসানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, মুসলমানের কার্যত বনধ পালন করা শুরু হয়। তা স্বচক্ষে দেখে আপ্লুত সাংসদ কল্যাণ ব্যানার্জি। এই অনুষ্ঠান থেকে স্যোশাল মিডিয়ার পোস্টের মাধ্যমে রাজ্যবাসীকে জানিয়েছেন, "রামনবমী উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় আজ অংশগ্রহণ করেছিলাম, চাঁপদানী বিধানসভায়। সাধারণ মানুষ এবং দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার বুঝলাম, মানুষ সম্প্রীতির পক্ষে, শান্তির পক্ষে, মানুষের পক্ষে। সকলকে জানাই অভিনন্দন।" অর্থাৎ, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর অস্ত্র প্রদর্শন এ সমাজে স্বাভাবিক, এটাই আসলে 'ধর্মীয় সম্প্রীতি', এই রূপ বার্তাই দিলেন। আইনের চোখে পড়া পট্টি আজ খুলে গেলেও বিচারব্যবস্থা এখানে অন্ধ, অচল, অবাস্তবিক। পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস সরকার এবারের রাম নবমীকে 'সম্প্রীতির মিলন' হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। দলীয় মুসলমান নেতাদের মিছিলে নামিয়েছে, নানা অঞ্চলে পোষ্টার সাঁটিয়েছে, 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার'। এবারে রামনবমীর 'উৎসব' পালনের নানা কলাকৌশলের মাধ্যমে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মানুষকে বোঝাতে চেয়েছে যে, এই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের হিংস্রতার সম্প্রীতিই আসলে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী বাঙালির সংস্কৃতি। পাশাপাশি প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে এরই মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে আরও একলা(অস্তিত্ব সংকটে ফেলে) করে দাবিয়ে রাখবার প্রচেষ্টাও চালিয়েছে আরএসএস। তাই চারিদিকে অস্ত্র মিছিল বিপুল পরিমাণে সংগঠিত হয়েছে। এটিও আদপে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী সমাজ গঠনের পদ্ধতির একটি নমুনা। এমনটাই লেখকের ধারণা। যদিও বাঙালির অন্নপূর্ণা বা বাসন্তী পূজো রাম নবমীর ব্রাহ্মণ্যবাদীকরণে মিশে গেছে। প্রায় প্রতিটি জায়গায় রামের মূর্তি রেখে 'জয় শ্রী রাম' স্লোগানে অন্নপূর্ণা বা বাসন্তী পূজো সমাপ্তি ঘটেছে। ঠিকই একইভাবে অনেক জায়গায় সরস্বতী ও কার্তিক পূজো পালিত হয়েছে। যেমন ভাবে বড় মাছ, ছোট মাছকে গিলে খায় তেমন ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিদুত্বের প্রতীক হিংস্র রাম ও হনুমান সদলবলে গিলে খাচ্ছে হিন্দুদের বহুত্ববাদের আচার-আচরণগুলোকে।
ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, ধর্ম ধর্মের অন্তর্ঘাত। শ্রেণি সমাজে যার উৎপত্তি শ্রেণি দ্বন্দ্ব বা সংঘাত থেকে। লেখকের প্রধান নজর সে দিকে। এখন যদি, নিম্নবর্ণ-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সংখ্যাগুরু শোষিত শ্রেণির মানুষেরাও শ্রেণি সংগ্রামের সশস্ত্র ধারার ইতিহাস অনুযায়ী, লুটেরা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী শোষক শ্রেণিকে বধ করতে, এই একই পন্থা নেয় তাহলে মেনে নেবেন জন 'নেতা' ও 'নেত্রী'?