পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তালাকের স্ত্রী, স্ত্রীর তালাক অথবা ফৌজদারি অপরাধের কিসসা

  • 02 August, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2952 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
তাৎক্ষণিক তিন তালাক আসলে পুরুষের একতরফা বিচ্ছেদ ঘোষণা। ভারতে এমন ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে। তবে আইন শুধু মুসলমান পুরুষের জন্য কেন? আইনের তোয়াক্কা না করে স্বামী ত্যাগ করেছেন, এমন স্বামী পরিত্যক্তা হিন্দু রমণীর সংখ্যা ১৯ লক্ষ আর মুসলমান নারী ২.৮ লক্ষ

৩০ জুলাই, ২০১৯রাজ্যসভায় পাশ হল তালাক অর্ডিন্যান্সআগেই এই বিল অনুমোদিত হয়েছে লোকসভায়কী আছে ওই বিলে? তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ এবং যে স্বামী এমন তালাকের দ্বারস্থ হবেন, তার তিন বছর জেল হবেমুসলমান পুরুষের জন্য এই ফৌজদারি আইন

তাৎক্ষণিক তিন তালাক আসলে পুরুষের একতরফা বিচ্ছেদএকতরফা বিচ্ছেদ এ দেশে বিরল নয়২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী, এই দেশে স্বামী-পরিত্যক্তা (আইনগতভাবে নয়) মহিলার সংখ্যা হল ২৩ লক্ষ ৭০ হাজারতাঁরা কিন্তু আইনিভাবে বিচ্ছিন্না ননতাঁদের মধ্যে ১৯ লক্ষ হলেন হিন্দু এবং ২.৮ লক্ষ হলেন মুসলমানফলে দেখা যাচ্ছে, সব ধর্মের পুরুষরা এমন অন্যায় সুযোগ নিয়ে থাকেনযদি একে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়, তবে কেন সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে বলা হবে নাএমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিককেউ বলতে পারেন, অন্য ধর্মেতালাক তালাক তালাকবললেই তো বিচ্ছেদ হয় না, তাহলে তাদের কেন এই ফৌজদারি অপরাধের অন্তর্ভুক্ত করা হবে! এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও অগস্ট ২০১৭ থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাক আর নেই, কারণ সুপ্রিম কোর্ট তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেতাহলে কেন শুধু মুসলমান পুরুষের ক্ষেত্রে এই আইন? নানা ধর্মের বিপুল সংখ্যক নারী স্বামীর কাছে আইনিভাবে বিচ্ছিন্না না হয়েও পরিত্যক্তা, তাঁরা কেন সুবিচার পাবেন না, কেন ওই স্বামীরা অপরাধী বলে গণ্য হবেন না? বলতেই হয়, এই বিল একদেশদর্শী এবং সাম্যের বিরোধী

২০১৭ সালের অগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের দু জনপ্রধান বিচারপতি জে এস খেহর ও এস এ নাজির তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে সরকারকে আইন প্রণয়নের কথা বলেছিলেনকিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি (জাস্টিস জোসেফ, নরিম্যান ও ললিত) তাঁদের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তিন তালাক অসাংবিধানিক ও অ-ইসলামীয়পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কথা তাঁরা বলেননিস্পষ্টতই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায় (যেটি প্রকৃত রায় বলে গৃহীত) গ্রহণ না করে অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করে পার্লামেন্টের দুই কক্ষে তালাক বিল পাশ করালোএমন তিন তালাক অবৈধ, অসাংবিধানিক, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় সত্ত্বেও নতুন করে সংসদে আইন প্রণয়নের অর্থ কী? ওই সময় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় যেহেতু এই তালাককে বাতিল করা হয়েছে, তাই পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের কোনও প্রয়োজন নেইকোর্টের নির্দেশ না মানা হলে দেশের যে গার্হস্থ্য আইন রয়েছে সেই মোতাবেক দোষীর বিচার ও শাস্তি হবে

তবে কেন এই বিল? একজন মুসলমান স্বামী তাঁর মুসলিম স্ত্রীকেতালাক তালাক তালাক’ (তোমার সঙ্গে থাকছি না) বললেও বিচ্ছেদ হবে নাএত কাল যে হত, সেটাই চরম লজ্জারআদালতের রায়ে সেই লজ্জা দেরিতে হলেও দূর হয়েছেকিন্তু তালাক বিলের উদ্দেশ্যটা কী? বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, স্বামী যদিবিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদএই কথা স্ত্রীকে বলে, তাঁর তিন বছর পর্যন্ত জেল হবেএমন ফৌজদারি অপরাধ হল অ-জামিনযোগ্য অপরাধ কিন্তু এখানে অপরাধটি ঠিক কী সংঘটিত হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে নাযদি কোনও স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন যে গতরাতে উনি নিভৃতে তিন বার তালাক শব্দ উচ্চারণ করেছেন, পুলিশ ওই পুরুষকে প্রমাণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যেতে পারবেতার পর জেলের ঘানি টেনে ওই পুরুষের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কের উন্নতি হবে নিশ্চয়! ফুসকুড়ি (তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাকে ফুসকুড়ি বলা হচ্ছে না) ভাল করতে গিয়ে গোটা পাটাকে কেটে বাদ দেওয়ার এই বিল মানবতাবিরোধীযে কোনও শাস্তির পিছনে চরম অনিবার্যতা না থাকলে ওই শাস্তি হয়ে পড়ে অত্যাচার, প্রজাপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারবর্তমান সরকার ঠিক সেটাই করলেনবিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক ও আইনজ্ঞ জেরেমি বেন্থাম বলেছিলেন, তিনটি ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন ব্যবহার করা যাবে না যার অন্যতম হলকুকর্মের চেয়ে শাস্তির ওজন যেখানে বেশিতাছাড়া, এই বিল যে আইন আনতে চলেছে, শাস্তিতত্ত্ব অনুযায়ী তা মধ্যযুগীয় রবিশঙ্কর প্রসাদ একদা বলেছিলেন, তাৎক্ষণিক তালাক হল পাপমুসলমান আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হওয়া অনিবার্যমন্ত্রীমশাই জানেন না যে এই দেশের শাস্তিতত্ত্ব মধ্যযুগীয় প্রতিশোধাত্মক মতবাদে বিশ্বাসী নয়ভারতে নিবৃত্তিমূলক শাস্তির প্রচলন আছেশাসক দলন্যায়’-এর পথ অনুসরণ না করেক্ষমতা’-র অপব্যবহার করছেনসুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে, এই রায় যথেষ্টপার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আসলে মুসলমান সমাজের সর্বনাশ ডেকে আনছেনদেওয়ানি বিধি কেবল ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের নেই, তা আছে সব অ-মুসলমান মানুষেরও। এ দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি না থাকলেও অভিন্ন ফৌজদারি বিধি আছে বলে ধরা হয় তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিলে মুসলমান পুরুষকে যে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া হল, তা ফৌজদারির বিধির অভিন্নতাকে বড়সড় ধাক্কা দেয়যে কোনও এক তরফা বিচ্ছেদ কাম্য নয় এবং তার জন্য আইন দরকারসেই আইন ফৌজদারি নয়, তা হওয়া উচিত দেওয়ানি বৈবাহিক অপরাধ

0 Comments

Post Comment