পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈধতা রাষ্ট্র নিজেই ধ্বংস করছে না তো?

  • 19 November, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 474 view(s)
  • লিখেছেন : সৌম্য মণ্ডল
বিহার ভোটের পরে জনমানসে নির্বাচন কমিশনের প্রতি সন্দেহ বাড়তেই থাকবে, কমবে না৷ হঠাৎ আচমকা ভোটার সংখ্যা বেড়ে যাবে, বিকেল পাঁচটার পর ভোট দেওয়া বেড়ে যাবে: কিন্তু তার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাবে না, একজনের ছবিতে একাধিক এপিক নম্বর সহ ভোটার কার্ড আসবে, শূন্যনম্বর বাড়ির মিস্টার ABCD এর ৮০ জন ছেলে মেয়ে ভোটে দেবে, ভোটার বুথে গিয়ে দেখবেন তার নাম উধাও আরও যে কত রকম পদ্ধতি!

যেমনটা ভাবা হয়েছিলো, নির্বাচনে ঠিক তার উলটো ফল হওয়াটা নতুন কিছু নয়। বিরোধীদের ভরাডুবিও নতুন কিছু নয়। কিন্তু যেটা নতুন, সেটা হল - নির্বচনের আয়োজকদের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নিশ্চিত হওয়া, নির্বাচন কমিশনের নৈতিক বৈধতা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন তৈরি হওয়া। ফলত কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানাতে ভোট চুরির অভিযোগে ভারতের প্রধান বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর অকাট্য প্রমাণ সহ প্রেস কনফারেন্সের পর, বিশেষত অভিযোগ গুলো খন্ডনে নির্বাচন কমিশন অপরাগ হওয়ার পর, গত বিহার নির্বাচন সহ আগামী সমস্ত নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যাবে। বিরোধী দল এবং ভোটারদের মনে হবে আসলে কারচুপি করেই নির্বাচন কমিশন বিজেপিকে জিতিয়ে দিয়েছে। এমনকি কোনো ভোটে বিরোধীরা জিতলেও ভাবা হবে হয়তো ব্যাবধান এতই বেশি ছিলো যে কারচুপি করেও নির্বাচন কমিশন সেটা মেটাতে পারেনি। জনমানসে এই সন্দেহের যথেষ্ট ভিত্তি স্বয়ং নির্বাচন কমিশনই তৈরি করে দিয়েছে।

নিশ্চিত ভাবে জনমানসে এই সন্দেহ বাড়তেই থাকবে, কমবে না৷ হঠাৎ আচমকা ভোটার সংখ্যা বেড়ে যাবে, বিকেল পাঁচটার পর ভোট দেওয়া বেড়ে যাবে: কিন্তু তার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাবে না, একজনের ছবিতে একাধিক এপিক নম্বর সহ ভোটার কার্ড আসবে, শূন্যনম্বর বাড়ির মিস্টার ABCD এর ৮০ জন ছেলে মেয়ে ভোটে দেবে, ভোটার বুথে গিয়ে দেখবেন তার নাম উধাও আরও যে কত রকম পদ্ধতি! এসব চলতে থাকার সম্ভবনাটাই প্রবল, কারণ সংসদে বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে মোদী সরকার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে নতুন আইন তৈরি করেছে, যেখানে একছত্র ভাবে শাসক দলের পছন্দেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হবে, এবং নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া যাবে না। 

মোদী সরকারের আমলে এমন অনেক কিছুই মুমকিন হয়েছে যা ভারতের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। মোদী সরকার ১ এর আমলে, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অভূতপূর্বভাবে সুপ্রিম কোর্টের চারজন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সংবাদ সম্মেলন করে তৎকালীন ভারতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ আনেন এবং দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

একটি প্রেস কনফারেন্সে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি চেলমেশ্বর তিনজন বিচারকের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন—“...এটা কোনো দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ঘটনা, বিশেষ করে এই দেশের ক্ষেত্রে। বিচার বিভাগের ইতিহাসেও এটি এক অসাধারণ ঘটনা… আমাদের কোনো আনন্দ নেই এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়ে। কিন্তু কখনো কখনো সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন সঠিকভাবে চলে না… আমরা চারজনই নিশ্চিত যে এই প্রতিষ্ঠানটি টিকে না থাকলে এবং তার ভারসাম্য রক্ষা না করলে এই দেশে বা কোনো দেশেই গণতন্ত্র টিকবে না। একটি ভালো গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা্নড

ঐবছরই ২০১৮ সালের অক্টোবরে  আরেকটি বিব্রতকর ঘটনা ঘটেছিল। দেশের অন্যতম প্রধান তদন্ত সংস্থা—সিবিআই এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হঠাৎ করেই প্রকাশ্যে আসে, যা দেখিয়ে দেয় সংস্থাটির শীর্ষ নেতৃত্বের ভেতরের বৈরিতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে শুরু করেন, পরস্পরের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, এবং মোদি সরকারের সহায়তায় এক পক্ষ ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে অন্য পক্ষকে টেনে নামানোর তীব্র চেষ্টা চালাতে থাকে। প্রথা ভেঙে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ সিবিআই এর তৎকালীন প্রধানকে অপসারণ করে বিজেপি ঘনিষ্ঠ  সিবিআই এর দ্বিতীয় পদাধিকারী ব্যক্তিকে রক্ষা করেন।

শাসক শ্রেণির কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই সংস্থার অভ্যন্তরীণ এই নজিরবিহীন বিবাদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় চটকদার শিরোনাম—যেমন: “সিবিআইয়ের শীর্ষে যুদ্ধ; বিশেষ পরিচালক অস্তানার বিরুদ্ধে নতুন তদন্ত” (হিন্দুস্তান টাইমস, ২১ অক্টোবর), “সিবিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা ইতিহাসে কখনও এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি: যশবন্ত সিনহা” (দ্য ইকনমিক টাইমস, ২৬ অক্টোবর), “সিবিআইয়ের সুনাম ধাক্কা খেল, বলছেন সাবেক প্রধানরা” (হিন্দুস্তান টাইমস, ২৪ অক্টোবর), “সিজারের স্ত্রীর মতো সিবিআই কর্মকর্তাদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে: অরুণ জেটলি” (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২৬ অক্টোবর)।

মোদী সরকার ২ এর শেষ বেলায় ২০২৩ সালের শুরুতে আমরা দেখতে পেলাম পরপর দুইজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার হতে হল দুর্নীতির দায়ে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। যা ভারতে কোনোদিনই হয়নি। শুধু কেজরিবাল নয় আম আদমি পার্টি দলটিকেই দিল্লি আবগারি মামলায় অভিযুক্ত করা করা হয়, এর আগে কোনো মূল ধারার সংসদীয় দলকে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়নি। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের তহবিল বাজেয়াপ্ত করা হল। অন্যদিকে ইলেক্টরাল বন্ড দাতাদের নাম জানানো অসম্ভব বলার পরেও আদালতের ধমক খেয়ে শেষে রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য হন। 


এবার মোদী সরকার ৩ এর শুরুতেই ২০২৫ সালে আমরা দেখলাম ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী অপারেশন সিদুরের সময় দুইজন নারী মুখপাত্রকে সামনে রাখলো, এবং দুইজন নারীই সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের। এই নারীরা খুব স্পষ্ট ভাবে জোরের সাথে ভারতের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে উর্ধ্বে তুলে ধরলো। যা শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য বিব্রতকর। আসলে সেনাবাহিনীও হয়তো বুঝতে পারছে যে উগ্রহিন্দুত্ববাদের উত্থান সেনাবাহিনীর ঐক্য শৃঙ্খলাকেও হুমকির মুখে ফেলছে, তাই কী এই শান্তিপূর্ণ সেনা বিদ্রোহ?  সেই প্রশ্ন থাকবে। এর পর আমরা দেখলাম প্রধান বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধী একের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফাস করলেন খোদ নির্বাচন কমিশনের ভোট জালিয়াতি!   
এই সমস্ত কিছুর মানেটা কী? এগুলো ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ফ্যাসিবাদী দখলদারি এবং সেই দখলদারির বিরুদ্ধে অফ্যাসিবাদী উদারনৈতিক শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের তাত্বিক মন্তেস্কুর ভাবনা অনুযায়ী আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার ট্রাইপাটাইড ব্যাবস্থা অর্থাৎ আইনসভা, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থার স্বাতন্ত্রকরণের মধ্যে বিভিন্ন যুযুধান বুর্জোয়াদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। ফ্যাসিবাদের অর্থ বুর্জোয়াদের একটি অংশের একনায়কত্ব। অর্থাৎ বুর্জোয়াদের একটি অংশ শুধু শ্রমজীবী মানুষ নয় বুর্জোয়াদের অন্য অংশের উপর একনায়কত্ব চালাতে চায়৷ ফলত যে রাষ্ট্র কাঠামো আগে বুর্জোয়াদের নিজেদের দ্বন্দ্বের আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করতো, সেই রাষ্ট্র কাঠামো তারা দখল করে, এই স্বাতন্ত্র্যতা ধ্বংস করতে চায়৷ সেই নির্দিষ্ট গুজরাটি পুজিপতিরা কারা, যারা বাকি সমস্ত পুজিপতিকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়ে ফুলে ফেপে উঠছে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে সেটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট। রাষ্ট্রকাঠামোয় এই ফ্যাসিবাদী দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যেমন রাষ্ট্রীয় অভিজাতদের ভেতর থেকেই আসছে, তেমনি বহু ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদীরা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামো দখল করতে সক্ষমও হচ্ছে।

এর ফলে এমন একটি পরিস্থিতির দিকে ভারত এগোচ্ছে, মাও সে তুং এর ভাষায় যাকে বলা যায় “ভয়ঙ্কর অথবা চমৎকার”। কারণ জনতার কাছে ক্রমাগত  বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, আইনসভায় একতরফা দখলদারির চিত্রটা স্পষ্ট হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, তার বিচার বিভাগ নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে। এই আস্থা ফিরিয়ে আনাও সম্ভবত সম্ভব হবে না কারন ভুয়ো নির্বাবন, রাষ্ট্রযন্ত্রে একচ্ছত্র কতৃত্বের অনাবিল আনন্দ উপভোগ কোনোভাবেই ফ্যাসিবাদীরা ছাড়তে চাওবে না, বলা ভালো রাষ্ট্র যন্ত্রের উপর একতরফা দখলদারি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যই তারা একের পর এক আইন সংশোধন করে চলেছে। যার অন্যতম উদাহরণ নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ সংক্রান্ত আইন। এবার নির্বাচন, আদালত, তদন্তকারী সংস্থা সব কিছুর উপর জনতা আস্থা হারালে তার পরিনতি কী হতে পারে তা আমরা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে দেখেছি। পরপর তিনটে ভুয়ো নির্বাচন মানুষকে স্বতঃস্ফূর্ত ভোট বয়কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মানুষ নির্বাচন বহির্ভূত সমাধান খুজে নিয়েছে। ফলত আরএসএস বিজেপির একতরফা দখলদারি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর লেজিটিমেসি ধ্বংস করে ভারতকে আরেকটা জুলাই মোমেন্টের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এমন বলাটা বাড়াবাড়ি হবে না।

0 Comments

Post Comment