এই মুহূর্তে যে সংসদ চলছে সেখানে বেশ কয়েকটি বিল পাশ হয়েছে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হয়েছে। যার পোশাকি নাম “তথ্য জানার অধিকার আইন সংশোধন”। প্রথমে বুঝে নেওয়া জরুরী এই আইনটিতে কি আছে আর কেনই বা সরকার এটাতে বদল করতে চাইছে। এতদিন অবধি কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরের তথ্য আধিকারিকেরা ছিলেন যাঁদের মূল কাজ ছিল সরকারী তথ্য যদি কোনও নাগরিক জানতে চান তাহলে তাঁরা সেই মধ্যস্থতাকারীর ভুমিকা পালন করতেন। ধরা যাক কোনও নাগরিক জানতে চাইলেন কোনও সরকারি প্রকল্পে যত টাকা খরচ বলা হয়েছে তত টাকা কি আদৌ খরচ হয়েছে? তখন সেই আধিকারিকের দায়িত্বের মধ্যে পরে এই বিষয়ে উত্তর দেওয়া। এই ভাবেই এতদিন চলে আসছিল কিন্তু কি এমন হল যে আইনটিকে সংশোধন করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো এই সরকারের? আসলে এতদিন অবধি এই তথ্য আধিকারিকেরা ছিলেন সরকার নিরপেক্ষ। মানে যেকোনো সরকারই আসুক না কেন এই আধিকারিকদের কাজ ছিল অনেকটা নির্বাচন কমিশনারের মতন। শুধু তাই নয় এই আধিকারিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল সরকার নিরপেক্ষ এবং তাঁদের চাকরিরও একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল। এর কারণ, এই আধিকারিকদের কাজ ছিল দেশের নাগরিকদের এবং সরকারের মধ্যে যে সূক্ষ্ম অমিল থাকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সরকারের স্বচ্ছতা এবং ভাবমূর্তিকে বাড়িয়ে তোলা। প্রচুর অসুবিধা সত্ত্বেও গত এক দশক ধরে এই আইন চলে আসছিল। গত এক দশকে বেশ কিছু মানুষ এই তথ্য জানতে চেয়ে সরকারের রোষানলে পড়ে প্রাণ অবধি দিয়েছেন। কিন্তু তাও সারা দেশে বহু আরটিআই কর্মীরা বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে বেশ বিব্রত করেছেন তাঁদের নির্দিষ্ট প্রশ্ন করে। এই প্রশ্নগুলোই আসলে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সেফটি ভাল্ভ। একটি সরকার কতটা প্রশ্নকে সহ্য করে এবং উত্তর দেয় তার ওপর নির্ভর করে সরকারটি কতটা গণতান্ত্রিক ?
নতুন কি হয়েছে?
যে সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে এবার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করবে কাকে তাঁরা তথ্য আধিকারিক হিসেবে নির্বাচিত করবেন, তাঁর বেতন কত হবে এবং কতদিন তিনি এই পদে আসীন থাকতে পারবেন। এমনিতে খালি চোখে দেখলে খুব বেশী অসুবিধার মনে না হলেও এর পিছনে যে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা সূক্ষ্ম চাল আছে সেটা বুঝে নেওয়া জরুরী। যদি কোনও ব্যক্তিকে সরকার তথ্য আধিকারিক হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং তাঁর কাজের মেয়াদকাল কিংবা বেতন নির্ধারণ করে দেন তাহলে সেই আধিকারিক কি পারবেন নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কোনও নাগরিকের প্রশ্নের উত্তর দিতে? এই বিষয়ে মির্জা গালিবকে স্মরণ করাটা জরুরী। মির্জা গালিবের পরিচিতি ছিল উনি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতেন, তারপর উনি সরকারী সুবিধা পেতে শুরু করেন অবসরের পরে। তখন উনি নিজেই নিজেকে বলেন।
“ গালিব ও দিন গ্যায়ে আব ইয়ে হিমাকত কৌন করতা হ্যায়?
ও ক্যায়া কেহতে হ্যায় উসকো ? হাঁ মোহাব্বত কৌন করতা হ্যায়?
গালিব ওয়াজিফকওয়ার হো, দো শাহ কো দুয়া,
ও দিন গ্যায়ে, কেহতে থে নকর নেহি হু ম্যায়”
গত নির্বাচনে ভারতের নির্বাচন কমিশনার তাঁর ভুমিকা দেখিয়েছেন তাতে একটা কথা পরিষ্কার যে তথ্য আধিকারিকদের চাকরি যদি নিয়ন্ত্রিত হয় সরকারি মন্ত্রীদের দ্বারা তাহলে ভারতের গণতন্ত্রের যে ভারসাম্য এতদিন এই আইনের সাহায্যে নাগরিকেরা পেতেন তা থেকে নাগরিকেরা অচিরেই বঞ্চিত হবে্ন এটা বলতে কি খুব বেশী সাধারণ জ্ঞ্যানের প্রয়োজন হয়? আরও একটা বিষয় বলা জরুরি এই সংশোধনী আনার কারণ কিন্তু সরকার জানায়নি। কেন ১৫ বছরের পুরোনো এই আইনটিকে বদলানোর প্রয়োজন অনুভব করলো সরকার?
এখন কি করনীয় ?
এরপর এই বিলটি রাজ্যসভা বা সংসদের সর্বোচ্চ কক্ষে যখন আনা হবে তখন সমস্ত সাংসদের উচিৎ এটার বিরোধিতা করা, তাও যদি আটকানো না যায় তাহলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যেন এটাকে আটকানো যায় সেটা নিয়েও লড়াই শুরু করাটা জরুরি। এর পাশাপাশি দেশের সমস্ত বিরোধী দলের দায়িত্ব এই বিষয়ে দেশের নাগরিকদের সচেতন করা আর নাগরিকেরা সচেতন হলেই তাঁরাই প্রশ্ন করা শুরু করবে। আর কে না জানে ক্ষমতা প্রশ্নকে ভয় পায়। যদিও বাংলায় এই তথ্য জানতে চাওয়ার মানুষ সত্যিই কম। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তের এই নিয়ে যারা কাজ করছেন যেমন অরুণা রায়, অনুপম শরাফেরা এই নিয়ে বলা শুরু করেছেন যে এরপর তো আর কোনও কিছুই জানা সম্ভব হবে না। তাঁরাও আশঙ্কা করছেন যে আসলে ঘুরিয়ে যে নাগরিকেরা এই প্রশ্ন করাটাকে উৎসাহিত করেন এই “তথ্য জানার অধিকার আইন সংশোধন” সেই নাগরিকদেরই ডানা ছাঁটার চক্রান্ত নয় তো ?