পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শিক্ষার ভবিষ্যৎ কি মাফিয়াদের হাতে ?

  • 11 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2674 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ প্রতিম রায়
শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোগ আমাদের দেশে নতুন নয়। কিন্তু ‘বাইজু’ জাতীয় কোম্পানি গুলো যা করছে তা মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করার সামিল। বাবা মায়েরা অভিযোগ করছেন যে খদ্দের যোগাড় করার জন্য ওরা ছোট শিশুদের এমন প্রশ্ন করছে যার উত্তর বেশিরভাগ শিশুরই দিতে পারার কথা নয়, আর যেই তারা উত্তর দিতে পারছেনা অমনি অলীক স্বপ্ন দেখা বাবা মায়েদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে প্ররোচিত করা হচ্ছে যাতে তারা ঐ অলীক স্বপ্ন সফল করতে এই কোম্পানির লক্ষ টাকার পাঠক্রমে শিশুটিকে ভর্তি করেন।

ভারতের বর্তমান সরকার সম্প্রতি একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন – নয়া শিক্ষানীতি ২০২০ । এর আগে ১৯৮৬ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির কিছু পরিমার্জন ১৯৯২ সালে করা হয়েছিল । একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা কিছু ভালো হওয়া সম্ভব তার সবকিছু এই নতুন নীতিতে লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে বুঝে তার জন্য উপযোগী শিক্ষার বন্দোবস্ত করা, প্রকৃতিবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও মানব-সংস্কৃতিবিদ্যার মধ্যেকার কঠোর বিভাজনরেখা মুছে দিয়ে জীবনের সাথে সংযুক্ত শিক্ষার প্রচলন করা, পাঠ্যবিষয় মুখস্থ করার অভ্যাস বন্ধ করে বিষয়বস্তুর সম্যক ধারণা তৈরিতে জোর দেওয়া, বছরের শেষে দেশজুড়ে পরীক্ষা নেওয়ার চলতি সংস্কৃতির বিপরীতে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, সংবিধানে উল্লেখিত মূল্যবোধগুলি যেমন, ভাষা – ধর্ম – সংস্কৃতির বহুত্বকে গ্রহণ ও সম্মান করতে শেখানো, ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগানো, শিক্ষাকে জনপরিষেবা (Public Service) হিসেবে মনে করা, শিক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগকে স্বায়ত্বশাসন, সুশাসন ও সক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবনে (innovative) উৎসাহ দেওয়া, শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার সুনিশ্চিত করা, শিক্ষার সুযোগকে সর্বজনীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রসারিত করা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির জন্য বিশেষ ভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা – এরকম একঝাঁক ভালো ভালো কথা এই শিক্ষানীতির পাতায় পাতায় লেখা আছে । অথচ সরকারী দলের আশীর্বাদ ধন্য দেশভক্তরা যারা ভিন্ন ধর্মের মানুষকে পিটিয়ে বা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে, তারা সবাই এই ভালো ভালো কথা বলা শিক্ষানীতিরই ফসল । এই নীতির শেষের দিকে বলা আছে যে এইসব মহৎ লক্ষ্যের দিকে বাস্তবে পৌছানোর জন্য যা চাই তা হলো অর্থ, যা দেশের জিডিপি র অন্তত ৬ শতাংশ হওয়া উচিত । ১৯৬৮ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতে এই পরিমাণ খরচের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছিল, ১৯৮৬ এবং ১৯৯২ এর নীতিতেও একই কথা জোরের সাথে বলা হয়েছিল, আবার এবারের নীতিতেও বলা হলো । কিন্তু এতবার সরকারী নীতিতে বলা সত্বেও কেন এটা ৩ থেকে ৪ শতাংশের ওপরে উঠলো না, এবং কি করলে এবার এটা সম্ভব হবে, সেটা নিয়ে কিছু বলা হলো না । অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ২৬.৬ এ বলা হয়েছে যে বেসরকারী মানবকল্যানকামী উদ্যোগকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহ এবং সুযোগ সুবিধা দিতে হবে ।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারী মানবকল্যাণকামী উদ্যোগ যে প্রয়োজন, ও তা যে অনেক সময় নতুন দিশা দিতে পারে তা আমরা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে দেখেছি, আর সেই উদ্যোগ সরকারের হাতে যাবার পর তার কি দশা হয় তাও দেখেছি । প্রশ্নটা সরকারী বা বেসরকারী প্রচেষ্টা নিয়ে নয়, সমাজে ও প্রকৃতিতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাবার অধিকার মানব প্রজাতির প্রতিটি প্রাণীর আছে কিনা প্রশ্নটা তা নিয়ে, আর ঐ মানব প্রজাতির প্রতিটি প্রাণীর শ্রমে পূষ্ট সরকার এই শিক্ষার দায়িত্ব নিতে দায়বদ্ধ থাকবে কিনা, তা নিয়ে । ১৯৬৮ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত এত ভালো ভালো কথা বলে চলা সরকারী শিক্ষানীতি যে এই প্রশ্নে কতটা অন্তঃসারশূন্য তা এই করোনা মহামারী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে । করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে সারা দেশ জুড়ে সরকারী স্কুলগুলিতে পঠন পাঠন এমন ভাবে থমকে গেল যে শিক্ষানীতি গুলিতে উল্লেখ করা বহুমাত্রিক শিক্ষার টিকিটিও দেখা গেল না । গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের কাছে এ নতুন কিছু নয় । করোনা থাকুক আর না থাকুক, ঐসব অঞ্চলের স্কুলে যে শিক্ষকেরা চাকরি করতে যান তাঁদের অধিকাংশই মনে করেন এই সব ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়েও কিছু হবেনা, আর সরকার কাগজে কলমে তার সাংবিধানিক দায় টুকু সারতে পারলেই খুশি । সবার চিন্তা শহর, আধা শহর বা মফস্বলের স্কুল নিয়ে – যেখানে মূলতঃ মধ্যবিত্ত, মানে উচ্চ থেকে নিম্ন, সবরকম মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা পড়ে । এই মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েদের মোবাইল ফোন আছে, আর এরা ভারতবর্ষের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে চিন্তিত নয় । ভারতের অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে এই মধ্যবিত্ত মানুষ সংখ্যায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে – ২০০৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত এই সংখ্যা ৩০ কোটি থেকে বেড়ে ৬০ কোটি হয়েছে । মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের একটি গবেষণা অনুযায়ী প্রতিদিন ২ ডলার থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত খরচ করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (Sandhya Krishnan and Neeraj Hatekar, “Rise of the New Middle Class in India and Its Changing Structure,” Economic and Political Weekly 52, no. 22 (2017): 40–48.) । এদের মধ্যে ড্রাইভার, রাস্তার ধারের দোকানদার, ছুতোর মিস্ত্রির মতো মানুষেরাও পড়েন । এঁদের ছেলেমেয়েরা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখে, বহুজাতিক কোম্পানির চাকুরে হতে চায়, আর বাকি অর্ধেক ভারতের মানুষের কথা ভাবতে পছন্দ করেনা । এই মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা -- যারা দিনে ১০ ডলারের বেশি আয় করেন সেই মানুষদের সংখ্যা করোনাকালে প্রায় ৩ কোটি কমেছে (PEW Research), আর জয়েন্ট এন্ট্রান্স এ সফল হয়ে বড়লোক হবার স্বপ্ন বিক্রি করার অনলাইন কোম্পানি ‘বাইজু’ র মূল্যমাণ এই ২ বছরে প্রায় ১৩০০০ কোটি টাকা বেড়েছে । আরো মজার ব্যাপার হলো, যখন স্কুল গুলোতে লেখাপড়া প্রায় বন্ধ, তখন কেন্দ্রিয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ওয়েবিনার করে শিক্ষক শিক্ষিকাদের বলছেন তারা যেন ছাত্রছাত্রীদের স্টার্টআপ কোম্পানি তৈরি করতে উৎসাহিত করেন । অর্থনৈতিক চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তের কাছে স্বপ্ন বেচে মুনাফা করার জন্য এর চেয়ে ভালো সরকারী উৎসাহ আর কিই বা হতে পারে ! যখন স্কুলে ইংরাজী, অংক, বিজ্ঞান এর ক্লাস নেওয়া প্রায় বন্ধ, তখন একদিকে কেন্দ্রীয় বোর্ড ‘আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স’ এর মতো অত্যাধুনিক বিষয়, যার প্রকৃত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের আগে হওয়া অসম্ভব, সেই সব স্কুলেই শিখিয়ে দেবার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে, আর অন্যদিকে ‘বাইজু’র কিনে নেওয়া কোম্পানি ‘হোয়াইটহ্যাট জুনিয়র’ ছোট্ট শিশুদের কোডিং শিখিয়ে বড়লোক বানানোর লোভ দেখাচ্ছে। একদিকে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের অভাবে প্রান্তিক মানুষের কাছে লেখাপড়ার যেটুকু সুযোগ ছিল তা বন্ধ, আর অন্যদিকে মোবাইল ফোনধারী মধ্যবিত্তের কাছে সরকারী-বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে অলীক স্বপ্ন বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করা – শিক্ষানীতির ভালো ভালো কথার বাস্তব পরিণতি এটাই।

শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোগ আমাদের দেশে নতুন নয়। কিন্তু ‘বাইজু’ জাতীয় কোম্পানি গুলো যা করছে তা মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করার সামিল। বাবা মায়েরা অভিযোগ করছেন যে খদ্দের যোগাড় করার জন্য ওরা ছোট শিশুদের এমন প্রশ্ন করছে যার উত্তর বেশিরভাগ শিশুরই দিতে পারার কথা নয়, আর যেই তারা উত্তর দিতে পারছেনা অমনি অলীক স্বপ্ন দেখা বাবা মায়েদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে প্ররোচিত করা হচ্ছে যাতে তারা ঐ অলীক স্বপ্ন সফল করতে এই কোম্পানির লক্ষ টাকার পাঠক্রমে শিশুটিকে ভর্তি করেন। এই বিশেষ পদ্ধতিতে খদ্দের ধরার জন্য কোম্পানি গুলি সদ্য কলেজ পেরনো প্রচুর যুবকদের নিয়োগ করছে, যাদের মাইনের অর্ধেকটাই এই অসদুপায়ে খদ্দের ধরায় সাফল্যের উপর নির্ভরশীল। এইসব কোম্পানির চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া যুবকদের অনেকে ইউটিউবে ভিডিও করে এইসব তথ্য জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, যদি কোনো বাবা-মা এককালীন লক্ষ টাকা দিতে না পারেন তখন তাদের অজান্তে কোনো একটি ব্যাংক থেকে ধার নিইয়ে মাসে মাসে তার কিস্তি শোধ করার ফাঁদে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যদি অপছন্দ হবার কারণে কোনো বাবা-মা শিশুটিকে ‘বাইজু’ থেকে ছাড়িয়ে নেন ও সেই কারণে মাসে মাসে প্রদেয় টাকা আর না দেন, তখন ঐ ব্যাংকের তরফে টাকা আদায়ের হুমকি শুরু হয় ও বাবা-মা প্রথম জানতে পারেন যে তার সন্তান ক্লাস করুক আর না করুক, ‘বাইজু’ পুরো পাঠক্রমের টাকা শুরুতেই ব্যাংক থেকে পেয়ে গেছে, আর ওরা মাসে মাসে কিস্তি শোধ করছিলেন মাত্র। মাসে মাসে টাকা দেওয়ার সুযোগটা কোম্পানির তরফ থেকে দেওয়া কোনো সুবিধে ছিলনা। এই সব অভিযোগ বাবা-মায়েরাই নানা মাধ্যমে জানিয়েছেন, আর তা থেকে আমরা জানতে পেরেছি । এইসব অভিযোগের ফল কি হয়েছে? যারা অভিযোগ করেছেন বা বিভিন্ন সোস্যাল নেটওয়ার্কে প্রচার করেছেন, হয় তাদের বিরুদ্ধে মোটা টাকার মানহানির মামলার ভয় দেখানো হয়েছে, নয়তো তাদের ঐ নেটওয়ার্কের একাউন্ট বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে । সরকার বা তার শিক্ষা দপ্তর কি চাইলে এটা আটকাতে পারেনা ? অনেকেই এর পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখতে পাচ্ছেন। আর ‘বাইজু’ মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পুরো জগত টাকে একটু একটু করে নিজের কব্জায় নিয়ে আসতে শুরু করেছে এবং একের পর এক অনলাইন ও অফলাইন শিক্ষার কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানকে কিনে নিচ্ছে ।

২০২১ এর ASER (Annual Staus of Education Report) এর একটি অংশ দেখা যাক । যে দেশের ৬৭.৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে মোবাইল ফোন আছে, ২৭ শতাংশ সবসময় সেটি ব্যবহার করতে পারে, আর ৪৭ শতাংশ কখনো না কখনো সেটি ব্যবহারের সুযোগ পায়, সেই দেশে অনলাইন শিক্ষার কোম্পানি যে কত উগ্র ভাবে খদ্দের ধরার খেলায় নামতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায় । যে ২৬ শতাংশের মোবাইল ফোন নেই, আর বাকী যারা মোবাইল থাকা সত্বেও তা লেখাপড়ার কাজে ব্যবহারের সুযোগ পায় না, তাদের জন্য কিছু ভালো ভালো কথা বলা নীতি ও প্রকল্পের গল্প থাকাই যথেষ্ট । অতএব সরকারী শিক্ষা প্রকল্পের উপর বেসরকারী মাফিয়াতন্ত্রের প্রভাব যে বাড়বে তা বলাই বাহুল্য । আর একদিন হয়তো স্কুলশিক্ষার বোর্ড গুলিও একে একে এইসব মাফিয়া শিক্ষা কোম্পানির দখলে চলে যাবে । তাই এই প্রশ্নটা করা হয়তো অতিশয়োক্তি হবেনা – শিক্ষার ভবিষ্যৎ কি মাফিয়াদের হাতে ?

লেখক সেন্টার ফর ফিজিক্স এডুকেশন রিসার্চ, কলকাতার সঙ্গে যুক্ত।

0 Comments

Post Comment