রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/ নীল জামা গায় লাল জামা গায়/ এই রাজা আসে ওই রাজা যায়/ জামা কাপড়ের রং বদলায়…./ দিন বদলায় না! বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যাপায়ের কবিতার লাইনগুলো যেন দেশের গরিব গুর্বো মানুষদের কথার সম্মিলিত প্রতিধ্বনি। তাঁরা দিন বদলের আশায় স্বপ্ন দেখেন কিন্তু দিন আর বদলায় না। লড়াই করতে করতে কেটে যায় প্রায় গোটা জীবন। অভাব তাঁদের নিত্যসঙ্গী। এই অভাবী মানুষদের একটা ভালো অংশ আমাদের অন্নদাতা। যাদের পোশাকি নাম কৃষক বা চাষি। এঁদের আয় বাড়িয়ে জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে, স্বাধীন ভারতে কত যে কমিটি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এক একটা কমিটির এক এক রকমের সুপারিশ। কমিটি তো সুপারিশটুকুই করতে পারে প্রয়োগের দায়িত্ব দেশের সরকারের। সেখানেই সবচেয়ে বড় ফাঁক রয়ে গেছে। ফলে চাষিরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। এঁদের যন্ত্রনার কাহিনী চাপা পড়ে রইল রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে।
১৮ তম লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ক্ষমতায় ফিরলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফসলের ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ বা ‘এম এস পি’ - র বৃদ্ধি ঘটাবে। তারা সরকার গঠনের ১৫ দিনের মধ্যেই ১৪ টি খারিফ শস্যের ‘এম এস পি’ র বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। যা আগামী জুলাই -২৪ থেকে জুন- ২৫ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। গত ১৯ শে জুন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এম এস পি বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব মিডিয়াকে ব্রিফ করার সময় বলেছেন – ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস (সি এ সি পি)’ – এর সুপারিশের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা খারিফ ফসলের এম এস পি বৃদ্ধির অনুমোদন দিয়েছে। এম এস পি-র এই বৃদ্ধিতে গত খারিফ মরসুমের তুলনায় চলতি মরশুমে কৃষককুলের আয় বাড়বে অতিরিক্ত ৩৫,০০০ কোটি টাকা।” তিনি আরও বলেন - “খারিফ ফসলের এম এস পি বৃদ্ধি, মোদি-৩ সরকারের কৃষকদের পাশে থাকার এবং আয় বাড়ানোর নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ন।” নতুন মোদি সরকারকে, কৃষক দরদী হিসেবে তুলে ধরতে রেলমন্ত্রী এম এস পি-র বৃদ্ধিকেই এই মুহূর্তে ব্যবহার করেছেন।এখন জেনে নেওয়া যাক –
‘এম এস পি’ কী ?
এম এস পি সরকার নির্ধারিত ফসলের দাম। যা সারা দেশে নির্দিষ্ট ফসলের জন্য একই। এই দামে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনেন। সরকার যে ফসল সংগৃহীত করেন তা দিয়ে খাদ্যশস্যের মজুত ভান্ডার গড়ে তোলে। খাদ্যশস্যের এই ভান্ডার গণবন্টনে এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। সংগৃহীত শস্যের একাংশ ভবিষ্যতের জন্য ‘বাফার স্টক’ আকারে মজুত রাখা হয়। এছাড়াও খোলা বাজারে ফসলের দাম খুব কমে গেলে সরকারের কাছে কৃষক তার ফসল ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারেন। তাই এম এস পি কৃষকের কাছে তাঁর ফসলের নিশ্চিত মূল্য। এতে কৃষক কিছুটা ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পান। আবার ক্রেতাও সাধ্যানুযায়ী দামে কৃষিপন্য কিনতে পারেন।
‘এম এস পি’ – র বর্তমান বৃদ্ধিতে কৃষক-প্রীতি কতখানি ?
এম এস পি বৃদ্ধির ঘোষণা হতেই সরকারের শুভানুধ্যায়ীরা বলতে শুরু করেছেন, মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সচেষ্ট। তবে, এম এস পি-র পরিসংখ্যানে চোখ বোলালে দেখা যাবে এই বৃদ্ধি একেবারেই নিয়ম রক্ষার। এতে কোন নতুনত্ব নেই। যারা ভারতীয় কৃষির একটু আধটু খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা সবাই জানেন বছরে ২ বার সরকার কৃষিপণ্যের এম এস পি ঘোষণা করেন। একবার খারিফ মরশুমের আগে আর একবার রবি মরশুমের শুরুতে। ফলে এম এস পি -র বৃদ্ধি মন্ত্রীসভায় অনুমোদন দেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। বিগত পাঁচ বছরের এম এস পি – র পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২০- ২১, ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ সালে সাধারণ ধানের এম এস পি ছিল যথাক্রমে ১৮৬৮ টাকা, ১৯৪০ টাকা, ২০৪৯ টাকা ও ২১৮৩ টাকা প্রতি কুইন্টাল। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৩.৮৫%, ৫.১৫% ও ৭.০০ %। এবছর সাধারণ ধানের এম এস পি বাড়িয়ে ২৩০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল করা হয়েছে। বার্ষিক বৃদ্ধি ৫.৩৬%। যা গত বছরের বৃদ্ধির তুলনায় ১.৬৪% কম। সাধারন ধানের এম এস পি-র চেয়ে কুইন্টালে ২০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে গ্রেড- এ ধানের এম এস পি নির্ধারণ করা হয়। বৃদ্ধির শতকরা হিসেবে এখানেও একই ছবি অর্থাৎ গতবারের তুলনায় কম। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও এম এস পি বেড়েছে ১.৪৫% থেকে ৯% । যা অতীতের ধারাবাহিকতাকেই বহন করছে। ১৪ টি শস্যের মধ্যে ধান-সহ জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, মুগডাল, বাদাম, সয়াবিন, তিল ও তুলোর ক্ষেত্রে নতুন সরকারের ঘোষিত এম এস পি তে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধির হার গতবারের চেয়ে কম। মুগ ডালের এম এস পি বেড়েছে মাত্র ১.৪৫%। এটা যদি কৃষকপ্রীতির নমুনা হয় তাহলে আগামী দিনে কৃষকের যন্ত্রণা আরও বাড়বে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ।
‘এম এস পি’ নির্ধারণে ‘সি এ সি পি’ – র হিসেব না হয়ে ‘এন সি এফ’ – র ’ হলে কী হত?
মন্ত্রী মহাশয়ের যে কথাটা উল্লেখ্য, ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস বা সি এ সি পি’ – র সুপারিশের ভিত্তিতে এম এস পি নির্ধারিত হয়েছে। এখানেই অঙ্কের যত মারপ্যাঁচ। আর ঠকছেন চাষিরা। একটু অতীতে ফেরা যাক, এম এস স্বামীনাথনের নেতৃত্বে ২০০৪ এর নভেম্বরে গঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ফার্মার্স কমিশন বা এন সি এফ্’। কৃষকের দুর্দশা বিচার করে কমিশন ফসলের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে এম এস পি - র সঠিক বাস্তবায়ন এবং গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে দিতে ধান ও গম ছাড়া অন্যান্য ফসল এম এস পিতে কেনার সুপারিশ করে – যা এই মুহুর্তে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল উৎপাদন ব্যয়ের ‘ওয়েটেড এ্যাভারেজ’ এর উপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ধরে এম এস পি নির্ধারণ করা হোক। স্বামীনাথনের নেতৃত্বাধীন এন সি এফ্ চাষের মোট খরচ হিসাব করার ক্ষেত্রে সমস্ত খরচের সঙ্গে জমির খাজনা এবং কৃষি মূলধনের সুদকেও যুক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন। যাকে চাষের অর্থনৈতিক খরচ বলে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সি এ সি পি চাষের খরচের যে হিসেব করে সেই হিসেবের মধ্যে চাষের নগদ খরচ ও পারিবারিক শ্রমের মজুরিকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও বাদ পড়েছে জমির খাজনা এবং মূলধনের সুদ। ফলে সি এ সি পি চাষের খরচের যে হিসেব করে তা এন সি এফ্- এর হিসেবের তুলনায় অনেকটাই কম । সি এ সি পি-র সুপারিশ অনুযায়ী এম এস পি ঘোষণা করা হয়েছে বলে রেলমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন অর্থাৎ এবারও স্বামীনাথন কমিশনের(এন সি এফ)সুপারিশকে মান্যতা দেওয়া হল না। এতে চাষিদের ক্ষতি অনেকটাই। সি এ সি পি-র হিসেব অনুযায়ী ২০২২- ২৩ সালে ধানের এম এস পি নির্ধারিত হয় কুইন্টাল প্রতি ২০৪০ টাকা। কিন্তু এন সি এফ - এর সুপারিশ মেনে নিলে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২৭০৮ টাকায় গিয়ে দাঁড়াত। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকরী না হওয়ায় ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত সরকার শুধুমাত্র ধানের ক্ষেত্রেই এম এস পি বাবদ কৃষকদের ২৩৭ হাজার কোটি টাকা কম দিয়েছেন। একইভাবে, গমের ক্ষেত্রে কৃষকদের কম দিয়েছেন ৫৮,৪৬০ কোটি টাকা। শুধু ধান ও গমেই কৃষকরা ২৯৬ হাজার কোটি টাকা কম পেয়েছেন।
‘এম এস পি’ কি শুধুই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ?
২০১৯ সালের নির্বাচনে, বি জে পি প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় এলে তারা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে কৃষকদের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করবে । কিন্তু ক্ষমতায় স্থায়ী হয়েই সরকার কৃষক মারা ‘কৃষি আইন’ চালু করতে উদ্যোগী হয়। যদিও কৃষক আন্দোলনের চাপে সেই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। সেই সময় সরকার আন্দোলনকারীদের পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মেনে এম এস পি স্থির করবেন এবং কৃষি পণ্যের সরকারি ক্রয় বাড়াবেন। বিষয়টিকে আইনী স্বীকৃতি দেবেন। কিন্তু ২০২৩ সালের বাজেটে দেখা গেল মার্কেট ইন্টারভেনশন স্কিম এবং প্রাইস সাপোর্ট স্কিমে বরাদ্দ কমিয়ে নামমাত্র করা হয়েছে, অর্থাৎ কৃষি সহায়তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তী কালীন বাজেটে দেখা গেলো পি এম-আশা স্কিমে বরাদ্দের পরিমাণ পুনরায় ২১% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পগুলিই দেশের এম এস পি - ভিত্তিক কৃষিপণ্যের সরকারি ক্রয়ের নির্ণায়ক। তবে, সরকার এই পথে যে হাঁটবেন তার ঈঙ্গিত সেদিন -ই পাওয়া গিয়েছিল যেদিন তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে একটা এফিডেভিট দাখিল করে বলেছিলেন, এম এস পি র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করা অসম্ভব। সমস্যা আরও বাড়িয়ে তারা একটি নির্দেশ জারি করলেন, যেসব রাজ্য কৃষকদের কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অতিরিক্ত বোনাস দেবে, সেই সব রাজ্যে সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এসব করতে গিয়ে, এম এস পি সংক্রান্ত যে প্রতিশ্রুতি কৃষকদের দিয়েছিলেন বিগত ৩ বছরে তা নিয়ে একটুও ভেবে দেখেন নি। উল্টে কৃষিকে কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
‘এম এস পি’ কি সব চাষিকে সমান সুবিধা দেয়?
এম এস পি র নির্ধারণে, চাষের যে খরচ হিসেব হয় তার প্রচলিত নিয়মে অন্য একটা সমস্যা রয়েছে। বেশ কিছু রাজ্যে উৎপাদনের প্রকৃত ব্যয় এম এস পি-র চেয়ে বেশি । একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২৩ সালে মহারাষ্ট্রে এক কুইন্টাল ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছিল ২৬১৯ টাকা। অথচ ওই বছর সাধারণ ধানের এম এস পি ধার্য্য হয়েছিল ২০৪০ টাকা এবং গ্রেড এ ধানের ক্ষেত্রে ২০৬০ টাকা। ধানের এম এস পি মহারাষ্ট্রের চাষিদের কোনও সুবিধা দেয়নি। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশে এক হেক্টর জমিতে ধান চাষের মোট খরচ ৮০,৩০৩ টাকা, উত্তরপ্রদেশে সেটাই ৫৮,৪২৯ টাকা এবং পাঞ্জাবে তা আবার ৭৬,০৭৯ টাকা। শুধু ধান নয়, ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস’ -এর রিপোর্টে চোখ বোলালে দেখা যাবে যে কোনো ফসলের উৎপাদন ব্যয় রাজ্য থেকে রাজ্যে আলাদা। তাহলে, প্রশ্ন উঠে, কোনও নির্দিষ্ট ফসলের উৎপাদন ব্যয়ে এতো তারতম্য থাকলে দেশজুড়ে সেই ফসলের একই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কীভাবে সব চাষিকে সমান সুবিধা দেবে? কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইস’ রাজ্য ভিত্তিক চাষের খরচ হিসেব করে। তার উপর অতিরিক্ত ৫০% চাপিয়ে রাজ্য ভিত্তিক এম এস পি ঠিক করলে দেশ জুড়ে সব চাষি তার উৎপাদন ব্যয়ের উপর সমান সুবিধা পেতেন। এ ক্ষেত্রে আন্তরাজ্য কৃষিপণ্য বাণিজ্যের সমস্যা তৈরি হতে পারে। তারজন্য সুনির্দিষ্ট নীতি তৈরি করতে না পারলে রাজ্যগুলিতে শস্যের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে।
‘এম এস পি’ তে সব ফসলের গুরুত্ব কি সমান ?
শুধু এম এস পি নির্ধারণ করলেই কৃষকের আয় বাড়বে - এমনটা নয়। ওই বাড়তি দামে কৃষক তাঁর বিক্রয়যোগ্য উদ্বৃত্ত বিক্রি করতে পারছেন কিনা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তাই এম এস পি তে প্রকৃত সরকারি ক্রয় থাকলেই চাষি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পাবেন নচেৎ নয়। এখন দেখা যাক মোট উৎপাদনের কতটা সরকার কেনেন কতটা খোলা বাজারে চাষি বিক্রি করেন । গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করতে চাল এবং গমের সংগ্রহই সবচেয়ে জরুরী। পরিসংখ্যান বলছে দেশের মোট গম উৎপাদনের কম বেশি ৪০ % সরকার কেনেন। ধানের ক্ষেত্রে এর পরিমান ৩৫-৩৭ %। সরকারি মজুত ভান্ডারের ৮৫ % গম সংগৃহীত হয় মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে। দেশের সরকারি মজুত ভান্ডারের ৭৪% ধান আসে পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং হরিয়ানা থেকে। ধান এবং গম ছাড়া বেশির ভাগ ফসলের সরকারি সংগ্রহের মান খুব হতাশাজনক। তথ্য অনুযায়ী দেশের মাত্র ৬-১০ % কৃষক এম এস পি দ্বারা উপকৃত হন। সরকার এম এস পিতে প্রধানত ধান আর গম কেনেন। অভিজ্ঞতা বলছে, যে রাজ্যগুলি থেকে সরকার এম এস পি তে ধান ও গম কেনেন, বিক্রি নিশ্চিত জানার ফলে সেখানকার চাষিরা ধান ও গম চাষেই বেশি উৎসাহী। এম এস পিতে ডাল, তৈলবীজ এবং মোটা দানা শস্যের সরকারি ক্রয় নেই বললেই চলে। ফলে এই ফসল চাষে চাষিদের কোন আগ্রহ নেই। তাই এই ফসলগুলির উৎপাদন দারুনভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য ফসলের চাষ তখনই সম্ভব যখন চাষি এম এস পি তে সেই ফসল বিক্রির নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি পাবে । সেটা সম্ভব হবে এম এস পি আইনি বৈধতা পেলে। তখন চাষিরা ধান এবং গম বাদে তৃতীয় কোন ফসল যেমন তেল কিংবা ডাল ফলাবেন । ফসল চাষে বৈচিত্র্য আসবে । ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে তেল এবং ডালের আমদানি। এম এস পি-র সুবিধা পৌঁছে যাবে সবার কাছে।
‘এম এস পি’ – র সুবিধা পাচ্ছে কে?
ফসল তোলার পরে চাষিরা বেশিদিন তাদের ফসল ধরে রাখতে পারেন না । কারণ, এক, ফসল গুদামজাত করার উপায় নেই । দুই, তাদের অন্য কোনো জীবিকা নেই অথচ নগদ টাকার প্রয়োজন। এইসব কারণে ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের তা বিক্রি করতে হয়। অথচ ওই সময় সরকারি সংস্থাগুলি এম এ পি তে ফসল কেনার জন্য হাজির থাকে না। ফলে, সরকার নির্ধারিত এম এস পি পাওয়ার সুযোগ কৃষকদের কাছে নেই । তাঁরা বাধ্য হন ফসলের ‘অভাবি বিক্রি’ করতে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু ফোঁড়ে ও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে কম দামে ফসল কিনে পরে সেটাই সরকারকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করে। কোনোরকম বিনিয়োগ ও ঝুঁকি ছাড়াই তারা বিপুল পরিমাণ লাভ ঘরে তোলে।
এছাড়াও, দেশের প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার গ্রামে এম এস পি- তে ফসল কেনার সরকারি কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৭৭০০ টি। ফলে চাষির কাছে, এম এস পি তে ফসল বিক্রির সুযোগ সীমিত। এই কারণে, বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি গ্রামেই কোনও ছোটো ব্যবসায়ী বা দালালের কাছে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। ওই ক্রেতারা চাষিদের ফসলের ন্যায্য মূল্য দেয় না। এ ঘটনা কৃষকদের চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
আলোচনায় পরিষ্কার স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে এম এস পি নির্ধারিত হলে আয় বাড়বে কৃষকের। এম এস পি আইনি স্বীকৃতি পেলে ধান গম ছাড়া অন্যান্য ফসলের সরকারি ক্রয় বাড়বে। চাষে বৈচিত্র্য আসার পাশাপাশি এম এস পি র সুফল সুদূর প্রসারী হবে।
‘এম এস পি’ ও কৃষক আন্দোলন
স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলা মেনে সমস্ত ফসলের এম এস পি নির্ধারণ ও তার আইনি নিশ্চয়তার দাবীতে এখনও কৃষক আন্দোলন চলছে। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা এবং কিষাণ মজদুর মোর্চার নেতৃত্ত্বে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের ২০০ টিরও বেশি কৃষক সংগঠন আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। কম বেশি দশ হাজার কৃষক শম্ভু সীমান্তে জড়ো হয়েছেন। সরকার আন্দোলনকারীদের শহরে ঢোকা বন্ধ করতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছেন। অনেকটা অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাচ্ছেন। আন্দোলন ঠেকাতে গুলি চালিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৫ জন মারা গেছে। যার মধ্যে শুভকরন সিং নামের ২১ বছরের এক তরুনও রয়েছে – যিনি তার সংসারের একমাত্র রোজগেরে। অর্থনীতিবিদ মধুরা স্বামীনাথন বলেছেন “সরকার কী ভুলে গেলেন, এরা কেউ সমাজ বিরোধী নন? এঁরা আমাদের অন্নদাতা।” এই আন্দোলনের সমর্থনে ইতিমধ্যে গ্রামীন ভারতে বনধ পালিত হয়েছে। সমাধান সূত্র বের করতে মোদি -২ সরকারের মন্ত্রীদের সাথে কৃষক নেতারা একাধিক বার আলোচনায় বসেছেন। সরকারের অনমনীয় মনোভাবের জন্য কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসেনি।
মজার বিষয় হল এম এস পি কৃষকের আয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ন হলেও আজ অবধি কোনও কৃষি আইনে এম এস পির উল্লেখ নেই। এটা ‘বাধ্যতামূলক’ তা কোথাও বলা নেই। দেশের সরকার কোনো বছর এম এস পির ঘোষণা না করলে তাকে আইনি উপায়ে বাধ্য করা যাবেনা। বর্তমানে কোন ফসল এম এস পি - র আওতায় আসবে সেই দামে সরকারি ক্রয় কতটা হবে সবটাই সরকারের মর্জি মাফিক। এমনকি এম এস পি মেনে বেসরকারি ক্রেতাকেও ফসল কেনায় জোর করা যাবে না।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে, রুটিন মাফিক এম এস পি বৃদ্ধির ঘোষণা করেই সরকার বলতে শুরু করেছেন তাঁরা কৃষক-দরদী!! নতুন সরকারের এম এস পি- র বৃদ্ধিতে অনেক বেশি চমক থাকত যদি চাষের খরচ হিসেবের ক্ষেত্রে স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ মানা হত। আশা জাগত এম এস পি তে সরকারি ক্রয় বৃদ্ধির কথা থাকলে। সরকারকে কৃষক-দরদী বলা যেত, যদি স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে (জনগণের কাছে পুষ্টিকর খাদ্য পৌঁছে দিতে) ধান ও গম ছাড়াও অন্যান্য ফসল এম এস পিতে কেনার ঘোষণা করতেন। এম এস পি র সুবিধা দালাল ও ব্যবসায়িদের হাত থেকে চাষিদের হাতে তুলে দিতে সরকার কী পরিকল্পনা করেছে তা প্রকাশ্যে আনলে সরকারের কৃষক- প্রীতির পরিচয় মিলত। এর কোনোটাই নজরে পড়েনি।
সরকার কৃষকদের বিষয়ে আন্তরিক হলে নতুন সরকার গঠনের পর পরই প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনরত অন্নদাতাদের দাবি দাওয়াকে সম্মান দিয়ে আলোচনায় বসতেন। সমাধান সুত্র খুঁজে বের করতেন। তা না করে বিজেপি কর্মীদের দিয়ে কৃষক আন্দোলনের মঞ্চে হামলা চালিয়েছেন। সম্প্রতি কৃষক নেতা সর্বান সিং পান্ধের অভিযোগ করেছেন, “বিজেপি ও খনি মাফিয়ারা স্থানীয় জনগণের নাম করে শম্ভু সীমান্তের আন্দোলন মঞ্চে হামলা চালিয়েছে। বিজেপি নির্বাচন চলাকালীন- ই হুমকি দিয়ে রেখেছিল ৪ জুনের পর দেখা হবে।” তিনি আরও বলেন কৃষক মোর্চার আন্দোলনকে দুর্বল করতে রাজ্য ও কেন্দ্রিয় এজেন্সিগুলোও তৎপর। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বি জে পি নেতৃত্বাধীন মোদি -৩ সরকার আদৌ কৃষক-দরদী নয়।
এবার, বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে, এম এস পি – র বিষয়টি খুব বুদ্ধি করে রেখেছে। সেখানে বলা আছে তারা সরকার গঠন করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এম এস পি বাড়াবে। এ আর নতুন কী? যে দিন থেকে এম এস পি -র ধারণার জন্ম হয়েছে সেদিন থেকেই তো ফি বছর কিছু না কিছু বেড়েইছে। কৃষকের ফসলের ভালো দাম এবং বিক্রি নিশ্চিত করতে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মানার কথা অর্থনীতিবিদ থেকে আন্দোলনকারীরা সবাই বলছেন। চাইছেন এম এস পি - র আইনি স্বীকৃতি। তবে, এসব কথা মোদি সরকার কানে তুলছেন না। ভবিষ্যতেও তুলবেন না। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা (মোদি-২ সরকার) স্বামীনাথনকে মরনোত্তর ভারতরত্ন দিয়েছেন ফলে এম এস পি সংক্রান্ত তাঁর সুপারিশ না মানলেও চলবে!